somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প :: ভাড়া-টিয়া ::

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বন্ধুরা
আমার এই গল্পটি গত শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর তারিখে যুগান্তর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। আপনারা পড়বেন, পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাবেন-- এই ভরসায় এখানে পোস্ট করলাম।
---------------------------------------------------
ভাড়া-টিয়া
-----------------------------

অ ব নি অ না র্য
--------------------------------------------------
দীর্ঘকাল ভাড়াটিয়া ছিলাম। প্রথমত আজিজ মার্কেটে, দ্বিতীয়ত রায়ের বাজার। তৃতীয়তে তেজগাঁয়, চতুর্থতে মণিপুরীপাড়া, পঞ্চমেতে... এভাবে একটা তালিকাসমগ্র করা সম্ভব হবে। কিন্তু কোনও কিছু সম্ভবপর মানেই সেটা করা সঙ্গত হবে-- এমনটা ভাবা খুব অসঙ্গত। কেননা, সম্ভব মাত্রই ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত; আর ক্ষমতার চর্চা সবসময় যে করা উচিত নয়, সেটা বলাই অপরিহার্য। একই সঙ্গে বলা বাহুল্য যে, বাড়িপরিবর্তনের বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িঅলার অনিচ্ছার সঙ্গে সম্পর্কিত, আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যাপক ঝক্কি, আর মূল্যবান সম্পদ/সম্পত্তি ইত্যাদি খোয়া যাওয়ার ঘটনা। আমার স্ত্রী অতএব এসব ঝামেলার সাততাড়াতাড়ি সমাধান প্রত্যাশা করেন। যেহেতু তিনি প্রত্যাশা করেন, সেহেতু আমার না-করলেও চলে।

বোঝা গেল, যে-করেই হোক, ভাড়া-বাড়ির ঐতিহ্য বর্জন করে আমাদের একটা নিজের বাড়ি চাই। এখানে কাব্য করে বলা গেলে ভালো হত যে, যে-করেই হোক আমাদের একটা নিজের বাড়ি চাই, সেটা যত ছোটই হোক, আর যে কোনও স্থানেই হোক। কিন্তু এস্থলে (এ-জলেও পড়তে পারেন) প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং স্বামী-স্ত্রীর ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে বলে যেটা ধরে নেওয়া যায় সেটাই সত্য, অর্থাৎ কিনা আমার স্ত্রী নগরীর ছদ্ম-অভিজাত একটা এলাকায় বাড়ি করার বিষয়টা নিশ্চিত করলেন, সঙ্গে বাড়ির স্কয়ার ফিটের বিষয়টায় কিছুটা ছাড় দিয়ে সেটাকে বারো শ'তে নামিয়ে আনার সুযোগ দিলেন।

জীবনের সমস্ত সঞ্চয় (সেটা খুব একটা আহামরি মনে করা হাস্যকর, বরং সে-দিকটা হিসেব করলে দেখা যাবে, ওই সঞ্চয়ে কেবল একটা অ্যাটাচড বাথের মতো ছোট আকারের গোসলখানার ব্যবস্থা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ওই বাথরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড কোনও লিভিং রুম নেই।) যোগ করা হলো স্ত্রীর সঞ্চয়ের সঙ্গে। গ্রামের বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি হাতছাড়া হল, যার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক রহিত হল রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গেও; বাদ গেল না মা'র গয়না, বাবার এফডিআরঃ তবু একটা বাড়ি তো হল শেষতক। নিজে(দে)র [এখানে উল্লেখ করা অনুচিত হবে না যে, নিজে(দে)র= নিজেদের-নিজের।] ইচ্ছামতো ঘর সাজাতে শুরু করি আমরা।

ছোটবেলা থেকেই আমার পাখি পোষার শখ। গ্রামে যখন ছিলাম, তখন দোয়েল শালিখ থেকে শুরু করে পেঁচা, কাক, কাঠঠোকরা পর্যন্ত পুষেছি। অবশ্য একে ঠিক পোষা বলা যাবে কী-না জানি না, আমি ওদের বাচ্চা অবস্থায় বাসা থেকে ধরে নিয়ে এসে আমার খাঁচায় পুরতাম, আর ঠিকঠাক খাবার-দাবারের আয়োজন করতাম। যাই হোক, শেষতক কেবল একটা শালিখই ছিলো আমার সঙ্গে। এত বাড়ি ছেড়েছি (অর্থাৎ আরেকটা ধরেছিও), কিন্তু এই শালিখ পাখিটাকে কখনও ছাড়িনি। আমার স্ত্রীরও এ-বিষয়ে কোনও আপত্তি ছিল না এতকাল। কিন্তু এই ভদ্রসমাজে এসে তার আপত্তি প্রকাশিত হল। ভদ্রসমাজে শালিখ পোষা মানে নাকি খেজুরগুড় দিয়ে বার্গার খাওয়া। আমি এমনকী জীবনানন্দের উদ্ধৃতি দিয়েও তেমন একটা ফল পাইনি; অনেকের হয়তো এ-পরিবেশে জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশের কথা মনে পড়বে। মনে পড়লেও, আমার স্ত্রী যেন জানে যে, এটা আপনার এমনি-এমনিই মনে পড়েছিল, এ-ঘটনার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

আমার স্ত্রী এমনিতে কিন্তু দয়াপরবশ, যেমন সংসারের প্রায় সকল বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই পাকা হয়। আমি যেহেতু জগতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াশয় নিয়ে গবেষণা করি, বিশেষত আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ইত্যাদি, ফলে তিনি নিজেই নিজের কাঁধে এমন মহাদায়িত্ব নিয়েছেন। তো পাখি-বিষয়ে সাব্যস্ত হল যে, পাখি পুষতেই হবে, এবং টিয়া পাখি পুষতে হবে। শালিখ শিস দিতে জানলেও, কথা তেমন বলতে পারে না। অথচ, টিয়া খুব সুন্দর করে কথা নকল করতে পারে। অতএব শালিখের চেয়ে টিয়া উত্তম, ভদ্রসমাজ বলে কথা! আমি কিন্তু ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ধুর আর পাখিই পুষব না। কিন্তু এই যে তিনি চাপিয়ে দিলেন, পাখি পুষতেই হবে এবং সেটা টিয়া পাখিই হবে, এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় আমার আবেগের প্রতি তিনি কতটা যত্নশীল। আমি অতএব পাখি, এবং অবশ্যই টিয়া পাখি, পোষার বিষয়ে সহমত পোষণ করি।

বাজারে গিয়ে দেখি টিয়া পাখির দর বেশ উঁচু। এমনিতে বাড়ি করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছি। এ-নিয়ে আমি অবশ্য শোককাতর হই না। জগতের সব অর্জনের মধ্যেই হারানোর বেদনা লুকিয়ে থাকে (উল্টো করে কি বলা যায়, অনেক বর্জনের মধ্যেও আনন্দ লুকিয়ে থাকে? না, বলা যাবে না, অনেকেই আমাকে এর জন্য 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দিতে পারেন।)। তা, টিয়া পাখির দর উঁচু হওয়াই স্বাভাবিক, কচুও যখন মিডিয়ার কল্যাণে বনানীতে গিয়ে পৌঁছাল, তখন কচু-এবং-লতির দামও হু-হু করে বেড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, উঁচু দর দেখে মুহূর্তেই একটা ভাবনা মাথায় এল। আজকাল সব কিছুই প্রায় ভাড়ায় পাওয়া যায়, এমনকী জরায়ুও। ফলে, এই নিদেন একটা টিয়া পাখি ভাড়ায় পাওয়া উচিত বলেই আমার মনে হয়েছে। দোকানী আমার প্রস্তাব শুনে স্তম্ভিত হলেও, গররাজি হননি। আমি বললাম, আপনি ভেবে দেখুন। আমার পক্ষ থেকে বেশ কিছু অফারও দিলাম-- দেখুন, বিক্রি করে দিলে একবারই এক থোক টাকা পাবেন। অথচ ভাড়ায় দিলে আপনি প্রতি মাসে থোক-থোক টাকা পাচ্ছেন, আর তাছাড়া শেষ পর্যন্ত টিয়া পাখিটা আপনারই থাকছে। আর এর মধ্যে পাখির কোনও ক্ষতি হলে আমিই সেটার দায় নেব, ইত্যাদি ইত্যাদি। দোকানী কী ভেবে যেন আমার কথায় রাজি হলেন শেষতক।

আমার দিক থেকে ভাবনা ছিল যে, পাখিটা কোনও মতে বাড়িতে নিয়ে যাই। কদিন পর স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেড়ে (অর্থাৎ দোকানীকে ফেরত দিয়ে) দেব। একেবারেই রাজি না হলে, প্রয়োজনে পাখি-অধিকার ফোরামের বরাত দেব। যাই হোক, ভাড়া-টিয়ার প্রথম দুই মাসের অগ্রিম পরিশোধ করলাম। হঠাৎই মনে হল, পাখিটাকে একটু দেখে নেওয়া দরকার। দোকানীও আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন। কিন্তু আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখার কিছু নাই জনাব, এই পাখি বেশ প্রশিক্ষিত। একে নতুন করে ভাষা শেখাতে হবে না। ভাষার ব্যাকরণ ওর কণ্ঠগত। যা বলবেন, তাই শোনাতে পারবে আপনাকে। স্বভাবতই, কিছুটা সময় হয়তো নেবে। আমি তবু বলি, একটা কিছু শোনাক না দেখি। দোকানী তখন ইশারা করলেন পাখিকে। অমনি পাখি গাইতে শুরু করল, পাক সার জমিন...

রাগে ক্ষোভে আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হলাম। দোকানীর কলার চেপে ধরতে গেলাম। দোকানী কায়দা করে সরে গেল। পরে আমাকে বোঝাতে লাগল, জনাব উত্তেজিত হবেন না। এ-গানটি নিশ্চয়ই আগের মালিক ওকে শিখিয়েছে। আপনি ওকে যা শেখাবেন, সেটাই পাখিটি গাইতে পারবে। বিশ্বাস না হয়, নিয়েই দেখুন। আর যদি আপনার শেখানো গান পাখিটি গাইতে না পারে, তখন ফেরত দিয়ে যাবেন। আমি অর্থদণ্ড দিতে রাজি।

আমিও রাজি হলাম। কেননা পরিবর্তনের সুযোগ থাকছে; ক্ষতিপুরণের আশ্বাসও পাওয়া গেছে। আর তাছাড়া যে-পাখি একদিন পাক সার জমিন গেয়েছে, তার মুখে আমি আমার সোনার বাংলা ফোটাবো-- এটাও কম প্রাপ্তি হবে না। অতএব পাখিটা নিয়ে বাড়িমুখে যাত্রা শুরু করি।

আমার স্ত্রীরও বেশ পছন্দ হল পাখিটি। পাখিটা চলনে-বলনে স্মার্ট, দেখতে সুন্দর। কথাও শিখছে বেশ দ্রুত। আমার স্ত্রীও আগ্রহসহকারে পাখিটিকে কথা শেখাচ্ছেন। আমি কিন্তু আমার পরিকল্পনার কথা ভুলিনি। প্রতিদিন রুটিন করে তাকে আমি গান শেখাই। আমার স্ত্রীও আমার চেষ্টা দেখে বিস্মিত। তিনি আবার পাখিদের ভাষাশিক্ষা বিষয়ক একজন গবেষকের সন্ধান পেলেন। তাকেও নিয়ে আসলেন একদিন আমাদের বাড়িতে। তার কাছ থেকে এ-বিষয়ে মূল্যবান সবক নিয়ে আমি নতুন কায়দায় টিয়াকে গান শেখাতে শুরু্ন করি। প্রশিক্ষণ কার্যকরী মনে হল আমার। পাখিটি গান গাইতে শুরু করেছে। অ-কারান্ত, ও-কারান্ত ইত্যাদি জায়গায় প্রথম দিকে খানিকটা সমস্যা ছিল। আমি হাল ছাড়িনি। গান মানে তো কেবলই উচ্চারণ নয়, সুর-তাল-লয় আছে, সঙ্গে আছে হৃদয়ের প্রসঙ্গ।

আমি খুব আবেগ দিয়ে গান গাই। আমার গানের গলা মোটেও ভালো নয়-- এগুলো অবশ্য আমার স্ত্রীর মূল্যায়ন। অতএব এটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নাই। দেখার সুযোগ থাকলেও দেখা ঠিক হবে না। কেননা, ওই যে বলেছি, সম্ভব তথা সুযোগ মানেই ক্ষমতার প্রসঙ্গ। আর ক্ষমতা সর্বদা জাহির করা ঠিক না। আর তাছাড়া এই মূল্যায়নের সঙ্গে আমার নিজেরও বিশেষ দ্বিমত নেই। তবে, আমার গলায় নাকি আবেগের আতিশয্য আছে, সে-কারণে নাকি স্কেল ঠিক থাকে না। এখানেও আমি একমত। এবং বলা যায়, খানিকটা গর্বিত। কেননা, এ-মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে হলেও, অন্তত, আমার যে আবেগ আছে সেটা আমার স্ত্রী ধরতে পেরেছেন। ধন্য পাখি, ধন্য আমার গান।

গান প্রসঙ্গে একটা কথা এখানে সাবধানতবশত বলে রাখি। আমার স্ত্রীর গানের গলা খুব ভালো। আমি অবশ্য এটা প্রকাশ্যে কখনও বলি না, অন্তত ওর সামনে তো কখনোই নয়। কেননা, আমি এ-মন্তব্য করামাত্রই তিনি এটার বিরোধিতা করে বসবেন। বরং আমি উল্টোটা বললে, তিনি হয়তো নিজে থেকেই বলবেন যে, তার গানের গলা সুন্দর। এবং হয়তো উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেক নামি-দামি শিল্পীদের উদ্ধৃতি নিজের মুখে শোনাবেন। সেসব শিল্পীর কারোর নামই আমি হয়তো আগে কখরও শুনিনি। কিন্তু আমি তো সেটা প্রকাশ করি না। উপস্থিত অন্য শ্রোতারা তো আমার মতো অভিজ্ঞ নন, ফলে তাদের অনেকেই হয়তো সেটা প্রকাশ করে ফেলেন, আর অনতিবিলম্বে তোপের মুখে পড়েন। সংগীত বিষয়ে তারা যে খুবই অজ্ঞ, সে-বিষয়ে তাদের অবহিত করা হয়। তখন হয়তো, তাদের মধ্যে অনেকেই একটু মাথা চুলকে সেসব শিল্পীদের একজন বা কয়েকজনের কথা মনে করার চেষ্টা করেন। এবং বলেই ফেলেন যে, ও হ্যাঁ, ওস্তাদ করিমুল্লার কথা বলছেন তো? আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনেরও তো উনার কাছে স্বল্পসময় তালিম নেবার সৌভাগ্য হয়েছে। তো শিল্পী করিমুল্লাহ মুহূর্তেই ওস্তাদ বনে যান। তাতে সুবিধা অনেক। সংগীতবোদ্ধা হিসেবে তিনি বা তারা সূচিবদ্ধ হন। আমি সংগীতবুদ্ধু হিসেবেই পরিগণিত থাকি। তবে আমার স্ত্রীর গানের গলা সত্যিই ভালো। শুধুমাত্র এ-কারণেই তার প্রেমে আমি পতিত হয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর সেই গান প্রথমত বাগানে পরিত্যক্ত হয়, অতঃপর স্লো-গানে, পরবর্তীতে স্লোগানে, এবং আরও পরিপক্ক হয়ে মেশিনগানের গর্জনে রূপ নেয়। আমি পতিত যে হয়েছিলাম, পতিতই থাকি।

অনেকের মতে, আমার হেঁড়ে গলায় গান শুনেই নাকি তার গানের এই ক্রমপরিবর্তন। হতে পারে। অর্থাৎ হতে না-ও পারে। কিংবা না-ও হতে পারে। তবু, ভাড়া-টিয়া এ-বাড়িতে আসার পর থেকে, খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে আমি তালিমে লেগে যাই। আশপাশের কিম্ভুতকিমাকার ভাবী-বৌদিরা আমার তারিফ করেন। এরা মানে বড়লোকের বৌ-শ্যালিকারা, যারা প্রত্যহ সকালে মর্নিং ওয়াকে যান একটা কুত্তা ল'য়ে, মতান্তরে কুত্তাই মর্নিং ওয়াকে যান এদের নিয়ে। সঙ্গে পাহারাদার হিসেবে থাকেন তাদের বাড়ির দু'একজন পরিচারিকা। তো বড়লোকের এসব স্ত্রী-এবং-কুত্তাগণ ২০০ কিলোক্যাল শক্তি যদি পোড়ান হেঁটে, তো ৬০০ কিলোক্যাল ফের গ্রহণ করেন বাসায় ফিরেই। ফলে নেট অর্জন ৪০০ কিলোক্যাল। বিপরীতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের সঙ্গে প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে বের হওয়া পরিচারিকাগণ বাসায় গিয়ে কাজে লেগে যান। ফলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের শরীরগঠনের মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটে, তাদের মনিব-স্ত্রীর শরীরে চর্বি জমার সমানুপাতিক হারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব পরিচারিকাদের সঙ্গে তাদের মালিকদের একটা সহ-অনুভূতিশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তো, এসব ভাবী কিংবা বৌদিরা কিন্তু আমার গলার বা গানের প্রশংসা করেন না, বরং এই যে এমত ভদ্রসমাজে প্রতিদিন ভোরে উঠে সংগীতের রেওয়াজ চলে-- এটাই তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এবং এ-নিয়ে তারা নিজ নিজ সর্বসামপ্রতিক স্বামীদের নিয়ে কপট গোস্বাও প্রকাশ করেন। আমার স্ত্রী এসব ক্ষেত্রে খুবই নিয়ন্ত্রিত আচরণ করেন, যেমন_ আসলেই ভাবী, আমার যে কী ভালো লাগে, ও যখন ভোরে উঠে রেওয়াজ করে। আর তাছাড়া আমি তো একসময় হাতিয়া বেতারের নিয়মিত এবং তালিকাবদ্ধ শিল্পী ছিলাম। বোঝেনই তো, সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি রীতিমতো। মেয়েদের এমনই হয় বুঝলেন ভাবী, সংসারে ঢোকা মানেই শিল্প-সাহিত্য সব শেষ। আর উনি তো বেশ আয়েশেই আছেন। খাওয়া দাওয়া অফিস কবিতা লেখা আর টিয়া পাখিকে গান শেখানো...

এ-পর্যায়ে এসে কিন্তু তিনি নিজেকে নিরস্ত্র করেন, পাছে যথারীতি উনার স্বাভাবিক আচরণে ফিরে যান, আর ভদ্রসমাজে আমাদের মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি তখন আবার একটু হাসি। এমনিতেই হয়তো হাসিহাসিমুখ করেই ছিলাম, তাতে কী! আরেকটু দৃশ্যমান পর্যায়ের হাসি তো আমাদের ভদ্র-অবস্থান আরও উঁচুতেই নিয়ে যাবে, তাই না? স্ত্রীর কাছে মানুষের অনেক কিছুই শেখার থাকে, প্রায় সবকিছুই।
এভাবে ক্রমাগত আমার হেঁড়ে গলায় সংগীত শেখানোর কাজ চলতে লাগল, ভাবিদের প্রশংসাও অব্যাহত থাকল। ভাড়া করা টিয়ার মুখেও গান ফুটতে লাগল। বলা অনাবশ্যক যে, টিয়ার গলাটা খানিক হেঁড়েই শোনায়। কথাটা আমার স্ত্রীর কাছে পাড়তেই তিনি ফের আমার দিকে তার মেশিনগান তাক করলে, আমি বললাম থাক। পাখিটার গলায় চাপ পড়ছে কি না জানার জন্য পাখি-বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, "না সব ঠিকই আছে। আমি অনেক কথা জিজ্ঞেস করলাম, সব তো ঠিকঠাকই বলল।" আমি যেই তাকে গান গাইতে বললাম, তখন ফের হেঁড়ে গলায় গাইতে লাগল। তখন ডাক্তারবাবু আমায় বললেন, "ও বুঝতে পেরেছি। ওর স্বাভাবিক গলায় সমস্যা নেই। যখন শিল্প করতে যায়, তখন একটু অন্যরকম হয়ে যায় আর কী। এটা তো সমস্যাই নয়, বরং স্বাভাবিক। এই যে আবৃত্তি যারা করেন, তাদের সঙ্গে ডাল-চালের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে যান, দেখবেন গলা স্বাভাবিক। জীবনানন্দ নিয়ে কথা বলতে যান, দেখবেন গলা গিয়ে কোথায় ঠেকেছে।" আমি বুঝতে পারি পুরো ঘটনা। ফলে ফি দিয়ে আমি সাততাড়াতাড়ি প্রস্থান করলাম।

বাড়ি এসে টিয়ার জন্য আমার মনটা খারাপ হল ভীষণ। বেচারার কোনও দোষ নেই, অথচ ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। জানি না, বেচারা কী মনে করেছে। একজন সুস্থ মানুষকে সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে গেলে মনের অবস্থা কী হয়, সেটা আমি খুব ভালোই জানি। ফলে, টিয়া বুঝুক আর নাই বুঝুক, আমি ওর কানে-কানে বারবার বলেছি যে, যে-ডাক্তারের কাছে ওকে আমি নিয়ে গেছি, উনি আসলেই কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট নন। এবং এর পরপরই ওর মন ভালো করবার জন্য ওকে আমার সোনার বাংলা গাইতে বললাম। ও গাইল, যথারীতি হেঁড়ে গলায়। কিন্তু ওর মন ভালো হল বলে মনে হল না। ঠিক এমন সময় আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন। ভেতরঘরে গিয়ে দেখি, টেলিভিশনে দেখাচ্ছে দেশের হঠাৎ-আবির্ভূত অচলাবস্থার কথা। এই দেশটা যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, তখনই এমন একটা-কিছু ঘটে যে, ফের পনেরো বছর পিছিয়ে পড়ে। আমি টেলিভিশনের সামনেই বসে থাকলাম, মাথা আর কাজ করছে না।
কিছুক্ষণ বাদে বাইরে আসলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা বাসা বাঁধে। এই পরিকল্পনার কথা আমার স্ত্রী শুনলে আমার আর রক্ষে নেই। গৃহযুদ্ধ বাস্তবিকই গৃহে প্রবেশ করবে। তাই বেরিয়ে পড়লাম বিষয়টা নিয়ে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য। সব শুনে তিনি বেশ উত্তেজিত। নিজে থেকেই তিনি আরও-আরও সমমনা লোকজনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করলেন। সবাই নাকি রাজি। আমাকে তিনি এমনই জানালেন। যথারীতি একটা তারিখও ঠিক হল_ ২৬ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক দুঃসম্পর্কের প্রেমিকার মতো হলেও, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ে বাঙালির আবেগের কমতি নেই। জাতীয় সংগীতের প্রতি আমাদের ভালবাসারও ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। সবাই অন্তত এই গানে আলোড়িত হয়। যারা হয় না, তাদের কথা আপাতত থাক, কেননা আমাদের উদ্দিষ্ট শ্রোতা তারা নন। আয়োজন শুরু হয়ে গেল তখন থেকেই।
দিনক্ষণ মোতাবেক আমি আমার টিয়া নিয়ে হাজির হলাম গণজমায়েতে। যেহেতু আমি মঞ্চের পাশেই, ফলে আমি জনসমাবেশের শুরুটাা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু এর শেষ বলে কিছু নেই। আমার হাতে পাখির খাঁচা, ভেতরে টিয়া পাখিরও মন বেশ উৎফুল্ল। গত রাতে আমি ওকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শেষতক কাজটা হলেই হয়। বিভিন্ন দিক থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেল। সব আয়োজন সম্পন্ন। শব্দযন্ত্রে বারবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে_ একটু পরেই আপনারা শুনতে পাবেন টিয়া পাখির কণ্ঠে জাতীয় সংগীত, সম্মানিত সুধী, একটু পরেইঃ
আমার অবস্থান এখন মঞ্চের উপরে, হাতে আমার পাখির খাঁচা, ভেতরে তার টিয়া। নির্দিষ্ট সময়ে আমি মাইক্রোফোনের সামনে গেলাম, আবেগের চোটে আমি কেঁদে ফেললাম। কোনও কথা বলতে পারি নাই। মঞ্চের সামনেই বিশেষ আসনে উপবিষ্ট আমার স্ত্রী। কিন্তু এটাই আমার বাকরুদ্ধ হবার কারণ বলে আমি অন্তত এখন আর মনে করি না। যাই হোক, কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম-- আমার আর কিছুই বলবার নেই। আপনারা বরং আমার টিয়ার গান শুনুন।
শব্দযন্ত্র শেষবারের মতো নিরীক্ষা করা হল। দেশ-বিদেশের সব প্রচারমাধ্যমের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন প্রস্তুত। অনেকেই সরাসরি প্রচার করছে পুরো অনুষ্ঠান। টিয়া পাখির মুখটা আমি মাইক্রোফোনের সামনে নিয়ে গেলাম, এবং গান গাইবার জন্য ইশারা করলাম। কিন্তু পাখিটা আমার দিকেই চেয়ে আছে, গান করছে না। বেচারা বোধ করি ভয় পেয়েছে ভীষণ। আমি ওর দিকে সৌম্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলাম। খানিক বাদেই ফের গান করবার ইশারা করলাম। কিন্তু এবারও গাইছে না। সবার ধৈর্যচু্যতি হবার সম্ভাবনা দেখা দিল। এমন সময় দেখি ভিড় ঠেলে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন এই পাখিটির বিক্রেতা তথা মূল পাখিঅলা। আর চিৎকার করেই বলছেন-- পাখিটাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিন, নইলে গান গাইবে কী করে!

তাইতো তাইতো। নিজের উপর ভীষণ ঘেন্না হল। আমি কতটা অ-পাশবিক। পাখি-অধিকারের প্রসঙ্গটা কী বেমালুম আমি ভুলে গেলাম। তাছাড়া, অনুষ্ঠানটি যেহেতু বিশ্বব্যাপী সরাসরি প্রচারিত হচ্ছে, সেহেতু পাখি-অধিকার সংরক্ষণের কর্মকতর্ারা আমার বিরুদ্ধে আন্তজর্াতিক আদালতে মামলা ঠুকে দিতে পারেন। আমি কণামাত্র দেরি না-করে পাখিটাকে খাঁচা থেকে বের করে দিলাম। ওকে বেশ মুক্ত-নিশ্চিন্ত মনে হল। একটা শিসও বাজাল হঠাৎ করেই। এটি অবশ্য আমার স্ত্রী ওকে শিখিয়েছিলেন। যাই হোক, নিশ্চিত হওয়া গেল যে, টিয়া এবার গান করবে।

আমি আমার হাতের উপর টিয়াকে বসতে দিয়ে ওর মুখটা মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে দিলাম। যারা এরই মধ্যে বসে পড়েছিলেন, তারাও সবাই দাঁড়ালেন ফের। জাতীয় সংগীত বলে কথা।

উপস্থিত জনতার হট্টগোলের মধ্যে পশ্চিম-আকাশের দিকে উড়ে যাবার আগে পাখিটি গেয়ে উঠেছিল-- পাক সার জমিন সাদ বাদ
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×