somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায় (প্রাচীন যুগ) - ৫

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
৫ম অধ্যায়: আর্যভাষী দেশে দেশে


প্রাচীন হিব্রুভাষীদের ঘিরে ইতিহাসের যে আবর্তন আমরা দেখেছি, তাতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং পারস্য সভ্যতার কথা। মেসোপটেমীয় ৪ টি সভ্যতার অবস্থান ছিল দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। আলেকজান্ডার এই অঞ্চলের নাম দেন ‘মেসোপটেমিয়া’ অর্থাৎ দুই নদীর মধ্যবর্তী জায়গা। মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলো হল-বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন শহর নিয়ে গড়ে ওঠা সর্বপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা, প্রাচীন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওটা আমোরীয়দের প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, নিনেভা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অ্যাসিরীয় সভ্যতা এবং নতুন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্যালদীয় সভ্যতা। মেসোপটোমীয় সভ্যতাগুলোর পরে আসে আর্য পারস্য সভ্যতা। তখনও পর্যন্ত দুনিয়ার আর কোথাও এত জমজমাট সভ্যতার দেখা পাওয়া যায় না। এর বাইরে সিন্ধু ও চৈনিক সভ্যতা ছাড়া এশিয়ার আর কোথাও উল্লেখযোগ্য কোন নগর সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। সিন্ধু সভ্যতাও বহু আগে খ্রিস্টপূর্বে ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কোন এক অজানা কারণে এশিয়ার অনেক অঞ্চলে তখনও সভ্যতার আলো পৌঁছায় নি। তবুও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোই ছিল পৃথিবীর সেরা সভ্যতা।

অন্যদিকে আফ্রিকা ও ইউরোপের সামান্য জায়গা ছাড়া বাকী পুরোটাই ছিল ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। আফ্রিকার মিসর ছাড়া বাকী পুরো মহাদেশটাই ছিল অন্ধকারে। এ সময় সভ্যতায় সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল ইউরোপ। গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন অন্ধকারের রাজত্ব। ইউরোপের মূল ভূখন্ডে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে যাযাবর টিউটন জাতির লোকেরা। আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের কোন ইতিহাস নেই। কারণ আদিম জীবনের তেমন কোন ইতিহাস থাকে না।

ইউরোপের মূল ভূখন্ডে সভ্যতার সূচনা ঘটায় এশিয়া মাইনর থেকে আসা আর্যরা। ‘আর্য’ বলতে এখন আর জাতি বোঝায় না। বরং ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে এশিয়া মাইনরের উত্তরের অধিবাসীরা যে ভাষায় কথা বলত, সেই ভাষাটিকে ‘আর্য’ ভাষা বললে বেশি সঠিক বলা হয়। জাতিসত্ত্বার ভিত্তি হল স্বাধীন ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস। আর্যরা ছিল মেষপালক ও যাযাবর প্রকৃতির। সম্ভবত খাদ্যাভাবের ফলে তারা ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, যা চলতে থাকে পরবর্তী ২০০০ বছর ধরে। ২০০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তারা এশিয়ার ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য অর্থাৎ ইরান, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম অংশ তুরষ্ক এবং ইউরোপের দক্ষিণে গ্রিস ও ইতালিতে বসতি গড়ে তোলে। ছাড়াছাড়ি হবার পর এই দলগুলো আলাদা আলাদা এক একটা জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষাও তৈরি হয়েছিল-সংস্কৃত, ফারসি, হিট্টীয় ভাষা, গ্রিক আর ল্যাটিন। ছাড়াছাড়ি হবার আগে পর্যন্ত এরা সকলেই যে একই ভাষায় কথা বলত, তা এই কটি প্রাচীন ভাষার অনেক মিল দেখে বোঝা যায়। পৃথিবীর সকল ভাষায় মূল উৎস যে ৭টি ভাষা বংশ চিহ্নিত করা হয়েছে তার অন্যতম হল আর্যদের ভাষা এ ভাষার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।

আর্যদের যে শাখাটি ইউরোপের দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছেছিল তাদের বংশধররাই একসময় গড়ে তোলেছিল গ্রিক ও রোমান সভ্যতা ও এরও আগে গড়ে তোলে মাইসেনীয় সভ্যতা। এ সময় ইউরোপের অন্ধকার ইতিহাস বাঁক নিল আলোর দিকে। মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার সূচনার কয়েক হাজার বছর পরে গড়ে ওঠে গ্রিক ও রোমান সভ্যতা। আর্যদের একটি শাখা যখন এভাবে ইউরোপকে নিয়ে চলেছে, ইতিহাসের পথে, তখন আর্যদের আরেকটি শাখা মেসোপটেমীয় সভ্যতার অবসান ঘটিয়ে গড়ে তোলেছে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য।

গ্রিক সভ্যতার উত্থানের সময় মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য সভ্যতা ছিল শক্তিতে দুনিয়ার সেরা। ৫৩৮ খ্রিস্টপুর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস এ শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পারস্য সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল মিসর থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের সিন্ধু নদ পর্যন্ত। এর আগে এত বড় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর দেখা যায় না। গ্রিকদের সাথে পরাসীয়দের সম্পর্ক মধুর হয় নি। পরষ্পরের সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়েছে বারবার। এ যুদ্ধে অবিশ্বাস্য ভাবে প্রত্যেকবারই পারসীয়রা হেরে গিয়েছে গ্রিকদের কাছে, বিপুল সেন্যশক্তি থাকা সত্ত্বেও। পারসীয়দের এ পরাজয় গ্রিকদের উত্থানের পথ সুগম করে। পারস্য সভ্যতাকে ফেলে গ্রিক সভ্যতা পৌছে যায় সভ্য দুনিয়ার শীর্ষে। খ্রিস্টপুর্বে ৪৮০ থেকে ৪৩০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৫০ বছর গ্রিকরা সভ্যতায় দুনিয়ার শীর্ষে থাকলেও তাদের প্রতিপক্ষ পারসীয়দের সাথে আর কোন যুদ্ধে জড়ায় নি।

গ্রিক সভ্যতার পুর্বে অবশ্য ইউরোপ এশিয়ার মধ্যবর্তী ইজিয়ান সাগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আরেকটি ইউরো-এশিয়া সভ্যতা। এর নাম ইজিয়ান সভ্যতা। এ সভ্যতা ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। একটি ছিল ইজিয়ান সাগরের দ্বীপমালা ও তুরষ্কের উপক’ল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা মিনীয় সভ্যতা এবং অপরটি ছিল গ্রিসের উপকূলবর্তী মাইসেনিয়া শহরকে কেন্দ্র করে বিকশিত মাইসেনীয় সভ্যতা।

ইজিয়ান সাগরের প্রশস্ত দ্বীপ-‘ক্রীট’ দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মিনীয় সভ্যতা। ক্রীট দ্বীপের ‘নসাস’ শহর ছিল মিনীয় সভ্যতার মূল কেন্দ্র। শহরটি ছিল সাগর থেকে ৩ মাইল ভেতরে। দেয়াল ঘেরা এই শহরে ছিল চমৎকার সব প্রসাদ। ক্রীটের ভৌগলিক অবস্থা ছিল বানিজ্যের জন্য অনুকূল। আবার পাহাড় আর সাগরের বেষ্টনী বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ধারণা করা হয় একটি কৃষক সম্প্রদায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম ক্রীটে বসতি গড়ে তোলে। শহর সমূহ গড়ে ওঠে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, অর্থাৎ মিশরীয় ও সুমেরীয়দের প্রাচীন শহরগুলোর সমসাময়িক ছিল সেগুলো। ক্রীটের রাজাদের উপাধি ছিল ‘মিনস’ আর এ থেকেই তাদের রাজ্যের নাম হয় মিনীয় রাজ্য। মিনীয়দের যেসব লেখা পাওয়া গেছে, তা আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। সেসব লিখন পদ্ধতি পাঠোদ্ধারের বাইরে রয়ে গেছে তার মধ্যে অন্যতম হল এইসব মিনীয় লিপি। ক্রীটবাসীদের বাণিজ্যপোত যাতায়াত করত মিসর এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে।

অন্যদিকে ইজিয়ান সভ্যতার অন্য অংশটি গড়ে তোলে ইউরোপে আসা প্রথম দিকের আর্যভাষীরা। মিনীয়দের সংস্পর্শে আসা এই আর্যরা গ্রিসের উপকূলীয় শহর মাইসেনিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে মিনীয় প্রভাব সমৃদ্ধ এই সভ্যতা। এটাই ইউরোপর মূল ভূখন্ডের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা। যা ছিল আর্যদের অবদান।

আর্যভাষীদের সাথে সভ্যতার ইতিহাস ইহুদিদের মতই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। তবে ইতিহাসে তাদের ভূমিকা ইহুদিদের মত পরাধীনতা সর্বস্ব নয়, বরং তৎকালীন পৃথিবীর বিশাল আকারের সভ্যতাগুলো গড়ে তোলেছিল তারাই। প্রকট দখলদারি চরিত্র থাকার কারণে তারা অনেক দেশ দখল করে নিতে পেরেছিল। ভারতবর্ষে আসা আর্যদের রচিত রামায়ন, মহাভারতে তাদের এই চরিত্রটিই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। রামায়নে যে লঙ্কার রাখা রাবনের উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন এ ভূখন্ডের প্রকৃত অধিবাসী এবং সেই সাথে বলা যায় ভূখন্ডের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের সবচেয়ে পুরনো বীর। আধিপত্যবাদী রামের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া এই অনার্য বীরকে আর্যরা তাদের রামায়নে রাক্ষস বলে চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতাকামী অনার্যদের তারা রাক্ষস-খোক্ষস অভিধায় ভূষিত করেছে। সেভাবে সন্ত্রাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন তৃতীয় বিশ্বের বীরদেরকে সন্ত্রাসী অভিধায় চিহ্নিত করে থাকে। ভারতে আসা আর্যদের সাথে এখানকার অনার্যদের রক্তের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালী জাতির মত বহু মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে। সংমিশ্রণ ঘটেনি এমন জাতিও রয়েছে যেমন- তামিল, দ্রাবিড় ইত্যাদি।

এখানকার আর্যদের রচিত রামায়ন মহাভারতের সাথে গ্রিসের আর্যদের রচিত ইলিয়াড ওডিসির দারুন মিল দেখা যায়। রামায়নের গীতা ছিলেন দেবতার স্ত্রী আর ইলিয়াড-ওডিসির হেলেন ছিলেন দেবরাজ জিউসের জারজ কন্যা। উভয়েই অপহৃত ও মুক্ত হয়েছিলেন দীর্ঘ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এভাবে দুনিয়া জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে আর্যদের কীর্তির কথা।

কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন এশিয়া মাইনরের উত্তরের তৃণভূমি এলাকা ছিল আর্যদের আদি নিবাস। ভাষার দিক থেকে তারা ছিল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী। সংখ্যায় বেড়ে গেলে একসময় তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। একটি শাখা দক্ষিণ পুর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এসে পৌঁছায় ভারতে। একটি শাখা দক্ষিণ পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ইরান অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। এদের মধ্য দিয়েই বিকাশ লাভ করে পারস্য সভ্যতা। আরেকটি শাখা দনিয়ুব নদী অতিক্রম করে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বলকান উপদ্বীপে এসে পৌঁছায়। এরাই গ্রিক-রোমান জাতির পূর্বপুরুষ। ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী এই জনগোষ্ঠী গ্রিসের মূল ভূখন্ডে বসতি গড়ে তোলে। এই অঞ্চলের সাথে মিনীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্কে ছিল। ক্রমে এখানে মিনীয় সংস্কৃতি প্রবেশ করতে থাকে। মাইসেনিয়া শহর ছিল এই সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র। তাই এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি মাইসেনীয় সংস্কৃতি নামে পরিচিত হয় ।
মাইসেনিয়াতে ইজিয়ান সংস্কৃতি উন্নতির চরমে পৌঁছে ১৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। মিসর, ক্রীট, সাইপ্রাস ও উত্তরের বিভিন্ন নগরের সাথে মাইসেনিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এক সময় ইজিয়ান সভ্যতারও অবসান ঘটে। আর্যদের অন্য একটি শাখা ডোরীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী এক আক্রমণকারি গোষ্ঠি উত্তর দিক থেকে এগিয়ে আসে মাইসেনিয়ায়। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সমগ্র ইজিয়ান অঞ্চল এদের অধিকারে চলে যায়।

ইজিয়ান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী আর্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন-এচীয়, আইওলীয়, ইওলীয় এবং ডোরীয়। ১১৫০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সমগ্র গ্রিস চলে যায় ডোরীয়দের দখলে। এই ডোরীয়রে সাথে মিশ্রণ ঘটেছিল ইজিয়ান আর্যদের। ফলে একটি শক্তিশালী জাতির উদ্ভব হয়। গ্রিস জুড়ে তারা ক্রমে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলতে শুরু করে। এ সভ্যতার একটি বিশেষত্ব ছিল। তা হল, এটি কোন নদীতীরে গড়ে ওঠেনি। তখন পর্যন্ত সবগুলো সভ্যতাই নদীতীর বা সমুদ্রতীরে গড়ে উঠতে দেখা গেছে। গ্রিক সভ্যতাই প্রথম, যা ভূখন্ডের গভীরে গড়ে উঠেছে পাহাড়ী এলাকার কাছে।

ভৌগলিকভাবে গ্রিস দেশটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। খাড়া খাড়া পাহাড়ের কারণে দেশটি ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত। ফলে জন্ম হয় অনেকগুলো নগর রাষ্ট্রের। ১১০০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে গ্রিসের ইতিহাসের তেমন কোন উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় না। একমাত্র হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসিতে এ সময়ের কথা কাহিনীর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কাহিনীতে দেখা যায় দেবদেবী আর মানুষে মাখামাখি সম্পর্ক। সেমেটিকদের মতো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অনুশাসন মেনে চলার কোন ব্যাপার তাদের মাঝে ছিল না। ইলিয়াড ও ওডিসিতে রামায়ন-মহাভারতের মতই প্রচলিত সামাজিক ধর্মের চেহারা ফুটে উঠেছে। গ্রিকদের সেই ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ইলিয়াড ও ওডিসি এখন আর ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায় না বরং সাহিত্যের মর্যাদা পায়। অন্যদিকে রামায়ন-মহাভারত এখনও সনাতন ধর্মের অনুসারিদের কাছে ধর্মীয়ভাবে পাঠ্য ।

ইলিয়াড-ওডিসি এবং রামায়ন-মহাভারতের দেবদেবীর ধারণা এত কাছাকাছি যে, দুই অঞ্চলের ধর্ম আলাদা দুটি ধর্ম নাকি একই ধর্ম তা নিরূপণ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সিরিয়ার উত্তরের আর্যদের আরেকটি গোষ্ঠী মিতানীদের ধর্মবিশ্বাসেও ভারতীয় বৈদিক দেব-দেবীর অস্তিত্ব দেখা যায়। তুরস্কের বোগাজকুই নামক জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আর্যভাষী মিতানীদের সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা মিতানীদেরও দেবতা ছিল। তবে এসব দেব-দেবীর ধর্মের চেয়ে পৃথিবীতে এক সর্বশক্তিমান স্রষ্টায় বিশ্বাসী ধর্মের ধারাসমূহ নিরংকুশভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
একত্ববাদী সেমেটিক ধর্মের ধারায় উদ্ভুত খ্রিস্টধর্মের তোড়ে গ্রিক ও রোমান দেব-দেবীরা ভেসে গেছে ইতিহাসের বিস্তৃতির আড়ালে। আর একত্ববাদী ধারায় সবচেয়ে র‌্যাডিকেল ধর্মমত ইসলামে প্রবেশ করেছে ভারতীয় আর্যদের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার অনার্য শুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। আর্য ধর্মীয় ধারায় অবশ্য ভারতবর্ষীয়দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও টিকে আছে। এখনও আর্য ব্রাহ্মণরা মন্ত্র পাঠ করে আর্যভাষার অন্যতম নির্দশন সংস্কৃত ভাষায়।

অন্যদিকে ইরানী তথা পারসীয় আর্যরা প্রথমে জরথ্রুস্তবাদ ও পরে ইসলামে প্রবেশ করে। এর আগেও পারসীয়দের দেখা যায় একেশ্বরবাদী ইহুদিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পারস্য সম্রাটদের বিপুল অর্থ বিত্ত সহকারে ইহুদি ধর্মের পেছনে পৃষ্টপোষকতার কথা ওল্ড টেস্টামেন্টার ইষ্রার পুস্তকে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। তবে এই পৃষ্টপোষকতা ইহুদি আচার্য ইষ্রাকে শোষিত মানুষের প্রতিনিধিত্বকারি একত্ববাদী ধর্মের মূল চেতনা থেকে বিপথে নিয়ে যায়। নিজের যাজকতন্ত্রের ক্ষমতাকে নিরংকুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধর্মকে তিনি বানিয়েছিলেন শোষণের হাতিয়ার, যা তাকে ঠেলে দেয় ইহুদি জাতির উপর বিশুদ্ধতার অনুশাসন চাপানোর দিকে। আর এ কাজের বৈধতা প্রমাণের জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের বানানো অবৈধ দৈব বিধানের যুক্তি। ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবৈধ ও বানোয়াট দৈব বিধান প্রবর্তনের এই পর্বটিতে এসে ভারতীয় আর্যভাষীদের সাথে হিব্র“ভাষীদের দারুন মিল দেখা যায় । প্রাচীন মানুষের ভিন্ন দুটি ঐতিহাসিক ধারা হিব্র“ভাবী ও ভারতীয় আর্যভাষীদের মধ্য থেকে উদ্ভুত বর্ণবাদের দুটি আলাদা ধারা যায়নবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রকৃতিতে অভিন্ন। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শেকড় অনুসন্ধানের পরে আমরা আবার ফিরে যাব আর্য ইতিহাসের সবচেয়ে সুদৃষ্টান্ত, গ্রিক সভ্যতার কথায়।

প্রাচীন জীবন ও অর্থনীতিতে শ্রেণি বিভাজনের ব্যাপারটি খুবই স্পষ্ট। সমাজের একদিকে অপ্রয়োজনীয় ফুর্তি বিলাসের বিপুল আয়োজন আর অন্যদিকে এসবের মূল্য দিচ্ছে শ্রমজীবী দাস, কারিগর ও প্রজাসাধারণ। যে ক্রীতদাস ও প্রজাদের শ্রমের সুফল ভোগ করে মালিক ও বড়লোকদের
এত বিলাসিতা, সেই ক্রীতদাস ও প্রজারা প্রতিদানে পেত বড়লোকের চাবুকের ঘা, নিষ্ঠুর অত্যাচার ও দুঃখ দারিদ্র পীড়িত মানবেতর জীবন। এ অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য সুবিধাভোগী বড়লোক শ্রেণির হাতে যেসব শক্তিশালী অস্ত্র ছিল তার অন্যতম হল তাদের স্বরচিত ধর্ম। সেই সব ধর্মে দেখা যায় খড়গহস্ত দেবী আর বল্লমধারী দেবতাদের ছড়াছড়ি। শোষণের ওপর গড়ে ওটা সমাজ ব্যবস্থাটাকে এসব দেব-দেবীরা পাহারা দিতেন। বড়লোকদের সাথে শোষণের অংশীদার ধর্ম যাজক ও পুরহিতকুল শোষণে জর্জরিত মানুষদের বোঝাত, তাদের দুর্গতির মূল হল দৈব বিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা, পূর্বজন্মের পাপ ইত্যাদি। সমাজবিধির লংঘন কিংবা বিদ্রোহের শাস্তি হিসাবে দেখানো হত দেব-দেবীর বল্লমের ভয়, অভিশাপের ভয়। এ ভয়ে জবুর্থবু হয়ে থাকত শোষিত মানুষ। তাই মনমত দৈববিধান প্রবর্তনে কোন অসুবিধা ছিল না।

গ্রিক দেব-দেবীরা যেভাবে সাহিত্যের চরিত্র হয়ে উঠেছেন তার বিপরীতে ভারতীয় দেব-দেবীরা হয়ে উঠেছেন শোষণের পাহারাদার। প্রাচীন ভারতের আর্য ধর্মের শোষণ ও বর্বরতার প্রতীক হলে ওঠার পর্বটি শুরু হয় মনুর বিধানের মধ্য দিয়ে। ইহুদি আচার্য ইষ্রার জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশুদ্ধতার বিধানের আর্য সংস্করণ যিনি নিয়ে এলেন তার নাম মনু। ভারতীয় আর্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজ-রাজড়াদের শোষণের দৈব অধিকার প্রতিষ্টায় তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য তিনি ফিরিয়ে আনলেন বেদের বর্ণবাদী অনুশাসন। এ অনুশাসন পালনে কঠোরতা আরোপ করতে গিয়ে তিনি যে সংহিতা রচনা করলেন তার নাম মনুসংহিতা। কি আছে সেই মনুসংহিতায়? যা আছে তা শুনলে আতংকে রক্ত হিম হয়ে যায়। অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অনার্যদের জন্য একটি নরকতুল্য পৃথিবী সৃষ্টি করলেন মনু তাঁর এই মনুসংহিতায়। তাদেরকে বানালেন আর্যদের ক্রীতদাস, অস্পৃশ্য ও অপবিত্র জীব। এরা হল শুদ্র। অন্যদিকে আর্যদের বানালেন সৃষ্টির প্রভু। এরা হল ব্রাহ্মণ - প্রভুর জাত। এদেরকে স্পর্শ করাও শুদ্রের জন্য মহাপাপ। অন্য দিকে কোন ব্রাহ্মণ যদি নিকৃষ্ট জাত শুদ্রদের কাউকে মেরেও ফেলে তাহলে যে সামান্য পাপ হবে, তা মোচনের জন্য তিন রাত দুধ পান করা বা এক যোজন রাস্তা হাটা অথবা নদী স্নান করাই যথেষ্ট। এছাড়াও বিড়াল, নেউল, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরেও শুদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে। (মনুসংহিতা, শ্লোক ১৩১ ও ১৩২)

হাম্মুরাব্বির আইন সংহিতায় নিম্নজাত মুশকেলুমের ওপর উচ্চজাত আওএলুমের যে দৈব শ্রেষ্টত্ব দেওয়া হয়েছে তার সাথে মনুর বিধানের মিল পাওয়া যায়। তবে মনুর বিধান তার চেয়েও অনেক বেশী অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট। মনুর কথায় দাসত্বের জন্যই শুদ্রের সৃষ্টি (মনুসংহিতা ৮:৪১৩)। ক্ষুন্ন না হয়ে, প্রসন্নমনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করা শুদ্রগণের প্রধান কর্তব্য (মনুসংহিতা ১:৯৯)। শুদ্র নামের এই দাসদের কোন পারিশ্রমিক দিতে হত না। কিন্তু গতর খাটাবার জন্যই তো এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই মনু বিধান দিলেন-শুদ্রভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা বা কুটির দান করিবে (মনুসংহিতা ১০:১২৫)। ভারতবর্ষের আদি সন্তান এই শুদ্রদের সম্পদ সৃষ্টির অধিকার ছিল, কিন্তু ভোগের অধিকার ছিল না। ভোগের অধিকার ছিল ছিল মালিকদের (মনুসংহিতা ৮: ৪১৬ এবং ৪১৭)। তিন বর্ণের মানুষদের চেয়ে যাতে শুদ্রদের আলাদাভাবে চেনা যায় সেজন্য প্রতি মাসে তাদের কেশ মুন্ডনের নির্দেশ দিলেন মনু (মনুসংহিতা ৫:১৪০)। এটাই হল মোটামোটিভাবে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের নৃশংস ও দানবীয় চেহারা।

আধুনিক ভারতের সংবিধান রচয়িতা শুদ্রজাত ড.বি.আর. আম্বেদকর ১৯৪৮ সালে অস্পৃশ্যদের আধুনিক আইনের মারপ্যাঁচে মনুবাদের বেড়াজালে আটকানোর জন্য মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক তাদের হরিজন নামে অভিহিত করার ফন্দি ও কৌশলের প্রতিবাদে জানাতে গিয়ে তাঁর The Untouchables: A Thesis on the Orgins of untouchabitity গ্রন্থে বলেন,
“হিন্দু সভ্যতা ......... মানব সভ্যতাকে ক্রীতদাস বানাবার একটি কৌশল। এর যথার্থ নামকরণ হওয়া উচিত ‘কলঙ্ক’। একটি সভ্যতাকে আর কী অভিধায় চিহ্নিত করা যায়, যা সাধারণ মানুষকে ........ যাদের অস্তিত্বকে দেখা হয় সামাজিক মেলামেশা থেকে বাইরের কোন প্রাণী হিসেবে ....... যাদের একটুখানি স্পর্শ অপবিত্র বলে বিবেচিত হয়।"

মনুর পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী নিষ্ঠুরতায় যিনি সবচেয়ে বেশী কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি হলেন শংকরাচার্য। তার আবির্ভাবকাল ৬৭৭-৭২০ খ্রিস্টাব্দ। শশাংকের রাজত্বকালের শেষদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে তিনি কেরালা থেকে বের হলেন ভারতভূমি পরিক্রমণে। তার এই পরিক্রমণ সম্পর্কে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়েছে।
“শংকরের আগমণে বৌদ্ধবিহার গুলি কম্পমান হইত এবং ভিক্ষুগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিত।" - ড. মনিকুন্ত হালদার, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। পৃষ্টা ৩২৩।

মনুর বিধানে শুদ্ররা অস্পৃশ্য হলেও তবু তো তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু বৌদ্ধ? সে তো বর্ণেরই বাইরে। অতএব সে কদাচারী, পাপিষ্ট এবং একদমই পরিত্যাজ্য। তাকে হত্যা করলে পাপ তো হবেই না, বরং দ্বিজ ব্রাহ্মণের অর্জিত হবে পূণ্য। এর মানে হলো যারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মানে না, তারা কুকুর, সাপ বা বেজীরও অধম। এদেরকে শায়েস্তা করার জন্য মহাব্রাহ্মণ শংকরাচার্য নিখাদ হিংস্রতায় ভারতজুড়ে চালালেন নারকীয় বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাদে আর্য ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন তার দানবিক ব্যাপ্তি ঘটিয়ে শংকরাচার্য রাজকীয় সৈন্য সহযোগে হত্যা করলেন অসংখ্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে। শংকরাচার্যের আজ্ঞাবহ রাজা সুধন্বা প্রভৃতির মত রাজাদের হত্যার শিকার ৬৪০০০ বৌদ্ধের কথা উদ্ধৃত হয়েছে প্রাচীন শিলালিপিগুলোতে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন : ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পতন, পৃষ্টা ১২)।

শংকরাচার্য যে রাজ্যে পা রাখতেন সেখানকার বৌদ্ধধর্মীরা প্রাণভয়ে বনেজঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতার নমুনা হল, তার নির্দেশে ওদের হাত পা বেঁধে নিক্ষেপ করা হত ফুটন্ত তেলভর্তি কড়াইয়ে। যে বর্ণের ভিত্তিতে আর্য ব্রাহ্মণবাদের এত নিষ্ঠুরতা সেই বর্ণের বিশুদ্ধতার ভিত্তি কতটুকু ছিল? ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার যায়নবাদী ভিত্তি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে ইব্রাহিম-মুসা-দাউদ-সলোমনের পরজাতীয় কন্য বিবাহের ঘটনায়, ঠিক সেভাবেই আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তি খসে পড়ে-খোদ মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস দ্বৈপায়নের শুদ্র মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়ার ঘটনায় এবং বেদের অন্যতম রচয়িতা ঋষি বশিষ্ঠর বেশ্যা গর্ভজাত হওয়ার ঘটনায় (দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ, প্রথমখন্ড, পৃষ্টা ১২০)।

ব্যাস দ্বৈপায়ন এবং বশিষ্ঠ দুজনেই ব্রাহ্মণ ধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তাদের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান অনেক। একজন মহাভারতের রচয়িতা অপরজন বেদের রচয়িতা। দুজনকেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সংগে বলা হয়-মহর্ষি অর্থাৎ মহা ঋষি। ঋষি নামক এই পরজীবী শ্রেণিটির সৃষ্টি আর্যরা ভারতে আসার ২০০ বছর পরে।

আর্যভাষীরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা প্রথমে এসে পৌঁছায় গান্ধার রাজ্যের তক্ষশিলায়, তক্ষশিলার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানে এবং গান্ধার রাজ্যের বর্তমান নাম আফগানিস্তানের কান্দাহার। সেই সময়ে আর্যরা ছিল নিরক্ষর কিন্তু ভারতভূমির অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলন ছিল লেখার। লেখ্য সংকেত লিপির সাহায্যে তারা লেখত। অথচ আর্যরা ভারতভূমির এই প্রাকৃতজনদের অভিহিত করল ‘অনার্য’ নামে যার আভিধানিক অর্থ অসভ্য ও অসুর এবং নিজেদের অভিহিত করল ‘আর্য’ নামে যার অর্থ সুসভ্য, শ্রেষ্ঠ। শিকারজীবী আর্যদের চেয়ে কৃষিজীবী অনার্যদের সমাজ ব্যবস্থাও ছিল উন্নত-যদিও তখনও রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র না থাকায় দাসতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রও গড়ে ওঠেনি। দাস শ্রম শোষণের ওপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে ওঠে তা দাসতন্ত্রী সমাজ, আর কৃষক প্রজাদের ফসলের ভাগ কেড়ে নেওয়ার যে অত্যাচারি ব্যবস্থা তার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতবর্ষের প্রাচীন অনার্য সমাজে তখনও এরকম ভাঙন সৃষ্টি হয় নি। শ্রেণি শোষণের উপযোগী অর্থনীতি তখনও যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার বাকী। তাই কৃষিজীবী অনার্যদের মাঝে প্রচলিত ছিল এক ধরনের গুচ্ছগ্রাম ব্যবস্থা। একগুচ্ছ গ্রাম নিয়ে একেকটি স্বাধীন মানব বসতি গড়ে উঠত। এর নাম ছিল ‘জন’। আর জনের শাসক ছিলেন জনপতি। জনপতি নির্বাচিত হতেন জনের সকল সদস্যের সম্মতিতে। এসব জনপতিদের কেউ কেউ সাম্যবাদী নিয়ম ভঙ্গ করে সামন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছেন, বাড়তি সুবিধা ও বিলাসীতার আশায়। কিন্তু জমিতে দাস খাটিয়ে কিংবা প্রজা বসিয়ে ফসলী কর আদায়ের মত উন্নত পর্যায়ে অর্থনীতি বিকশিত না হওয়ায় এসব স্বৈরাচারী জনপতিদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াত সৈন্যবল নিয়ে বিভিন্ন জনের গরু-ছাগল ডাকাতি করা। আর অনার্যদের সব কিছুর চেয়ে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল আর্যদের। আর্য জনপ্রতিদের মধ্যে যারা মুগুরভাজা শরীরের অধিকারি তারা হয়ে উঠলেন গরু মোষ ডাকাতির সর্দার।

ভারত ভূমিতে এসে কালক্রমে পশুপালনই হয়ে ওঠে আর্যদের প্রধান জীবিকা। অনার্যদের কাছ থেকে তারা অনেক কিছুই শেখে। তবে একটি ব্যাপারে তারা অবশ্যই অনার্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। এটা হল আধিপত্য ও শোষণকে চিরস্থায়ী করার কাজে ধর্মের ব্যবহার। অনার্য স্বৈরাচারী জনপতিরা একাধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার কোন কৌশল আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে যখনই জন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তাদেরকে গদি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। অন্যদিকে আর্য জন পতিরা রাজত্বকে বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করলেন ঋষি নামক এক পরজীবী শ্রেণিকে। ততদিনে গরু-ছাগল ডাকাতি করে আর্য জনপতিরা ফুলে ফেঁপে হয়ে উঠেছেন ছোট ছোট সামন্ত বা রাজা। আর সামন্ততন্ত্রকে আধ্যাত্মিক কৌশলে নিরাপদে রাখার কাজে নিযুক্ত ভাঁড়াটে ঋষিরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন এক পাল দেবতা, যাদের বাস মর্তে নয়-স্বর্গ নামক এক কাল্পনিক জগতে। এরা অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী। গোত্রাধিপতি থেকে যারা পরিণত হয়েছেন রাজায়, তাদের লাঠিয়াল ও বল্লমধারী বাহিনীর শক্তির সাথে এবার যুক্ত হল ঋষিদের সৃষ্টি এসব দেবতাদের শক্তি। রাজা সর্বদাই এসব দেবতাদের পছন্দের ব্যক্তি এবং দেবভক্তি আর রাজভক্তিতে কোন তফাৎ নেই। রাজভক্তিতে ঘাটতি থাকলে দেবতা অসন্তুষ্ট হন। মৃত্যুর পরে যেতে হবে দেবতাদের কাছেই। রাজদ্রোহী পাপীদের জন্য তখন ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন দেবতারা। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে সাবলীল ভাষার ফুটিয়ে তুলেছেন পন্ডিত রাহুল সাংকৃতায়ন তাঁর ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটিতে।

এ ভূখন্ডে কালক্রমে শোষণবাদী আর্য ধর্ম একটি আকার ধারন করতে থাকে। এ ধরনের ব্যাপারে সময় লাগে ঢের। ইতোমধ্যে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পরে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বছর। সমান্ততন্ত্র, তখন দানা বাঁধছে ভারতের মাটিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গুচ্ছগ্রাম অর্থনীতি যাচ্ছে হারিয়ে। তার জায়গায় আসছে ছোট ছোট রাজা। ছোট ছোট রাজ্য। অনার্য জন এর জনপতিরা রাজা হয়ে উঠতে পারেননি স্থায়ী ভাবে। কিন্তু আর্য জনপতিরা পান্ডা পুরুত সমেত দস্তুরমত রাজা হয়ে উঠছেন। তাই ক্ষমতার বেলায় শক্তিশালী আর্য রাজাদের কাছে জনগুলো পরাজিত হতে লাগল। এমনকি আর্য গোত্রপতি-রাজারাও পরষ্পরের সাথে লিপ্ত হত যুদ্ধে! স্বার্থ জাত মানে না।

ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা টিকে থাকল তাদের ব্যক্তিশাসনের ভিত মজবুত করার কাজে নিযুক্ত মুনি ঋষিরা নানা দৈব বিধি বিধান প্রবর্তন করে চলেছেন দেবতার নামে। এসব দৈব বিধি-বিধানই সংকলিত হয় ঋকবেদে। ততদিনে প্রাথমিক যুগের যেসব আর্য গোত্রপতি গরু, মোষ ও ছাগল ডাকাতির ঘটনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, তার পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। যুদ্ধবিজয়ী এসব ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন প্রবাদপুরুষ। আরো কয়েক পা এগিয়ে ঋকবেদের রচয়িতা অতি উৎসাহী তিন ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ এদেরকে বানিয়ে ফেললেন দেবতা। এর হলেন ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অগ্নি প্রভৃতি। এরা প্রত্যেকেই সুদুর অতীতে ছিলেন মর্ত্যরে মানুষ এবং বিখ্যাত গরুচোর। স্বয়ং ইন্দ্র, যিনি স্বর্গ দেবতাদের রাজা তাঁর সকল সুকর্ম-কুকর্মের মধ্যে প্রধানতম কাজটি ছিল গরু চুরি। (দিনেশচন্দ্র সেন; বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খন্ড, পৃষ্টা-২৪৪)। পশুপালন ভিত্তিক সেই সমাজে ধনসম্পদ বলতে এরা একমাত্র গরুকেই বুঝতো। এমন কি এদের ভাষায় যুদ্ধ আর গরুলাভের ইচ্ছা বোঝাতে একটাই শব্দ প্রচলিত ছিল।

ঋকবেদ রচনা শুরুর সময়কালে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। গঙ্গা-যমুনার সন্নিহিত উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাচীন দেশ রোহিলাখন্ড ও মধ্যদোয়াব অঞ্চলের নাম তখন পঞ্চাল। পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের রাজবেদী নিরাপদ রাখতে এগিয়ে এলেন তিন পরজীবী ঋষি। এরাই হলেন বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ। পুরনো দিনের বিখ্যাত গরুচোরদেরকে তারা বানালেন পরম ক্ষমতাধর দেবতা। এমনকি এসব দেবতাদেরও একজন স্রষ্টার জন্ম দিলেন। তার নাম ঈশ্বর। তিনি দেবতাদেরও স্রষ্টা। দেবতারাও তার অনুগ্রহ প্রার্থী। তার বিধানই দেবতাদের বিধান। কী সেই বিধান? ঋষিরা জানিয়ে দিলেন রাজাকে দেবতারা পাঠিয়েছেন শাসন করতে। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে দেবতারা ক্ষুদ্ধ হবেন, ঈশ্বরও ক্ষিপ্ত হবেন। আর ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হলে নেমে আসবে বিপর্যয়। এই ঘোষণা দেওয়া হল যজ্ঞ করে, যার নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ। এই ঘোষণার সাথে শুরু হলো ঋকবেদ নির্মাণের কাজ। তৈরি হয়ে গেল সামন্তবাদী শোষণের ভিত। গরু-মোষ হরণে পারদর্শী প্রাচীন আর্য গোত্রপতিরাই এ ব্যবস্থায় পরিণত হলেন বিখ্যাত দেবতায়। গরু-মেষ চুরিকে কেন্দ্র করে বেধে যাওয়া যুদ্ধে তাদের বিজয় ও বিক্রমই তাদের এনে দেয় এই গৌরব। ৪টি বর্ণের বিভাজন তখনও সৃষ্টি হয় নি। তবে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের-প্রাথমিক চেহারাটি দেখা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। এদের কর্মক্ষেত্রেও এসে গিয়েছিল বিভাজন। একজনের কাজ রাজপাট করা, দখল-লুণ্ঠন-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আর অন্যজনের কাজ ধর্মীয় যুক্তিতে রাজকৃত অন্যায়কে ঈশ্বরের বিধান বলে প্রচার করা। তবে এই প্রতারণাও খুব বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে উঠল। কারণ শ্রমজীবী মানুষের বুকের ওপর চেপে বসা দেবতাদের বিধানগুলো দিন দিন আরও দুঃসহ হয়ে উঠছিল। তাই মানুষ বিধানের জাল কেটে বেরিয়ে পড়তে চইছিল। অতএব শঙ্কিত রাজার রাজবেদী রক্ষার জন্য নতুন কৌশল জরুরি হয়ে উঠল। আর তা আবিষ্কার হয়ে গেল একসময়। এর নাম পূণর্জন্মবাদ। সৃষ্টি হল ব্রহ্মা। এসব ধারণা আবিষ্কার করলেন স্বয়ং রাজন। তবে ঘোষিত হল পুরোহিতের মুখ দিয়ে, শতশত গো-মহিষ বলি দিয়ে যাগযজ্ঞের আয়োজন করে। এসব ঘটনা ঘটল ঈশ্বর সৃষ্টি ও ঋকবেদ রচনার কয়েকশ বছর পরে।

পঞ্চালভূমির রাজা দিবোদাসের রাজবেদীকে নিরাপদ করার জন্য রাজ-উচ্ছিষ্টভোগী ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ যে ঢাল তৈরী করেছিলেন তা ৭০০ বছর ধরে নিরাপদে রেখেছে দিবোদাসের বংশধারার রাজত্বকে। কিন্তু এই ঢালে ফুটো দেখা দিল দিবোদাসের উত্তর পুরুষ রাজা প্রবাহনের বেলায়। তিন ঋষি সৃষ্ট দৈব অনুপান এতদিনে তেজ হারিয়েছে। দেবতারাই রাজাকে পাঠিয়েছেন শাসন করতে এই দৈব বিধান আর কাজ দিচ্ছিল না। শোষণে জর্জরিত প্রজা সাধারণের মনের খটকা ক্রমেই বাড়ছিল। কারণ তাদের শ্রমের ফসল গিয়ে উঠবে রাজার ঘরে আর রাজার ভোগ বিলাসের উপকরণ জুগিয়ে চলবে তারা-এমন দৈব বিধান তারা আর মেনে নিতে পারছিল না। দেবতা নামক অদৃশ্য সত্ত্বার নামে চালু করা এসব বিধানের প্রতি তাদের অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিল। তাই রাজা প্রবাহন রাজত্বকে মজবুত অবলম্বন দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাকে। এর আগের ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের কেউ দেখেনি। তাই লোকের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল। এজন্য প্রবাহন সাকার দেবতাদের স্থলে নিরাকার ব্রহ্মের আমদানি করলেন, যাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠে না। ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে চাই সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়। আর সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় লাভ করতে হলে চাই সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হল তাতে ছাপ্পান্ন পুরুষ ধরে সাধনা করেও মানুষ সফল হতে পারবে না, ভ্রমাচ্ছন্ন থেকে যাবে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন: ভোগলা থেকে গঙ্গা, পৃষ্টা ১৩৮-১০৯,১১০)।

বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি কিন্তু প্রবাহনের নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। এর সাহায্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু ব্রহ্মের চেয়েও বড় হল প্রবাহনের দ্বিতীয় আবিষ্কার (প্রাগুক্ত)। আবিষ্কারটি হল, মরে গিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা - অর্থাৎ পূণর্জন্মের ধারণা। এতদিনে বৈষম্য ও শোষণের পক্ষে খাটানো হয়েছিল শুধু মাত্র দৈব বিধানের যুক্তি। এবার আমদানী হল অনেকগুণ শক্তিশালী যুক্তির। ধনীদের ফূর্তি ও বিলাসীতার ফলে শোষিত গরীবের জীবনে যে দুঃখ ও দুর্দশা নেমে আসে তা ব্যাখ্যা করা হল পুর্বজন্মকৃত ফল হিসেবে। একদিকের ভোগ বিলাস আর অন্য দিকের দুঃখ দারিদ্রতাকে আগের জন্মের সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল হিসেবে দেখানো হল। শোষকের ধন শুধু দেব কৃপায় পাওয়া বস্তু নয় বরং পুর্ব জন্মের সুকর্ম ও দেব ভক্তির পুরষ্কার। আর গরীবের দুর্দশা পুর্বজন্মের পাপের শাস্তি। এভাবে দেবকৃপায় পাওয়া শোষণের অধিকারের যুক্তির স্থলে কাল্পনিক পুর্ব জীবনের সুকর্মের পুরষ্কার হিসেবে শোষণের অধিকার পাওয়ার যুক্তি একটি শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিল সামন্তবাদী শোষণে। দরিদ্র প্রজারা পূণর্জন্মের আশায় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নিতে শিখল। ধন্য প্রবাহন! ধন্য তার যুক্তি! পুরোগামী ঋষিরাও যা পারেনি, ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারি ব্রাহ্মণরাও যা পারেনি, অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সেই কাজ সম্পন্ন করলেন প্রবাহন। আর্য ইতিহাসের এই কুৎসিত অধ্যায়, যা সম্পন্ন হয়েছিল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সে সম্পর্কে প্রখ্যাত শেকড় সন্ধানী লেখক মাসুদুল হক বলেছেন:
“এবং এসে গেলেন ব্রহ্মা। এসে গেল পূণর্জন্মবাদ, তৈরি হয়ে গেল মানুষকে চিরকালের মত শৃঙ্খলিত করার, তার শ্রম-ডাকাতির জন্য মহাজালিয়াতিপূণর্, মহাপ্রতারণামূলক এবং কুৎসিত কদাকার দলিল। যদিও সাহিত্যের মানদন্ডে এটি-এই বেদ, তৎকালীন মানুষের এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি তথাপি সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে শৃঙ্খলিত করার, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা আর অবমাননার এই চিরকালীন দলিলের তুল্য দ্বিতীয়টি মেলা ভার।” - মৌলবাদ, পৃষ্টা-১৩৪।

দিবোদাস তিন ঋষি-বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজকে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপরে প্রভুত্ব করার যে ঢাল তৈরি করেন তার পাশাপাশি প্রবাহন তৈরি করলেন এক অভেদ্য নতুন ঢাল যার ভেদ্যতা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। একমাত্র একজনই সেই ঢালের অভেদ্যতা ভেদ করার দুঃসাহস দেখালেন। তাঁর নাম গৌতম বুদ্ধ। তাঁর জন্ম ৫৬৬ খ্রিস্পুর্বাব্দে, মৃত্যু ৪৮৩ ক্রিষ্টপুর্বাব্দে। ৫১৪ খ্রিস্টপুর্বাব্দে ২৯ বছর বয়সে সেমেটিক নবীদের মত ধ্যান করতে চলে যান নির্জনে। ছয় বছর ধ্যানের পর হলেন বিশেষ জ্ঞান প্রাপ্ত। এর পর নামলেন নতুন ধর্ম প্রচারে। এই নতুন ধর্মে শোষিতরা দলে দলে দীক্ষা নিতে আসলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের জন্য তা অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দেখা দিল। ততদিনে ক্ষমতার দৌঁড়ে ক্ষত্রিয়কে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রাহ্মণ। রাজা প্রবাহনের পর ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য হন ক্ষত্রিয় রাজা।
একসময়ের রাজ উচ্ছিষ্টভোগী ব্রাহ্মণ ধর্মের বাণীর জালে আটকে ফেলে ক্ষত্রিয় রাজাকে এবং নিজেই হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। কারণ তার হাতেই তো আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দন্ড। তার মুখ নিঃসৃত বাণীই রাজার কাছে হয়ে ওঠে অলঙ্ঘনীয় বিধান। ব্রাহ্মণ পরিণত হয় অবতারে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই বসন্তের দিনে বুদ্ধের আগমণ। বুদ্ধের দর্শন হয়ে ওঠে এদের প্রাণের শত্র“। পরবর্তীতে মনু ও শংকরাচার্য বৌদ্ধধর্মীদের ওপর যে কঠোরতা আরোপ করেন তা আমরা দেখেছি। তবে ব্রাক্ষণ্যবাদ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেদের অনুশাসন পালনে বুদ্ধের সময়েও যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়।

মহাভারতের রচনাকাল ৪০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে। সে সময়ে বেদ নির্দেশিত বর্ণভেদ পালনে কঠোরতা দেখা যায় না। শোষিতের সম্পদ লুট করেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সন্তুষ্ট ছিল। বাড়তি ঘৃণা প্রদর্শনের প্রয়োজন এত বেশি ছিল না। তাই উচ্চ বর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের বেদ বিরোধী দৈহিক মিশ্রণে কোন ক্ষতি ছিল না। সেই সময়ের নিয়োগ প্রথা এর স্বাক্ষ্য দেয়। নিয়োগ প্রথায় সন্তান জন্ম দানে অক্ষম রমণীর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় স্বামী বংশ রক্ষায় নিম্ন বর্ণের রমণীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করত। একে ব্যভিচার মনে করা হত না। খোদ মহাভারতের সৃষ্টিকর্তা মহা কবি ব্যাস দ্বৈপায়নের জন্ম শূদ্রা মায়ের গর্ভে এবং তিনি নিজেও নিম্নজাত মহিলার গর্ভের সন্তানের জনক। এমনকি তার বাবাও নিম্ন বর্ণের গর্ভজাত। তিন পুরুষের এই বিচ্যুতি দেখে বোঝা যায় বর্ণবাদ তখন শাস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ব্যাস দ্বৈপায়নের পিতা মহর্ষি পরাশর ছিলেন নিখাদ ব্রাহ্মণ। তারই ঔরসে খাঁটি শুদ্র ধীবর কন্যা সত্যাবতীর গর্ভজাত ব্যাস দ্বৈপায়ন লিখেছেন পৃথিবীর পাঁচটি মহাকাব্যের একটি। এর ২০০ বছর পরে ভারতীয় সমাজকে বর্ণবাদের লৌহশেকলে বাঁধতে চালু হল মনুর বিধান। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে রচিত হয় মনুসংহিতা এবং বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুর অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। নারকীয় উল্লাসে মনু শ্রমজীবী মানুষকে নিম্ন বর্ণে স্থান দিয়ে তাদের উপর চাপিয়ে দিলেন উচ্চ বর্ণের ঘৃণা-অত্যাচার-নিষ্ঠুরতা ও প্রভুত্বকে। এটা সমগ্র বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত এবং জঘন্য দৃষ্টান্ত। মহাভারত সৃষ্টির দুই তিনশ বছর পরে মনু এ বিধান দেন। এর পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টপুর্ব ১৮৫ সালে ভারত ভূমিতে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। এরও দীর্ঘদিন পরে আবির্ভূত হন শংকরাচার্য। রাজকীয় ও নিজস্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে তার বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের পরবর্তী বড় নিষ্ঠুরতার ঘটনা। এর পরেও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত উদয়নাচার্য, রামানুচার্য, বাচষ্পতি মিশ্র প্রমুখ ব্রাহ্মণাচার্যরা বৌদ্ধ নিধন ও ভারতভূমি থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তি ঘটানোর হেন কোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতার শিকার বৌদ্ধদের কথা পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সহিংসতা বন্ধ হয় ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের পরে।

মুসলিম সামন্তরা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে কেড়ে নিল ভারত ভূমির ক্ষমতা। সেই সাথে এ ভূখন্ডে প্রবেশ করল সেমেটিক ইসলাম ধর্ম। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ আহত কেউটের মত শুধুই ফোঁস ফোঁস করেছে। ১৭৫৭ সালের পরে ভারতভূমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে চলে গেলে আহত কেউটে সোজা হয়ে ফণা তোলে দাঁড়ায়। সাতশ বছর পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ছত্র ছায়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদ আবার দানবিক মুর্তিতে আবির্ভূত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বৌদ্ধরা নয় - মুসলিমরা। তাই ব্রিটিশের হাতে মুসলিম শাসকই হোক আর বিপ্লবীই হোক, পরাজিত হলে মনু শংকরাচার্যের উত্তরসূরিরা আনন্দে ভেসে যেত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশের জয় কামনা করে কবি ঈম্বরচন্দ্র গুপ্ত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লিখলেন-

যবনের যত বংশ একেবারে হবে ধ্বংশ
সাজিয়েছে কোম্পানীর সেনা
গরু জরু লবে কেড়ে চাপ দেড়ে যত নেড়ে
এই বেলা সামাল সামাল।

এখানেই শেষ নয়। দিল্লীর যুদ্ধ কবিতায় লিখলেন:
চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়।
আরও লিখলেন:
‘ভারতের প্রিয়পুত্র হিন্দু সমুদয়
মুক্ত সুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।’

এছাড়াও ঝাঁসির রানী যবন মুসলমানদের মতই তার প্রভু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে তার ভাষায় হয়ে গেলেন ‘ঠোঁট কাটা-কাকী’।
ব্রিটিশের গোলামীর ইতিহাসে আরেকজনের পারদর্শীতাও আলোচিত হতে পারে। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৫৭ সালের ২২ জুন ইংরেজ সৈন্যরা যখন সিপাহী বিদ্রোহীদের পরাজিত করে দিল্লী দখল করে সেই দিনটি ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য মহাআনন্দের। এই কদর্য আনন্দের প্রকাশ ঘটালেন তিনি সংবাদ ভাস্কর এ প্রকাশিত এর রচনায় বিপ্লবীদের পাপিষ্ট বলে অভিহিত করে এবং ইংরেজদের জয়ে আনন্দ নৃত্যের আহবান জানিয়ে।
ব্রাহ্মণ্যবাদ এভাবে পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে। ব্রিটিশ প্রভুর গোলামীতে তার কোন খুত ছিল না। ভারতীয় আর্য সভ্যতার সমগ্র ইতিহাসটাই এভাবে পরিণত হয়েছে সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে যা বৈদিক প্রতারণা, ব্রাহ্মণ্যবাদ-বর্ণবাদ, মনুবাদ এবং নারী নির্যাতনের এক ঘৃণ্য দলিল ছাড়া আর কিছু নয়। এ সভ্যতা কলঙ্কের শীর্ষে পৌঁছে যায় বর্ণবাদী অনুশাসনে সভ্যতার আসল কারিগর শ্রমজীবী মানুষের পবিত্র দেহকে অস্পৃশ্য ঘোষণা দিয়ে; নারকীয় নৃশংসতায় সতীদাহের মত প্রথার প্রবর্তন করে; পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলে নারীর অধিকারকে বন্দী করে এবং সর্বোপরি নারী, অন্যধর্মী ও অন্ত্যজ হিন্দুসহ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে শোষণ, ঘৃণা ও অত্যাচারের বেদীতে বলী দেয়ার মধ্য দিয়ে। মানবতার পরাজয়ের এক করুণ ইতিহাস হল এই বৈদিক ও আর্য সভ্যতা। রোমান গ্লাডিয়েটরদের কথা বাদ দিলে এই ভারতীয় আর্য সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান - অস্পৃশ্যতা-বর্ণবাদ-নিরীহ মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্য বলী দেয়া-সতী পোঁড়ানো-বিধবাকে বেশ্যা হতে বাধ্য করা - এসবই হবে সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নারকীয় নির্দশন। মানুষের মর্যাদা ও মানবতার অবমাননার এত করুণ চিত্র, এত বড় সামাজিক পরিমন্ডলে আর কোথাও দেখা যায় না। আর্য ব্রাক্ষণ্যবাদ ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই একবিংশ শতকেও গুজরাটের মুসলিম হত্যায় মেতে ওঠে সমান নৃশংসতায়। মানুষের খোলস ছেড়ে দানবের চেহারায় বেরিয়ে আসেন মনু-শংকরাচার্যের উত্তরসুরি গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদী।

মোটামোটিভাবে এসবই হল ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাস। এ ইতিহাস গৌরবের নয়, কলঙ্কের। তবুও তা পড়তে হবে, জানতে হবে। জীবনকে কলঙ্কের ভারমুক্ত করার জন্যই তা প্রয়োজন। আগামী জীবনকে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও শোষণমুক্ত করে গড়ে তোলার জন্যই এ ইতিহাসকে জানতে হবে। সেইসব শ্রমজীবী মহামানবেরা, যারা সভ্যতার আসল কারিগর, যাদের বুকের ওপর গড়ে ওঠেছে সভ্যতা; ইতিহাসের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে তাদের দুঃসহ জীবনের করুণ কাহিনী। তারা সভ্যতার পিলসুজ। মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। উপরের সবাই আলো পায়, সেই আলোতে বাবুসাহেবরা খেলা করে। অথচ ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। বাবুদের ইতিহাস তাদের প্রতি সম্মান দেখানো দুরের কথা, করুণাও প্রদর্শন করে না। ইতিহাসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা তাদের অসম্মান, লাঞ্ছনা ও অবমাননার কাহিনী জানতে হবে পড়তে হবে। জানতে হবে তাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনী যা এখনও শেষ হয়ে যায় নি। বাবুদের অত্যাচারও বন্ধ হয় নি। বাবুদের ভাঁড়াটে সশস্ত্র বাহিনী হামলে পড়ে ভারতের জঙ্গলে, শিকার করে নিয়ে আসে মাওবাদী বিদ্রোহীর লাশ। সৌখিন বাঘ শিকার-নয়, বাবুরা হিংস্র উল্লাসে মেতে উঠেন মাওবাদী শিকারে। এর নাম অপারেশন গ্রিন হান্ট, যা শুরু করেছে বাবুদের রাষ্ট্র। তাই বুঝতে হয় ইতিহাস এখনও বড়ই অসমাপ্ত। ইতিহাস সেদিনই সমাপ্ত হবে যেদিন শ্রমজীবী মানুষ তার নায্য অধিকার ফিরে পাবে। যেদিন মানুষ তার প্রাপ্য ফিরে পাবে এবং সেদিনই শুরু হবে মানুষের গৌরবের ইতিহাস। তার আগে কখনোই নয়।
সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে গৌরবের চেয়ে কলঙ্কের নির্দশন অনেক বেশি। শোষণ আর অপচয়ের অপর নামই সভ্যতা। তবে এর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসটাও ক্ষুদ্র নয় মোটেও। সভ্যতার ইতিহাসে একদিকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় শোষণ আর কলঙ্ক অন্য দিকে তেমনই খুঁজে পাওয়া যাবে বিদ্রোহ-বিপ্লব-সংগ্রাম। তবে শোষকের ইতিহাসে তা স্থান পায় নি। তাই সেই সকল গৌরবের কাহিনীর অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব না কখনোই। ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাসে যেভাবে শোষণ ও কলঙ্ক ছড়িয়ে আছে তার বিপরীতে সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়গুলো এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি। কারণ সংগ্রাম আজ অবধি চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারে নি। তাই সংগ্রাম বারে বারে পরাজিত হয়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু আবার ফিরে আসে।

সভ্যতা বিশ্বকে যতটা না আলোকিত করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে। সংগ্রাম যেহেতু চুড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে পারে নি, তাই তা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এ কারণে সকল ক্ষেত্রেই শোষক ও সুবিধাভোগী শ্রেণিই সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে শোষক শ্রেণির এ প্রতিনিধিত্ব আর্যদের অন্যান্য শাখা যথা পারসীয় ও দক্ষিণ ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে নিরংকুশ ভাবেই কলংকের নয়। দাস শোষণের কলংকে কলুষিত হলেও সেসব সভ্যতা মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই অবদান সৃষ্টি করতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক সভ্যতা গুলো এবং দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্য নগর সভ্যতাগুলোর বেশ কিছু উদ্ভাবন আজও আমাদের কাজে লাগছে। বর্ণমালা, ভাষা, সংখ্যা গণনা, ক্যালেন্ডার, গণিত, জ্যামিতি, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা, দর্শন-চিন্তা, যন্ত্র কৌশল, আইন, সাহিত্য, জ্ঞান শাস্ত্র এবং সর্বোপরি শিল্প কলায় এসব সভ্যতা মানুষের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিশ্রমের বোঝাটা শোষিত শ্রেণির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে অবকাশটা পাওয়া যায় তা বৈদিক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা যেভাবে শুধু ষড়যন্ত্র ও নোংরা কৌশল উদ্ভাবনের পেছনে ব্যয় করেছে সেরকমভাবে না করে দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্যরা কিছুটা হলেও সময়কে জ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার পেছনে ব্যায় করেছে। গ্রিসে জন্ম নিয়েছেন এস্কাইলাস, সফোক্লিসের মত ন্যাট্যকার, পিথাগোরাসের মত গণিতবিদ, সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মত দার্শনিক, হেরোডোটাসের মত ইতিহাসবিদ, ফিদিয়াসের মত ভাস্কর এবং ডেমোক্রিটাসের মত প্রকৃতি বিজ্ঞানী। যদিও তারা দাস শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের সভ্যতা তবুও জ্যোতিবিজ্ঞান, চিকিৎসা, স্থাপত্যকলা, সঙ্গীত ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রে গ্রিকরা দুনিয়ার সেরা ছিল। এমনকি এথেন্সের পেরিক্লিসের মত রাষ্ট্রনায়কও সেই যুগের ইতিহাসে বিরল।

বই পোকায় বইটি পড়তে চাইলে এই লিংকে যান:
http://banglabookhouse.com/book/MjI3/Itihaser-Pathshalay-PrachIn-zug

লেখক: আসিফ আযহার, শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শা.বি.প্র.বি.
ঠিকানা : ৫৬, ঝরনা আ/এ, ঝরনারপার, কুমারপারা,সিলেট-৩১০০।
যোগাযোগ: ০১৮১৬ ৯৪৭৩২৩,
E-mail: [email protected]
FB: Asif Ajhar
Blog: http://www.asifajhar.blogspot.com
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×