হাটহাজারী পৌরসভাস্থ ক্বওমীপন্থী ফটিকা আবু হুরাইরা আদর্শ হেফজখানার এক শিক্ষক ওই মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রকে যৌন নির্যাতন (বলৎকার) করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৬ জুলাই। ঘটনার পর ছাত্রটিকে চমেক হাসপাতালের মানসিক বিভাগে ভর্তি করানো হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সালিশের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দশদিন আগে ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার (১৬ জুলাই)। এ ব্যাপারে ছাত্রের মা পারভিন আক্তার বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার হাটহাজারী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১৮, তাং ১৬/০৭/১৩। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত শিক্ষক পলাতক রয়েছেন। তবে তাকে গতকাল প্রকাশ্যে হাটহাজারী বাজারে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে বলে জানান এলাকাবাসী।
মাদ্রাসার পরিচালক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপে জানা যায়, পৌরসভাস্থ আবু হুরাইরা আদর্শ হেফজখানায় চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ভর্তি করানো হয় উপজেলার গড়দুয়ারার মোঃ সেলিমের ৯ বছরের পুত্র শিফাতুর রহমান শাওনকে। তার পিতা সেলিম পেশায় জাহাজের সারেং। পুত্রের জন্মের পূর্ব থেকে সেলিমের ইচ্ছা ছিল ছেলেকে হাফেজ হিসাবে গড়ে তুলবেন। মাদ্রাসায় প্রত্যেক মাসে তিনি ছেলের খোরপোষ বাবদ দুই হাজার আটশ’ টাকা দিতেন। গত পবিত্র শবে বরাতের আগের দিন পিতা সেলিম তার ছেলেকে দেখতে ও খোরপোষের খরচ দিতে মাদ্রাসায় যান এবং ছেলেকে দেখে বাড়ি ফিরে যান।
পরবর্তীতে গত ৬ জুলাই একই মাদ্রাসার শিক্ষক তথা মাদ্রসা পরিচালকের আপন সহোদর মাওলানা মোঃ শফিক শিফাতুর রহমান শাওনকে ভয় দেখিয়ে পাশবিকভাবে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে শাওনের প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রক্তক্ষরণ দেখে মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ মাওলানা মোঃ রফিক আহমদ ও মাওলানা মোঃ শফিক একটি গাড়ি করে শাওনকে কোথায় নিয়ে যান এবং সেখানে চিকিৎসা করান। এরপরে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখে মাদ্রাসার বাবুর্চি তার মাকে খবর দেন। খবর পেয়ে তার মা দ্রুত মাদ্রাসায় এসে ছেলেকে নিয়ে প্রথমে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। কিন্তু অবস্থা অপরিবর্তিত দেখে চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নগরী একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করানো হলে সেখানেও অবস্থা অপরিবর্তিত দেখে তারা তাকে চমেক হাসপাতালের মানসিক বিভাগে ডা. মহিউদ্দিন সিকদারের অধীনে চিকিৎসা শুরু করেন।
এদিকে ঘটনার পর থেকে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তৎপরতা শুরু করে। তারা স্থানীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও পুলিশের কাছে বিষয়টি আপোষ মীমাংসার জন্য ছুটে যায়। মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ মোঃ রফিক আহমেদের সাথে মুঠোফোনে ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন।
তিনি বলেন, যা শুনেছেন তা সত্য। তবে ঘটনাটিতো ৭ জুলাই সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনি জানান, সালিশে স্থানীয় আবছার চেয়ারম্যান, দিদারুল আলম বাবুল ও কালু সওদাগর উপস্থিত ছিলেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও শালিশদারগণ ছেলেটির পরিবারকে ঘটনাটি প্রচার না করার অনুরোধ জানান।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দেড় লক্ষ টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি আপোষ রফা করে। প্রথম দফায় এক লক্ষ টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে ওই ছাত্রের পরিবারের পক্ষ থেকে এ যাবত কোন টাকা গ্রহণ করা হয়নি বলে তার পিতা মোঃ সেলিম সারাং জানান।
হেফজখানার ছাত্র শিফাতুর রহমান শাওনের ওপর পাশবিক যৌন নির্যাতনকারী শিক্ষক মাওলানা মোঃ শফিক ফটিকছড়ি উপজেলার বাগান বাজার ইউনিয়নের পুরান রামগড় গ্রামের কাজী বাড়ির মাওলানা করিমুল হকের পুত্র। তার অগ্রজ ভাই হাফেজ মাওলানা রফিক আহমদ উক্ত মাদ্রাসার পরিচালক। ২০০৮ সালে হাটহাজারী পৌরসভাস্থ ৬নং ওয়ার্ডে এডভোকেট শাহ আলমের বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে তিনি ওই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ ব্যাপারে হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম লিয়াকত আলী জানান, এ ঘটনায় ছাত্রটির মা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সাথে জড়িত শিক্ষককে আটকের জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে নিদেশ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, রক্ষণশীল মাদ্রাসাগুলোতে জুনিয়র ছাত্রদের উপর সিনিয়র ছাত্র ও শিক্ষকদের যৌন নির্যাতন (বলৎকার) নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সন্ধীপে অল্প বয়সী সুদর্শন বালকদের উপর যৌন নির্যাতনের হার খুবই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে এ ধরনের ঘটনা ধর্ষিত বালকের অভিভাবকরা প্রকাশ করেন না, তাছাড়া অনেক এলাকায় একে খুব একটা বড় অপরাধ বলেও মনে করা হয় না।
সূত্র: দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম : ১৭-০৭-২০১৩