অসাধ্য সাধন করল শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাঙ্গালির গৌরবোজ্জল ইতিহাসকে আলপনার শৈল্পিক ছোঁয়ায় রাঙ্গিয়ে ক্যাম্পাসকে করেছেন গৌরবান্বিত। ২০১৩ সালের ৮ ই মার্চ শুক্রবারে যে স্বপ্নযাত্রার সুচনা হয়েছিল তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ১১ই মার্চ সোমবারে। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করল শাবিপ্রবির দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীরা চার দিনে বাংলাদেশের ৬১ বছরের ইতিহাস তুলির আঁচড়ে তার ক্যাম্পাসে ফুটিয়ে তুলেছে।
অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে ১০ টি দলে ভাগ হয়ে ৪ প্রহর ৪ রাত টানা তুলি চালিয়ে গেছেন বিশাল কর্মযজ্ঞের যোদ্ধারা। প্রতিটি দলে একজন করে দল নেতা ছিলেন। ১.৭৫ কিলোমিটারের প্রতিটি অংশে ধাপে ধাপে ইতিহাসকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে দৃষ্টি নন্দন এক কিলো রাস্তার দুই ভাগেই ছিল রং তুলির সমাহার। বাম রাস্তায় আঁকা হয়েছে ১৯৫২ থেকে ৭০ এর নির্বাচনের বিভিন্ন স্মারক ও আমাদের প্রিয় বর্ণমালা। ডান পাশে লেখা হয়েছে বিস্তারিত ইতিহাস। তুলির আঁচড়ে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি। ভাষা আন্দোলনে লেখা বিখ্যাত কবিতার বিখ্যাত চরন। রক্তে আগুন ঝরানো কবিতার লাইনে রঙ্গিন হয়েছে পিচ ঢালা পথ। বাদ যায় নি লেখকেরাও। প্রত্যকের কর্মের সাথে তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে সবিস্তারে। অমর কবিদেরকে তাদের সৃষ্টির মতই গুরত্ব দেয়া হয়েছে। প্রাচীন কবিদের মধ্যে উঠে এসেছে আব্দুল কাদিরের নাম। বঙ্গবানী কবিতার বিখ্যাত চরণ
যেসব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
লেখার মাধ্যমে আজকের দেশ বিরোধীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই কিছু মানুষ বাংলার বিরুদ্ধাচারন করেছে।
রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শরত চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, শওকত ওসমান, মুজতবা আলী সহ আরও অনেক কবি সাহিত্যিকের উপাধি সহ তাদেরকে স্মরণ করা হয়েছে। তাদের বিখ্যাত কবিতার লাইন গুলো ছিল আলপনার অলংকার।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন সংগঠনের ভুমিকা ও ভাষা আন্দোলনের অমর গান ও তাদের রচনার ইতিহাস স্থান পেয়েছে। ভাষা শহিদদের নাম ও অবদানকে দেয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
এর পরপরই তুলে ধরা হয়েছে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সময় কালের সংগ্রামী ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশ। যার মধ্যে রয়েছে অস্থায়ী শহীদ মিনার ভাঙা, স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস। মসজিদের সামনের রাস্তায় তুলে ধরা হয়েছে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ইতিহাস, যার মধ্যে রয়েছে ছয় দফা আন্দোলন।
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি এবং ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার কালো অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে আইসিটি বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তা থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত অংশে।
ঊনসত্তরের গন অভ্যুত্থানের নায়ক আসাদকে নিয়ে লেখা শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ছয় দফা দাবির প্রক্ষাপট ও তার ফলাফল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ইতিহাসের বাঁক নেওয়া সবকিছুর দেখা পাওয়া যাবে শাবিপ্রবির আলপনা উৎসবে।
গোল চত্বর থেকে শাহপরান হল পর্যন্ত ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সালের প্রজন্ম চত্বরের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শাবিপ্রবির অঙ্গনে স্থান দিতে পেরে ক্যাম্পাস হয়েছে ধন্য। গোল চত্বরকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে বিজয় দিবসের চমৎকার আলপনা। এরপর এসেছে রাজাকারের ফাঁসি চাই, বাংলার দামাল ছেলেদের ৭১ এর হাতিয়ার, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। ইউনিভার্সিটি সেন্টার থেকে গোলচত্বর, রাস্তার এ অংশে স্থান পেয়েছে ১৯৭৫ থেকে ২০১৩’র উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী। যার মধ্যে আছে ১৯৭৫-এর ভয়াল কালো রাত আর জেলহত্যার মতো মর্মস্পর্শী ঘটনা।
আরও আছে ১৯৮৫’র সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া স্বৈরাচার পতন আন্দোলন, ১৯৯২’র শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ঘোষণা, যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ২০০৮ সালে গঠিত ট্রাইব্যুনাল এবং সবশেষে ২০১৩ সালের চলমান গণজাগরণ। এই অংশের কাজটুকু গোলচত্বরে এসে শেষ হয়েছে
গুরত্ব দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালের গন জাগরণকে। গন জাগরণের বিভিন্ন ধাপ ও সফলতা উল্লেখ করা হয়েছে এই মহান কর্ম যজ্ঞে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গন জাগরণের সাথে উঠে এসেছে সিলেটের গন জাগরণের ইতিহাসও।
নবীন হিসেবে ইতিহাসের অংশ না হওয়াটা শাবিপ্রবির জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাসকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার এই যে প্রচেষ্টা এটা অত্যন্ত গৌরবের। বিশ্ববিদ্যালয়য়ের প্রতিটি প্রান্ত আজ ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের নিয়ে এই ক্যাম্পাসে আসছেন এবং রংতুলির ছোঁয়ায় ফুটে উঠা শিল্পে তাদের সন্তানদের ইতিহাসের পাঠ দিচ্ছেন। এই প্রজন্ম কখনও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির কবলে পড়বে না।
আমরা যখন এই আলপনার স্পর্শে আসি তখন মনে একটা আনন্দ বিরাজ করে। আমাদের ইতিহাস কতটা শক্তিশালী তা এখানে না আসলে বুঝা যাবে না। যারা জামাত-শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট তারা যদি একটি বার এই মহাযজ্ঞে আসেন তবে তারা সত্যিই বুঝবেন যে তাদেরকে ইতিহাসের সঠিক পাঠ দেয়া হয় নি। তাদেরকে অহংকারের ইতিহাস না দিয়ে ঘৃণার পাঠ দেয়া হয়েছে।
৪ দিন ৪ রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে যারা শাবিপ্রবির এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন তারা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৪৭