somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নো নেটওয়ার্ক কাভারেজ

১০ ই মে, ২০১২ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এমন একটা সময় ছিল… হ্যাঁ, রুপকথা নয়। খুবই নিকট অতীতের কথাই বলছি। চিঠিই ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। টি এন্ড টির ফোন কল ক’জনের ভাগ্যেই বা জুটতো! মাঝে মাঝে খুবই জরুরী প্রয়োজনে গুনতে হতো মিনিট প্রতি টাকা! এছাড়া চিঠির মাধ্যমেই হতো নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের হৃদয়ের নিবিড় কথোপকথন। দু’টাকার খামেই সীমাবদ্ধ ছিলো অজস্র কথামালা। আজ আর তা নেই। আজ চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন।

মোবাইল বিপ্লবের এই যুগে এসে লক্ষ্য করলাম চারপাশে প্রায় সবার হাতেই শোভা পাচ্ছে লেটেস্ট মডেলের এক একটি মোবাইল। যাদের হাতে মোবাইল নেই, তারাও কাগজে লিখে একটি নাম্বার দেয়- “রুমমটের নাম্বার, অন রিকোয়েস্ট!”

আমারও এক সময় মোবাইল ছাড়া নিজেকে ‘মোবাইল’ অর্থাৎ ভাসমান মনে হতে লাগলো। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠে তাই বহু কষ্ট করে টিউশনির টাকা জমিয়ে একদিন একটা নতুন সিম কার্ড এবং একটা সেকেন্ড –হ্যান্ড মোবাইল সেট কিনে ফেললাম। আমিও হয়ে গেলাম মোবাইল ফনের একজন গর্বিত মালিক।
সেই মোবাইল ফোনে অনেক কথা বলেছি, ইথারে ভেসে গিয়েছে অনেক শব্দ মালা। সময় এগিয়েছে আর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গিয়েছে কথার পরিধি।

প্রথম প্রথম মোবাইলটি আগলে রাখতাম যক্ষের ধনের মতো। ভয় হতো কখন মোবাইলটি হারিয়ে যায় কিংবা ছিনতাই হয়ে যায়! রাস্তায় হাঁটার সময় কিছুক্ষণ পরপরই পকেট হাতড়ে নিশ্চিত হয়ে নিতাম মোবাইলের অস্তিত্ব সম্পর্কে। পাবলিক বাসে পারতপক্ষে উঠতাম না। একান্ত উঠতে হলেও একটি হাত সবসময় থাকতো পকেটে। অবশ্য পরবরতীতে এ অনুভূতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে।

এক সময় লক্ষ্য করলাম, মোবাইল বিহীন অবস্থায় যাদের সাথে আমার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো, তাদের সাথে আর দেখাই হয় না! শুধু ফোনেই কয়েক মিনিটের জন্য পাই! যাদের সাথে চিঠিতে হতো হৃদয়ের সহজ আলাপন, তাদের সাথে চিঠি আদান-প্রদান আস্তে আস্তে কমে এলো। “ দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন” – গ্রামীণ ফোনের এই শ্লোগানটা মনের মধ্যে আওড়ে চলি, আথচ ঠিকই অনুভব করতে পারি, মোবাইল ফোন আমাদের যান্ত্রিক যোগাযোগটা অনেক সহজ করে দিলেও আমাদের আত্মিক দূরত্বটা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন! মানবিক সম্পর্ক গুলো আজ প্রযুক্তির কল্যাণে বড় বেশি যান্ত্রিক রুপ লাভ করেছে।

এখন মোবাইলের সাথে মোবাইলের টেলিকনফারেন্স হয়, কিন্তু খোলা আকাশের নীচে মখমলের মতো ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে আগের সেই অকৃত্রিম ও প্রাঞ্জল আড্ডাটি আর দেয়া হয় না। এখন আর মায়ের বকুনিতে ঘুম ভাঙ্গে না, মোবাইল ফোন তার আগেই কর্কশ শব্দে জাগিয়ে দেয়!

ডাইভারসিটি ভিসার কল্যানে যুক্তরাষ্ট প্রবাসী যে বন্ধুটির দীর্ঘ চিঠি পড়তে পড়তে অশ্রুভারে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতো, আজ মোবাইলের কল্যাণে মাঝে মাঝে ক্ষণিক সময়ের জন্য তার ইংরেজী-বাংলা মেশানো কথা শুনতে পাই, তার কাছ থেকে পাই ইন্টারনেটে চ্যাটিং এর আমন্ত্রণ! সৌদী প্রবাসী ছোট চাচার ভুল বানান সমৃদ্ধ আগেকার সেই চিঠি গুলো আমি এখনো মাঝে মাঝে পড়ি। পড়ি আর ভাবি- দীর্ঘ সূত্রিতার মাঝেও কত সহজ-সরল ছিলো আমদের জীবন!

মানুষ এখন ‘মোবাইল’ নামের এই যোগাযোগ যন্ত্রের মাধ্যমে যত কথা বলে, অন্য কোন উপায়ে বোধহয় এত কথা বলে না। বিজ্ঞাপনের ভাষায় – ‘ইস কত কথা বলেরে!’ আশেষ কথার মাঝে আসল কথা টি প্রায় সময় অনুক্ত থেকে যায়। মোবাইলে সবাই কাছে থাকের অঙ্গীকারই করে কিন্তু দূরত্ব ক্রমশঃ বেড়েই চলে।

কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। দেখা হলো শৈশবের এক বন্ধুর সাথে। একথা ওকথার পর সেও পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে। আমার নাম্বার জেনে নিয়ে একটা মিসড কল দেয়। আমি সেটা মোবাইলে সেভ করে রাখি। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে তাকে কল করার চেষ্টা করি। কিন্তু আধিকাংশ সময় কল যায় না। নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকে বন্ধুটি!

এক সময় হুট করে মরে গেলো নানীটা। যার কোলে মাথা রেখে চাঁদের বুড়ির গল্প শুনতে শুনতে আমি বড় হয়েছি। নানীর জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময় জীবিকার সন্ধানে আমাকে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়েছে। তখন তার সাথে অনেক কথা বলেছি বহু স্মৃতিবিজড়িত আমার এ মোবাইলে। এখনো মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে হয়। বেশী না! মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য যদি একটু কথা বলতে পারতাম! কিন্তু যতবারই তার সাথে কথা বলার ইচ্ছে জাগে ততবারই মনের স্ক্রিনে শুধু একটি কথাই ভেসে ওঠে- “নো নেটওয়ার্ক কাভারেজ!”

মোবাইল বিপ্লবের পর আজ আমারা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি। আমদের জীবনের সবকিছুই আজ ডিজিটাল। আমাদের প্রিয় দেশটির নাম আজ “ডিজিটাল বাংলাদেশ” । আমরা আশান্বিত হই! কিন্তু দিনদিন আমরা যতই ডিজিটাল হচ্ছি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ছে দারিদ্র্য এবং বেকারত্বর ‘ডিজিট’! বাড়ছে ছিন্নমূল মানুষের ‘ডিজিট’! তার চেয়েও দ্রুত গতিতে বাড়ছে বস্তি-ছাউনি! আমাদের যান্ত্রিক নেটওয়ার্ক বাড়ছে, কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতার নেটওয়ার্ক থেকে। জাতি হিসেবে আমরাও হয়ে পড়ছি বিচ্ছিন্ন।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আমারা- ‘আশরাফুল মাখলুকাত!’ আমরা বিশ্বাসীরা প্রতিদিন স্রষ্টার সামনে মাথা নত করি। প্রতিদিন সাধনা করি তাঁর সান্নিধ্য লাভের। প্রতি সকাল- সন্ধ্যায় নামাজে দাঁড়িয়ে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালাই। কিন্তু হৃদয়ের ভেতর কী কোন সাড়া পাই? প্রতিবারই আত্মার ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়- “নো নেটওয়ার্ক কাভারেজ!” আমাদের অনুভূতির এন্টেনাগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে!
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×