somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালোবাসার যাদুকরী মহিমা

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিবাহিতরা ভালো সৈনিক হতে পারে না, এই অজুহাতে ২৭০ খৃস্টাব্দের দিকে রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তরুণ-তরুণীদের বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইন গোপনে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসাহিত ও বিয়ের ব্যবস্থা করতে থাকেন। খবর পেয়ে সম্রাট তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। সম্রাট অবশ্য ভ্যালেন্টাইনের প্রত্যয় ও প্রেমের প্রতি অবিচল বিশ্বাসে মোহিত হয়ে শর্তসাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শর্ত হিসেবে তাঁকে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে রোমান দেবতার প্রতি অনুরক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। ভ্যালেন্টাইন রাজি হননি বরং সম্রাটকেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। পরিণতিতে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপনের রেওয়াজ চালু হয়েছে। অবশ্য, এই কাহিনী তথা ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস, একে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপি ব্যাবসা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপোযোগিতা নিয়ে রয়েছে ম্যালা বিতর্ক। আমরা সেদিকে যাবনা। কীভাবে এলো, কারা আনলো ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এই দিবস সেই ‘ভালোবাসা’ কিন্তু সার্বজনিন। স্থান, কাল, পাত্র বা জাত-গোষ্ঠীতে বিভাজন বা পার্থক্য থাকলেও ভালোবাসা উপলব্ধি বা আকাঙ্ক্ষায় কারো আগ্রহের কমতি নেই। সেই ভালোবাসা নিয়েই আজকের আলোচনা।

‘ভালোবাসা কাকে বলে?’ সম্ভবত অতি পুরাতন কিন্তু সবসময়ের আকর্ষণীয় এবং রহস্যময় প্রশ্ন। যুগে যুগে হাজারো কবি, সাহিত্যক, দার্শনিক আর অধুনাকালে বিজ্ঞান সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে কোনও সন্দেহ নেই। কোন সাধারণ বা সরল সূত্র দিয়ে ভালোবাসাকে প্রকাশ করা খুবই দুরহ। ভালোবাসার অনুভুতি অনেক বেশি ব্যাক্তি-আপেক্ষিক। এই অনুভুতির সূত্র ধরে বলা যায়, ভালোবাসা একটা আবেগ যেটা ভীষণভাবে অনুভুত হয়। যেমনটা হয়, ঘৃণার বেলায়, দুঃখের সময় অথবা রাগান্বিত হলে। তীব্র অপছন্দ থেকে ঘৃণা তৈরি হয়। আমরা অপছন্দের জিনিস বা ব্যক্তি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। সেটার কোন মঙ্গল চাই না। বরঞ্চ ধ্বংস হলেই ভালো। অন্যদিকে, ভালোবাসা হলো কাছে টানার, একত্রিত হওয়ার, বিকশিত হওয়ার আবেগ। এই আবেগ সামান্য কিছু সময় থেকে অনেক বছরব্যাপি উপলুব্ধ হতে পারে। বিজ্ঞান বলছে এগুলো আমাদের প্রাথমিক আবেগ যা সবার মাঝে থাকে। মস্তিস্কে লিম্বিক সিস্টেম নামে একগুচ্ছ ব্রেইন স্ট্রাকচার রয়েছে যা মুলত এই আবেগগুলোর জন্য দায়ী। আর আবেগগুলো দায়ী সৃষ্টি অথবা ধ্বংসে।

অন্য মানুষের অন্দরমহলে কী ঘটছে, কী চাচ্ছে সে অবচেতনে সেটা বুঝতে সাহায্য করে আমাদের আবেগ। আমরা অন্যের অনুভুতি খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারি এবং সে অনুসারে নিজের চিন্তা, অনুভুতি, অথবা কার্যক্রম সাজিয়ে ফেলি। এই বিষয়টাকে শারীরবিদরা নাম দিয়েছেন ‘লিম্বিক অনুরণন’ (Limbic Reasonace)। অবাচনিকভাবে এবং অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সাথে পরস্পরের আবেগ অনুভুতিগুলো বিনিময় হয়ে খাপ খেয়ে যায়। এই আবেগীয় খাপ খাওয়াটাই আসলে ভালোবাসা। আর এই জন্যই বুঝি দু’জন দু’জনের সান্নিধ্য বা তাকিয়ে থাকার মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা চরমভাবে পুলকিত হন। চোখ যে মনের সদর দরজা। এভাবে একটা গভীর, আন্ত-ব্যাক্তিক সম্পর্ক তৈরি হয়, অনেকটা অবচেতনে। অন্যের আবেগীয় চাহিদাগুলো বোঝার এবং সেই অনুসারে আবেগীয় প্রতি-উত্তর দেয়ার ক্ষমতার মধ্যে একটা ছান্দিক মিলন ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে। সেটা হতে পারে মায়ের সাথে শিশুর অথবা প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে।

ভালোবাসার ধরনের মধ্যেও ভিন্নতা থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা একটা সাধারণ সূত্র দেয়ার চেষ্টা করেছেন, যেখানে পরিপূর্ণ ভালোবাসাকে দেখা হচ্ছে চরম আবেগ, প্রতিশ্রুতি আর পারস্পরিক অন্তরঙ্গের সুষম মিশ্রণ হিসেবে। অনেকটা সমবাহু ত্রিভুজের তিন বাহুর মতো। যদি, তিনটা বাহু সমান না হয়? তাহলে, ভালোবাসা হবে তবে অসম্পূর্ণ। যেমন, শুধু অন্তরঙ্গ থাকলে সেটাকে পছন্দ বলা যায়। আবার ভালোবাসায় বিমুগ্ধদের মধ্যে শুধু তীব্র আবেগ থাকে, প্রতিশ্রুতি, অন্তরঙ্গের বালাই নেই।

একজন মানুষ ভালোবাসায় পড়লে বা ভালোবাসা পেলে কী অনুভব করে? লেখক-নির্মাতারা সুচারুভাবে সেই চিত্রায়ন করার প্রয়াস চালিয়েছেন বা যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। আমরা দেখেছি, প্রেমে পড়লে মানুষকে একটু বোকা অথবা সাহসী হতে। অন্যসব চিন্তা বা কাজকর্ম ফেলে শুধু ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে। একটা অদৃশ্য কিন্তু স্পস্টত অনুমেয় ঘোরের মধ্যে থাকতে দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা ব্রেইন এর পরীক্ষা (এফএমআরআই) করে দেখেছেন এ সময় প্রেমিক-প্রেমিকার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামক এক রাসয়ায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটে। অবশ্য অন্য কোনও কারণেও শরীরে ডোপামিন বৃদ্ধি পেতে পারে। যেমন, ড্রাগ। আবার এই ঘোর দীর্ঘদিন স্থায়ী নাও হতে পারে। হয়তোবা, এই ঘোর রূপান্তরিত হয় সচেতনতায়, সামাজিকতায়।

পরিপূর্ণ ভালোবাসায় মগ্ন একজন মানুষের দেহ ও মন দুটোতেই ব্যপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সে তার ভেতরের আবেগ অনুভূতিগুলোর সাক্ষাৎ পায় অন্যের ভালোবাসার মাধ্যমে। বুঝতে পারে ‘আমার আমি’কে। নান্দনিক সৌন্দর্য তাকে যেন শীত কালে গরম চাদরের মতো মুড়িয়ে রাখে। সঙ্গত কারণেই অন্য নেতিবাচক আবেগগুলো দুর্বল হতে থাকে। রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, ক্রোধ ব্যপকভাবে হ্রাস পায়। ফলে, নিজের প্রতি আস্থা বেড়ে যায়। নিজেকে মুল্যবান ভাবতে পারে, নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। একবুক সাহস নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে থাকে। এতদিন শুধু অন্যদের রোল মডেল ভাবতো, এখন নিজেকেও তাদের মতো ভাবতে পারে।

পরিপূর্ণ এই ভালোবাসার জন্য উভয়ের মধ্যে সমানভাবে আবেগীয় অনুরণন (Emotional Reasonance) হওয়া আবশ্যক। তার উপস্থিতি, স্পর্শ, চোখ, ঘ্রাণ যদি আমাকে মোহিত না করে, পুলকিত না করে, তাহলে সেই ভালোবাসায় সম্পূর্ণতা আসে না। অনেককে দেখা যায়, ভালোবাসার জন্য বাজারের লিস্টের মতো বিশাল লম্বা একটা ক্রাইটেরিয়ার ফর্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। হেলদি, ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ হতে হবে, লাগবে অমুক, থাকতে হবে তমুক। প্রকৃত ভালোবাসায় এসবেই কী মুখ্য? এসব শর্তযুক্ত ভালোবাসায় স্বস্তি থাকে না, থাকে শংকা। যদি শর্ত পূরণ না হয়? নিজেকে না জেনে, নিজের মনের কথা না শুনে, অন্যের আবেগ না বুঝে, শুধু ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে ভালোবাসার জন্য হুরুহুরি করলে কোন লাভ হয় না। এতে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ভালোবাসার যাদুকরী মহিমায় জড়িয়ে পড়ার সুযোগ মানুষের জন্য একটি অপরিসীম পাওয়া। বিবর্তনবাদের মতে নিজের প্রজাতি রক্ষার তাগিদেই মানুষ ভালোবাসে, প্রণয় করে। কারণ যাই-ই হোক না কেন, ভালোবাসার অকৃত্রিম স্বাদ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসাকে নিয়ে ভালোভাবে ভাবার সুযোগ করে দিবে, সবার মনে সঞ্চার করবে প্রেম, এই প্রত্যাশা রইল।

--আজহার
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×