somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না । প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায় যে ডাক্তাররা সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন । নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন একজন রোগীর প্রাণ বাচানোর ক্ষেত্রে । কিন্তু যদি জানতে পারেন যে এই ডাক্টারই আপনার প্রাণ কেড়ে নেওয়ার কারণ এবং এটা সে করছে স্রেফ নেশা থেকে তখন?

আজকে তেমনই একজন ডাক্টারের গল্প । তার নাম হ্যারল্ড ফ্রেডরিক শিপম্যান । তিনি তার জীবদ্দশ্যয় প্রায় ২৩০-২৬০ জন রোগীকে হত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হয় । সংখ্যাটা এর থেকে বেশিও হতে পারে । এবং এই খুন গুলো করেছে একেবারে ঠান্ডা মাথায় ।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সিরিয়াল কিলাররা অতীতের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠে। বেশির সিরিয়াল কিলারদের শৈশব খারাপ ভাবে কাটে কিংবা ভালবাসায় ব্যর্থ বা প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু হ্যারল্ড শিপম্যানের বেলাতে এমন কিছুই ঘটে নি । তার শৈশব বেশ চমৎকার ভাবেই কেটেছে । বাবা মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল সে। কোন সমস্যা ছিল না । অন্য দশটা পরিবারের মতই ছিল হ্যারল্ডের পরিবার ।

কিন্তু হ্যারল্ডের বয়স যখন ১৭ বছর তখন তার মায়ের ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়ে । পরিবারের ভেতরে হ্যারল্ড তার মায়ের সব থেকে কাছের মানুষ ছিল । অসুখ ধরা পড়ার হ্যারল্ড আরও ভাল করে তার মায়ের দেখাশুনা শুরু করে। ডাক্তার তার মায়ের ব্যাথা কমাতে মরফিন দিতেন । এতে সাময়িক ভাবে তার মায়ের ব্যাথা কমে যেত বটে শেষ পর্যন্ত তার মা এই রোগেই মারা যায় । মায়ের মৃত্যুতে হ্যারল্ড খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল।



তবে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশোনাতে বেশ ভাল ছিল। সে ঠিক করল নিজেকে সে চিকিৎসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে । লিডস ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে। এই সময়ে তার পরিচয় হয় প্রিমরোজের সাথে। মাত্র ২০ বছর বয়সেই সে প্রিমরোজকে বিয়ে করে ফেলে । তবে এটা তার লক্ষ থেকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে নি । সে একজন ডাক্তার হিসাবেই পড়াশোনা শেষ করে। কর্মজীবন শুরু করে ইয়র্কশায়ারের জেনারেল ইনফর্মাতিতে । কয়েক বছর সেখানে কাজ করার পরে প্রথম অপরাধটা করে সে । প্রেসক্রিপশন জালিয়াতি করে বিপুল পরিমান ডায়ামরফিন জাতীয় ঔষধ চুরি করে । এক সময়ে ধরা পড়ে সে । তার শাস্তিও হয় । তবে সেটা বড় কিছু ছিল না ।

শাস্তির দুই বছর পরে সে ডনিব্রুক মেডিক্যাল সেন্টারে যোগদান করে। সেখানে ধীরে ধীরে তার নাম ফুটতে থাকে । নিজের অতীত একেবারে মুছে ফেলে সে । সে সবার মাঝে এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে লোকে তাকে গুড ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করে। এরপরই সে তার প্রথম শিকারকে বেছে নেয় ।

হ্যারল্ড খুনের জন্য কেবল নারীদের বেছে নেওয়া শুরু করে এবং সেই সমস্ত নারী যাদের বয়সে বৃদ্ধ । প্রথম গুণটা করে ইভা লিওন্স । তার বয়স ছিল একাত্তর বছর । কয়েক বছর আগে চুরি করা সেই মরফিন ওভার ডোজেই ইভাকে খুন করে হ্যারল্ড। এরেপর একের পর এক খুন করতে থাকে যাদের সবাই ছিল বায়োজোস্থ নারী। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সে ডনিব্রুক মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত ছিলেন । এরপর সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস শুরু করেন ।

প্রথম সন্দেহটা আসে ১৯৯৮ সালে । শহরের মৃতদেহ সৎকার করা এক ব্যক্তির মনে সন্দেহ দেখা দেয় । সে খেয়াল করে দেখে শহরে যত মানুষ মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই বয়সে বেশি । এটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে তারা সবাই হ্যারল্ড শিপম্যানের রোগী । তাদের মৃত্যুর লক্ষ্যন গুলো একই রকম। বৃদ্ধরা সামান্য অসুখে হ্যারল্ডের কাছে আসছেন তারপর কিংবা পরের দিনই মারা যাচ্ছেন। এদিকে হ্যারল্ডের সহকর্মী সুসান বুথের মনেও এই একই সন্দেহ দেখা দেয় । থানায় গিয়ে অভিযোগ করা হয় । তবে সেখানে পুলিশ খুব ভাল করে তদন্ত করে নি । ছাড়া পেয়ে যায় হ্যারল্ড । মূলত তার ভাল সুনাম ছড়িয়ে ছিল পুরো শহর জুড়ে । সেটাই তাকে বাঁচিয়ে দেয় ।

তবে নিজের ভুলের কারণেই হ্যারল্ড ধরা পরে যায় । ৮১ বছর বয়স্ক ক্যাথলিন গ্রান্ডি ১৯৯৮ সালের ২৪ জুন যান ডাক্তার হ্যারল্ডের কাছে রুটিন চেকাপের জন্য । এবং ডাক্তার খানা থেকে ফিরে আসার কিছু সময় পড়েই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরেন। হ্যারল্ডকেই ডাকা হয় । সে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই ঘোষণা করেন । বয়স জনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে । তাকে করব দেওয়া হয় ময়নাতদন্ত ছাড়াই । কিন্তু গ্রান্ডির মেয়ে এঞ্জেলা উডরফের মনে একটা সন্দেহের দানা দেখা যায় । পেশায় সে ছিল উকিল । সে তার মায়ের সমস্ত সম্পত্তি নিজের দেখা শোনা করত । এই পর্যন্ত সব ঠিক । কিন্তু যে ভুলটা হ্যারল্ড করল সেটা হচ্ছে সে লোভ করে বসল । মায়ের মৃত্যুর কিছু দিন পরে একটা উইল হাতে আসে এঞ্জেলার । সেখানে দেখা যায় তার মা নিজের সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ দান করেছে হ্যারল্ডের নামে !

দক্ষ উকিল হওয়ার কারণে এঞ্জেলার বুঝতে কষ্ট হয় না যে উইলটা নকল । তার মনে তো সন্দেহ আগে থেকেই ছিল । এরপর সেটা আরও পাকাপোক্ত হয়ে দেখা দেয় । সোজা হাজির হয় থানাতে । লাশ তোলা হয়। ময়নাতদন্ত করা হয় । জানা যায় যে মরফিনের ওভারডোজের মৃত্যু হয়েছে গ্রান্ডির । এবং যখন এটা দেওয়া হয় তখন গ্রান্ডি ছিল হ্যারল্ডের চেম্বারে ।

পুলিশ তদন্ত শুরু করে বেশ জোরেসরেই । আরও প্রায় ১১টা লাশ তোলা হয় এবং দেখা যায় প্রত্যেকের মৃত্যুর কারণ মরফিন ওভারডোজ । হ্যারল্ডের কম্পিউটার থেকে নকল ডেথ সার্টিফিকেট খুজে পায় পুলিশ । একই বছর সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার করা হয় । অক্টবর মাসে তার কেস কোটে ওঠে। ধারণা করা হয় প্রায় আড়াইশ মহিলাকে সে খুন করেছিল তবে মাত্র ১৫ টা খুন প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছিল ।

মোট ১৫ বার যাবজ্জীবনের সাজা হয়েছিল । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে জেলের ভেতরেই থাকতে হত । তবে ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে সে নিজের কারাক্ষে আত্মহত্যা করে মারা যায় । এতো গুলো খুন করে মারে বছর পাঁচেকের মত জেলে ছিল সে ।
হ্যারল্ডের এতো গুলো মানুষকে হত্যা করেই পার পেয়ে যাওয়ার ব্যাপারটার দিকে তাকালে অনেকটাই অসম্ভব মনে হতে পারে । তবে এমনটা সে করতে পেরেছিল নিজের বুদ্ধিমত্তা, তার সাথে যোগ হয়েছিল তার ডাক্তারী সুনাম । এছাড়া সম্ভবত আরও একটা কারণ ছিল । সেটা হচ্ছে তার ভিক্টিম বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া । বৃদ্ধ মানুষ মারা গেলে আসলে আমরা কেউই তেমন মাথা ঘামাই না । পশ্চিমে এটা স্বাভাবিক ঘটনা যে বৃদ্ধ বাবা মায়ের খোজ কেউ রাখে না । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকা একাই থাকে । এমন অনেক বার দেখা গেছে বৃদ্ধ বাবা মা ঘরে মরে পড়ে আছে কয়েকদিন । কেউ জানে না । লাশ পচে গন্ধ ছড়িয়েছে তারপর টের পেয়েছে । এটাও একটা বড় কারণ ছিল হ্যারল্ড এতো দীর্ঘ সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল ।

হ্যারল্ড আসলে কেন এমনটা করেছে তার কোন ব্যাখ্যা কেউ বলতে পারে না । এমন কি শেষ দিন পর্যন্ত হ্যারল্ড নিজের দোষ স্বীকার করে নি। নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে । তার ভেতরে কোন অনুশোচনা ছিল না । এটাই হচ্ছে আমাদের ডাক্তার ডেথের গল্প ।



আরও বিস্তারিত জানোতে
বই দ্য ডেঞ্জারাস গেম - অন্বয় আকিব
হ্যারল্ড ফ্রেডরিক শিপম্যানঃ ডাক্তারের আড়ালে লুকনো এক ভয়ঙ্কর খুনি
Harold Shipman
Harold shipman
Harold Shipman: Doctor Death Who Killed 250 Patients (Crime Documentary)- Real Stories


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×