মেসের যে রুমটাতে আমি থাকি তার একটামাত্র জানালা। সেই জানালাটা খুললেই যে বেলকনিটা দেখা যায়— সেই বেলকনিটার একটা দুঃখ আছে।
বেলকনিটা সুন্দর, ছবির মতো সাজানো গোছানো। রোজ বিকালে যে মেয়েটা সেই বেলকনিতে বসে চা খায়, হালকা সুরের গান শোনে— সেই মেয়েটাও সুন্দর।
মেয়েটাকে শুধু সুন্দর বললে তার উপর অবিচার করা হয়। “অতীব সুন্দরী" বলতে যা বুঝায় মেয়েটা আসলে তাই।
প্রথম যেদিন মেয়েটাকে দেখি সেদিনই টের পাই অদ্ভুত কোন কারণে আমার হার্ট বিট মিস করা শুরু করেছে। সেই বিট মিস করা রোগ এখনো ভালো হয় নি। কোনদিন হবে বলেও মনে হয় না।
মেয়েটা বারান্দায় আসে বিকেলে, চারটার পর। আমি দুপুরের ঘুম কামাই দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করি। বারান্দায় তার জন্য একটা ইজিচেয়ার রাখা আছে। সে ইজিচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দেয়। পাশের মিউজিক সিস্টেমে তখন গান বেজে উঠে — “চোখ তার চোরাবালি, মন যে পাথার!"
মিনিট বিশেক পর কাজের মেয়েটা চা দিয়ে যায়। সেই চায়ে মেয়েটা যখন আলতো করে চুমুক দেয়— আমার মনে হয় সে আসলে চা খাচ্ছে না, পৃথিবীর সবচে' বড় শিল্পকর্মটি সম্পাদন করছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তার চা খাওয়া দেখি। আমারও চায়ের তৃষ্ণা পায়। দৌড়ে রান্নাঘরে যাই। বুয়াকে ভয়ে ভয়ে এক কাপ চায়ের কথা বলি— বুয়া মুখ ঝামটা দেয়। সেই মুখ ঝামটা খেয়ে জানালার পাশে ফিরে আসি। মেয়েটা পরপর দু'কাপ চা খায়। আমার চায়ের তৃষ্ণা আরো বাড়ে। আমার হঠাত্ ইচ্ছে জাগে মেয়েটার পাশে বসে তার চোখে চোখ রেখে তারই হাতে বানানো এক কাপ চা খেতে। আমার সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি সিগারেট ধরাই। শেষ বিকেলে— একেবারে গোধূলি লগ্নে মেয়েটা কছুক্ষণের জন্য আমার জানালার দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে। গোধূলির কন্যা সুন্দর আলোটা তখন রুপবতী মেয়েটার মুখের উপর পড়ে তাকে আরো রুপবতী লাগে। যদিও আমি জানি— মেয়েটা আমাকে দেখে না। সে আসলে কাউকেই দেখে না।
তার দৃষ্টি জুড়ে উদাসীন বিষণ্ণতারা খেলা করে। অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ বেয়ে নেমে আসে মুক্তো দানার মতো দু' ফোঁটা অশ্রু। যেন দৃষ্টসীমার ওপারে গিয়ে কিছু একটা দেখতে চায় সে, কিন্তু দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা তাকে কিছুই দেখতে দেয় না বলেই তার এই অভিমানী অশ্রুবর্ষণ।
নিয়তি বড় অদ্ভুত জিনিস। সে মাঝেমধ্যে কুঁজোকেও চিত্ হয়ে শোয়ার সৌভাগ্য দিয়ে দেয়। সে নিয়মেই একদিন আমি মেয়েটার হাতে হাত রাখতে চাইলাম। সে বলল, ভেবে বলছ তো? যে বেলকনিটাতে আমাকে বসে থাকতে দেখ তার একটা দুঃখ আছে, জানো? সে এতকাল একটা অন্ধ মেয়ের অন্ধ আবেগ, অন্ধ দুঃখবোধ কে সহ্য করে যাচ্ছে। আজ যদি তুমি আমার হাত ধরো তবে সেই দুঃখের ভারটা তোমার ঘাঁড়েও চাপবে। সেই ভার বেলকনিটির সাথে সাথে তোমাকেও আজীবন
বয়ে বেড়াতে হবে।
আমি মেয়েটার হাত দু'টো শক্ত করে ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার ঠোঁটে হাসি, চোখে অশ্রু। এমন অপূর্ব রুপবতী একটা মেয়ে অথচ পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্যের কোন কিছুই দেখার কোন অধিকার তার নেই। কোন মানে হয়?
(সমাপ্ত।)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:২৯