somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফকির ইলিয়াস : ভাঙনের রেখাচিত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কবিচিত্র

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাঙন ধরে এগুতে থাকে শব্দের চিত্রালডানা। গর্তের দন্তগুলো বেরিয়ে পড়েছে হা করা খাদের উপর। ঐখানে দাঁড়িয়ে আছেন কবি ফকির ইলিয়াস─কবিতায় দশ আঙুল দাবিয়ে। যারা এখনও কবিতাকে কেবল নির্জনতার বিলাসী-আধার ভেবে গুটিয়ে থাকতে চান সুবিধাজনক দূরত্বে, তিনি তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত নন। মানুষজনের কোলাহলের ভয় তার নেই। যে চর্মচক্ষু প্রতিদিন অশ্লীল ও দূরাচারের পণ্য-সমাচার হতে উতলা হয়ে রয়, কবি ফকির ইলিয়াসের কবিতা তাদের স্বরবিদ্ধ করে সময়ের সকল-স্থূলতা-কপঠতা ও এলিট-আবর্জনাকে অস্থির করে তোলতে প্রয়াসী হয়। তখন তিনি আরও অগ্রসর হন জল ও গীতলতার শাসন দ্বিখণ্ডিত করার স্পর্ধা নিয়ে। তার ফকিরী এইখানে সরল ব্যাবিচ্ছেদ ঘটায়। এই পঙক্তির শূন্যতায় দাঁড়িয়ে তাকে তথাকথিত পান্ডিত্য প্রকাশের কসরত দেখাতে হয় না। একজন প্রাজ্ঞ শিক্ষক সাইদুল হক খানের উক্তি দিয়ে যদি বলি, ‘পুরুষদের রাগ থাকা ভালো, তা প্রকাশ হয়ে গেলে বড় অশ্লীল দেখায়’ কবিতায়ও তাকে এই পাণ্ডিত্যের ভাব ধরতে হয়নি, তার লেখাজীবনের শুরুর কালেও। কবির প্রারম্বিককালও ছিল স্বচ্ছ ও সরল। কোথাও লেখা প্রকাশে যেমন কোনো চ্যুতমার্গ নেই, লেখকের আত্মমর্যাদা সমপর্কিত বিষয়েও তিনি যথেষ্ট সচেতন।
কবি ফকির ইলিয়াস গদ্য ও কবিতাশিল্পে দ্বৈত-সত্বায় অবস্থান করেন। হাংরিজেনারেশনের কবি মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা দেখি কঙ্কালসার কবিতা লেখতে, আবার গদ্যে তিনি কঠোরভাষ্যকার হয়ে উঠেন কোনো রাখঢাক না রেখেই। আমাদের এই ফকির কবি (ফকিহচিন্তক) কঙ্কালের বিলুপ্ত মাংসবিশেষকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। গদ্যে তিনি একজন প্রকট ভাষ্যকার, কবিতায় স্থির লক্ষ্য থেকে আলোফেলে শোষে নেন গদ্যের সকল সংকট। যে চাপ তিনি প্রকাশ করেন গদ্যের ভেতর─রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম-চিত্রকল্প-শিল্প-বোধ-বোধির উৎস-মুখ বিষয়ে, কবিতায় ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি চলমান নৌকার তীরবর্তী দর্শক হয়ে উঠেন। ল্যাম্পপোস্ট থেকে সার্চ করেন তীর্থযাত্রীর সকল অবগাহন। কীভাবে ইতিহাসের বীত-বাতায়ন তাকে দীক্ষিত করে তোলে, আশ্চর্য বীক্ষণে কদার্যতাকে কীভাবে চিহ্নিত করে চলেন─ফকির ইলিয়াসের কবিতার পঙক্তিধরে আলোচনায় অবতির্ণ হলে তার সারাংশ খোঁজে পাবো।
এই পর্বে আমরা কেবল শব্দের কারুকার্যে মোটেই আপ্লুত হবো না, যদি না একে সমাজ-দর্শণের ক্যানভাসে অর্থবহ হয়ে উঠতে না দেখি।

কবি পলকহীন উচ্চারণ করেন─ ‘তারপর হেঁটে হেঁটে ভূমিতৃণে ভাঙো সব প্রথা/ ভাঙা-ই বিবর্তন জানি, নির্ভুলে-যতির মরমে’ (কবিতা : আয়ু্িবন্দু)। তিনি জ্ঞাত হয়েই ভাঙনকে নির্ভুল সংজ্ঞায় প্রতিষ্ঠা দিতে চান। তার বিপরীতে আমরা এও বলতে পারি প্রথা ভাঙাই শেষ পর্যন্ত প্রথারূপে চিহ্নিত হবে। এখানে কবির ভাঙনের নির্ভুল সংজ্ঞাকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। যে মানুষ সমস্ত সৃষ্টিকে একবার অনুভব করেছে─সকল যাতনার ভেতর দিয়ে, সেই এমন বদলে দেয়ার অধিকার রাখে। পূর্বত কাঠামোকে যদি দর্শনচোখে অনুভব না করে এমন কর্মে কেউ উপনিত হয়, সেক্ষেত্রে একে উশৃঙ্খল বা লক্ষ্যহীন অনাচারই বলা যেতে পারে। ফকির ইলিয়াস সেই অসহনীয় জায়গাটিতে আলো ফেলতেই ‘ভাঙন’ শব্দের সঙ্গে ‘নির্ভুল’ শব্দটি যোগ করেছেন। লেখকের অনুভব পূর্বজ-অভিজ্ঞানের ধারণাকেই এভাবে ফলপ্রসুরূপে প্রকাশ পেতে দেখি। অবশেষে এই সনেট কাঠামোর কবিতার সমীক্ষণ শেষে তিনি সমাপনি টানেন─‘আবারো রহস্য ভেদে ডাকো কাছে সমুদ্র প্রবর/ এখানেই ঢেউ ভেঙে যুগে যুগে জাগে নয়াচর।’ রহস্য তো থাকবেই। আমরা কি সৃষ্টির সকল রহস্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভেদ-ভাঙতে পেরেছি। সবই তো একটি ধারণাকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। ফকির সেই রহস্যকে সঞ্চালক হিসেবে দেখেন বলেই তিনি যুগের ঢেউ-ভাঙাকে আহবান করেন নতুন চর তুলে দিতে। মরমি যেমন মানব-গ্রন্থি থেকে সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করেন, ব্যাখ্যা করেন, কবিও একটি বিন্দু থেকে সমস্ত সৃষ্টিকে দেখার চেষ্টা করেন। এ হলো কবির আত্ম-উপলব্ধিকে কঠিন-বাঁধনে ফেলে সীমিত আয়তনে বিশালক্ষেত্রকে ব্যাখ্যা করার শিল্পকৌশল।
আবার কবির ক্ষরণেও যে সৃষ্টি-তত্ত্ব উপসর্গে বিলিন হতে থাকে সেই লুপ্তকে বিলিকেটে তুলে আনতে চান তিনি। অঙুলের স্পর্শে কবি সেই রুদ্রাক্ষরকে দেখতে পান সূর্যের অশ্রুপ্রভায়। ‘ভারাক্রান্ত নদী, ভারপ্রাপ্ত সূর্য’ কবিতাকে আমরা এভাবেই দেখি। এর প্রকাশক্ষমতা ঘটেছে গীতপ্রবণ, চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে। এও ঠিক কবির চিত্রকল্প একটি সহজাত স্বর। তিনি এটিকে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছেন। সুবিধাটা হলো যে, তিনি এর মাধ্যমে একটি বিন্দু, একটি ভ্রুণকেও সহজে সনাক্ত করতে পারছেন, এর মাধ্যমে একটি ধারাভাষ্যকেও একলহমায় কবিতার-মুগ্ধতায় ছুড়ে দিচ্ছেন যা কবিতার-আলোয় পূর্ণতা পাচ্ছে, পূর্ণ-পঙক্তি হয়ে উঠছে।

‘পোড়া-ই সমাপ্তিসার, জন্মের তীর্ণ কারুকাজ
প্রকাশের শ্রেষ্ঠ পথ। বীজবাহী কালের দেরাজ
খুঁলে গেলে মাটি থেকে জন্ম নেয় অর্জনের লক্ষ আলো-ভ্রুণ
বদলবার ভূমি ছুঁয়ে, প্রেম খুঁজে দ্বীপের উনুন।

তারপর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে কোনো এক সমুদ্র সন্ধ্যায়
জলের জানালা খুলে সূর্য ভাসে অশ্রু প্রভায়।’

ফকির ইলিয়াসের এই জন্মস্বাদের মোহ-ঘ্রাণ-গ্রস্থতা-গ্রহণ─ভেতর থেকে বার বার উসকে দিচ্ছে তার প্রবল ইচ্ছাকে। উনুনভর্তি তাপ-উত্তাপকে প্রবলশক্তিরূপে উত্তির্ণ হতে দেখলে কোনো ভাঙনকেই আর ভয় পাবার কারণ থাকে না। সর্বগ্রাসি ভাঙন জানান দিয়ে যায় কোনো বিষপানেই কবির মৃত্যু ঘটে না, কবি লোকচক্ষুর অন্তরালে সর্বব্যাপি হয়ে উঠেন, লক্ষযোজন দূরত্বও কবিকে আরও অপরিহার্য করে তোলে। এটি এক অমিমাংসিত সত্য।
মানববীজ-ভূমি সংক্রান্ত লীলাকে কবিই পারেন একে মানবীয়ভাবে দেখতে, সুন্দরের এই প্রকাশ অনন্তকাল থেকে কবির হাতেই ন্যস্ত হয়েছে। যে জল জলবাহি প্রতীক সরস্বতী, যিনি জ্ঞানের প্রতীক ‘উঠ গো সরস্বতী মা কণ্ঠে করে ভর/ কন্ঠেতে বসিয়া মা গো জোগাও নানা স্বর’ (প্রেমমালা ১ম খণ্ড : পীর মজির উদ্দিন) ফকিরী-তথ্যের জলবিন্দুর সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। মিথমিশ্রে প্রকাশ পায় নতুন ব্যঞ্জনা─ব্যগ্রতাও বটে। এই অপার আগ্রহ কবির বিশ্বাসকে দৃঢ়ভিত্তিমূলে স্থাপন করে দিয়ে যায়। একে না ভেঙেই কবি গড়ে তুলতে চান জলের-নতুন সমাচার। জলের ঢেউ দিয়ে যাবে যুগের নতুন চরাচর-ভূমি। সেই মানুষ-সমাজ-ভূমি-বিবর্তন ক্রিয়ার ভাঙাপর্বের রেখাচিত্রে দাঁড়িয়ে আছেন কবি ফকির ইলিয়াস।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:৪৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×