somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন এক মে মাসে সিরাজুল বাঁচতে চেয়েছিলো

২৭ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বন্ধুদের মধ্যে যার কথা সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে, সে সিরাজুল। অথচ তার সাথে আমার তেমন কোন আহামরি সম্পর্ক ছিলো না, যেমনটা দোস্তদের মধ্যে হয়। কলেজে আসতো, ক্লাসে এটেন্ড করতো, স্যারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো, এই যা, যেমন আমিও। সিরাজুলের মাথাভর্তি চুল, সরল অভিব্যক্তি, হ্যাঁ বলার ধরণ, অবাক হবার ক্ষমতা সব মিলে আমি তাকে মনে রেখেছি এরকমও না কিন্তু, আবার এটাও না যে সে খুব ভালো ছাত্র ছিলো, সারাক্ষণ সবার সাথে লেগে থাকতো, কিংবা বিনয়ী কিংবা লাজুক কিংবা দুঃখী কিংবা সাধাসিদা খুব। আমার অন্য বন্ধুদের সাথে অনেক স্মৃতি আছে যাদেরকে জীবনের পড়ন্তবেলায় এসেও মনে করতে হবে,এমন কিছু আছে যেটা অতলান্ত হৃদয়ের মাঝে গাঁথা, অথচ সিরাজুলের সাথে বস্তুত আমার কোন স্মৃতিই নেই মনে রাখার মত। ডাকবাংলোর মসজিদে দুয়েকদিন যোহরের নামাজে সিরাজুলকে দেখেছি আলাদা করে, কলেজের বাইরে, এরপর আর কোন আলাদা স্মৃতি পর্যন্ত নেই। অথচ বন্ধুদের মুখ মনে করতে গেলে ওর মুখটাই একটা সহজপাঠ আয়না হয়ে সামনে ঝুলে থাকে।

মরে গেলে কি সবকিছু স্মৃতিবহ অর্থবহ হয়ে যায়? লাভ কি তাতে।কার লাভ?


সিরাজুলের সাথে আমার পরের ঘনিষ্ঠতা একটু জটিলই। যোগাযোগহীন অনেকদিন পরে জানলাম সিরাজুল ক্যান্সারে আক্রান্ত। সিলেটের ডাক্তারদের রেফারেন্সে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে, দীর্ঘ ঝামেলা মাড়িয়ে ঢাকা মেডিকেলের সিটে শুয়ে সিরাজুল ভাবছে কিংবা ভাবেনিকে জানে, আমাদের কথা। জানার পরে কোন একদিন অফিসের ফাঁকে, কিংবা এক শুক্রবারে দেখতে গেলাম, আহা সেই মুখ আমি দেখি নি কোনোদিন। রেডিয়েশনে পড়া চুলে সিরাজুল এক আগন্তুক কোন, যার সাথে আমার কোন সংস্পর্শই নেই। অথবা অনেকদিন না দেখা বলে কিংবা দূরত্ব ডিঙ্গানোর ব্যর্থতায় কেউ কাউরে অভিযোগ করিনি, জানলাম রোগের আদিঅন্ত। আমার সাথে বেশ কদিন ছিলো তারপর, মেডিকেলের বারান্দায় আমিও কদিন দেখতে গেছি তাকে, ভিতরে যেতে আমার ভয় বলে। অনেকগুলো থেরাপির ফলে চুল সব ঝরে গেছে, শরীরে অনেক রোগের জীবাণু , পেট খারাপ, এলার্জি এসব সয়েও বলতো বেঁচে উঠার গল্প, পরীক্ষার কথা, এমনকি ওর একটা চাকরী কনফার্ম হবার কথাও। আমি নীরব শ্রোতা না হয়ে আশ্বাস দিয়েছি, গল্প বলেছি জাতিস্মরের, আমাদের ফেলে আসা বন্ধুত্বের রেশটুকুকে বেশ করে ঝালিয়ে ঘষামাজা করে আবার নতুন করে রাঙতাকাগজে মুড়ে বেঁচে উঠতে চেয়েছি দুজনেই।অমন সরল একটা মুখ, যে মুখের রেখা দৃশ্যমান ক্রমশ, যার শেষদিনগুলো কোন এক বন্ধুকে পেয়ে সামান্য ঝিলিক দিচ্ছে, আর প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ক্লান্ত হতে হতে বেঁচে উঠার গল্প ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে, আর আমি প্রতিদিন তাকে দেখতে আসার আশ্বাস দিয়ে মিথ্যেমিথ্যে কোন এক মানুষের গল্প বলছি, যে এর থেকেও ভয়ংকর ফেজ থেকে সেরে উঠছে দিব্যি। সিরাজুল জানতো কি কিংবা জানতো না বোধহয়, ও আর বাঁচবে না। আমি কিছুই ভাবিনি, সত্যিকথা বলতে কি এতোকম বয়সে একটা মানুষ মারা যাচ্ছে একথা মুখে আনতে আমার বুকে আটকে যেতো, তারোপর আমার বন্ধু। অবিশ্বাস্য দোলাচলে দুলতে দুলতে সিরাজুল জানাতো তার রক্তকণিকার কমে যাওয়া রিপোর্টের আদিঅন্ত, জানাতো ব্লাডকাউণ্ট আর মাথার পড়াচুলের হিশেবনিকেষ, এমনভাবে বলতো যেনো সংসারের দরকারি কোন জিনিশের ডিটেইলিং দিচ্ছে। আমি অবাক হতাম না, আমি জেনে গেছি ততদিনে ওর প্রাণশক্তি শেষ হবার আগের রেশটুকু একসাথে আলো দিচ্ছে, দপ করে নিভে যাবে হঠাৎ। (ক্ষমা করিস সিরাজুল,একথা তোরে বলিনি কোনোদিন, বললে বোধহয় আমাকে করুণা করতি)।


থেরাপি শেষে কিছুই খেতে পারতো না, হজম শক্তি কমে যাওয়া সহ আরো নানাবিধ জীবাণু নিয়ে কদিন মেডিকেলের বেডে কদিন আমার সাথে, পরে বাড়ী চলে গেলে ফোনেই কথা হতো সামান্য। আমাদের অনেক বন্ধুদের কাউকেই আমি রিচ করতে পারিনি সিরাজুলকে বাঁচাতে, তারপরো চেষ্টা করেছিলাম, হয়নি। কিছু মানুষ আশ্বাসবাণী শুনাতে সবসময়ই ওস্তাদ, তাদের অমৃতবাণীকে আমি পরম ভেবে ভুল করে অনেক কিছু শিখেছি যদিও কিন্তু যার জন্য এ আয়োজন তাকে তো আর ধরে রাখা যায়নি, সিরাজুলকে বলিনি এসব, শুনলে কষ্ট পাবে, তাছাড়া সে নিজেও অনেকের আশ্বাস শুনতে শুনতে নিজেরে অপাংক্তেয় ভাবা শুরু করে দিয়েছিলো আগেই। সিরাজুল বাড়ীতেই ছিলো, স্বজনদের মাঝে, বোনদের কথা খুব বলতো ও, বড়াপুকে রক্ত দিতে গিয়েই তো জানা গেলো ওর রক্তের ভিতর ক্যান্সারের জীবাণু, আর এসব নিয়েও সে দিব্যিই আছে।


কোন এক মে মাসে সিরাজুল বাঁচতে চেয়েছিলো, বাঁচাতে পারিনি আমাদের অক্ষমতা, আমাদের দীনতা, ক্ষমা করিস সিরাজুল। এক ভোরে আমি জানলাম সিরাজুল আর নেই। আমি শুনেছি কিংবা শুনিনি কিংবা কেউ আমাকে বলেই নি সিরাজুলের কথা এরকম করে ভাবতে থাকি, ভাবতেই থাকি।


১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×