somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষ্টেশনঃ গৌরিপুর জংশন – গন্তব্যঃ অচিনপুর

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পড়ন্ত বিকেল। হালকা বাতাস বইছে, বাতাসে প্লাটফর্মের উপরে হালকা ধুলো উড়ছে। ষ্টেশনের নাম গৌরিপুর জংশন। অন্য ষ্টেশনের চেয়ে এই ষ্টেশনটা একটু আলাদা। এখানে কোনো ষ্টেশন মাষ্টার নেই, কোন সিগনাল নেই। কোনো শোরগোল নেই। তাছাড়া ষ্টেশনে অন্যান্য মানুষজনও কেউ নেই বললেই চলে। এখানে আছে শুধু কয়েকজন যাত্রী। যদিও কেউ কাউকে চিনে না, কিন্তু সবার গন্তব্য একই। মজার ব্যাপার হল তারা এটাও জানে না কি তাদের গন্তব্য। তারা শুধু জানে যে ট্রেনটা আসবে সেই ট্রেনের একজন আগুন্তুক আসবেন যিনি তাদের সবাইকে নিয়ে গন্তব্যে যাবেন। ট্রেনের যাত্রী বলতে অবশ্য ঐ একজন’ই। উনি একজন শিল্পী। যদিও পেশাদার চিত্রশিল্পী না। তাছাড়া অন্য চিত্রশিল্পীদের সাথে তার পার্থক্য হচ্ছে উনি ছবি আকেন কাগজে কলমে। গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে। উনি ছবি আকেন মানুষের, মানুষের জীবনের; বেশীরভাগই সাধারণ মানুষের।


প্লাটফর্মের এক কোণায় চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটছে রুপা। একবার তাকাচ্ছে ঘড়ির দিকে আর একবার তাকাচ্ছে স্টেশনের পেছনের দরজার দিকে। “একটু দাঁড়াও তো আসছি আমি” এই কথা বলে এক ঘন্টার বেশী হল হিমু বের হয়ে গেছে স্টেশন থেকে। এখনো আসছে না। এদিকে ট্রেন আসার সময় হয়ে গেছে। সব সময় যদি এরকম দায়িত্বহীনের মত কাজ করে তাহলে কি হয়? হঠাৎ রুপার মনে হল, “আচ্ছা ট্রেনটা যদি হিমু আসার আগেই চলে আসে তাহলে কি হবে? ট্রেনটা যদি হিমুকে রেখে চলে যায়?”। হঠাৎ রুপা সিদ্ধান্ত নিল হিমু’কে ছেড়ে যাবে না। প্রয়োজনে গৌরিপুর জংশনেই থেকে যাবে সারা জীবন, হিমুর অপেক্ষায়।


এদিকে হিমু একটু দূর থেকে চুপচাপ রুপাকে দেখছে। রুপার চিন্তিত চেহারাটা দেখতে মজা লাগছে। তবে আজ এই মজার মধ্যে একটা ভালবাসা ভালবাসা বোধ হচ্ছে। রুপাকে দেখে হঠাৎ হিমুর কাছে ‘পেন্সিলে আকা পরী’র মত লাগছে। কেন জানি রুপাকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী’র তীরে যেতে ইচ্ছে করছে। যদিও হিমুর নিজের কাছে ব্যাপারটা কেমন জানি লাগছে। মনের ভিতর থেকে আজ কেউ বলছে না হিমালয় ভালবাসা শব্দটা তোমার জন্য নয়। যাহোক রুপার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেহেতু ভাল লাগছে তাই আপাতত তাকিয়ে থাকাই ভাল। সব সময় নিজেকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। পান চিবুতে চিবুতে রুপাকে দেখার মধ্যে একটা আলাদা মাদকতা আবিষ্কার করল হিমু। যাক বেচারিকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। রুপার দিকে আস্তে আস্তে এগুতে লাগল।



স্টেশনে ঢুকার গেটের ঠিক বাম পাশের সিগারেটের দোকান থেকে একটা সস্তা সিগারেট কিনে আগুন জ্বালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে মিসির আলী। অনেক চেষ্টা করেও ম্যাচটা জ্বালানোর চেষ্টা করেও পারছে না কেন এটা আপাতত তার কাছে একটা রহস্য হলেও এ ব্যাপারে সে চিন্তিত না। তার মনে একটাই চিন্তা ট্রেন আসার সময় তো প্রায় হয়ে গেল। এখনো কেন আসছে না। মিসির আলীর হাতে একটা বই। বইয়ের নাম “মেঘ বলেছে যাব যাব”। এই বইটা তার হাতে কিভাবে এল এটাও একটা রহস্য। তবে এটা নিয়ে ভাবতেও ইচ্ছা করছে না। একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব কাজ করছে। উদাস ভঙ্গিতে বইটা পড়তে লাগল। আপাতত সময় কাটানোর জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল উপায়।


এদিকে জরির অবস্থা বেশ খারাপ। যদিও শুভ্র’র হাত ধরে বসে আছে। কিন্তু একটা লজ্জ্বা আর ভয়ের মিশ্র আবেগ কেন জানি বারবার বিচলিত করছে তাকে। একটু ভয় নিয়েই বারবার তাকাচ্ছে বাইরের দিকে। যদিও এখানে আসার নেই কেউ তবু একটা ভয় কাজ করছে। ট্রেন আসার সময় তো হয়ে গেল। তবু আসছে না কেন। ট্রেনটা আসলেই তো পাট চুকে যায়। একটু অসহায়ের মতই শুভ্র’র দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। শুভ্র কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ওকে আরও কাছে টেনে নেয়। শুভ্র’র চোখের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এরপরে ও যতইবার জরি’র দিকে তাকায় জরি’র কাছে মনে হয় এ দৃষ্টি অনেক গভীর। কিন্তু দৃষ্টিতে কোণ রহস্য নেই, আছে শুধু ভালবাসা। কিন্তু এখন ভালবাসার সাথে একটা অস্থিরতার উপস্থিতি ও দেখা যাচ্ছে। চোখের ভাষাটা পড়তে কষ্ট হয় না, শুভ্র ও চাচ্ছে ট্রেনটা তাড়াতাড়ি চলে আসুক।



সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেল। এত দেরী তো হওয়ার কথা না। এই ষ্টেশনে লাইট ও দেখা যাচ্ছে না কোনো। সেই সাথে শুরু হয়েছে মশার উৎপাত। সবার ধৈর্য্যের সীমা যখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে এমন সময় দূর থেকে আলো দেখা গেল। আস্তে আস্তে আলোটা এগিয়ে আসছে। ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। যাক শেষ পর্যন্ত ট্রেনটা এল। সবার মনে একটা স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। ট্রেনটা এসে আস্তে করে থামল স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামল হাসিখুশি আগুন্তুক। বয়স হলেও মনে হচ্ছে কোন ক্লান্তি নেই। সবাই তার দিকে এগিয়ে গেল। হাসিখুশি লোকটা বলল, “আমি হুমায়ুন, হুমায়ুন আহমেদ। এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠো সবাই, নাহলে দেরী হয়ে যাবে।” কেউ কোনো প্রশ্ন না করেই উঠে পড়ল।


রুপাঃ “স্যার আপনার এত দেরী হল কেন?”
আগুন্তুকঃ “একই দিনে একই সাথে সবাইকে, সব কিছুকে বিদায় জানানো অনেক কঠিন। এই কঠিনটাকে সহজ করতে গিয়েই সময়টা একটু বেশী লেগে গেল”।
হিমুঃ “আমরা যাচ্ছি কোথায় আসলে?”
আগুন্তুকঃ “যেখান থেকে কেউ ফেরত আসে না, সেই অচিনপুরে।”
জরিঃ “আমরা ফেরত আসব না কেন?”
আগুন্তুকঃ “কারণ আমি ফেরত আসব না। যেখানে শিল্পী প্রস্থান করবে সেখানে শিল্পের কি থাকা উচিত?”
মিসির আলীঃ “শিল্পীর অনুপস্থিতি’তে শিল্প থাকবে মানুষের মনে। আমার মনে হয় সেটা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। তাই চলে যাই সবাই মিলে সেটাই মনে হয় ভাল। জীবনের চেয়ে মৃত্যু বেশী রহস্যময়।”
শুভ্রঃ “তাহলে, কি আমরা মারা গেছি?”


আগুন্তুকঃ “মৃত্যু বলে আসলে কিছু নেই। এটা মানুষের তৈরী করা একটা জগৎ। যেখানে তুমি ছাড়া কেউ থাকবে না। থাকলেও তারা তোমার মতই থাকবে। মানুষের ভাষায় সেটাই মৃত্যু। আমরা তেমনই কিছু করব। অচিনপুরে আমরা সবাই নতুন পরিবার বানাব। আমরা সবাই থাকব আমাদের মত, এ পৃথিবীর অন্যায়, অত্যাচার দূর্নীতি আমাদের ছুঁতে পারবে না। আমাদের গ্রাস করতে পারবে না কোনো কালিমা। আমরা সব কিছু সাজাবো আমাদের মত। নিস্পাপ, নির্লোভ কিন্তু সজীব করে। এ পরিবারে হিমু উদাস হবে না, হবে একজন প্রেমময় পুরুষ। হলুদ পাঞ্জাবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা হৃদয়ের উপচে পড়া ভালবাসা দিয়ে সে ভালবাসবে রুপাকে যে ভালবাসার জন্য জানালায় দাঁড়িয়ে সারা জীবন অপেক্ষা করেছে রুপা, এখানে শুভ্র’র দৃষ্টি’তে আলোর কোনো অভাব থাকবেন না। আবার সে আবেগ নিয়ে শুধু জরি’কে না, দেখবে আমাদের সবাইকে। মিসির আলীর কাছে কোন কিছুই আর রহস্য থাকবে না। কারণ এ পরিবারে রহস্য বলে কিছু নেই। কারণ আমরাই আমাদের জগতের শিল্পী, কেউ এখানে নাক গলাতে আসবে না।”


শেষ কথাঃ
ক্যালেন্ডারের পাতায় আজকের তারিখটা ১৯শে জুলাই, ২০১২। ট্রেনটা আস্তে আস্তে চলা শুরু করল। পেছনে রয়ে গেল গৌরিপুর জংশন। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে। অল্প কিছু যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি চলে যাচ্ছে সবকিছু থেকে দূরে। বহু পাঠকের কান্না, হঠাৎ কিছু হারানোর আর্তনাদ, শোকের মাতম, দারুচিনি দ্বীপ কিংবা ময়ুরাক্ষীর মায়া সবকিছুকে কাটিয়ে ট্রেনটি এবার চলছে পূর্ণ গতিতে। গন্তব্য অচিনপুর।

[লেখাটি অপরবাস্তব-৭ এ জমা দেওয়ার জন্য লেখা। আশা করি ভাল লাগবে সবার।]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×