somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের কৌশলপত্র এবং উচ্চ শিক্ষার সংকট

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। আন্দোলন চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্যকালীন কোর্স (নাইট-শিফ্ট) চালুসহ শিক্ষা সংকোচন ও শিক্ষা বাণিজ্যিকীরণের সকল প্রকার অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে এই ছাত্র বেতন-ফি বৃদ্ধিসহ শিক্ষা সংকোচন ও শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের সকল পরিকল্পনা এক সূত্রে গাঁথা এবং এর মূল সূত্র হল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রণীত ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র। ২০০২ সালের ২রা ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রণয়ন করে “বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার জন্য কৌশলপত্র (২০০৬-২০২৬) এই কৌশলপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংক এর সামগ্রিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। চার পর্বে বিভক্ত এই কৌশলপত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। উচ্চ শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের প্রশ্নে কৌশল পত্রে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব তহবিল তৈরি করতে হবে এবং সেই তহবিল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হবে। অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে ধাপে ধাপে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ আয় দিয়েই চলতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কোন শিল্প কারখানা নয়, তাহলে এর অভ্যন্তরীণ আয়ের খাতগুলো কী? কৌশলপত্রে এ বিষয়েও রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা। অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির খাত গুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র বেতন-ফি বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেওয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, দোকান ভাড়া, কনসালট্যান্সি সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের বীমা, সাইবার ক্যাফে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু, গ্রাজুয়েট ট্যাক্স প্রভৃতি। তবে এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীন আয় বাড়ানোর দিকে জোর দিতে বলা হয়েছে কৌশলপত্রে। এরই অংশ হিসেবে প্রতি সেমিস্টারে ২৫-৩০% হারে বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে কৌশলপত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রেডিট ফি, রেজিষ্ট্রেশন ফি, হল ভর্তি ফি, ডাইনিং চার্জ ইত্যাদি। একই সাথে উন্নয়ন ফি এর নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। অপরদিকে বাণিজ্যিকভাবে চালু করা হচ্ছে সান্ধ্যকালীন কোর্স।

কৌশল পত্রের প্রস্তাবক্রমে, নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক ভাবে বেতন-ফি বৃদ্ধির ফলে শিক্ষা ব্যয় এমন একটা অবস্থায় পৌঁছুবে যে, এদেশের দরিদ্র ঘরের সন্তানদের পাশাপাশি নিু-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের জন্যও উচ্চ শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও একথা স্বীকার করে দরিদ্র ঘরের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার ব্যবস্থা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র ঋণের নতুন প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব করেছে। ইউজিসি’র পরামর্শ বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা ঋণের দায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে আর বের হবে লাখ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন শিক্ষা ঋণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নীপুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বাণিজ্যের নতুন মডেল:
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্ধিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অপ্রতুল আসন সংখ্যার কথা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেছে। কেমন হবে ইউজিসি প্রস্তাবিত এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? ইউজিসি প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ৫৮০০, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফিসহ অন্যান্য সকল ফি হবে অত্যন্ত বেশি, যার প্রমাণ সা¤প্রতিক প্রতিষ্ঠিত নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। নোবিপ্রবি’র প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ভর্তি ফি ২০,২০০ টাকা। একই অবস্থা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েরও। সেখানে ভর্তি হতে প্রয়োজন প্রায় ১৩,০০০ টাকা। নতুন প্রতিষ্ঠিত এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেতন-ফি এমনভাবে ধার্য্য করা হয়েছে যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আয়ে চলতে পারে। প্রাক-বাজেট পদ্ধতিতে এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে, অর্থাৎ প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পূর্বে প্রশাসনের পেশকৃত বাজেটের ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি নির্ধারিত হবে। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, সীমিত আসন সংখ্যার এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হবে। সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যন ডঃ আসাদুজ্জামানও এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় সর্ম্পকে বলছেন “এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে মূলত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।" আশঙ্কার ব্যপার এই যে, নব্য প্রতিষ্ঠিত এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকেই ইউজিসি আগামী দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে কারণ কৌশলপত্রে বলা হয়েছে সা¤প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রদের কাছ থেকে ক্রেডিট প্রতি ৭৫ থেকে ৩০০ টাকা ফি নিচ্ছে এবং একমাত্র এভাবেই সম্ভব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানো। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় অধিক অর্থ উপার্জন করছে। অতএব বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকেও সেই গন্তব্যেই পৌঁছতে হবে। ২০ বছর মেয়াদী কৌশল পত্রের মাধ্যমে ইউজিসি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।

মেধাদাসত্বের শেকল :
উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য কী হবে? এ শিক্ষা কেমন জনগোষ্ঠী তৈরি করবে? কৌশল পত্রের সুপারিশ অনুযায়ী, উচ্চ শিক্ষার পুরোটাই হবে বাজার নির্ভর একটা লাভজনক বাণিজ্যিক বিষয়। এখানে পুঁজি বিনিয়োগ ও মুনাফার বিষয়টিই আগে বিবেচিত হবে। সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোকে গৌণ, গুরুত্বহীন ও অকেজো করে তথাকথিত ICT, Peace and conflict, micro-credit Dept. American studies, population science, hotel management, MBA প্রভৃতি বিষয় চালু করে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজি ও পণ্যের পাহারাদার, কর্মচারী ও সেবাদাস তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন বিষয়ের উপর গবেষণা হবে তা নির্ধারণ করে দেবে বিশ্বব্যাংক এবং অর্থায়নকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সমূহ। একটি দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কোন বিষয়সমূহের উপর গবেষণা করা হবে তা সম্পূর্ণভাবে ঐ দেশের অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। অথচ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের (শিল্প, কৃষি প্রভূতি) স্বার্থে নয়, বরং ঔপনিবেশিক আমলে যেমন কেরানী তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, ঠিক তেমনি বহুজাতিক কোম্পানীগুলির মুনাফার প্রয়োজনে কিছু সেবাদাস তৈরি করাই এ কৌশল পত্রের উদ্দেশ্য।

সংকুচিত হবে আবাসন সুবিধা :
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যতটুকু আছে তাও শতসহস্র সংকটে জর্জরিত। পানি, বিদ্যুৎ সমস্যা, ডাইনিংয়ের অস্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিহীন খাবার, হল লাইব্রেরী ও রিডিং রুমের দারিদ্র, গাদাগাদি করে থাকা, হলরুমের ছারপোকার কামড় প্রভৃতি সমস্যা আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিতই পোহাতে হয়। আবাসিক হলের অপর্যাপ্ততা ও অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মেস ভাড়া করে থাকতে হয়। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পক্ষে দুরূহ। ফলে শিক্ষাজীবন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের টিউশনির উপর নির্ভর করতে হয়। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শিক্ষর্থীদের পড়াশুনার উপর। এ অবস্থায় যেখানে সকল শিক্ষার্থীদের ধারণ করার জন্য পর্যাপ্ত আবাসিক হল নির্মাণ জরুরী সেখানে “আবাসিক হল সংঘাতমূলক রাজনীতির ভিত্তি তৈরী করে” এই অজুহাত দাঁড় করিয়ে ইউজিসি নতুন হল নির্মাণ না করার প্রস্তাব করছে। একটু তলিয়ে দেখলেই, ইউজিসি’র এই যুক্তির অসারতার প্রমাণ মেলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব কায়েমকারী শক্তি সমূহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রের আর্শীবাদ ও মদদপুষ্ট। প্রশাসনের সহযোগিতায় হল দখল, সিট বাণিজ্যসহ হলে সিট দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি করাতে বাধ্য করছে এ সকল প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র-সংগঠনগুলো। অথচ ইউজিসি এ সকল প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন গুলোর সংঘাতময় রাজনীতির দায় সমগ্র ছাত্র সমাজের উপর চাপিয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা পাবার অধিকার খর্ব করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে আবাসিক হল নির্মাণ না হলে সরকার আবাসিক হল নির্মাণের দায়ভার হতে মুক্ত হবে, অপরদিকে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক সময়ের বাইরে ক্যাম্পাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং এই বিচ্ছিন্নতা সংঘবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পথে অন্তরায় হবে, যা কিনা শাসক শোষক গোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত লাভজনক।

ক্যাম্পাস পুলিশ গঠন ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের তৎপরতা :
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কৌশলপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংঘর্ষিক রাজনীতির ফলে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রক্টরের নেতৃত্বে ক্যাম্পাস পুলিশ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সৃষ্ট সন্ত্রাসের দায় দালাল প্রশাসনগুলো কখনও এড়াতে পারে না। আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে রদবদল হয়, একই সাথে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনও হল, ক্যাম্পাসসহ সর্বক্ষেত্রে দখলদারিত্ব কায়েম করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠন যে প্রশাসনের মদদেই ক্যাম্পাসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। রাতের আঁধারে হল দখলের পরেও প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চললেও কোনরূপ বিচার না করে প্রশাসন পাওয়ার প্র্যাকটিসের রাজনীতির সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। অপরদিকে হল দখলের সুযোগ দানের মাধ্যমে সিট বাণিজ্য ও হল কেন্দ্রিক রাজনীতির সুযোগ করে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনার উৎস খুঁজলে দেখা যাবে যে, প্রত্যেকটি ঘটনার মূলে রয়েছে শাসক গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্ন। এর সাথে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দাবি দাওয়ার অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সরকার প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সৃষ্ট সন্ত্রাসকে বন্ধ না করে ছাত্র দিয়ে ছাত্র হত্যার সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী ঘটনার মাধ্যমে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিবেশের মাধ্যমে ছাত্র সমাজের বিশাল অংশকে ছাত্র রাজনীতি হতে দূরে সরিয়ে রাখার, ছাত্র রাজনীতিকে গণবিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সরকার। অপর দিকে সন্ত্রাসী ঘটনার দায় সমগ্র ছাত্ররাজনীতির উপর চাপিয়ে দিয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পাঁয়তারা করছে সরকার। কাজেই এ প্রশ্ন আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ও ক্যাম্পাস পুলিশ গঠন তবে কিসের স্বার্থে?

এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সচেতন শিক্ষার্থীরা যখনই অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে তখনই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর দালাল সরকারগুলো তাদের রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী পুলিশ, র‌্যাব দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর দমন-নিপীড়ন চালায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সা¤প্রতিক ছাত্র আন্দোলনই যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন তার লাঠিয়াল বাহিনী সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকেও আন্দোলন দমাতে কাজে লাগায়। কাজেই প্রক্টরের নেতৃত্বে পরিচালিত ক্যাম্পাস পুলিশ যে, ছাত্র আন্দোলনসহ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু হরণ এবং বিদ্যমান প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রকে আরো সুসংহত ও তীব্রতর করার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন আইন (Umbrella Act) প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। কৌশলপত্রে বর্ণিত এই আইনের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সভা, স্লোগান, মিছিল নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের লুটের স্বার্থের হিসাব থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ভূমিকা পুনঃ নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করেছে বিশ্বব্যাংক।

শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং পিপিপি :
বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে বেসরকারীকরণের পথে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে এবং ২০ বছর মেয়াদী কৌশল পত্রকে সফল করার উদ্দেশ্যে সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) বা সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক কাঠামো পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের বক্তব্য হল পিপিপি’র মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে এবং এর মাধ্যমে সরকারি, বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানই লাভবান হবে। আসুন একটু তলিয়ে দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিপিপি খাতে ছেড়ে দিলে শিক্ষার্থীদের কী লাভ হবে। সরকার প্রথমেই বলছে, অবকাঠামো নির্মিত হবে পিপিপি’র মাধ্যমে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো (হল, একাডেমিক বিল্ডিং ইত্যাদি) নির্মাণের দায়ভার এড়াতে চাচ্ছে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিপিপি'তে বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে লাভবান হচ্ছে সে কথাও স্বীকার করছে সরকার। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সমূহে বিনিয়োগকারীরা যেভাবে মুনাফার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করে সেই একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও মুনাফার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা আর ছাত্র বেতন-ফি বৃদ্ধির মাধ্যমেই যোগান দেওয়া হবে কাঙ্খিত মুনাফা। বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনা অনুসারে শিক্ষার মত সেবা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের স্বার্থে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেওয়ার যে সামগ্রিক পরিকল্পনা তারই অংশ হিসেবে আজ শিক্ষা খাতে পিপিপি’র বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে দালাল সরকারগুলো।

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণঃ প্রেক্ষাপট শাবিপ্রবি :
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শাবিতেও শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত কৌশল পত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কৌশলপত্রের প্রস্তাবক্রমে শাবি প্রশাসন প্রতি সেমিস্টারে ২৫-৩০% হারে বেতন-ফি বৃদ্ধির অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বেতন-ফি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় শাবিতে ২০০৪-০৫ সেশনের ক্রেডিট-ফি (তত্ত্বীয় ৪০/= ব্যবহারিক ৭০/=) বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯-২০১০ সেশনে প্রায় দ্বিগুণ (তত্ত্বীয় ৭০/= ব্যবহারিক ১১০/=) হয়েছে। এভাবে ২৫-৩০% হারে বেতন-ফি বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০২৬ সালে প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ব্যয় হবে বর্তমানে প্রচলিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমান। ইউজিসি’র প্রস্তাবক্রমে শাবিতে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে প্রশাসন। অথচ শাবিতে বিদ্যমান শিক্ষক সংকট, শ্রেণীকক্ষ সংকট, ব্যবহারিক সরঞ্জামের সংকটসহ নানামুখী সমস্যার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিনিয়ত ব্যহত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করলে শিক্ষা কার্যক্রমের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এছাড়াও কৌশলপত্রের প্রস্তাবক্রমে শাবিতে ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া দেওয়া, হল ডাইনিংয়ের চার্জ বৃদ্ধি, প্রাইভেট হলের নামে ছাত্রীদের কাছ থেকে অধিক অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
“শাবিপ্রবি হবে পিপিপি’র প্রথম মডেল” সা¤প্রতিক সময়ে সিএসই কার্নিভাল ১০ এ এই বক্তব্য পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। অর্থাৎ শাবি হবে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সহ সাম্রাজ্যবাদী অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানগুলোর লগ্নী-পুঁজি বিনিয়োগের মৃগয়া ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে প্রশাসন পিপিপি’র মাধ্যমে টিএসসি নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের টিএসসি নির্মাণের প্রতি দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন পিপিপি’র মাধ্যমে বেসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

প্রয়োজন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন :
বাংলাদেশ একটি নয়াউপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ। এ দেশের যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা সবাই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তাই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বসংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি প্রভৃতির নির্দেশে আমাদের দেশের শিল্প কারখানা বেসরকারী হয় ও বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই ও বেকার হয়; কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার হয় সার, বীজ, কীটনাশক সংকটে জর্জরিত কৃষি ধ্বংস হয়। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজি বিনিয়োগের এবং বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সহ সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মত নয়াউপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলোর সেবা খাতকে বেসরকারীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লাসহ অন্যান্য সেবা খাতগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এবার মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকেও লগ্নীপুঁজি বিনিয়োগের স্বার্থে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। শিক্ষিত জাতি, উন্নত জাতি গঠনের প্রধান উপায় অথচ বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত কৌশলপত্রের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশকে উচ্চ শিক্ষা হতে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ অবস্থায় একটি গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালালদের উচ্ছেদের মাধ্যমে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রাম এক সূত্রে গাঁথা। তাই আসুন ঐক্যবদ্ধ ছাত্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালালদের উচ্ছেদ করে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×