somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৩৮ | হযরত উমারের খিলাফত (৬৩৪-৬৪৪ সাল)

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হযরত উমার খলিফা হওয়ার পর হযরত আবু বকরের অসাপ্ত মিশন শেষ করার দায়িত্ব নেন। এ মিশন ছিল সমগ্র আরব বিশ্বকে ইসলামি খিলাফতের অধীনে নিয়ে আসা। হযরত উমার তাঁর শাসনামলে পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিশাল অঞ্চলকে খিলাফতের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন এবং একটি আরব মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। হযরত উমার খলিফা হওয়ার পর প্রথমেই হযরত আবু বকরের সময়ে শুরু হওয়া পারস্য অভিযানের হাল ধরেন।

আবু বকরের সময়ে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ হীরা ছেড়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়ার পরে মুসান্না একাই তাঁর বাহিনী নিয়ে পারস্য অভিযান অব্যাহত রাখেন। তিনি ইউফ্রেটিস নদী পার হয়ে ব্যবিলনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ইতোমধ্যে পারস্য সম্রাটের বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তমের অধীনে এক বিরাট বাহিনী হীরা দখলের জন্য অগ্রসর হয়। খলিফা উমার মুসান্নার সাহায্যার্থে আবু উবাইদার নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন। মুসলমানদের মিলিত বাহিনী নামারকের যুদ্ধে পারসিকদেরকে পরাজিত করে।

নামারকের যুদ্ধের পর পরসিকরা রণহস্তী কাজে লাগিয়ে মুসলমানদেরকে একটি যুদ্ধে পরাজিত করে। ‘সেতুর যুদ্ধ’ নামক এ যুদ্ধে ৯০০০ মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ৬০০০ সৈন্যই নিহত হয় এবং দুই সেনাপতির একজনও নিহত হন। অপর সেনাপতি মুসান্না খলিফার সাহায্যের অপেক্ষায় থাকেন। উমার যথারীতি একটি বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন। এবার মুসলিম বাহিনী বুয়ায়েবের যুদ্ধে পারসিকদেরকে পরাজিত করে এবং নিম্ন ইরাক তাদের অধীনে নিয়ে আসে। তবে এ যুদ্ধের পর বীর সেনাপতি মুসান্না মারা গিয়েছিলেন।

বুয়ায়েবের পরাজয়ের পর পারস্য সম্রাট বড় ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এদিকে মুসলিম খলিফাও সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ৩০০০০ সৈন্যের এক মুসলিম বাহিনীকে পারস্য অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। পারস্য সেনাপতি মহাবীর রুস্তমের নেতৃতেব ১২০০০০ সৈন্যের এক পারসিক বাহিনী মুসলিমদেরকে বাঁধা দিতে এগিয়ে আসে। কাদেসিয়া প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে তিন দিনব্যাপী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পারসিকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পারসিক সেনাপতি রুস্তম যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন।

এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মরুবাসী মুসলমানরা ইরাকের বিশাল উর্বর ও সবুজ ভূখন্ডের মালিক হন। সেলুসিয়া ও টেসিফোনের মতো সমৃদ্ধ শহর মুসলমানদের হাতে আসে। এর অল্পদিনের মধ্যেই জালুলা যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের পর পুরো ইরাক তাদের হাতে চলে আসে। পারস্য সম্রাট খলিফা উমারের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরাক খলিফার এলাকা এবং পারস্য পর্বতমালার অপর পাশের অঞ্চল পারস্য সম্রাটের এলাকা হিসেবে স্বীকৃত হয়। মুসলমানরা বিজিত ইরাকের বসুরা ও কুফায় দুটি গ্যারিসন শহর নির্মাণ করেন।

মুসলিম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের শক্তিশালী সামরিক ঘাটি ছিল এ দুটি শহর। এক সময় কুফা ও বসরা মুসলিম সাম্রাজ্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ৬৩৭ সালে সংঘটিত কাদেসিয়ার যুদ্ধ ও জালুলার যুদ্ধের পর সন্ধি স্থাপিত হওয়ায় কয়েক বছর ধরে পারসিকদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল। ৬৪১ সালে খলিফা উমার আবারও পারসিকদের বিরুদ্ধে অভিযানের অনুমতি দেন। মুসলিম বাহিনী আলবুর্জ পর্বতের পাদদেশের নিহাওয়ান্দে পারসিক বাহিনীর মুখোমুখী হয়। এ যুদ্ধে দেড় লক্ষ পারসিক সৈন্য অংশ নিয়েছিল।

এ যুদ্ধে মুসলমানরা তাদের চেয়ে ছয়গুণ বড় বাহিনীকে পরাজিত করায় এ যুদ্ধকে মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ জয়লাভের ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধের পর আজারবাইজান ও খোরাসান পর্যন্ত প্রসারিত পুরো পারস্য সাম্রাজ্য ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের পদানত হয়। এমনকি ৬৪৩ সালে মাকরানে বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্য ভারতের সীমানা স্পর্শ করে। পরাজিত পারস্য সম্রাট ইয়াজদজার্দ এ সময় একস্থান থেকে আরেক স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৬৫১ সালে তুর্কিস্থানের সীমান্তের এক গ্রামে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।

খলিফা উমার পারস্য অভিযানের পাশাপাশি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দিকেও সমান দৃষ্টি রেখেছিলেন। পূর্ববর্তী খলিফা আবু বকরের সময়ে আজনাদাইনের যুদ্ধে দক্ষিণ সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের কিছু অংশ মুসলমানদের হাতে এসেছিল। খলিফা আবু বকরের আদেশে মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ পারস্যের রণাঙ্গণ ছেড়ে আজনাদাইনের যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সফলতার খবর শোনার পরপরই খলিফা আবু বকর মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে আজনাদাইনের যুদ্ধের পর বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস সিরিয়ার এন্টিয়ক শহরে অবস্থান নিয়েছিলেন।

নতুন খলিফা হযরত উমার ক্ষমতায় আসার পর বাইজেন্টাইন রণাঙ্গণের প্রধান সেনাপতি আমর ইবনুল আস এবং পারস্যের হীরা থেকে আগত খালিদ বিন ওয়ালিদকে আলাদাভাবে দুটি বাইজেন্টাইন অঞ্চল বিজয়ের গুরুভার অর্পণ করেন। ফিলিস্তিন বিজয় সম্পূর্ণ করার জন্য তিনি আমর ইবনুল আসকে ফিলিস্তিনের বিজিত অংশে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে খালিদ বিন ওয়ালিদকে সিরিয়া বিজয় সম্পন্ন করার জন্য অগ্রসর হতে আদেশ দেন।

খালিদ সিরিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শহর দামেশক অবরোধ করেন। ৬ মাস অবরোধের পর ৬৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ নগরীর পতন ঘটে। দামেশকের পতন ঠেকাতে যে বাইজেন্টাইন বাহিনী অগ্রসর হয়েছিল তাদের সাথে মুসলিম বাহিনীর সংঘর্ষ হয় জর্ডানের মাটিতে। এ যুদ্ধ ফিহলের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ফিহলের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে সমগ্র জর্ডান মুসলমানদের হাতে চলে আসে। জর্ডান ও দামেশকের পর সিরিয়ার হিমসও মুসলমানদের দখলে চলে আসে।

এ পর্যায়ে খলিফা উমার মুসলমানদেরকে আর অগ্রসর না হতে নির্দেশ দেন। খলিফার আদেশে খালিদ দামেশকে অবস্থান করতে থাকেন। জর্ডানে অবস্থান নেন আমর ইবনুল আস এবং হিমসে অবস্থান নেন আরেক সেনাপতি আবু উবাইদা। দামেশক, জর্ডান ও হিমসের পতনের পর বাইজেন্টাইন সম্রাট তাঁর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তাঁর ভাই থিওডোরাসের নেতৃত্বে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠান। এ বাহিনীকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আমর ইবনুল আস এবং আবু উবাইদা ইয়ারমুকে এসে অবস্থান নেন।

খালিদ বিন ওয়ালিদের বাহিনীও শীঘ্রই এগিয়ে এসে তাদের সাথে যোগদান করে। সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর সাথে বাইজেন্টাইন সৈন্যদের মাসাধিককালব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে। অবশেষে ৬৩৬ সালের ২০ আগস্ট ইয়ারমুক উপত্যকায় এক সর্বাত্মক যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনী পরাজিত হয়। থিওডোরাস নিজেও এ যুদ্ধে নিহত হন। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। বাইজেন্টাইনদের অন্যতম সমৃদ্ধ প্রদেশ সিরিয়া চিরতরে তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়।

সিরিয়া সেই যে খ্রিষ্টানদের অধিকার থেকে মুসলমানদের হস্তগত হয় তার ১২৮১ বছর পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তা আবার খ্রিষ্টান শক্তির পদানত হয়েছিল। কাদেসিয়ার যুদ্ধে যেভাবে পারস্য সাম্রাজ্যের চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল সেভাবে ইয়ারমুকের যুদ্ধ সিরিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল। এ যুদ্ধের পর দামেশক, এন্টিয়ক ও আলেপ্পোসহ সিরিয়ার সকল গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থায়ীভাবে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আরও বিভিন্ন জায়গা দখল করা সহজ হয়ে যায়।

ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর খলিফা উমার সিরিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন সেনাপতি আবু উবাইদাকে। খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে আবু উবাইদা সেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। সিরিয়া বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস তাঁর পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে ফিরে আসেন- অর্থাৎ ফিলিস্তিন বিজয়ের পথে অগ্রসর হন। ৬৩৭ সালে তিনি ফিলিস্তিনের বাইজেন্টাইন শাসনকর্তা আরতাবিনকে পরাজিত করে ফিলিস্তিন দখল করেন; তবে ফিলিস্তিনের রাজধানী জেরুজালেম তাঁর দখলের বাইরে থেকে যায়।

খ্রিষ্টানরা সহজে তাদের এই পবিত্র শহরকে হাতছাড়া করতে চায়নি। আবার মুসলমানরাও এই পবিত্র শহরকে তাদের আয়ত্তে আনতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। তাই আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করে। অবরূদ্ধ জেরুজালেমে অচলাবস্থা দেখা দেওয়ার এর অধিবাসীরা আত্মসমর্পণের উপায় খুজঁতে থাকেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে নগরীর পতন দেখতে চাচ্ছিলেন। মুসলমানদের হাতে পড়লে জেরুজালেমের পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়ে তারা শঙ্কিত ছিলেন।

তাই জেরুজালেম প্রধান খ্রিষ্টান ধর্মগুরু সোফরোনিয়াস কোন মুসলিম সেনাপতির হাতে এ নগরীর অধিকার তোলে দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন তিনি এ নগরীর অধিকার সমর্পণ করবেন স্বয়ং খলিফার হাতে; যিনি এ নগরীর পবিত্রতা রক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন এবং এ নগরীকে রক্তপাত থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। সোফরোনিয়াস আমর ইবনুল আসের কাছে দূত পাঠিয়ে জানালেন যে, তিনি কেবল মুসলিম খলিফার হাতেই এ নগরীর চাবি অর্পণ করতে ইচ্ছুক।

মুসলিম সেনাপতি আবু উবাইদা তাড়াতাড়ি খলিফাকে এ সংবাদ জানানোর ব্যবস্থা করেন। খলিফা উমার সংবাদ পেয়ে মদিনা থেকে জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর অবর্তমানে রাজধানী মদিনার দায়িত্ব অর্পণ করে যান হযরত আলীর হাতে। খলিফা তাঁর সাদামাটা পোষাকেই জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। জেরুজালেমের খ্রিষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফরোনিয়াস খলিফার এ বেশভুষা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।

তিনি বিনা দ্বিধায় খলিফার হাতে নগরীর কর্তৃত্বের ভার তোলে দেন। জেরুজালেম বিজয়ের পর বাইনজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে মুসলমানদের টানা যুদ্ধ কিছুটা শিথিল হয়। তবে জারিয়া অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় মুসলমানদেরকে আবারও যুদ্ধে ব্যস্ত হতে হয়। সেনাপতি আবু উবাইদা জারিয়া দখল করে বিদ্রোহ দমন করেন। এরপর বাইজেন্টাইন যুবরাজ সিরিয়া ও ফিলিস্তিন উদ্ধারের উদ্দেশ্যে আরও কয়েকটি যুদ্ধ করে পরাজিত হন। মুসলমানরা কুর্দী অধ্যুষিত উত্তর ইরাক ও আর্মেনিয়া পর্যন্ত তাদের সীমানা বিস্তৃত করেন।

এশিয়া মাইনর অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত তৎকালীন সাইলেসিয়া প্রদেশটিও বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে মুসলমানদের অধিকারে এসেছিল। এভাবে ৬৩৩ সাল থেকে ৬৪০ সালের মধ্যে সমগ্র সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও পারস্যে মুসলিম বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৬৪০ সালে খালিফা উমার হযরত মুয়াবিয়াকে বৃহত্তর সিরিয়া প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সিরিয়া তথা উত্তর আরবে মুসলিম বিজয় অভিযানের পর এ অঞ্চলজুড়ে উদ্ভূত এক আকস্মিক সমস্যায় মুসলমানরা বেশ পর্যুদস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

এ সমস্যা হল দুর্ভিক্ষ ও মহামারী। ৬৩৮-৩৯ সালে সমগ্র সিরিয়া ও উত্তর আরবে এক ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। এতে প্রায় ২৫০০০ লোক মারা যায। এমনিক মুসলিম সেনাপতি আবু উবাইদা, ইয়াযীদ ও সোরাহবিলও মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। খলিফা উমার নিজে সিরিয়ায় উপস্থিত হয়ে এ দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা করেছিলেন।

মুসলমানদের সিরিয়া ও ফিলিস্তিন বিজয় পরবর্তী সফলতা ছিল মিশর বিজয়। অর্থনৈতিকভাবে মিশর ছিল আরবের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ। ইরাক ও সিরিয়ার চেয়েও বহুগুণ বেশি কৃষিপণ্য উৎপাদিত হত মিশরে। তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে মিশর দখল করা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়াও সামরিক দিক থেকে মিশর ছিল মুসলমানদের জন্য একটি বড় হুমকি। কারণ মিশর ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশারী প্রদেশ।

সুয়েজ ও আলেকজান্দ্রিয়ায় বাইজেন্টাইনদের শক্তিশালী নৌ-ঘাটি ছিল। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে যেসব বাইজেন্টাইন সেনারা পরাজিত হয়েছিল তারা একত্রে মিশরে অবস্থান করছিল। তাই সামরিক কৌশলগত কারণেও মিশর বিজয় মুসলমানদের জন্য বেশ প্রয়োজনীয় ছিল। এসব কারণে খলিফা উমার যখন সন্ধি চুক্তির উদ্দেশ্যে জেরুজালেমে এসেছিলেন তখন আমর ইবনুল আস তাঁর কাছ থেকে মিশর দখলের অনুমতি আদায় করেছিলেন।

৬৩৯ সালের ১২ ডিসেম্বর আমর ইবনুল আস ফিলিস্তিন থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ৬৪০ সালের জুলাই মাসে তিনি হোলিওপোলিসের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদেরকে পরাজিত করেন। এদিকে খলিফা উমার জনৈক সেনাপতি যুবাইরের নেতৃত্বে আরও কিছু সৈন্য মিশরে পাঠিয়ে দেন। সেনাপতি আমরের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বাইজেন্টাইনদের সামরিক কেন্দ্র আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধ করে।

বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়াকে রক্ষার জন্য ৫০০০০ সৈন্যের এক বাহিনী পাঠান। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। ৬৪১ সালে আলেকজান্দ্রিয়ার পতন ঘটে। আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের সাথে সাথে প্রাচ্য অঞ্চলে বাইজেন্টাইনদের কর্তৃত্ব চিরতরে বিলুপ্তি লাভ করে। আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের পর মিশর ইসলামি খিলাফতের আবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। ৬৪২ সালে আমর ইবনুল আস মিশরে ফুসতাত নামে একটি নগরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং একে মিশরের রাজধানী বানান।

৯৬৯ সালে কায়রো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফুসতাত ছিল মিশরের রাজধানী। মিশর বিজয়ের পর মুসলমানরা একে কেন্দ্র করে উত্তর আফ্রিকায় অভিযান শুরু করেন। ৬৪৩ সালে আমর ইবনুল আস মিশরের পশ্চিমে বার্কায় একটি বাহিনী পাঠান। এ বাহিনী বিনা যুদ্ধে বার্কা দখল করে। এরপর দখলে আসে ত্রিপলী। তবে ত্রিপলীর অধিবাসীরা বাঁধা দেওয়ায় মুসলিম বাহিনী বিনা যুদ্ধে এ শহর জয় করতে পারেনি।

খলিফা উমারের সময়ে ইসলামি খিলাফত একটি সার্থক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁর সময়ে যেসব রাজ্যজয় ও সামরিক সফলতা অর্জিত হয়েছিল তা একদিকে যেমন ছিল বিপুল সম্ভাবনার তেমনি ভবিষ্যত বিপর্যয়েরও ক্ষীণ আভাষও যেন দিচ্ছিল। কথিত আছে, পারস্যের লুন্ঠিত দ্রব্যসামগ্রী যখন মদিনায় পাঠানো হয়ছিল তখন খলিফা উমার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এ সমস্ত লুন্ঠিত দ্রব্যের মধ্যে আমি আমার লোকজনের ভবিষ্যৎ ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি!

পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ প্রদেশগুলো বিজয়ের পর বিজয়ী আরবদের মধ্যে এ দুটি সমৃদ্ধশালী সভ্যতার ভোগ বিলাসী প্রবণতা ঢুকে পড়ে। রাজতন্ত্রী শান-শওকতের প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মায় এবং ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য্যের মিষ্টি স্বাদে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন। তবে সবাই যে সমানভাবে ভোগ বিলাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলেন তা নয়। তবে যাদের মধ্যে এসব প্রবণতা জন্ম নিয়েছিল তারা যথেষ্ট বিপর্যয়ের কারণ হতে পারেন ভেবে খলিফা উমার এ প্রবণতা রোধ করার পদক্ষেপ নেন।

খলিফা উমার পারসিক ও বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত আরবদেরকে নির্দেশ দেন তারা যেন বিজিত শহরগুলোতে বসবাস না করে। পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নগরসভ্যতার বিলাসিতা থেকে আরবদেরকে দূরে রাখার জন্য তিনি তাদেরকে বড় শহরগুলো থেকে দূরে সেনানিবাস স্থাপনের আদেশ দেন। ফলে এসব সেনানিবাসকে ঘিরে সিরিয়া, ইরাক ও মিশরে অনেকগুলো গ্যারিসন শহর গড়ে উঠেছিল।

এসব গ্যারিসন শহরের কয়েকটি একসময় বেশ বড় শহরেও পরিণত হয়েছিল। মিশরের ফুসতাত এবং ইরাকের কুফা ও বসরা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। খলিফা উমারের আরেকটি পদক্ষেপ ইতিহাসে বেশ আলোচিত। সেটি হল প্রধান মুসলিম সেনাপতি ও সিরিয়ার গর্ভনর খালিদ বিন ওয়ালিদের অপসারণ। ৬৩৬ সালে ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকা মুসলমানদের হাতে চলে আসায় খলিফা উমার প্রথমে আবু উবাইদা ও পরে খালিদ বিন ওয়ালিদকে এ প্রদেশের শাসনকর্তা অর্থাৎ গর্ভনর নিযুক্ত করেছিলেন।

৬৩৮ সালে খলিফা খালিদের কাছে সকল যুদ্ধের আয়-ব্যয়ের হিসাব তলব করলে খালিদ তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে খলিফা অসন্তুষ্ট হন। ৬৩৮-৩৯ সালে সিরিয়ায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ চলাকালে খালিদ এক হাজার দিনার খরচ কারে তাঁর নিজের বীরত্ব গাথা লিখার ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও খালিদ নিজস্ব তহবিল থেকে এ বিপুল অংকের অর্থ খরচ করেছিলেন তবুও খলিফা উমার খালিদের কাছে এ বিলাসীতার ব্যাখ্যা দাবী করলে খালিদ এর কোন ব্যাখ্যা দেননি।

এছাড়াও খালিদ যুদ্ধলব্ধ লুন্ঠিত সম্পত্তি থেকে মোট ৮০০০০ দিনার মূল্যের সম্পত্তি নিজের অধিকারে নিয়েছিলেন। যদিও প্রকৃত হিসাবে তাঁর পাওয়ার কথা ছিল ৬০০০০ দিনার। যুদ্ধক্ষেত্রে খালিদের অধিক নির্মমতাও খলিফা পছন্দ করতেন না। আরেকটি পুরনো কারণে খলিফা খালিদের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। সেটি হল রিদ্দা যুদ্ধের সময়ে বানি ইয়ারবু গোত্রের প্রধান মালিক ইবনে নোবায়রার হত্যাকাণ্ড।

রিদ্দা যুদ্ধের সময়ে মালিক ইবনে নোবায়রার খলিফা আবু বকরের বশ্যতা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করলেও সেনাপতি খালিদ তাকে হত্যা করেছিলেন এবং তাঁর সুন্দরী স্ত্রী লায়লাকে বিবাহ করেছিলেন। এতে হযরত উমার খালিদের ওপর অত্যাধিক চটে গিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে খালিদের বীরত্বের ফলে বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছিল। সিরিয়া সংকটের সময় বিষয়টি আবার বিবচেনার মধ্যে চলে আসে। খলিফা উমার খালিদের সম্পত্তির অতিরিক্ত ২০০০০ দিনার বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে যুক্ত করেন।

এরপর তিনি খালিদকে প্রধান সেনাপতি ও সিরিয়ার গর্ভনরের পদ তেকে অপসারণ করেন এবং আবু উবাইদাকে প্রধান সেনাপতি ও মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এটি ৬৩৮ সালের ঘটনা। খালিদ এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। ইসলামের এ মহান বীর জীবনে কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি। কিন্তু তাঁর শেষ জীবন হল খুবই দুঃখময়। ৬৪২ সালে ভগ্নহৃদয় নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর পদচ্যুতির ঘটনা ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়।

খলিফা উমার তাঁর বিশাল খিলাফত পরিচালনার জন্য বাধ্য হয়েই খিলাফতের একটি স্থায়ী রাষ্ট্রবাদী কাঠামো প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ইসলামি চেতনা ও আদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রবাদের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর পরবর্র্তীতে এই রাষ্ট্রবাদ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের গর্ভেই নিপাতিত হয়েছিল। ক্ষমতা, আভিজাত্য, সম্পদের বিপুল ঐশ্বর্য এবং ভোগ-বিলাসিতার মধ্যেই ডুবে গিয়েছিল পরবর্তী যুগের রাজতন্ত্রী খিলাফত।

খলিফা উমার তাঁর বিশাল খিলাফতে কেন্দ্রিয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। পুরো সাম্রাজ্যকে তিনি মোট ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। এগুলো হল- ১.মক্কা, ২.মদিনা, ৩.সিরিয়া, ৪.আল জাজিরা, ৫.আল বসরা, ৬.আল কুফা, ৭.মিশর, ৮.ফিলিস্তিন, ৯.ফারস, ১০.কিরমান, ১১. খোরাসান, ১২.মাকরান, ১৩.সিজিস্থান এবং ১৪.আজারবাইজান। প্রত্যেক প্রদেশ আবার বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলা প্রধানের উপাধী ছিল ‘আমীল’ এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে বলা হতো ‘ওয়ালী’।

ওয়ালীরা প্রশাসনিক শাসনকর্তা হওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রদেশের সামরিক, ধর্মীয় ও রাজস্ব বিভাগীয় প্রধানের কাজও করতেন। ওয়ালীকে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য একজন কাতিব (প্রধান উপদেষ্টা), একজন কাতিব উদ-দিওয়ান (প্রধান সামরিক উপদেষ্টা), একজন সাহিব উল-খারাজ (রাজস্ব উপদেষ্টা), একজন সাহিব উল-আদহাম (প্রধান পুলিশ উপদেষ্টা), একজন সাহিব উল-বাইতুল মাল (কোষাধ্যক্ষ), একজন কাজী এবং আরও কিছু কর্মচারী নিয়োজিত থাকতেন।

খলিফা উমার তাঁর শাসনের শেষের দিকে ওয়ালীদের ক্ষমতা অনেকটা সঙ্কুচিত করেন। তিনি রাজস্ব ও সামরিক বিভাগকে সরাসরি খলিফার অধীনে নিয়ে আসেন এবং কাজীর ক্ষমতাকেও ওয়ালীর কর্তৃত্বের উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেন। ওয়ালীদের ওপর খবরদারীর জন্য খলিফা গুপ্তচর বিভাগও সৃষ্টি করেছিলেন। খলিফা উমারের কেন্দ্রিয় সরকার রাজতন্ত্রী ছিলনা; যদিও সকল দিক বিবেচনায় খলিফাই ইসলামি খিলাফতের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন।

খলিফা উমার তাঁর এই একচ্ছত্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজতন্ত্রী রাষ্ট্রবাদ কায়েম করেননি। তিনি একটি সরল প্রকৃতির আইনসভা বা পরামর্শসভা গঠন করেছিলেন। খলিফা তাঁর সময়কার কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ‘মজলিশ উল খাস’ নামে একটি পরিষদ গঠন করেছিলেন। হযরত আলী, হযরত উসমান, হযরত তালহা এবং হযরত যুবাইরসহ খুবই অল্পসংখ্যক মুহাজির সাহাবীদেরকে নিয়ে ‘মজলিস উল খাস’ গঠিত হয়েছিল। খলিফা তাঁর দৈনন্দিন কাজে এ পরিষদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

খলিফা উমার আরেকটু বড় পরিসরে আরেকটি পরিষদ গঠন করেছিলেন যা ‘মসলিস উল আম’ নামে পরিচিত ছিল। মদিনার বিশিষ্ট নাগরিকগণ, বিশিষ্ট বেদুইন প্রধানগণ এবং বিভিন্ন সাহাবী এর সদস্য ছিলেন। মসজিদে নববীতে এর অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতো। যে কোন সাধারণ মানুষও ‘মজলিস উল আম’ এর আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন। এর ভূমিকা ছিল অনেকটা প্রাচীন গ্রিসের ‘একলেসিয়া’ এবং প্রাচীন রোমের ‘ট্রিবিউনেল’ এর মতো।

‘মজলিস উল আম’ এবং ‘মজলিশ উল খাস’ এ দুটি পরিষদকে একত্রে ‘মজলিসে শুরা’ বলা হতো। পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার সময়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে মজলিসে শূরার স্বাধীন কার্যকারিতা লোপ পেয়েছিল। খলিফা উমারের সময়ে অনেকগুলো রাজ্য বিজয় সাধিত হওয়ার খিলাফতের অর্থনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কয়েকটি সমৃদ্ধ দেশ জয়ের ফলে মুসলিম উম্মাহ অর্থনৈতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন।

খিলাফতের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী পর্যায়ে উন্নীত হওয়ায় পুরনো গোত্রবাদী অর্থনীতির স্থলে রাষ্ট্রবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। ইতোমধ্যে মহানবীর সময়কার আরবের গোত্রবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন- গাযু (বাণিজ্য কাফেলা লুন্ঠন), দাস-ব্যবসা, রক্তপণ, মুক্তিপুণ প্রভৃতি বিষয়ের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় মুসলিম উম্মাহের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণান্যাস জরুরী হয়ে পড়ে।

খলিফা উমরের রাষ্ট্রবাদী রাজস্বনীতি খিলাফতের অর্থনীতির প্রয়োজনীয় পূনর্বিন্যাস সাধন করেছিল। তাঁর রাজস্ব সংস্কার নীতি ছিল অনেকটা বৈপ্লবিক। বিজিত দেশসমূহের কৃষি-ব্যবস্থায় তিনি আমুল পরিবর্তন আনয়ন করেছিলেন। এসব দেশের পূর্ববর্তী কর-ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তিনি নতুন কর-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর সময়ে মোট ছয় প্রকারের রাজস্ব আদায় করা হতো। যথা:

১) যাকাত: যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা অথবা বৃদ্ধি পাওয়া। খিলাফতের যুগে স্বচ্ছল মুসলমানদেরকে তাদের প্রতি বছর তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ সম্পদকে যাকাত হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হতো।

২) জিজিয়া: জিজিয়া হলো ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি আইনের অনুকূলে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অমুসলিমদের জনপ্রতি বাৎসরিক ধার্যকৃত কর। খিলাফতের অমুসলিম নাগরিকদেরকে নিরাপত্তামূলক সামরিক কর হিসেবে জিজিয়া প্রদান করতে হতো।

৩) গনিমাহ: গনিমাহ হল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। প্রত্যেক যুদ্ধ বিজয়ের পর যেসব মূল্যবান সম্পত্তি লুন্ঠিত হতো তার ৫ ভাগের ১ ভাগ জমা হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। পূর্ববর্তীতে মহানবী ও তাঁর পরিবারের জন্য লুন্ঠিত সম্পদের যে অংশ নির্ধারিত ছিল তা উমারের সময়ে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের পেছনে খরচ করা হতো।

৪) ওশর ও খারাজ: ওশর ও খারাজ হল ভূমি কর বা ফসলী কর। উমারের সময়ে অমুসলিম কৃষকদেরকে তাদের উৎপন্ন শস্যের ১/৫ অংশ থেকে শুরু করে ১/২ অংশ পর্যন্ত খারাজ হিসেবে প্রদান করতে হতো। জমির উর্বরতা অনুযায়ী খারাজের অংশ কমবেশি হতো। অন্যদিকে মুসলমান কৃষকদেরকে তাদের উৎপন্ন শস্যের ১/১০ অংশ ওশর হিসেবে প্রদান করতে হতো। আভিধানিক অর্থে ‘ওশর’ বলতে এক-দশমাংশ বোঝায়।

৫) আল-ফে: রাষ্ট্রের খাস জমি থেকে যে আয় হতো তা ‘আল-ফে’ নামে পরিচিত ছিল।

৬) উশুর: উশুর ছিল বাণিজ্য শুল্প। বাণিজ্যিক দ্রব্যাদি থেকে এ কর আদায় করা হতো। উমার মুসলমান বণিকদের জন্য আড়াই শাতংশ, অমুসলমান বণিকদের জন্য পাঁচ শতাংশ এবং বিদেশীদের জন্য দশ শতাংশ হারে বাণিজ্য শুল্প নির্ধারণ করেছিলেন। ২০০ দিনারের বেশি মূল্যে বাণিজ্যিক দ্রব্যাশির ওপর উশুর ধার্য করা হতো।

উমারের খিলাফতের রাষ্ট্রবাদী কাঠামোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর স্থায়ী সামরিক অবকাঠামো। সামরিক খাতে খিলাফতের ব্যয়ভার ছিল বিশাল। খলিফা উমার তাঁর পুরো খিলাফত পাহারা দেওয়ার জন্য এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেনাবাহিনী মোতায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি পুরো সাম্রাজ্যকে নয়টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করেছিলেন। এগুলোকে বলা হতো আল-জুনদ।

প্রত্যেকটি জুনদে সর্বদা ৪০০০ অশ্ব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকত এবং অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে ৩৬০০০ অশ্বারোহী যোদ্ধাকে যুদ্ধে পাঠানোর ব্যবস্থা থাকতো। উমারের খিলাফত যে নয়টি জুনদে বিভক্ত ছিল তা হল- মদিনা, কুফা, বসরা, ফুসতাত, মিশর, দামেশক, হিমস, ফিলিস্তিন ও মসুল। উমারের সেনাবাহিনী মহানবীর সময়ের মতো অবৈতনিক বাহিনী ছিল না। তাঁর সেনাবাহিনীর সদস্যরা বছরে ৩০০ দিরহাম বেতন পেতেন। এছাড়াও যুদ্ধে লুন্ঠিত সম্পদের ৫ ভাগের ৪ অংশই পেতো সোনাবাহিনী।

হযরত উমার মোট ১০ বছর ২ মাস খিলাফতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৬৪৪ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ফলে এ মহান খলিফার ঘটনাবহুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। খলিফার অধীনস্ত কুফা প্রদেশের শাসনকর্তা মুগীরার জনৈক ভৃত্য আবুলুলু ফিরোজের ছুরিকাঘাতে খলিফার মৃত্যু হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে, আবুলুলু ফিরোজ হরমুজান ও জাফিনাহ নামে মদিনার দুজন যুদ্ধবন্দীর সহায়তায় খলিফাকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। মৃত্যুকালে উমারের বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তাঁর মৃত্যুর পর নতুন খলিফা হন হযরত উসমান।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।


সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×