বাবুল আবদুল গফুর
বিষয়টি স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীত! উল্টো। তবু আমাদের স্বার্থের জন্য বলতে হবে।
তার আগে ছোট্ট একটি ঘটনা বলি। এক শীতপ্রধান দেশে শীতের মৌসুম শুরু হলো। এক লোক আগুন পোহার জন্য প্রথমে তার জোগাড় করা লাকড়ি পোড়ালো, তারপর কাপড় চোপড়। এভাবে একদিন দেখা গেলো আগুন পোহানোর জন্য তার কাছে আর কিছুই নেই। শেষমেষ সে নিজের ঘরেই আগুন দিয়ে দিলো। রোহিঙ্গা ইস্যু কি সেই রকম পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে না?
রোহিঙ্গা নিপীড়ন নতুন কিছু নয়। আগেও হয়েছে। সামনেও থামবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীতে মুসলিম অধ্যূষিত রাষ্ট্র হলো ৬৫টি। যার মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১৪২ কোটি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬%। ২০১৫ এর আদমশুমারি অনুযায়ী মায়ানমারের মোট জনসংখ্যা হলো ৬০,০৭৭,৬৮৯ জন (জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী যা পৃথিবীতে ২৪তম)। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা হলো আনুমানিক ১৪ লক্ষ। যাদের অধিকাংশ মুসলিম। যারা শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং, মংডু, কিয়কতাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা, কাইউকপাইউ ইত্যাদি অঞ্চলে এদের অবাধ বসবাস। তাছাড়া মিনবিয়া, মাইবন ও আন এলাকায়ও এরা মিশ্রভাবে বসবাস করে আসতেছে। ১৯৪৮ সালে জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিলো। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মিয়ানমারের রাজনীতিতে নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করেন। মূলত তখন থেকেই রোহিঙ্গারা হয়ে পড়ে অত্যাচারের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সামরিক জান্তা এসব রোহিঙ্গাদেরকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করে। ফলে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। তাদেরকে জোর করে শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। তাদের সন্তান হলে নিবন্ধনের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শিক্ষা দীক্ষা থেকে তাদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়। বিয়ে করার ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। একের পর এক আইন দ্বারা রোহিঙ্গাদের জিবনকে দুর্বিষহ করা তোলা হয়। রোহিঙ্গারা সমগ্র মিয়ানমারে পরিচিত হয়ে উঠে ‘কালা’ নামে। যেটাতে বর্ণবাদি হিন্দুদের মতো প্রকাশ পায় চরম ঘৃণা।
সামরিক জান্তার হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর হতে শুরু হয় রোহিঙ্গা নিপীড়ন। ১৯৯১ সালে ‘অপারেশন পাই থায়া’ শুরু হয়। যার ফলে তখনকার দিনে প্রায় ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে অনেকে এদেশে বিভিন্নভাবে স্থায়ী হয়ে যায়। ২০১৭ সালে এসে একই কায়দায় শুরু হয় তৃতীয় দফা রোহিঙ্গা নিপীড়ন। যার ফলে নাফ নদী সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে অনু্প্রবেশ করেছে এরই মধ্যে ৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ক্ষুদ্র আয়তনের উন্নয়নশীল এ দেশে যেখানে নিজের জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অনু্প্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গা নতুন করে সংকট ও সমস্যার জন্ম দিবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম, বিভিন্ন রাষ্ট্র, তুরস্ক, সৌদি আরব, মালদ্বীপ, ইরাক, পাকিস্তান তাদেরকে সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে, বাড়িয়েছে সাহায্যের হাত। কিন্তু মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) এর বরাতে ইউ থাং টুন বলেছেন, যদের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। তাহলে অনুপ্রবেশকারী এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য কি হবে?
বাংলাদেশ সরকার কি তাদের নাগরিকত্ব দিবে? দিবে না। আবার আরকানেও ফিরে যাওয়া হবে না। এই বৃহৎ আশ্রয় দেওয়া জনগোষ্ঠী যে এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা আনবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। পূর্বেও এদেশের অধিকাংশ অপরাধ, চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদিতে এসব রোহিঙ্গার রয়েছে সরব উপস্থিতি। আমরা মানবতার মায়া কান্না দেখাতে গিয়ে রাষ্ট্রে টেনে আনছি নাতো আরো কিছু বিভৎস ঘটনার উৎস? এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, এসব রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলছে এক প্রকার ব্যবসা। কক্সবাজার, টেকনাফ ও সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জায়গায় চলছে ধর্ষণ, চলছে দেহ ব্যবসা। রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠানো সাহায্য ও মালপত্র নিয়ে দালালি করছে অসংখ্য স্বার্থন্বেষী মানুষ। ইয়াবা পাচারের এক রমরমা ব্যবসাও জমে উঠেছে রোহিঙ্গা সাহায্যের নেপথ্যে।
রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে গিয়ে, মানবতার মহান গান গাইতে গিয়ে নাকি আমরা পড়ে যাচ্ছি কোন ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল- সময় এর সদুত্তর দেবে। তবে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যে আর মিয়ানমারে ফিরে যাবে না তা প্রায় নিশ্চিত। এখন দেখার বিষয় সরকার তাদের ব্যাপারে কতটুকু কি করে!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪১