কবি ফকির ইলিয়াস গদ্য ও কবিতাশিল্পে দ্বৈত-সত্বায় অবস্থান করেন। হাংরিজেনারেশনের কবি মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা দেখি কঙ্কালসার কবিতা লেখতে, আবার গদ্যে তিনি কঠোরভাষ্যকার হয়ে উঠেন কোনো রাখঢাক না রেখেই। আমাদের এই ফকির কবি (ফকিহচিন্তক) কঙ্কালের বিলুপ্ত মাংসবিশেষকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। গদ্যে তিনি একজন প্রকট ভাষ্যকার, কবিতায় স্থির লক্ষ্য থেকে আলোফেলে শোষে নেন গদ্যের সকল সংকট। যে চাপ তিনি প্রকাশ করেন গদ্যের ভেতর─রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম-চিত্রকল্প-শিল্প-বোধ-বোধির উৎস-মুখ বিষয়ে, কবিতায় ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি চলমান নৌকার তীরবর্তী দর্শক হয়ে উঠেন। ল্যাম্পপোস্ট থেকে সার্চ করেন তীর্থযাত্রীর সকল অবগাহন। কীভাবে ইতিহাসের বীত-বাতায়ন তাকে দীক্ষিত করে তোলে, আশ্চর্য বীক্ষণে কদার্যতাকে কীভাবে চিহ্নিত করে চলেন─ফকির ইলিয়াসের কবিতার পঙক্তিধরে আলোচনায় অবতির্ণ হলে তার সারাংশ খোঁজে পাবো।
এই পর্বে আমরা কেবল শব্দের কারুকার্যে মোটেই আপ্লুত হবো না, যদি না একে সমাজ-দর্শণের ক্যানভাসে অর্থবহ হয়ে উঠতে না দেখি।
কবি পলকহীন উচ্চারণ করেন─ ‘তারপর হেঁটে হেঁটে ভূমিতৃণে ভাঙো সব প্রথা/ ভাঙা-ই বিবর্তন জানি, নির্ভুলে-যতির মরমে’ (কবিতা : আয়ু্িবন্দু)। তিনি জ্ঞাত হয়েই ভাঙনকে নির্ভুল সংজ্ঞায় প্রতিষ্ঠা দিতে চান। তার বিপরীতে আমরা এও বলতে পারি প্রথা ভাঙাই শেষ পর্যন্ত প্রথারূপে চিহ্নিত হবে। এখানে কবির ভাঙনের নির্ভুল সংজ্ঞাকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। যে মানুষ সমস্ত সৃষ্টিকে একবার অনুভব করেছে─সকল যাতনার ভেতর দিয়ে, সেই এমন বদলে দেয়ার অধিকার রাখে। পূর্বত কাঠামোকে যদি দর্শনচোখে অনুভব না করে এমন কর্মে কেউ উপনিত হয়, সেক্ষেত্রে একে উশৃঙ্খল বা লক্ষ্যহীন অনাচারই বলা যেতে পারে। ফকির ইলিয়াস সেই অসহনীয় জায়গাটিতে আলো ফেলতেই ‘ভাঙন’ শব্দের সঙ্গে ‘নির্ভুল’ শব্দটি যোগ করেছেন। লেখকের অনুভব পূর্বজ-অভিজ্ঞানের ধারণাকেই এভাবে ফলপ্রসুরূপে প্রকাশ পেতে দেখি। অবশেষে এই সনেট কাঠামোর কবিতার সমীক্ষণ শেষে তিনি সমাপনি টানেন─‘আবারো রহস্য ভেদে ডাকো কাছে সমুদ্র প্রবর/ এখানেই ঢেউ ভেঙে যুগে যুগে জাগে নয়াচর।’ রহস্য তো থাকবেই। আমরা কি সৃষ্টির সকল রহস্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভেদ-ভাঙতে পেরেছি। সবই তো একটি ধারণাকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। ফকির সেই রহস্যকে সঞ্চালক হিসেবে দেখেন বলেই তিনি যুগের ঢেউ-ভাঙাকে আহবান করেন নতুন চর তুলে দিতে। মরমি যেমন মানব-গ্রন্থি থেকে সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করেন, ব্যাখ্যা করেন, কবিও একটি বিন্দু থেকে সমস্ত সৃষ্টিকে দেখার চেষ্টা করেন। এ হলো কবির আত্ম-উপলব্ধিকে কঠিন-বাঁধনে ফেলে সীমিত আয়তনে বিশালক্ষেত্রকে ব্যাখ্যা করার শিল্পকৌশল।
আবার কবির ক্ষরণেও যে সৃষ্টি-তত্ত্ব উপসর্গে বিলিন হতে থাকে সেই লুপ্তকে বিলিকেটে তুলে আনতে চান তিনি। অঙুলের স্পর্শে কবি সেই রুদ্রাক্ষরকে দেখতে পান সূর্যের অশ্রুপ্রভায়। ‘ভারাক্রান্ত নদী, ভারপ্রাপ্ত সূর্য’ কবিতাকে আমরা এভাবেই দেখি। এর প্রকাশক্ষমতা ঘটেছে গীতপ্রবণ, চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে। এও ঠিক কবির চিত্রকল্প একটি সহজাত স্বর। তিনি এটিকে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছেন। সুবিধাটা হলো যে, তিনি এর মাধ্যমে একটি বিন্দু, একটি ভ্রুণকেও সহজে সনাক্ত করতে পারছেন, এর মাধ্যমে একটি ধারাভাষ্যকেও একলহমায় কবিতার-মুগ্ধতায় ছুড়ে দিচ্ছেন যা কবিতার-আলোয় পূর্ণতা পাচ্ছে, পূর্ণ-পঙক্তি হয়ে উঠছে।
‘পোড়া-ই সমাপ্তিসার, জন্মের তীর্ণ কারুকাজ
প্রকাশের শ্রেষ্ঠ পথ। বীজবাহী কালের দেরাজ
খুঁলে গেলে মাটি থেকে জন্ম নেয় অর্জনের লক্ষ আলো-ভ্রুণ
বদলবার ভূমি ছুঁয়ে, প্রেম খুঁজে দ্বীপের উনুন।
তারপর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে কোনো এক সমুদ্র সন্ধ্যায়
জলের জানালা খুলে সূর্য ভাসে অশ্রু প্রভায়।’
ফকির ইলিয়াসের এই জন্মস্বাদের মোহ-ঘ্রাণ-গ্রস্থতা-গ্রহণ─ভেতর থেকে বার বার উসকে দিচ্ছে তার প্রবল ইচ্ছাকে। উনুনভর্তি তাপ-উত্তাপকে প্রবলশক্তিরূপে উত্তির্ণ হতে দেখলে কোনো ভাঙনকেই আর ভয় পাবার কারণ থাকে না। সর্বগ্রাসি ভাঙন জানান দিয়ে যায় কোনো বিষপানেই কবির মৃত্যু ঘটে না, কবি লোকচক্ষুর অন্তরালে সর্বব্যাপি হয়ে উঠেন, লক্ষযোজন দূরত্বও কবিকে আরও অপরিহার্য করে তোলে। এটি এক অমিমাংসিত সত্য।
মানববীজ-ভূমি সংক্রান্ত লীলাকে কবিই পারেন একে মানবীয়ভাবে দেখতে, সুন্দরের এই প্রকাশ অনন্তকাল থেকে কবির হাতেই ন্যস্ত হয়েছে। যে জল জলবাহি প্রতীক সরস্বতী, যিনি জ্ঞানের প্রতীক ‘উঠ গো সরস্বতী মা কণ্ঠে করে ভর/ কন্ঠেতে বসিয়া মা গো জোগাও নানা স্বর’ (প্রেমমালা ১ম খণ্ড : পীর মজির উদ্দিন) ফকিরী-তথ্যের জলবিন্দুর সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। মিথমিশ্রে প্রকাশ পায় নতুন ব্যঞ্জনা─ব্যগ্রতাও বটে। এই অপার আগ্রহ কবির বিশ্বাসকে দৃঢ়ভিত্তিমূলে স্থাপন করে দিয়ে যায়। একে না ভেঙেই কবি গড়ে তুলতে চান জলের-নতুন সমাচার। জলের ঢেউ দিয়ে যাবে যুগের নতুন চরাচর-ভূমি। সেই মানুষ-সমাজ-ভূমি-বিবর্তন ক্রিয়ার ভাঙাপর্বের রেখাচিত্রে দাঁড়িয়ে আছেন কবি ফকির ইলিয়াস।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:৪৯