somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘মাসিমা মালপো খামু!’ শতবর্ষেও পর্দায় সুপারহিট ঢাকার ছেলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

২৬ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভানু বন্দোপাধ্যায় (জন্ম: ২৬ আগস্ট, ১৯২০ - মৃত্যু: ৪ মার্চ, ১৯৮৩) পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাস্যকৌতুকময় অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দিকপাল।




নিজ সরলতার গুনেই ঢাকা পরে গেছে ভানু বন্দোপাধ্যাযয়ের আসল নাম সাম্যময় বন্দোপাধ্যায় ।আর ঢাকার ছেলে বলে কথা তা কিছুটা চমক থাকবে না তা হয় না । ভানু জন্মেছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে ১৯২০ সালের ২৬শে অগাস্ট। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি’স হাই স্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে শিক্ষা শেষ করে কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। এখানে এসে তিনি আয়রন এন্ড স্টীল কম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন এবং বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তার বোনের কাছে দু’বছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিন্যু-তে বসবাস শুরু করেন।

ভানুর অভিনয়-জীবন শুরু হয় ১৯৪৭-এ, ‘জাগরণ’ ছবির মাধ্যমে। সেই বছরই ‘অভিযোগ’ নামে অন্য একটি ছবি মুক্তি পায়। এরপর ধীরে ধীরে ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মন্ত্রমুগ্ধ’(১৯৪৯), ‘বরযাত্রী’(১৯৫১) এবং ‘পাশের বাড়ি’(১৯৫২)। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, এবং বলা যেতে পারে যে এই ছবির মাধ্যমেই ভানু দর্শকদের নিজের অভিনয়ের গুণে আকৃষ্ট করা শুরু করেন। এর পরের বছর মুক্তি পায় ‘ওরা থাকে ওধারে’। ১৯৫৮ সালটিতে মুক্তি পাওয়া অনেক ছবির মধ্যে দু’টি ছিল ‘ভানু পেল লটারি’এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’।১৯৫৯-এ মুক্তি পায় ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট" এই ছবিতে ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘৮০তে আসিও না’ ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানেও ওনার বিপরীতে ছিলেন রুমা দেবী।১৯৬৭ সালে ভানুর আরো একটি ছবি মুক্তি পায়, ‘মিস প্রিয়ংবদা’ – যেখানে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অভিনয় করেন। এখানে ওনার বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী। ভানুর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। ভানুর শেষ ছবি ‘শোরগোল’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪-তে। কিছুদিন পরেই উনি পরলোকগমন করেন।

আপাত দৃষ্টিতে ভানু বন্দোপাধ্যাযয়ের জীবনী এভাবেই শেষ করা যায় । তবে , বড় বড় মহিরুহদের জীবনীর অনেক ধাপ থাকে সব গুলো না-জানা থাকলে তাঁকে জানা যায় না । উনার তিন সন্তান গৌতম বন্দোপাধ্যায় , বাসবিঘটক বন্দোপাধ্যায় ও পিনাকী বন্দোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উনাকে নিয়ে কথা বলেছেন যার অনেক কিছুই আমাদের অজানা । এবার থাকছে এই সব কথোপকথন ও তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণের বিশেষ দিক গুলো




"ছিলাম বাঁড়ুজ্জে হলাম ভাঁড়ুজ্জে" বলতেন তিনি । হয়ে যেতে পারতেন কট্টর স্বদেশী। হতে পারতেন পার্টির হোলটাইমার, হয়ে গেলেন ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! আট-দশ বছর বয়েস থেকে ‘গুরু’ বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তাঁরই সাইকেলে চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার। চলত পাচার করা।

দীনেশ গুপ্ত মারা যাওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে।’৪১ সালে, যখন বিএ পড়ছেন, কোনও এক ব্রিটিশ ইনফর্মার খুন হল অনুশীলন সমিতির হাতে। সে দলের পাণ্ডা ছিলেন উনি। ফলে হুলিয়া জারি। পালিয়ে আসতে হল পুব বাংলা ছেড়ে।তা’ও আবার কীসে? না, বন্ধু গোপাল মিঞার গাড়িতে, সিটের নীচে পাটাতনে লুকিয়ে।তত দিনে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয়পাত্র। রমেশ মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিনের প্রিয় ছাত্র। ক্লাসের বাইরে সত্যেন বসুর আবদারে তাঁকে  প্রায়ই ঢাকাই কুট্টিদের নিয়ে কমিক শোনাতে বসেন।বলতেন, ‘‘ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম

‘ভাঁড়ুজ্জে’!’’বিক্রমপুরের বিখ্যাত মাস্টার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতিদেবী। সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। তাঁরও নামজাদা বংশ। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া।তাঁদেরই ছেলে সাম্যময়। ডাকনাম ভানু। তার মঞ্চে নামাটা কিন্তু এক্কেবারেই আকস্মিক। পাড়ার নাটক দেখছিল ছোট্ট ভানু। স্টেজের নীচে দাঁড়িয়ে। ওপর থেকে কোনও এক খুদে অভিনেতা দুষ্টুমি করে  লাথি কষায় মাথায়।— ‘‘হালায় ওই লাথখা’ন কুনওদিন ভুলি নাই, ওই দিনই ঠিক কইরা ছিলাম, অগো দ্যাখাইয়া ছাড়ুম।’’ওয়াড়ি ক্লাবের ‘বনবীর’ নাটকে সুযোগ এসে গেল। তখন সবে ক্লাস সিক্স। উদয়সিংহ হলেন ভানু। তাঁর অভিনয়ে চমকে গেল সবাই। কলকাতায় এসেও পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’য় চাণক্য হলেন। সে অভিনয় এতই সাড়া ফেলল যে পল্লিরই এক ডাক্তার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখনকার নামকরা পরিচালক সুশীল মজুমদারের দরবারে।৪২ নম্বর চারুচন্দ্র অ্যাভিনিউ। দো তলা বাড়ি। ওপর তলার সাদা রংটা মাঝে মাঝে ধূসর। নীচের অ্যালা রঙের পোঁচের ওপরে কালো ছোপ ছোপ। দেওয়াল জুড়ে মাটি রঙের বর্ডার।জানলা, দরজা সেই সাবেক কালের মতো। সবুজ। রেলিং ঘেরা বারান্দার পাশে ক’ধাপ সিঁড়ি চড়লেই দরজা। যার মাথায় পাথরের ওপর খোদাই করা ‘সঙ্গীতশ্রী’।দরজা ঠেলে ঢুকলেই কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝের ছোট্ট করিডর। এগোলেই ডান ধারে বসার ঘর। বাঁ দিকে এক ফালি উঠোনের উল্টো পারে উপরে ওঠার চওড়া সিঁড়ি। কাঠের রেলিং।দো’তলায় উঠে ডান দিকে এক চিলতে বসার ঘরের লাগোয়া বিশাল শোওয়ার ঘর। এখানেই বিশ্রাম নিতেন উনি।সব আগের মতোই আছে। তবে বাসিন্দা বলতে এখন সাকুল্যে দুই। স্ত্রী নীলিমা। এক কালের নামী গায়িকা। বড় ছেলে গৌতম। প্রযোজক। অকৃতদার। ছোট পিনাকী বিদেশে। এনভারয়নমেন্টালে গবেষণা করে শিকাগোর চাকুরে। মেয়ে বাসবী কলকাতার এক নামী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। বিয়ে হওয়ার পর থেকে নিউ আলিপুরে।শেষ বারের মতো এ বাড়ির কর্তা তাঁর ভিটে ছেড়ে চলে গেছেন ’৮৩-র ৪ মার্চ। তার আগে? এ কুঠি যখন তখন গমগম করত।



জহর-ভানু ছিলেন যেন সহোদর

বিকাশ রায় এলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও তাঁর পাশে বসতেন না। বসতেন পায়ের নীচে, মাটিতে। অতিথি অস্বস্তি পেলেও শোনে কে! ছবি বিশ্বাস দেখা দিতেন এবেলা-ওবেলা। তাঁর ‘ভেনো’-কে যেন তিনি চোখে হারাতেন। জহর রায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অনুপকুমার— বাদ যেতেন না কেউই।সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তো ঘরের মেয়ে। বাড়িরই কুটুম। সেই কুটুমকে অবশ্য কলকাতায় এসে নতুন করে আবিষ্কার করেন উনি।সাবিত্রী তখন ফ্রক পরা মেয়ে। স্কুল ছুটির পর খালি পায়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলেছে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে বলতে।ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে সময় নাটকের দলের অভিনেত্রী চাই। রাস্তায় মেয়েটিকে মনে ধরল। কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘অভিনয় করবে?’’ মেয়েটি কটমট করে তাকাল। তারপর বলল, ‘‘আমায় বলছেন কেন, বাবাকে বলুন।’’ এর পরই ট্রামে উঠে ধাঁ।এ বার হন্যে হয়ে বাড়ি খুঁজে হাজির হয়ে দেখেন, মেয়েটির বাবা তার সম্পর্কের মামা! তখনই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মঞ্চে নামা। সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে। এই সেই ‘নতুন ইহুদী’, যা কি না মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভানুর জীবনেরও।চল্লিশের দশকের শেষ। পুববাংলা থেকে তখন দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে। মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ‘ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ তাঁদের সাহায্য করতে সীমান্তে, স্টেশনে শিবির গড়ছে। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সেই দলে ছিলেন ভানুও। তখন একটি অপেশাদার নাটকের দলও গড়েছিলেন। তারই এক সদস্য সলিল সেন উদ্বাস্তুদের নিয়ে লেখেন ‘নতুন ইহুদী’। সেই নাটকে ভানুর অভিনয় অভিভূত করে দেয় তখনকার তাবড় শিল্পীদের। লোকে বলে, এই সাফল্যই ওঁকে পুরোদস্তুর অভিনয়ে ফিরিয়ে দেয়।

‘ছবি জ্যাঠামশাই-এর শেষ দশ-বারো বছরে ফিল্ম লাইনে একমাত্র নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া বাবার মতো আপনার কেউ ছিল না। অথচ ওঁর সঙ্গে বাবার আলাপটা কিন্তু অত সহজে হয়নি,’’ বলছিলেন গৌতমবাবু।কী রকম? গৌতম বললেন, ‘‘সে ’৪৭ সাল-টাল হবে। ‘অভিযোগ’ ছবির কাজ চলছে। বাবার খুব ইচ্ছে, ওঁর সঙ্গে আলাপ করার। জেঠু পাত্তা দিতেন না। ভেবেছিলেন, ফিল্মে চান্স পাওয়ার জন্য বাবা বুঝি তোষামোদি করেছে। আসলে তখন জহরকাকা-বাবা-প্রদীপকুমারদের মতো নতুনদের একটা দল ছিল, যাঁরা সত্যিই কাজের জন্য স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরঘুর করতেন। শেষে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে বাবার অভিনয় দেখে উনি নিজেই ডেকে পাঠান।’’এর পর থেকে ছবি বিশ্বাস বলতে গেলে ওঁর অভিভাবকের মতো হয়ে যান। বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থ সাহায্য করা থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি প্রযোজনা করলেন, তখন নামমাত্র টাকায় কাজ করে দেওয়া। আর কী উৎসাহ সে কাজে! দুপুর দুটোয় শ্যুট। উনি এসে বসে থাকতেন ঘণ্টা দুই আগে। প্যাকআপের পরেও আড্ডা দিতেন। কাজ না থাকলেও সেটে ঘুরে যেতেন।এমন এক শ্রদ্ধার সম্পর্কে দুষ্টুমি-খুনসুটি যে ছিল না, তা নয়। একবারের ঘটনা যেমন।‘ডাকবাংলো’ নাটক। ছবি বিশ্বাসের বরাবরের অভ্যেস, মঞ্চে সংলাপ বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে অন্যকে জেরবার করা। সে দিন ভানু ঠিক করলেন, আজ  উনি ওঁকে বেকায়দায় ফেলবেন! সে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন সুখেন দাস।



মহানায়িকার সঙ্গে

বহু বছর আগের সেই ঘটনা বলতে গিয়ে আজও চোখ চকচক করে মধ্য আশির নীলিমাদেবীর, ‘‘নাটকে ওঁর নাম ছিল কৃতান্ত বিশ্বাস। ছবিদা নাম জিজ্ঞেস করলে, উনি বললেন। এ বার ছবিদা শুরু করলেন। ‘কী বললেন, বিশ্বাস?’ ‘আজ্ঞে।’ ‘কাউকে বিশ্বাস করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ ‘আবার অবিশ্বাসও করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ বলেই চলে যেতে চাইছিলেন। উনি বুঝে গিয়েছিলেন, আজ ছবিদা সহজে ছাড়বেন না। ছবিদা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, ‘আরে মশাই, চলে যাচ্ছেন কেন? বিশ্বাসও করবেন না, আবার অবিশ্বাসও করবেন না, তবে করবেনটা কী? বলুন,’ তখন উনি ওঁর কাছে এসে প্রায় হাত জড়ো করে বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আর কোনও দিন করব না।’ ছবিদা বললেন, ‘ব্যাটা চালাকি আমার সঙ্গে! বল্, ‘বাড়ি গিয়ে ভাবব।’ শেষ কালে তা-ই বলে সে দিনের মতো উদ্ধার।’’ছবি বিশ্বাস যে দিন জাগুলিয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, সে দিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যাওয়ার কথা ছিল।হঠাৎ রেডিয়ো নাটক পড়ে যাওয়াতে শেষপর্যন্ত যেতে পারেননি। তাতে আজীবন আপশোস বয়ে বেড়িয়েছেন। কেবলই তাঁর মনে হত, যদি সঙ্গে থাকতেন, কিছুতেই অমন হত না।ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে যদি অভিভাবকের সম্পর্ক হয়ে থাকে, জহর রায় ছিলেন যেন সহোদর।গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘‘বাইরের লোকে ভাবত বুঝি ওঁদের মধ্যে খুব রেষারেষি। কিন্তু একদম উল্টো। ’৫৫ সালে বাবা যখন গাড়ি কিনল, জহরকাকার সে কী কাণ্ড! স্টুডিয়োয় সবাইকে ডেকে বক্তৃতা দিল, ‘শোনো ভেনো আজ রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশের ও সর্বপ্রথম লোক, যে কমেডি করে গাড়ি কিনেছে। এ গাড়ি ওর একার নয়, সবার। বাবাকে বলেছিল, এই শোন, এ বার থেকে প্রত্যেক শনিবার সকালে আমায় গাড়ি পাঠাবি। বাবা তাই-ই করত। তেল পুরে শনিবার করে গাড়ি পাঠিয়ে দিত উত্তর কলকাতায় জহরকাকার বাড়ি। আর নিজে দরকার পড়লে ট্যাক্সি করে ঘুরত।’’‘বসু পরিবার’ ছবির আগে থেকেই উত্তমকুমারের সঙ্গেও খুব ভাল সম্পর্ক। ‘‘উত্তমকাকু বাবাকে ডাকতেন ভানুদা, তুই। বাবাও ওঁকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখত। ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি করার সময় বাবাকে যাঁরা অর্থ সাহায্য করেছিলেন, উত্তমকাকু তাঁদের একজন, সে কথা বুড়োকাকাও (তরুণকুমার) জানত কিনা সন্দেহ। ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ছবি করার সময় বাবাকে সোনার গিনি দিয়ে অ্যাডভান্স করেছিল কাকু। ছোটিসি মুলাকাৎ-এর পর উত্তমকাকুর যখন হার্ট অ্যাটাক হল, বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করা বারণ। বাবা এত ছটফট করছিল! সোজা চলে গিয়েছিল দেখা করতে। কেউ ঠেকাতে পারেনি,’’ বললেন গৌতম।
সেই সম্পর্কে কোথাও যেন একটু হলেও ফাটল ধরেছিল ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় চিড় ধরার সময়।ষাটের দশকের শেষাশেষি। সংঘ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হল। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়রা চলে গেলেন ও দিকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়ে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। ওঁরা ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হলেন। ওঁদের কাজকম্ম বন্ধ। ‘‘এর পরেই ‘গুপীগায়েন বাঘাবায়েন’ রিলিজ করবে। তাকেও আটকানো হতে পারে জেনে বিজলী সিনেমার সামনে বাবা, সৌমিত্রকাকু, অনুপকাকু, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দু রায়দের নিয়ে ঠায় আট ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এই সময়ই প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। উত্তমকাকুর সঙ্গে বিভেদ হওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। পরে অবশ্য সব স্বাভাবিক হয়ে যায়,’’ পুরনো সময়ের কথা বলতে গিয়ে আজও যেন দ্বিধায় গৌতমবাবু।হাতে কাজ নেই। কিন্তু মনে জেদ। কিছুতেই মাথা নোওয়াবেন না। যাত্রা দল গড়লেন। নীলিমাদেবী বলছিলেন, ‘‘যে মানুষ নরম বি‌ছানা ছাড়া শুতেন না, তিনিই কিনা তখন গ্রামগঞ্জে গিয়ে শতরঞ্চি পেতে গাছের তলায় ঘুমোতেন। দিনের পর দিন ফুলুরি, মুড়ি, জিলিপি খেয়ে কাটাতেন। একটা আধভাঙা বাড়িতে একবার বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, বুকের ওপর সিলিং-এর চাঙড় খুলে পড়ল।’’তবু নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কিছুতেই আপস নয়। যা ভাল বুঝতেন করতেন। সে অবস্থা যাই হোক না কেন। নইলে দ্বিরাগমনে গিয়ে অমন কাণ্ড কেউ বাধাতে পারে!নীলিমাদেবীর মুখে শোনা যাক। — ‘‘৪৬-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ে হল। ২৬ তারিখ গেছি জোড়ে। তখন উনি আয়রন অ্যান্ড স্টিল কনট্রোলে কাজ করেন। অফিস থেকে ফিরে আমায় নিয়ে বেরলেন। বাপের বাড়ির দরজায় ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো থেকে আসছি। কাজ আছে।’ আমরা স্টুডিয়ো পাড়াতেই থাকতাম। আমাদের বাড়ির এক দিকে রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো। যেটা প্রথম দিকে ছিল দূরদর্শন অফিস। অন্য দিকে ভারত লক্ষ্মী স্টুডিয়ো। যেটা এখনকার ‘নবীনা’ সিনেমা। আমাদের বাড়িটা একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধায়ের পাশের বাড়ি। ও চলে গেল। আর আসে না। এ দিকে সন্ধে গড়িয়ে রাত। সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ছে। বাড়ির জামাই আর ফেরে না। শেষে বাবা বেরোলেন খুঁজতে। স্টুডিয়োয় গিয়ে খোঁজ করতে, দারোয়ান একটা লোকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। গায়ে কালিঝুলি মাখা। ছেঁড়া চট চাদরের মতো জড়ানো। ভাল করে নজর করে দেখলেন, এই লোকটাই তাঁর জামাই। কী একটা নাকি ফিল্মের শ্যুটিং হচ্ছে, তাতে অভিনয় করছে সে। কাজ শেষ হতে তখনও আরও দেরি। বাবা ফিরে এসে গোঁজ হয়ে বসে রইলেন। আমার ঘুম এসে গিয়েছিল। গভীর রাতে কারও গলার আওয়াজ শুনে দেখলাম, মা তাঁর জামাইকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন। তখন রাত দুটো কী আড়াইটে।’’সে-ছবির নাম ছিল ‘জাগরণ’। নির্দেশক বিভূতি চক্রবর্তী। উনিই ডাক পাঠিয়েছিলেন স্টুডিয়োয়। যেতেই বলেন, ‘‘দুর্ভিক্ষপীড়িত এক চিমসে চেহারার চরিত্র আছে। করবে?’’ রাজি হতেই শ্যুটিং শুরু। সেই প্রথমবার।সেই যে ছবিঘরে ঢুকলেন, তারপর থেকে মঞ্চ আর সিনেমা, সিনেমা আর মঞ্চ। আর সে ভালবাসার যে কী টান! বাবা মারা গিয়েছেন, তাঁকে দাহ করে ধরাচুড়ো পরে সেদিনও স্টারে অভিনয় করতে গেছেন।এমনও হয়েছে, সবে হার্ট অ্যাটাক থেকে উঠেছেন। ডাক্তার বলেছেন একদম বিশ্রাম। এ দিকে শো। নাছো়ড়, যাবেনই যাবেন। কোনও কথা শুনবেন না। শেষে বেগতিক দেখে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন নীলিমাদেবী, ‘‘ফোন পেয়ে পুলু বাড়ি চলে এল। ওর কথা একমাত্র শুনত। ও বারণ করল। ফোন করে প্রডিউসারের সঙ্গেও কথা বলল। তবে যাওয়া আটকালো।’’বাড়ির কাজকম্ম করতেন কোনও দিন? শুনে হেসে ফেললেন নীলিমাদেবী, ‘‘জীবনেও না। বাড়িতে ঠাকুর ছিল যজ্ঞেশ্বর। সেই-ই সব করে দিত। একবার আমার শাশুড়ি বললেন, কী সব বাজার আনে, তুই যদি করতি, কত ভাল হইত ক’তো!’ মাকে তখনকার মতো আশ্বাস দিয়ে সরে পড়ল। পর দিন থেকে ঠাকুরকে নিয়ে থলে হাতে বেরত, সবাই ভাবত ও-ই সব করে। মা কী খুশি! একদিন ধরা পড়ে গেল সব। বাজারটা যথারীতি ঠাকুরই করছে। থলে হাতে বেরনোটা ওর বাহানা।’’তবে খেতে নাকি খুব ভালবাসতেন। গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘‘ইলিশ মাছ পেলে বাবা কিচ্ছু চাইত না। ভাজা ইলিশ হলে ভাতের ওপর মাছটা রাখত। কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে সরিয়ে তার তলার তেল-ভাতটা খেত। আবার ও পাশ থেকে সরিয়ে এ পাশে ভাতের ওপর নিয়ে আসত মাছটা। এমনি করে... আর ভালবাসত কই, ট্যাংরা। রবিবার হলে পাঁঠার মাংস চাই-ই।’’ভালবাসতেন গান। নজরুল গীতি। নীলিমাদেবীর গলায় প্রায়ই শুনতে চাইতেন, ‘বাঁশি বাজাবে কবে আবার বাঁশুরিয়া’। আর শচীনকর্তার পল্লিগীতি হলে তো কথাই নেই।‘কর্তা’র গান যেমন ভালবাসতেন, তেমন উনি কলকাতায় থাকলে আর ইস্টবেঙ্গলের খেলা পড়লে, লাইফ মেম্বর ভানু মাঠে যেতেনই যেতেন। হাফটাইমে শচীন কর্তার সিগারেট, পান, চিনেবাদামের জিম্মাদারও হতেন উনিই।বাড়িতে কুটোটি নাড়তেন না, কিন্তু বাইরে সেই মানুষটাই ‘দ্য গ্রেট ম্যানেজ মাস্টার’।‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র শ্যুটিং। এলাহাবাদে। আউটডোর। প্রবাসী বাঙালিরা হামলে পড়েছেন। ওঁরা শুনেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন লোকেশনে। এ দিকে তিনি তখন কাজ নেই বলে ‘যাত্রিক’ হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।এ দিকে লোকের ঢল এত বাড়ছে যে কিছুতেই ক্যামেরা নিতে পারছেন না অভিনেতা দিলীপ রায়। কাজ ভেস্তে যায় প্রায়। বিপদ বুঝে হোটেলে গাড়ি পাঠালেন কর্তারা। ভানু এলেন। আর দূরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখ করে নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলে বলে দর্শক সামলে দিলেন, ‘‘আমারে দ্যাখনের কী আছে কন তো! দ্যাখেন, তবে জোড় হাত কইর‌্যা কইতাছি, গোলমাল কইরেন না।’’দিব্যি কাজ হয়ে গেল তাতে। লোকে বলতেন, এমন মুখ করে এত হাসির কথা বলা কী করে সম্ভব? বার বার কেটে কেটে একটাই উত্তর দিতেন, ‘‘মন্ত্রগুপ্তি ফাঁসে মানা আছে।’’আড্ডায় বসে প্রায়ই বলতেন, ‘‘আমার দশা ক্যামনে শুনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, আরে ভানুদা কী হইসে? কোনওক্রমে কইলাম, ভাই মা মারা গ্যাসেন। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার! হালা, নিজে যখন শ্মশান যামু লোকে দেইখ্যা বলবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে!’’এই মানুষই কিন্তু বাড়িতে এলে অন্যরকম। গম্ভীর। বিশেষ কথা বলতেন না। ‘‘বা়ড়িতে থাকতই বা কতটুকু। চাকরি ছাড়ার পর তো আরওই। সক্কালে বেরত, রাত করে ফিরত। চুনী গোস্বামীর এক দাদা, ফুটবলার মানিক গোস্বামী এক বার বলেছিলেন, লোকে আড়াইশো বছরে যে কাজ করে, ভানু সেটা এক জীবনে করেছে,’’ বলছিলেন ছেলে গৌতম।সংসারে তেমন সময় দিতে পারেননি, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, কেরিয়ার নিয়ে কোনও দিন ভাবতে পারেননি, পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাওয়াও হয়ে ওঠেনি এর বারও। কিন্তু মুম্বই-এ অফার নিতে কী যে কুণ্ঠা ছিল! তার একমাত্র কারণ এই শহর কলকাতা, আর তাঁর পরিবার।গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’র অফার ছেড়েছেন। কোনওক্রমে পরিচালক সত্যেন বসুর ‘বন্দিস’ বা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’ করেছেন, তা’ও বন্ধুর আব্দারে।এর পর একে একে ফিরিয়েছেন বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকদের অনুরোধ।অথচ ওঁর ‘পাশের বাড়ি’ নিয়ে যখন ‘পড়োশন’ হবে, তাতে অভিনয় করার আগে মেহমুদ কলকাতায় ওঁর পরামর্শ নিতে আসেন। ‘সাগিনা মাহাতো’র শ্যুটিং করতে এসে কেষ্ট মুখোপাধ্যায় জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‘দাদা, কী করেছেন সাড়ে চুয়াত্তর-এ! ওটাই আপনার বেস্ট।’’ এত প্রশংসাও তাঁকে শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি।গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘‘বাবার বাইরের ইমেজটার জন্য লোকে ভুল বুঝত। এ জন্য আমাদেরও ভুগতে হয়েছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন শুনতাম। আমার বোন তো একবার সোজা এসে বলল, স্কুলে ওকে বন্ধুরা খালি বলে, ‘হ্যাঁরে, তোর বাবা সম সময় খুব হাসায় না?’’ বারবার অমন শুনতে শুনতে ওর বিরক্ত লাগছিল। বাবা শুনে বলল, ‘আইজ তরে যে কইসে তার বাবা কী করে?’ ও বলল, ‘সার্জেন। ডাক্তার।’ ‘অ, তাইলে ওরে কইবি, শুন, তর বাপ কি তরে দ্যাইখ্যা সব সময় ছুরি-কাঁচি লইয়্যা প্যাট কাটতে আসে? এই ছিল আমার বাবা।’’’

এই একই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, যখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ জেলে, বাড়ি থেকে প্রায়ই খাবার নিয়ে যেতেন। অন্যায় দেখলে বেপাড়ায় গিয়ে গুন্ডাও শায়েস্তাও করেছেন।বসুশ্রী সিনেমার মন্টু বসুর ঘর বা রাসবিহারী মোড়ে ‘অমৃতায়ণ’ রেস্তোরাঁ ছাড়া লেকমার্কেটে ‘রাধুর চায়ের দোকান’-এ ওঁর এক আড্ডা ছিল। ও পাড়াতেই থাকতেন গায়ক সুধীরলাল চক্রবর্তী। শচীনদেব বম্বে চলে যাওয়ার পর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় সুধীরলালের। সুধীরলালের তখনই খুব নাম। বোধহয় ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ও বেরিয়ে গেছে। লেক মার্কটের মস্তানরা সুধীরলালের ওপর জুলুম করতে শুরু করল। দলবল নিয়ে তার বিহিত করেছিলেন উনিই।ভয়ডর বলে সত্যিই কিছু ছিল না। জোরজলুম কখনওই বরদাস্ত করেননি। ’৫২-’৫৩ সালের কথা। বামনেতা রাম চ্যাটার্জির তখন খুব দাপট। তিনি তাঁর ভগ্নিপতি আর জনা চারপাঁচ লোক নিয়ে জিপে করে এলেন চন্দননগর থেকে। ‘‘বাবাকে বললেন, আমার ফাংশানে যেতে হবে। বাবা বলল, পারব না। কাজ আছে। তাতে উনি বললেন, ‘তোমায় যদি জোর করে নিয়ে যাই, আটকাতে পারবে?’ ওপরে গাড়ি বারান্দায় কয়েকটা মার্বেলের টব ছিল, সেটা দেখিয়ে বাবা বলল, ‘তোমার মাথায় কি মাসল্ আছে, ওগুলো মাথায় যদি মারি কী করবে?’ ব্যাপারটা আমায় বলেন খোদ রাম চ্যাটার্জিই। আমি যখন ওঁর কাছে গভর্নর হাউসে গিয়েছিলাম, বাবার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করতে। আসলে বাবার এই সাহসটা অনেকটা বাড়ি, বিশেষ করে ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া,’’ বলে ১৯০৫ সালের একটা গল্প শোনালেন গৌতমবাবু, ‘‘আমার ঠাকুমা বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় ইন্সপেক্ট্রেস্ অব স্কুলস্। দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়োয় ইংলিশ লেডিদের কামরায় উঠে পড়েন। মেমরা নেমে যেতে বললে, ঠাকুমা বলেন, পরের স্টেশনেই নেমে যাবেন। ওঁরা কোনও কথা শুনতে নারাজ। ওঁদেরই একজন টান মেরে ঠাকুমার বাক্স-প্যাঁটরা ফেলে দিলেন বাইরে। তাতে ঠাকুমা সেই মেমের চুলের মুঠি ধরে এমন প্রহার দেন, মেম অ়জ্ঞান হয়ে যান। ট্রেনের গার্ড তখন ওঁকে অ্যারেস্ট করবেই। শেষে ঠাকুমার এক ভাই  জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ওঁকে বাঁচান। এই ঘটনাটা বাবা মারা যাবার দু’দিন আগেও বলতেন।

’’বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপও অনেকটা এরকমই এক ঘটনায়।ঢাকায় কলেজ হস্টেলের ছেলেরা সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করে ডাকল। খুব হইচই। দালান জুড়ে বড় পাত করে এলাহি খাওয়াদাওয়া। কোথা থেকে একজন পঙ্গু ভিখারি খুব কাকুতিমিনতি করে খাবার চাইতে এল। ছাত্ররা তাকে ‘দূর দূর’ করে কম্পাউন্ডের বাইরে তাড়িয়ে দিল। ব্যাপারটা খেয়াল করে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দূরে গিয়ে বসে রইলেন অন্যদের মধ্যে। এ দিকে আমোদআহ্লাদ ক্রমে সপ্তমে। খাবার নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়িও শুরু হল। এ বার আর থাকতে না পেরে সটান হেঁশেলে চলে গেলেন ভানু। টান মেরে বাগানে খাবার ফেলতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘‘আমিও খাব না, কাউকে খেতেও দেব না।’’ সবাই মিলে বাধা দিতে এলে এক-আধজনকে দু-ঘা দিলেনও।এই ঘটনা নিয়ে তখন খুব হট্টগোল পড়ে যায়। সবাই প্রায় ওঁর বিরুদ্ধে। পাশে দাঁড়ান সত্যেন বসু। সেই শুরু। তারপর তো ছাত্র ভানুর ঢাকাই নকশায় মজে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় কোনও এক যাত্রা সম্মিলনী থেকে আমন্ত্রণ এলে বলেন, ‘‘আরে আমাকে কেন, ভানুকে নিয়ে যাও।’’ তাতেও তারা নাছোড় হলে তাদের রসগোল্লা খাইয়ে বিদায় দেবার সময় বললেন, ‘‘আমার কাছে শুধু গোল্লা পেলে, ভানুর কাছে গেলে রসটা পাবে।’’ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিকস-এ নাকি উচ্ছ্বসিত ছিলেন মুজতবা আলীও।

নাট্যকার মনোজ বসুর বাড়িতে ভানু প্রথম সাক্ষাতে আলী সাহেবকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার সাহিত্যের আমি খুব ভক্ত।’’ তাতে তাঁকে চমকে দিয়ে আলীসাহেব ভানুরই ‘ঢাকাই কুট্টি’-দের কমিক গড়গড়িয়ে বলে যান।এনালার্জড হার্ট ছিল। তিন চার বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তার মধ্যে রেনাল ফেলিওর। ‘‘চলে যাওয়ার এক মাস আগে নার্সিংহোমে ভর্তি হল। ডাক্তার বলল, তিন মাস রেস্ট। তার মধ্যেও এক বার উত্তরবঙ্গে গিয়ে যাত্রা করে এল। রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সে দিন সকাল থেকে কী বমি! কী বমি! ভর্তি করা হল। উডল্যান্ডস্। দোতলায়। আইসিসিইউ। আমার ভাই ঠিক সাত দিন আগে ন’বছর বাদে তখনই দেশে ফিরেছে। ভগ্নিপতির সঙ্গে ও-ই রাত জাগতে হাসপাতালে ছিল। সে রাত আর গড়াল না। বারোটা নাগাদ খবর এল, ‘বাবা আর নেই,’’ গৌতমবাবুর গলা বুজে এল। একটু আগেই নীলিমাদেবী উঠে গেছেন ছলছলে চোখে।মাঝদুপুরের আলো এসে পড়েছে চিলতে বসার ঘর পেরিয়ে বহু কালের ওঁর সেই শোবার ঘরের দরজাটায়। পরদাটা কাঁপছিল তির তির করে।


তথ্যসুত্র : আনন্দবাজার  পত্রিকা (  দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ,২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫  , অনলাইন সংস্করণ )


আমরা স্টারকিড ছিলাম না-- ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন ছেলে মেয়ে। গৌতম, পিনাকী ও বাসবী। গৌতম এবং বাসবী কলকাতা নিবাসী। পিনাকী পেশায় বৈজ্ঞানিক, দীর্ঘদিন ধরে থাকেন আমেরিকায়।



তিন ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তরুণ ভানু।

বড় ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “ঢাকা শহরে বাবারা থাকতেন। ১৯৪১ সালে কলকাতায় এসে প্রথমে দিদির বাড়িতে ওঠেন। তারপর চারু অ্যাভিনিউতে এখন আমরা যেখানে থাকি তার পাশের গলির একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলেন। মাত্র দেড়খানা ঘর ছিল। উদ্বাস্তু হয়ে আসা পরিবার তখন। তার মধ্যেই প্রথমে ঠার্কুদা, ঠাকুমা, আমার ছোট পিসিমা, বাবার এক মামা, সবাই থাকতেন। মা নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাবা বিয়ে করেন তার পর। সংসার বাড়ল, আমরা ভাই বোনরা হলাম। আমার জন্ম দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরে, ১৯৪৭ সালে। অত লোক ধরছিল না ওই দেড় খানা ঘরে। এর মধ্যে বাবার মামা মারা গেলেন, ঠার্কুদা মারা গেলেন আর ছোটবোনের বিয়ে হয়ে গেল।



স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

ওই সময় বাবা খুবই ব্যস্ত ছিলেন। সকালে বেরিয়ে যেতেন রাত্রে ফিরতেন। বাবাকে দেখতেই পেতাম না বাড়িতে। আস্তে আস্তে নামও হচ্ছিল বাবার। ‘পাশের বাড়ি’, ‘বসু পরিবার’ রিলিজ করল। তার পরে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর তো বাবা শিখরে চলে গেলেন। বছরে ১৭-১৮টা করে ছবি করছিলেন। আমার জন্মের পর প্রথম দশ বছর আমরা ওই বাড়িতে কাটানোর পরে ১৯৫৭ সালে জুবিলি পার্কের বাড়ি চলে এলাম। কিন্তু ওখানে বাবার মন টিকলনা। তখন ১৯৬০ সালে আবার এই এখনকার চারু অ্যাভিনিউয়ের দোতলা বাড়িতে এলাম। অন্য একটা বাড়ি। এই বাড়িটা ছিল দেববালা দেবী নামে এক পুরনো আর্টিস্টের বাড়ি। লিজে ভাড়া বাড়ি, কিন্তু পুরোটাই আমাদের। পরে বাড়িটার লিজ শেষ হলে মায়ের তাগাদায় এই বাড়িটাই বাবা কিনে নেন।”

ভানুর মেয়ে বাসবী ঘটক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন “আমরা ছোটবেলায় কোনও দিনই স্টারকিড ছিলাম না। কারন এসবে বাবার তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু লোকে তো জানত আমি ভানু ব্যানার্জীর মেয়ে। তখন স্কুলে আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত, তোর বাবা বাড়িতে হাসায় কিনা! আমার বাবা তার উত্তরে আমায় বলতেন, ‘তুমি গিয়ে বলবে যে ওর বাবা কী করেন?’ তা ওর বাবা ডাক্তার বলেছিলাম। তখন বাবা বললেন ‘ওকে জিজ্ঞেস করবে ওর বাবা কি বাড়িতে অস্ত্রোপচার করেন! কারও বাবা উকিল, কারও বাবা ডাক্তার, তোমার বাবার পেশা হল অভিনয়।’ ফলে আমরা কোনও মোহময় জগতে গড়ে উঠিনি। একদম আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আমরা মানুষ হয়েছি ।

বাবার আগে মা নাম করেন

ভানুর স্ত্রী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন নামী গায়িকা ছিলেন। রেকর্ড যুগ পেরিয়ে এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায় নীলিমা দেবীর গান। গৌতম বাবু বললেন “মা তো বাবার আগেই বেশ নাম করেছিলেন গানের জগতে। মা ১৯৪৫ সালে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। ফিল্মেও প্লে ব্যাক করেন, ‘কবি চন্দ্রাবতী’, ‘বনের ময়ূর’, ‘সর্বহারা’, ‘কাঞ্চন মূল্য’, ‘বৌ ঠাকুরানির হাট’ প্রভৃতি ছবিতে।

বাসবী বললেন, “মায়ের গানের স্কুল ছিল আমাদের বাড়িতেই। সঙ্গীতশ্রী নাম। আমাদের বাড়িতেই খুব ঘটা করে সরস্বতী পুজোর আয়োজন হত। পুজোতে বসন্ত কাকু (চৌধুরী) খুব আসতেন।”

অভিনয় জগতেও আসেন বাসবী ও গৌতম । গৌতম বললেন, “আমরা প্রথম অভিনয় করেছিলাম ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবিতে। এই ছবি দিয়েই বিকাশ রায়ের পরিচালক রূপে আত্মপ্রকাশ। তাতে আমরা তিন ভাই বোনই ছিলাম আর বাবাও ছিলেন। এর পরে আর একটু বড়বেলায় ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবিতে অভিনয় করি। বাবা ছিল ঐ ছবির প্রযোজক। তখন মূল চরিত্রে একটা ছেলে খোঁজা হচ্ছিল। তো পরিচালক নির্মল মিত্র বললেন, গৌতম তো ভালই কথাবার্তা বলে ওকেই নেওয়া হোক। চরিত্রটা গ্রামের ছেলের ছিল। একদিন আমাদের জুবিলি পার্কের বাড়িতে লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচালক এলেন। আমায় দেখে চুলটা এলোমেলো করে দিয়ে বললেন এই তো গ্রামের ছেলে, তবে ভীষণ ফর্সা। একটু কালো করতে হবে। তার পরে ‘কাঞ্চনমূল্য’তে অভিনয় করলাম।




পিতা-পুত্র অবিকল।

বাসবী নিজের ফিল্মে অভিনয়ে আসা নিয়ে বললেন “তখন আমার মাত্র আড়াই বছর বয়স। ‘শুভরাত্রি’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের কোলে চড়ে সুচিত্রা সেনের ছোট ভাইয়ের রোল করেছিলাম। এটাই মনে আছে, সুচিত্রা সেন অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমি বাবার খুব আহ্লাদী ছিলাম। তো সিনেমায় আমায় কাঁদতে হবে, কিন্তু আমি কাঁদছি না। তখন পরিচালক আমায় একটা চড় মারেন আর আমি কাঁদতে শুরু করি। এর পরে একটু বড় হয়ে বাবার সঙ্গেই বাবার মেয়ের রোলেই ছবি করলাম, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’। এই ছবিতে বাবা নায়ক। ছবিটা বাবার প্রাণের ছবি, আমাদেরও খুব ভাল লাগে। বাবা কমেডিয়ান ছিলেন না ওই ছবিতে।

এর পরে যে উল্লেখযোগ্য ছবিটার অফার তপন সিনহা দিলেন, তা হল ‘অতিথি’। চারুর রোলটা করলাম আমি। ছবিটা তো সবার দেখা, চারুকেও সবার দেখা। সেটা আমিই। আর ছবিটা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল। তপন সিনহার টিমের সঙ্গেই দিল্লি যেতে বাবা সেবার ছেড়েছিলেন আমাকে।”


সুপারহিট ছবি করেও আর ছবিতে এলেন না কেন বাসবী? গৌতম বললেন, “বোনকে তার পরে ‘ছুটি’ ছবিতে নায়িকা করবার জন্য আমাদের বাড়িতে আসেন অরুন্ধতী দেবী। কিন্তু বাবা না করে দেন। মাও চাননি মেয়ে ফিল্মে সেভাবে নামুক। আমাকেও কাঞ্চনমূল্যর পর পড়াশোনার জন্য ফিল্ম করতে দেননি বাবা। ভাই তো সিনেমার দিকে যায়ইনি কখনও।” বাসবীর মনে এ নিয়ে বাবার প্রতি অভিযোগ নেই। তিনি বললেন, “আমরা তখনকার দিনে অত প্রতিবাদ করতাম না, বাবা-মায়ের কথাই শিরোধার্য ছিল। আমাদের মনেও কোনও প্রশ্ন জাগেনি কেন ফিল্ম করব না। তখন ওঁরা যা বলেছেন, সেটাই ঠিক।





বাসবীর বিয়েতে অরন্ধতী দেবী, হেমন্ত জায়া বেলা মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়।

বাসবী দেবী যোগ দিয়ে বললেন, “ওঁদের তো আমরা ফিল্মস্টার ভাবতাম না। বাবার বন্ধু, সহকর্মী ওঁরা তো আসবেনই। কেউ কাকা, কেউ পিসি, মাসি, দিদি এরকম। তাঁরা আমাদের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন ছিলেন না। আমার বিয়েতে অরুন্ধতী দেবী, তপন সিনহা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুরো পরিবার, সন্ধ্যা রায়, উত্তম কুমার, গৌরীদেবী, সুপ্রিয়া দেবী এমনকি কানন দেবীও আসেন।”

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে লুচি মাংস খাওয়া

গৌতম ও বাসবীর এক দিদি থাকতেন ঐ চারু অ্যাভিনিউতেই, তিনি ভানু ব্যানার্জীর ভাগ্নি। সুচিত্রা সেনের অন্তরঙ্গ বান্ধবী ছিলেন তিনি, মিসেস সেন অন্তরালে যাওয়ার পরেও। দুই বান্ধবী বা দুই সই বলা চলে। ইন্দ্রপুরী থেকে শ্যুটিং সেরে সুচিত্রা চলে আসতেন এই দিদির বাড়ি। সেখানে স্নান সেরে, চা জলখাবার খেতেন।

সুচিত্রা সেনের পছন্দের পদ ছিল লুচি মাংস। আর সে বাড়িতে লুচি-মাংস হলেই গৌতমেরও ডাক পড়ত। দিদির বাড়ি গিয়ে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে লুচি খাওয়া চলত। ভাবা যায়, কী দুর্দান্ত হিরে-মানিক সব অভিজ্ঞতা। খেয়েদেয়ে সুচিত্রা ফিরে যেতেন বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ি।

ভানুর ফেভারিট মালপোয়া থেকে কৈ-ইলিশ

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপ ‘মাসিমা মালপোয়া খামু’ এক আইকনিক ডায়লগ। কিন্তু ভানুর বাড়িতে কী রান্না হত? ভানুদের রান্না থেকে বাজার-দোকান– সবই করতেন যোগেশ্বর ঠাকুর। ভৃত্য নন, চিরকাল পরিবারের সদস্যর মতো ছিলেন।

ভানুর বাড়িতে কোনও দিনও সবজি তরকারি বেশি ঢোকেনি, বরং তিন রকম মাছের পদ বাঁধা ছিল রোজ। বাঙাল মানুষ এমনিতেই মাছ ভক্ত। তবে ইলিশ আর চিংড়ি দুই আসত। নোনা ইলিশ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান তর্ক হত উত্তম কুমারের সাথে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থাকতেন তাঁর ভানুদার দলে। কিন্তু ভানুর বাড়িতে সব মাছের পোকা, চলত শুঁটকি মাছও। চিরকাল মাছের পিস বড় করে কাটা হত।

তবে ভানুর সবচেয়ে প্রিয় পদ ছিল সরষে দিয়ে তেল কৈ। আর ‘মালপো’ হত একটা বিশেষ ধরনের শুকনো মালপোয়া, সেটা ভানু ব্যানার্জীর মায়ের হাতের স্পেশ্যাল।

অজাতশত্রু ভানুর শেষযাত্রায় ভেঙে পড়ে টলিউড

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হার্টের অসুখ ছিল। এছাড়াও শিল্পীদের যা হয়, রাত জাগা, অনিয়ম, খাটুনি। সব মিলে শরীর বেশ ভেঙে যায়। উনি যাত্রাতেও আসেন। তাতে আরও অনিয়ম হয়। ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ রাত বারোটায় মাত্র ৬২ বছর বয়সে মারা যান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমিত্র, সাবিত্রী, অনিল, অপর্ণা, মাধবী, অনুপ, সন্ধ্যা, চুণী গোস্বামী থেকে বড় বড় পরিচালকরা শেষ দেখায় ছুটে আসেন। ভানুদার দেহ সৎকারে চলে গেলে নীলিমা দেবীর কাছে এসে হাত ধরে বসেন সুচিত্রা সেন।

তার আগে ৮০ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে কলকাতার পথে মহানায়কের শেষযাত্রায় এত ভিড় হয় যে পুলিশ ভিড় কন্ট্রোল করতে পারে না। তাই শিল্পীরা বিশৃঙ্খলা এড়াতে ঠিক করেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষযাত্রা ওই ভাবে শহরের পথে পথে ঘুরে হবে না।

শতবর্ষ পেরিয়েও ভানু তুলনাহীন

দুই বাংলায় ভালোবাসায় পূজিত উদয় ভানু তিনি। টলিউডের এখনকার কমেডিয়ানদের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কার’ টেলি সম্মান চালু হয়েছে। যদিও তাঁর কোনও স্ট্যাচু নেই শহরে। পুত্র গৌতম জানালেন, “নয়ের দশকে কংগ্রেসের পঙ্কজ ব্যানার্জী বলেছিলেন টালিগঞ্জ সার্কুলার রাস্তা বাবার নামে হবে। সৌমিত্র কাকা থেকে সুব্রত ভট্টাচার্য সবাই সই দেন। কিন্তু পার্টিগত কারণে আর হয়নি সেটা। ২০০৩ সালে সুভাষ চক্রবর্তী আমায় ডেকে কদিন বলেছিলেন, সুরেন্দ্রনাথ কার্জন পার্কে স্ট্যাচু বানানো হবে, এক দিকে থাকবেন তুলসী চক্রবর্তী আর এক দিকে থাকবেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর তো উনি মারা গেলেন, সে চেষ্টাতেও ইতি পড়ল।”

বাসবী যোগ করলেন “দর্শকরা যে বাবাকে মনে রেখেছে এটাই শতবর্ষে প্রাপ্তি। সেদিনও রিনাদি (অপর্ণা সেন) বলছিলেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমেডি এত ভাল কারণ ওঁর অসাধারণ টাইমিং-জ্ঞান। আমরা ভেবেছিলাম কোন মঞ্চে বড় করে বাবার শতবর্ষ অনুষ্ঠান করব। সে তো করোনা আবহে সম্ভব হল না। পরে করার ইচ্ছে আছে। আর অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলছি, এখানে যে যেটা করে তাকে সেটাই আবহমান কাল ধরে দেওয়া হয়। তবে আমার মনে হয় কৌতুকাভিনেতা কিন্তু সবাই হতে পারে না। নায়ক অনেকে হয় কিন্তু কৌতুক করা দর্শককে হাসানো খুব কঠিন কাজ। সেটা বাবা করে দেখিয়েছিলেন।”

গৌতম আরও বলছিলেন, “এখন যা কমেডি দেখি, প্রায় সবই কোনও না কোনও জোকস থেকে টোকা। চল্লিশ বছর আগে বাবা এসব করেননি। বাবা একদম অকৃত্রিম বাঙালি কমেডি করেছেন, সেই নিখাদ হাস্যরস মানুষ মনে রেখেছে।” বাসবীর মতে, “এখন যে সকলে সব লঘু মানের কমেডি করছেন তা নয়। কিন্তু বাবা, জহর কাকা, অজিত কাকা, তুলসী চক্রবর্তী– এঁরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই এমন কমেডি করতেন, যা আজও ভোলা যায় না। হাসির উদ্রেক করতে উদ্ভট সাজতে হত না কাউকে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বললেন “ভানু মানেই বাঙালদের আইকন অনেকেই বলেন। কিন্তু ঘটিরা ভানুর মুখে বাঙাল কথা না শুনতে গেলে সাড়ে চুয়াত্তর হিট হত কি? আমাদের ছোটবেলায় বাঙালরা হিন্দি ছবি দেখত বেশি। টালিগঞ্জের বাঙাল অঞ্চলে সব ছিল হিন্দির ছবির হল। আবার ভবানীপুরে সব বাঙলা ছবির সিনেমা হল। আমাদের বাড়িতে এদেশি-ওদেশি ভাগ ছিলনা অত। বাবা সবাইকে ভালোবাসতেন বলেই বাবাকেও আজও দুই বাংলার মানুষ মনে রেখেছে।”

এখন ভানুশ্রী

একটা কথা বলে সাক্ষাৎকার শেষ করলেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, “আমার মা থাকাকালীন আমরা ভাই-বোনরা মিলে ঠিক করি বাবার বাড়িটা ভগ্নপ্রায় হয়ে যাচ্ছে, তাই অ্যাপার্টমেন্ট বানানো হোক। কারণ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন, ভাই আমেরিকায়, মায়ের পরে আমি ব্যাচেলর মানুষ। একটা বিশাল পুরনো বাড়ি নিয়ে কী করব।

তাই হল। আমরা ফ্ল্যাট পেলাম। আর যেহেতু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমির উপর বাড়ি, তাই আবাসনের নাম দেওয়া হল ‘ভানুশ্রী’। এখানে আমরা বাবার সব ব্যবহার্য জিনিস রেখে, ফিল্মের জিনিস রেখে একটা সংগ্রহশালা করেছি। ২০১৮ সালে সাবুপিসি (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) এসে উদ্বোধন করেছেন। এই বাবার নামে সংগ্রহশালা সবাই এসে দেখতে পারেন ‘ভানুশ্রী’তে।”

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে ভানু

একজন ভদ্রলোক বললেন আমায়, “আপনার লগে কথা কইতে চাই। আপনে নাটক করবেন?” আমি আকাশ থেকে পড়লাম। প্রথমে না বললাম। তার পরেও তিনি শুনলেন না। গম্ভীর ভাবে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললাম, “আমার বাবার লগে কথা কইতে হইব।”

ঘটির দেশে খাস বাঙাল ভাষায় কথা শুনে মন ভাল হয়ে গেছিল। পরের দিনই ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবাকে তাঁর নাম বললেন, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ডাক নামে বেশি লোকে চেনে। ডাকনাম ভানু।

ভানুদার আবিষ্কার আমি। ভানুদার হাত ধরেই ফিল্ম জগতে আসা আমার। ভানুদা একটা জুতো কিনে দিয়ে আমায় বলেছিলেন, “কলকাতা শহরে পথে কাঁকর-পাথর বিছোনো পথে খালি পায়ে হাঁটা যায় না।” কথাটা মর্মে মর্মে সত্যি। সে জুতো বহুদিন আমি রেখে দিই। আর একটা কথাই বলব ভানুদার শতবর্ষে, ওঁর মতো এমন বহুমুখী প্রতিভাবান অভিনেতা হয় না। ভানুদা শুধু কমেডিয়ান ছিলেন না। ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে সবাইকে কাঁদিয়েও দিয়েছিলেন ভানুদা।”

(তথ্যসুত্র : ম্যাগাজিন দি রিয়েল নিউস পেপার , শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় , বুধবার, আগস্ট ২৬, ২০২০   )  

রিভলভার পাচারও করেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয়পাত্র। তিনিই কিনা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গল্প শোনাচ্ছেন ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়


তৃপ্তি মিত্র এত জোরে বাবার হাতটা চেপে ধরেছিলেন যে, কালশিটে মতো হয়ে গিয়েছিল!
ছবির নাম ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নির্দেশক সাধন সরকার প্রথমে চেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে।
সাবুপিসি (  সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ) রাজি হননি। বাবা ধরে নিয়েছিল, তা হলে ছবি বোধহয় আর হলই না। হঠাৎ শ্যুটিং-এ ডাক পেয়ে ফ্লোরে গিয়ে দেখে, তৃপ্তি মিত্র!বাবা বেশ ঘাবড়েই যায়। কিন্তু শটে অদ্ভুত কাণ্ড! ক্লোজ শট। তৃপ্তি মিত্রও নির্ঘাত টেনশন করছিলেন। ক্যামেরা চালু হতে ভয়ে খামচে ধরেছিলেন বাবার হাত।

এমন অনেক গল্প বাবার কাছে বড় হয়ে শুনেছি। ছোটবেলায় আমরা দুই ভাই কেউই বাবাকে তেমন করে পাইনি। পরদায়, মঞ্চে যতই হাসিয়ে বেড়াক, বাড়িতে বাবা গম্ভীর। আমরা কে কোন ক্লাসে পড়ি, তাও জানত না। বাজারহাট তো কোন ছার! তার ওপর পান থেকে চুন খসলেও বাবা ঘাবড়ে যেত। কারও রোগজ্বালা হলে যখন বাড়িতে ডাক্তার আসত, টেনশনে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা। আমরা তখন ৬৯এ, চারু অ্যাভিনিউয়ের ভাড়াবাড়িতে। একটা বড় ঘর আর গ্যারেজ ঘরের ওপরে খুপরি একটা ঘর। বড়টায় দাদু, ঠাকুমা, আমি, আমার ভাই। সঙ্গে বাবার এক মামা, তিনি আবার বদ্ধ উন্মাদ। মাটিতে ঢালাও বিছানা করে শুয়ে পড়তাম। দাদু শুধু খাটে। বাবা, মা আর বোন শুতো খুপরি ঘরে।

’৫৮ সাল নাগাদ আমরা চলে গিয়েছিলাম জুবিলি পার্কে। ’৬০-এ ফিরে গেলাম চারু অ্যাভিনিউ। ও পাড়ায় বাবা বাড়ি কিনল। বাসার ঠিকানা হল ৪২এ। এখানেই শেষ দিন পর্যন্ত বাড়িতে কে না আসতেন! উত্তমকুমার, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়। বিকাশ রায় বাবাকে এত শ্রদ্ধা করতেন যে পাশে বসতেন না, বসতেন পায়ের কাছে, মাটিতে। আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তো বাড়ির লোক। সেই কোন ফ্রকবেলায় বাবা সাবুপিসিকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে অভিনয় করাবে বলে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। পরে জানা যায় সাবুপিসিরা সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়। আসতেন মাধবীপিসিও (মুখোপাধ্যায়)




একটি অনুষ্ঠানে উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে

শুধু সিনেমারই নয়, খেলার জগতের লোকজনও আসতেন। খেলা বলতে ফুটবল। বাবা ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ। ক্লাইভ রো-তে যখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল’-এ চাকরি করত, ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানেই অফিস ‘কাট’! মেম্বরশিপ গেটে দাঁড়িয়ে গেটও ম্যানেজ করেছে বাবা। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন আর হিমাংশু দত্ত আসতেন মাঠে। শচীনকর্তা বাবার প্রাণ! হাফটাইমে বাবা নিয়ম করে ওঁর হাতে তুলে দিতেন একটা সিগারেট, এক খিলি পান আর এক প্যাকেট চিনে বাদাম।

হাতিবাগান পাড়ায় বাবার একটা গল্প মনে পড়ে। গাড়ি নিয়ে বাবা একদিন হাতিবাগানের স্টারে ‘পরিণীতা’র শো করতে গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড! একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে রাস্তায় ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। চাঁটিও মারছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল বাবার। গাড়ির দরজা খুলে সোজা গিয়ে এক-একজনকে রামধোলাই। কিল, ঘুষি, লাথি। নিমেষে সবাই হাওয়া। সে তো হল, এর পর তুলসী চক্রবর্তী কী বললেন শুনুন, ‘‘আহা, অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’’

বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে বাবা খুব ভক্তি করত। তার অবশ্য একটা অন্যতম কারণ বিক্রমপুরে বাবার কিশোরবেলা। ওই সময় বাবা এক দিকে যেমন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয়পাত্র, অন্য দিকে তেমন স্বদেশিও করত। বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই, রিভলভার নিয়ে পাচার করত। দীনেশ গুপ্তকে ‘গুরু’ মানত। এক সময় বাধ্য হয়েই বন্ধুর গাড়িতে ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে এ পার বাংলায় পালিয়ে আসে বাবা। এমন মানুষের অনন্ত সিংহের প্রতি দুর্বলতা থাকবে না!

অনন্ত সিংহ বাবার ছবির প্রযোজকও হয়েছিলেন। তার প্রথম দুটোই ডাহা ফ্লপ। ‘শেষ পরিচয়’, ‘নতুন প্রভাত’। পরেরটা অবশ্য ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। গল্পটা হলিউডি ছবি থেকে ধার করা। ছবির প্ল্যান-প্রোগ্রাম যখন সারা, তখনই খবর এল, ওই একই গল্প নিয়ে বিকাশ রায়ও ছবি করছেন। তখন পরিচালক আর প্রযোজকের সঙ্গে বসে গল্পটা আমূল বদলে দিয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম বড় কমেডি রোল ‘পাশের বাড়ি’। কমেডি করত বটে, কিন্তু সিরিয়াস রোল করার জন্য ছটফট করত। ওই ‘পাশের বাড়ি’ করার সময়েই বাবা নির্দেশক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিল সিরিয়াস ছবির জন্য আবদার নিয়ে। হল না। সেই কমেডি। ‘পাশের বাড়ি’।

প্রায় বছর ষোলো বাদে যখন ছবিটার হিন্দি ভার্সান ‘পড়োসন’ হচ্ছে, বাবার রোলটা করেছিলেন মেহমুদ। মেহমুদ বাবার পরামর্শ চেয়েছিলেন। এতটাই শ্রদ্ধা! কেষ্ট মুখোপাধ্যায় তো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। মুম্বইয়ের শিল্পীদের এত ভক্তি, অথচ বাবা তেমন কাজই করল না ওখানে। কেবল অফার ছেড়েছে! বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তী। বাবা অবশ্য আমাদের হিন্দি ছবি দেখা বড় একটা পছন্দ করত না। যদিও শুনেছি, নিজে নাকি ‘কিসমত’ দেখেছিল একুশ বার!

গান বলতে বাবা বুঝত নজরুল গীতি। আর গায়ক বলতে শেষ কথা শচীনকর্তা। তবে ছবির গানে শ্যামল মিত্র মাস্ট। আর ওঁর ছবি হলে দু’জন অভিনেতাকে রাখতেই হবে, ছবি বিশ্বাস আর তুলসী চক্রবর্তী। ছবিজেঠুকে গুরুর মতো মাথায় তুলে রাখত। জেঠুও বাবাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। প্রত্যেক দিন হয় আসতেন, নয় ফোন।

‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’।  প্রথমে কাস্টিং-এ নাম ছিল অরুন্ধতী দেবী আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্ক্রিপট শুনে অরুন্ধতীদেবী উত্তমকাকুকে করতে অনুরোধ করলেন। কাকুও রাজি। তাঁকে মনে রেখে তিনটে গান লিখে ফেললেন নচিকেতা ঘোষ। একদিন উত্তমকাকু বললেন, ‘‘কয়েকটা জায়গা পাল্টানো দরকার।’’ নির্মাতারা রাজি হলেন না। ব্যস, উত্তমকাকু অ্যাবাউট টার্ন। সরে দাঁড়ালেন অরুন্ধতীদেবীও। শেষে রুমা গুহঠাকুরতা আর বাবা। তখন নচিকেতাকাকু মজা করে বলেছিলেন, ‘‘যাব্বাবা, ভানু থাকবে জানলে আমি গানই লিখতাম না।’’

বাবা লিপ দিল। ছবিও হিট। তখন  নচিকাকু বললেন, ‘‘না, না, ভালই লিপ দিয়েছে কিন্তু ভানু।’’

তাতে বাবার কী হাসি!

সিরিয়াস ছবি ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’। বিএল খেমকা ডেকে পাঠালেন। নির্মল দে নির্দেশক। বাবার আর এক গুরু। সিরিয়াস ছবি আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, এই দুটোকে মেলাতে পরিচালক বোধহয় ভরসা পাচ্ছিলেন না। ছ’-সাতটা গান ঢোকালেন। বাবার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু কিচ্ছু বলেনি, গুরু যে!  তাই বলে সবখানে যে আপস করেছে, এমন নয়। ‘কাঞ্চনমূল্য’য় যেমন। নির্মল মিত্র ডিরেক্টর। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গল্প। বাবা প্রযোজক। আমরা তখন জুবিলি পার্কে। ও পাড়ায় থাকতেন আর ডি বনসল। ডিসট্রিবিউটর। বাবা প্রযোজক শুনে উনি ছবিতে যোগ দিলেন। কিন্তু প্রথম থেকেই খটামটি লেগেই ছিল। মিন্টু দাশগুপ্ত একটা তরজা গান লিখেছিলেন। বলা হল, ওঁকে দিয়েই ওঁর গানের অংশটায় অভিনয়ও করাতে হবে। বাবা এ দিকে ওই জায়গায় তুলসী চক্রবর্তীকে ভেবে রেখেছিল। হাজার চাপাচাপিতেও বাবাকে কাত করানো গেল না। তুলসীজেঠুই রয়ে গেলেন।

ছবিতে আর একটা কাণ্ডও ঘটেছিল। সুর করেছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এ দিকে নির্মলকাকু বেপাত্তা। খোঁজ, খোঁজ। খবর এল, ‘গঙ্গা’ ছবির গান শিখিয়ে বে়ড়াচ্ছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। সেখানেও তাই, সলিল চৌধুরী সুর করেও হাজিরা দিতে পারছেন না, ভার দেওয়া হয়েছে ওঁকে।  শেষে হেমন্তকাকু গান শিখেছিলেন আমার মায়ের কাছে। মা অবশ্য ছোট থেকেই গানের চর্চায়। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র গায়িকা, তবু, হাজার হোক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো!




‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিতে জহর রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবার জীবনে কঠিন বাঁক ষাটের দশকের শেষে।  ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় ফাটল। উত্তমকাকু, অনিলকাকুদের (চট্টোপাধ্যায়) বেরিয়ে যাওয়া। পাল্টা সমিতি ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি। খুব কষ্ট পেয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা তখনই।  তবু মাথা নোয়ায়নি। ফলে ব্ল্যাক লিস্টেড। যে জন্য বহু দিন কাজ পেত না। এ দিকে সংসার চালাতে হবে যে! তখন যাত্রা একমাত্র সম্বল। কোথায় না কোথায় গেছে তখন যাত্রার জন্য! যে লোকটা নরম বিছানা ছা়ড়া ঘুমোতে পারত না, সে কিনা মাটিতে চাটাই পেতে রাত কাটিয়েছে। ভাঙা বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে। বুকের ওপর পাখা ভেঙে পড়েছে। তবু শক্ত চোয়াল আলগা হতে দেয়নি। ’৭৯ থেকে বাবার শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করল।

’৮৩-র ফেব্রুয়ারি। এত অসুস্থ হল যে, সিএমআরআই-এ ভর্তি করতে হল। সে বার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। মার্চের ৪। আবার অসুস্থ। বুকে অসহ্য ব্যথা। এ বারও ভর্তি না করে উপায় নেই। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝে কার সাধ্যি! সোজা হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠল।

উডল্যান্ডস। রাতও পেরোল না। চলে গেল বাবা। একটা মাত্র দিনও কেউই কিছু করার সুযোগটুকুও পেল না!

তথ্যসুত্র : আনন্দবাজার  পত্রিকা (  দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় , ৮ এপ্রিল, ২০১৭,  অনলাইন সংস্করণ )


মানুষকে আনন্দ দেওয়ার যে উপাদান, তা আমরা নিয়ে জন্মাই। পরে তা শানিত হয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জন্মেছেন, তখনই ওঁর মধ্যে উপাদানগুলো শানিত ছিল। ওঁকে যাঁরা কমেডিয়ান বলতেন, তাঁদের কাছে অন্য শব্দ ছিল না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কমেডিয়ান নন। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা --- বলেছেন বন্দ্যোপাধ্যায়

মানুষকে সত্যি করে আনন্দ দেওয়ার যে উপাদান, তা আমরা নিয়ে জন্মাই। পরে শানিত হয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জন্মেছেন, তখনই ওঁর মধ্যে এই উপাদানগুলো শানিত ছিল। তিনি ব্যতিক্রমী। ওঁকে যাঁরা কমেডিয়ান বলতেন, তাঁদের কাছে আর অন্য শব্দ ছিল না। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কমেডিয়ান নন। একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। তবে দর্শক ভালোবেসেই কমেডিয়ান বলতেন। আসলে কমেডিয়ান হতে গেলে সব দিক পরিক্রমা করে আসতে হয়। যিনি হাসাতে পারেন, তিনি দর্শকের চোখে জলও আনতে পারেন। যেমন চার্লি চ্যাপলিন। দেখে হাসছেন, কিন্তু কখন যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে, বুঝতে পারবেন না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমন। 

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যান্টেনা ছিল দারুণ স্ট্রং। কেউ চোখের পাতা এ পাশ ও পাশ করলে ধরে ফেলতে পারতেন, মনের মধ্যে কী চলছে। কথা বলার ফাঁকে গলা সামান্য কাঁপলে বুঝে যেতেন সত্য বলছে নাকি অসত্য। তাঁর প্রশংসা করা মানে সোনার অলঙ্কারের ওপর সোনালি রং করা। ওঁর প্রশংসা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। বাঙালি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। আমিও তাই। ভানুদাকে রসবোধ অর্জন করতে হয়নি। তবে শুধুমাত্র যে রসবোধ ছিল তা নয়, সাংঘাতিক সেনসিটিভ মানুষ ছিলেন।

একটা ছোট ঘটনা বলি। রেডিয়োতে নাটকের জন্য একবার রিহার্সাল করছিলাম। তখন নিয়ম হল, রিহার্সালের পর চা খাওয়া হয়। তারপর রেকর্ডিং হয়। আর সে আমলে রেডিয়োতে কেউ নিঃশ্বাস নিতে পারলেই মাটিতে আর পা পড়ত না। এ রকম রিহার্সালের পর, কুড়ি-বাইশ বছরের একটি ছেলে, হঠাৎ বিরাট কায়দা করে ডানদিকের চুল ঠিক করে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বলল, 'কী ভানুদা, ঠিক আছে তো?'। ভানুদা আমার দিকে তাকিয়ে বাঙাল ভাষায় বলতে লাগলেন, 'বুঝলে পরাণ, পাড়ার নাটকে এক জন শাহজাহানের রোল করছে। সে অনেক ডোনেশন দিয়ে রোলটা পেয়েছে। আমার মামাকে নেমন্তন্ন করেছিল। মামা নাটক দেখছে আর মাঝে-মাঝে মাথা নিচু করছে। মামা বেরনোর সময় গেটে সে মামাকে ধরেছে। তখন মামা তাকে বলে, 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনো? এই শাহজাহানের ক্যারিকেচারটা তোমার থেকে বেটার করতো'। এটা শুনে পাশের ছেলেটার মুখটা সেদিন একদম ছোট হয়ে গিয়েছিল। মানে ছেলেটির অডিয়ো আর ভঙ্গিমা সে দিন কাল হল। ভানুদা মেনে নিতে পারেননি, যে সিনিয়রদের সম্মান না দিয়ে ছেলেটি ও ভাবে কথা বলছে। এতটাই সেনসিটিভ মানুষ ছিলেন।  


এখন তো আমি পেকে দরকচা মেরে গিয়েছি। অভিনয় বিচার করা বা গল্প দেখার জন্য ছবি দেখি না। ছোট-ছোট কাজ দেখি। 'গৃহপ্রবেশ' ছবিতে একটা দৃশ্য আছে। বাড়ি নানা লোক ভানুকে ডাকছে। যখনই এক দিকে যেতে যাচ্ছে অন্য জন আবার ডাকছে। এ ভাবে কর্তার সামনে যখন পড়ে, 'হ্যাঁ' বলে না-এর ভঙ্গিমা করছে। আবার 'না' বলে হ্যাঁ-এর ভঙ্গিমা করছে। এ সময় ক্লোজ শট দেখার মতো। যেভাবে গাল নাড়াত, তারও টেকনিক রয়েছে। অনেকে নিজে হেসে দর্শককে হাসায়। ভানুদা কথা বললেই দর্শক হাসতেন।

'মিস প্রিয়ংবদা' বা 'আশিতে আসিও না'-র মতো কিছু ছবিতে একেবারে অন্য ধরনের চরিত্র করেছেন। সে সব ছবি দেখতেও আমার বেশ লাগে। কখনও আফসোস করতে দেখিনি ভানুদাকে। অনেক ঝড় এসেছে জীবনে। তবে সমবেদনা চাননি। কারও কাছে হাতজোড় করে সাহায্য প্রার্থনা করেননি। লড়াকু মানুষ ছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আসলে নকল করা যায় না। তাঁর থেকে উত্তাপ নেওয়া যায়।

(সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন: ভাস্বতী ঘোষ)  



এই পোস্টটি সত্যিকার  অর্থেই বিষদ । তাই বলবো জানার জন্য সময় নিয়ে পড়লে ভালো । আর যেহেতু বিভিন্ন সময়ে উনার  সন্তানদের  থেকেই  তথ্য গুলো প্রাপ্ত তাই কিছু কথা  দুইবার এসেছে । আমি যতোটুক সম্ভব  কিছুটা গুছিয়ে পোস্ট করেছি ।উনার সম্পর্কে এক পোস্টে জানানো যায় না । আজ উনার  জন্মশত বার্ষিকী তাঁর ও অভিনয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই আমার এই সংকলন

কৃতজ্ঞতা : উই্ত্রপ্ত্রিক, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা , অভিনেতা- অভিনেত্রী ও উনার সন্তানদের সাক্ষাৎকার



সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:০৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×