somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিখণ্ডিত আয়নায় (ছোটগল্প)

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আরাফাত আল মাসুদ

আমাকে এখানে পাঠানোর একটা বড় কারণ হচ্ছে, এখানেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। এই গ্রামেই। আমি জানি এই এলাকা সম্বন্ধে। এলাকার মানুষ সম্বন্ধে। জানি তাদের নাড়ীর খবর। কাজেই আমাকে দিয়েই হবে।
বার বছর পর ফিরে এলাম। সেদিন বাস থেকে নামতে না নামতেই কোত্থেকে যেন আমার ছেলেবেলা এসে আমার সঙ্গী হল। এতদিন পর বুঝলাম তার সাথে আমার বন্ধুতা একটুও কমেনি। আমার কাঁধে হাত জড়িয়ে আমাকে নিয়ে চলল গ্রামের পথ ধরে। অথচ এই বার বছরে বদলেছে এখানকার অনেক কিছুই। রাস্তা পাকা হয়েছে। বিদ্যুৎ এসেছে বাজারে। বেড়েছে মানুষ। মানুষের ঘরবাড়ি। পথঘাটও কিছু অচেনা। তবু এত অচেনার মাঝে যেটুকু অবিকৃত তাই যেন জাপটে ধরে আমাকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে, যেখানে যেভাবে আমার অতীত জড়িয়ে আছে। আমি কি আমার ছেলেবেলাকে নিয়ে ছুট দেব ওই খোলা মাঠে ? নারকেলের বাগানে? ক্ষীণ হয়ে আসা নদীটির পাড়ে? কী অবাক ব্যাপার! এত দিনের ভুলে থাকা কৈশোর এতখানি তিব্র হয়ে উঠবে ভাবিনি ঘুণাক্ষরেও। তুমি তাহলে এলে প্রতীক! হ্যাঁ। এলাম তো। কেন এলে? বুকের কোথায় যেন একটা কাঁটা গিয়ে বিঁধল। থাক না এখন সে কথা। কতদিন পর ফিরে এলাম এই স্নিগ্ধ কায়ায়! ফিরে তো এসেছ। কিন্তু প্রতারক হয়ে। না, না। তা কেন হবে। ওটা অহেতুক অস্থিরতা। কী যে ভাবনা আসে মাথায় আসলে। আমি তো এসেছি সবার ভালর জন্যই।
আমাকে চিনতে খুব একটা দেরি হয়নি গ্রামের লোকদের। ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’ ভাবটা কেটে যাবার পর, আরে এ আমাদের প্রিন্সিপল মতিন স্যারের ছেলে প্রতিক না! চিনতে পেরেছেন তাহলে! চিনব না ক্যান। আস বাবা আস। কী মনে কইরা এত বছর পর। কেন আবার! আপনাদের খোঁজখবর নিতে। এখন নিজে বড় চাকরি করি। আপনাদের কথা কি ভুলে যাব! আপনারা কি আমার পর! কি যে কও! আলহামদুলিল্লাহ। বেঁচে থাক বাবা।
খাতির কিছুটা প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু এতখানি ভাবিনি। গ্রামের একটা নিবন্ধিত কলেজ। বাবা এখানে প্রিন্সিপল ছিলেন বছর দশেক । আমার ক্লাস টু থেকে এস এস সি পর্যন্ত। এ আমার পূর্বপুরুষের গ্রাম না। এই জেলায় হলেও এখান থেকে পচিশ ছাব্বিশ কিলো দূর। কিন্তু এ আমারই গ্রাম। আমার বড় ভাই বোনদের চেয়ে আমার আবেগ তাই বেশি। এই সবুজেই আমার বেড়ে উঠা। যদিও একসময় পাড়ি দেই সবুজ ছেড়ে ধূসর জগতে। এই সবুজ মায়াকে তো ভুলেই ছিলাম এত বছর। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই আত্মার আপন হয়ে যাওয়া এতটুকু মলিন হয়নি এত বছরেও। আহা! সবুজের মায়ায় ফিরে এসেছ বুঝি! এ তোমার বায়বীয় আবেগ। ধক করে উঠে বুকের ভিতরটা। আহ, থাক না সে কথা। এসব কেন মাথায় আসছে। আমি তো এসেছি এক মহৎ দায়িত্ব নিয়ে।
গত কয়েকদিনেই সব গুছিয়ে নিয়েছি। এসেই প্রথমে উঠেছিলাম জামাল কাকার বাসায়। বাবার কলিগ ছিলেন। থেকে যাবার অনুরোধ অনেক বুঝিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। আসলে থাকার ভাবনা তো ছিল না। যারা আমায় পাঠিয়েছিল, এ শহরেই থাকার ভাল ব্যবস্থা করে রেখেছিল। নিয়মিত আসা যাওয়া কোন ব্যাপার ছিল না। আরও সহজ হয়েছিল পুরনো মানুষদের আগের মত করে পাওয়া। জামাল কাকা, শরিফ কাকা, বারেক ভাই। আর আমার পুরনো সব বন্ধু শফিক, হাসান, পঙ্কজ এদের সবাইকে। বার বছর আগের দিনগুলি গাঁয়ের এ পথে, ও পথে, সবুজ ধানক্ষেতের মাঝের আলপথে, নারকেলের বাগান আর মেহগনি কড়ইয়ের সারির নিবিড়তায়, নদীপাড়ের নির্মলতায় ফিরে এসেছিল যেন। পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমে উঠেছে নিয়মিত।
আচ্ছা তোর মনে আছে প্রতিক, ওইবার বারেক ভাইসহ স্বপনদের ডাব চুরি করতে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটছিল। বারেক ভাই ছিলেন বলে রক্ষা পাইসিলাম।
মনে থাকবে না কেন। এখানকার ডাবের পানি এত মিষ্টি! কত যে খেয়েছি। আর কত ঘটনা যে এর সাথে জড়িয়ে।
হ। ডাব আর ডাবের পানি খুব প্রিয় ছিল তোর। কতদিন তো এই খাইয়াই থাকতি।
এখন অবশ্য কোক খেয়ে গলা ভিজাই। সবকিছু কি আর আগের মত থাকবেরে! সময় বদলেছে না! তোদেরও বদলাতে হবে বন্ধু।
ওরা বদলাতে প্রস্তুত। গেরস্ত কৃষক বা গঞ্জের দোকানদারি বা জমি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া আর মাঝেমধ্যে বিদেশ যাবার নামে আদম ব্যাপারীর হাতে সর্বস্বান্ত হওয়া ছাড়াও করার আছে অনেক কিছু। ওরা বুঝতে পারে। তবে আমার মত করে। যেভাবে আমি চিন্তা করতে শিখিয়েছি ওদের। তারপর একসময় প্রস্তাব করি সবাই মিলে বসা যাক একদিন। সেইদিন আজ। আজ জামাল কাকার বাড়িতে বৈঠক।
আজ সকাল থেকে আমি বারবার ছুটে গিয়েছিলাম নদীর পাড়ে। না প্রতীক। তোমার এত আবেগ থাকা মানায় না। তুমি এখন যুবক। ছেলেবেলার মত ছেলেমানুষি করো না। কিন্তু মন যে আমার শাসন শুনতে চাইছে না। মনে হচ্ছে এই সবুজ আমায় অভিশাপ দিচ্ছে।
গাছ, গাছ আর গাছ। নদীর এপারে ওপারে যতদূর চোখ যায় শুধু নিবিড় ঘন সবুজ। হঠাৎ আমার কৈশোরকে দেখতে পেলাম এই সবুজের ভিড়ে ছুটে বেড়াতে। শুধু একটি আমি নই, অনেকগুলো আমি। কেউ এই নদীর পাড়ে, কেউ ওই খোলা মাঠে, ওই তো একজন আমগাছের মগডালে বসে আছে হাফ প্যান্ট, খালিগায়ে। শফিক, পঙ্কজ,হাসানও আছে। খালি গায়ে। পরনে কারো লুঙ্গি, কারো হাফ প্যান্ট। আরে অই তো আরেক আমি। নারকেল গাছ তলায়। প্রচুর নারিকেল গাছ এগ্রামে। বারেক ভাই ডাব পেড়ে নামল। ওমা! এখানেও দেখি শফিক, হাসানরা। ওখানে বসে আমি ডাবের পানি খাচ্ছি। এখানে আমার গলা ভিজে গেছে। তবু বুক যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু ভিজে উঠেছে চোখের দু কোন।
বৈঠক এখন জামাল কাকার বাড়িতে। সবকিছু গুছিয়ে বলতে পারব তো? নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এতখানি দ্বিধা তো আগে কাজ করেনি কখনো। কথার জাদুতে মানুষকে সম্মোহিত করতে পারার ক্ষমতা আমার আছে বলেই তো জানি। সেই বিশ্বাস আমার কোম্পানিরও আছে। যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির এক বিশ্বস্ত কর্মকর্তা আমি। অনেক আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আমায় তারা পাঠিয়েছে। এখানে কোম্পানির নতুন মিল বসবে। প্রশাসনেরও অনুমোদনও আছে। উজাড় হবে গাছ। বিলীন হবে সবুজ।থাকবেনা এখানকার আম কাঁঠালের গাছ, মেহগনি করইয়ের সারি, বিশাল বিশাল নারকেল গাছের বাগান,যা আমাকে তৃষ্ণায় তৃপ্ত করে রাখত। নষ্ট হবে মাটি।কমে যাবে ফসল। তার বিনিময়ে এরা পাবে কোম্পানির চাকরি। কিছু নগদ টাকা। কালো ধোঁয়া। বিষাক্ত পানি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার মানুষ হতে পারার গৌরব। তবু এসব গ্রহণ করতে যেন অবুঝের মত কোন ঝামেলা তৈরি না করে, তাই তো আমায় পাঠানো। বিনিময়ে আমার আরও উচ্চ পদে পদন্নোতি হবার হাতছানি। তাই কিছুই অসম্ভব মনে হয়নি। কিন্তু আমার ভিতর যে অন্য মানুষ আছে আর সে যে এখনও ইট রড সিমেন্টে বিনির্মিত হয়নি, জানা ছিল না।
প্রতিক, তুমি তো আর ছোটটি নেই। এখন বড় হয়েছ এবং এগিয়ে এসেছ অনেক দূর। সেই বহুদূরে এখন যে নদীর জলে দাপাদাপি করছে, বর্ষার কাদামাখা মাঠে ফুটবলের পিছনে দৌড়াচ্ছে কিংবা গ্রীষ্মের দুপুরে বন্ধুদের নিয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ডাবের পানিতে সে ধূসর এক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। এই তুমি বাস্তব। এই তুমি জান্তব। এটাই সত্য। আবেগের খোলস খুলে ফেলা আদি পুরুষ। আর সব মিথ্যা। আর সব মিথ্যা?
আপনারা বসেন। জামাল কাকা বলছেন বৈঠকের সবার উদ্দেশ্যে। আমাদের সাবেক প্রিন্সিপল মতিন স্যারের ছেলে প্রতিক বাবা এখন কিছু বলবেন আপনাদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ভালর জন্যি। সবাই মনোযোগ দিয়া শোনেন। শুরু কর বাবা।
একটু বস ভাই। যা গরম! বারেক ভাই ভিতরে গেলেন মিনিট দুয়েকের জন্য। ফিরলেন ডাব নিয়ে। নাও বাবা। আমাদের গাছের ডাব। তুমি খুব পছন্দ করতা মনে আছে। আগে ডাবের পানিটা খাও। তারপর শুনি তোমার কথা।



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×