আরাফাত আল মাসুদ
আমাকে এখানে পাঠানোর একটা বড় কারণ হচ্ছে, এখানেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। এই গ্রামেই। আমি জানি এই এলাকা সম্বন্ধে। এলাকার মানুষ সম্বন্ধে। জানি তাদের নাড়ীর খবর। কাজেই আমাকে দিয়েই হবে।
বার বছর পর ফিরে এলাম। সেদিন বাস থেকে নামতে না নামতেই কোত্থেকে যেন আমার ছেলেবেলা এসে আমার সঙ্গী হল। এতদিন পর বুঝলাম তার সাথে আমার বন্ধুতা একটুও কমেনি। আমার কাঁধে হাত জড়িয়ে আমাকে নিয়ে চলল গ্রামের পথ ধরে। অথচ এই বার বছরে বদলেছে এখানকার অনেক কিছুই। রাস্তা পাকা হয়েছে। বিদ্যুৎ এসেছে বাজারে। বেড়েছে মানুষ। মানুষের ঘরবাড়ি। পথঘাটও কিছু অচেনা। তবু এত অচেনার মাঝে যেটুকু অবিকৃত তাই যেন জাপটে ধরে আমাকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে, যেখানে যেভাবে আমার অতীত জড়িয়ে আছে। আমি কি আমার ছেলেবেলাকে নিয়ে ছুট দেব ওই খোলা মাঠে ? নারকেলের বাগানে? ক্ষীণ হয়ে আসা নদীটির পাড়ে? কী অবাক ব্যাপার! এত দিনের ভুলে থাকা কৈশোর এতখানি তিব্র হয়ে উঠবে ভাবিনি ঘুণাক্ষরেও। তুমি তাহলে এলে প্রতীক! হ্যাঁ। এলাম তো। কেন এলে? বুকের কোথায় যেন একটা কাঁটা গিয়ে বিঁধল। থাক না এখন সে কথা। কতদিন পর ফিরে এলাম এই স্নিগ্ধ কায়ায়! ফিরে তো এসেছ। কিন্তু প্রতারক হয়ে। না, না। তা কেন হবে। ওটা অহেতুক অস্থিরতা। কী যে ভাবনা আসে মাথায় আসলে। আমি তো এসেছি সবার ভালর জন্যই।
আমাকে চিনতে খুব একটা দেরি হয়নি গ্রামের লোকদের। ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’ ভাবটা কেটে যাবার পর, আরে এ আমাদের প্রিন্সিপল মতিন স্যারের ছেলে প্রতিক না! চিনতে পেরেছেন তাহলে! চিনব না ক্যান। আস বাবা আস। কী মনে কইরা এত বছর পর। কেন আবার! আপনাদের খোঁজখবর নিতে। এখন নিজে বড় চাকরি করি। আপনাদের কথা কি ভুলে যাব! আপনারা কি আমার পর! কি যে কও! আলহামদুলিল্লাহ। বেঁচে থাক বাবা।
খাতির কিছুটা প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু এতখানি ভাবিনি। গ্রামের একটা নিবন্ধিত কলেজ। বাবা এখানে প্রিন্সিপল ছিলেন বছর দশেক । আমার ক্লাস টু থেকে এস এস সি পর্যন্ত। এ আমার পূর্বপুরুষের গ্রাম না। এই জেলায় হলেও এখান থেকে পচিশ ছাব্বিশ কিলো দূর। কিন্তু এ আমারই গ্রাম। আমার বড় ভাই বোনদের চেয়ে আমার আবেগ তাই বেশি। এই সবুজেই আমার বেড়ে উঠা। যদিও একসময় পাড়ি দেই সবুজ ছেড়ে ধূসর জগতে। এই সবুজ মায়াকে তো ভুলেই ছিলাম এত বছর। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই আত্মার আপন হয়ে যাওয়া এতটুকু মলিন হয়নি এত বছরেও। আহা! সবুজের মায়ায় ফিরে এসেছ বুঝি! এ তোমার বায়বীয় আবেগ। ধক করে উঠে বুকের ভিতরটা। আহ, থাক না সে কথা। এসব কেন মাথায় আসছে। আমি তো এসেছি এক মহৎ দায়িত্ব নিয়ে।
গত কয়েকদিনেই সব গুছিয়ে নিয়েছি। এসেই প্রথমে উঠেছিলাম জামাল কাকার বাসায়। বাবার কলিগ ছিলেন। থেকে যাবার অনুরোধ অনেক বুঝিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। আসলে থাকার ভাবনা তো ছিল না। যারা আমায় পাঠিয়েছিল, এ শহরেই থাকার ভাল ব্যবস্থা করে রেখেছিল। নিয়মিত আসা যাওয়া কোন ব্যাপার ছিল না। আরও সহজ হয়েছিল পুরনো মানুষদের আগের মত করে পাওয়া। জামাল কাকা, শরিফ কাকা, বারেক ভাই। আর আমার পুরনো সব বন্ধু শফিক, হাসান, পঙ্কজ এদের সবাইকে। বার বছর আগের দিনগুলি গাঁয়ের এ পথে, ও পথে, সবুজ ধানক্ষেতের মাঝের আলপথে, নারকেলের বাগান আর মেহগনি কড়ইয়ের সারির নিবিড়তায়, নদীপাড়ের নির্মলতায় ফিরে এসেছিল যেন। পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমে উঠেছে নিয়মিত।
আচ্ছা তোর মনে আছে প্রতিক, ওইবার বারেক ভাইসহ স্বপনদের ডাব চুরি করতে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটছিল। বারেক ভাই ছিলেন বলে রক্ষা পাইসিলাম।
মনে থাকবে না কেন। এখানকার ডাবের পানি এত মিষ্টি! কত যে খেয়েছি। আর কত ঘটনা যে এর সাথে জড়িয়ে।
হ। ডাব আর ডাবের পানি খুব প্রিয় ছিল তোর। কতদিন তো এই খাইয়াই থাকতি।
এখন অবশ্য কোক খেয়ে গলা ভিজাই। সবকিছু কি আর আগের মত থাকবেরে! সময় বদলেছে না! তোদেরও বদলাতে হবে বন্ধু।
ওরা বদলাতে প্রস্তুত। গেরস্ত কৃষক বা গঞ্জের দোকানদারি বা জমি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া আর মাঝেমধ্যে বিদেশ যাবার নামে আদম ব্যাপারীর হাতে সর্বস্বান্ত হওয়া ছাড়াও করার আছে অনেক কিছু। ওরা বুঝতে পারে। তবে আমার মত করে। যেভাবে আমি চিন্তা করতে শিখিয়েছি ওদের। তারপর একসময় প্রস্তাব করি সবাই মিলে বসা যাক একদিন। সেইদিন আজ। আজ জামাল কাকার বাড়িতে বৈঠক।
আজ সকাল থেকে আমি বারবার ছুটে গিয়েছিলাম নদীর পাড়ে। না প্রতীক। তোমার এত আবেগ থাকা মানায় না। তুমি এখন যুবক। ছেলেবেলার মত ছেলেমানুষি করো না। কিন্তু মন যে আমার শাসন শুনতে চাইছে না। মনে হচ্ছে এই সবুজ আমায় অভিশাপ দিচ্ছে।
গাছ, গাছ আর গাছ। নদীর এপারে ওপারে যতদূর চোখ যায় শুধু নিবিড় ঘন সবুজ। হঠাৎ আমার কৈশোরকে দেখতে পেলাম এই সবুজের ভিড়ে ছুটে বেড়াতে। শুধু একটি আমি নই, অনেকগুলো আমি। কেউ এই নদীর পাড়ে, কেউ ওই খোলা মাঠে, ওই তো একজন আমগাছের মগডালে বসে আছে হাফ প্যান্ট, খালিগায়ে। শফিক, পঙ্কজ,হাসানও আছে। খালি গায়ে। পরনে কারো লুঙ্গি, কারো হাফ প্যান্ট। আরে অই তো আরেক আমি। নারকেল গাছ তলায়। প্রচুর নারিকেল গাছ এগ্রামে। বারেক ভাই ডাব পেড়ে নামল। ওমা! এখানেও দেখি শফিক, হাসানরা। ওখানে বসে আমি ডাবের পানি খাচ্ছি। এখানে আমার গলা ভিজে গেছে। তবু বুক যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু ভিজে উঠেছে চোখের দু কোন।
বৈঠক এখন জামাল কাকার বাড়িতে। সবকিছু গুছিয়ে বলতে পারব তো? নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এতখানি দ্বিধা তো আগে কাজ করেনি কখনো। কথার জাদুতে মানুষকে সম্মোহিত করতে পারার ক্ষমতা আমার আছে বলেই তো জানি। সেই বিশ্বাস আমার কোম্পানিরও আছে। যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির এক বিশ্বস্ত কর্মকর্তা আমি। অনেক আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আমায় তারা পাঠিয়েছে। এখানে কোম্পানির নতুন মিল বসবে। প্রশাসনেরও অনুমোদনও আছে। উজাড় হবে গাছ। বিলীন হবে সবুজ।থাকবেনা এখানকার আম কাঁঠালের গাছ, মেহগনি করইয়ের সারি, বিশাল বিশাল নারকেল গাছের বাগান,যা আমাকে তৃষ্ণায় তৃপ্ত করে রাখত। নষ্ট হবে মাটি।কমে যাবে ফসল। তার বিনিময়ে এরা পাবে কোম্পানির চাকরি। কিছু নগদ টাকা। কালো ধোঁয়া। বিষাক্ত পানি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার মানুষ হতে পারার গৌরব। তবু এসব গ্রহণ করতে যেন অবুঝের মত কোন ঝামেলা তৈরি না করে, তাই তো আমায় পাঠানো। বিনিময়ে আমার আরও উচ্চ পদে পদন্নোতি হবার হাতছানি। তাই কিছুই অসম্ভব মনে হয়নি। কিন্তু আমার ভিতর যে অন্য মানুষ আছে আর সে যে এখনও ইট রড সিমেন্টে বিনির্মিত হয়নি, জানা ছিল না।
প্রতিক, তুমি তো আর ছোটটি নেই। এখন বড় হয়েছ এবং এগিয়ে এসেছ অনেক দূর। সেই বহুদূরে এখন যে নদীর জলে দাপাদাপি করছে, বর্ষার কাদামাখা মাঠে ফুটবলের পিছনে দৌড়াচ্ছে কিংবা গ্রীষ্মের দুপুরে বন্ধুদের নিয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ডাবের পানিতে সে ধূসর এক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। এই তুমি বাস্তব। এই তুমি জান্তব। এটাই সত্য। আবেগের খোলস খুলে ফেলা আদি পুরুষ। আর সব মিথ্যা। আর সব মিথ্যা?
আপনারা বসেন। জামাল কাকা বলছেন বৈঠকের সবার উদ্দেশ্যে। আমাদের সাবেক প্রিন্সিপল মতিন স্যারের ছেলে প্রতিক বাবা এখন কিছু বলবেন আপনাদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ভালর জন্যি। সবাই মনোযোগ দিয়া শোনেন। শুরু কর বাবা।
একটু বস ভাই। যা গরম! বারেক ভাই ভিতরে গেলেন মিনিট দুয়েকের জন্য। ফিরলেন ডাব নিয়ে। নাও বাবা। আমাদের গাছের ডাব। তুমি খুব পছন্দ করতা মনে আছে। আগে ডাবের পানিটা খাও। তারপর শুনি তোমার কথা।