somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূর্যালোকে দেখা একটি বিশালাকার স্বপ্ন :পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস

২৯ শে এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৩:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একটি সেতু। সূর্যালোকে দেখা একটি বিশালাকার স্বপ্ন। পুরো দেশকে জাগিয়ে তোলার একটি প্রয়াস। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলা এবং বেনাপোল স্থলবন্দর এই অঞ্চলে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় কয়েক কোটি মানুষের বাস। ভেবেছেন কি কখনো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কেন এখনো কোনো ভারি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি? দেশের সবচেয়ে বড় নদী পদ্মা। আর এই পদ্মাই দক্ষিণকে রেখেছিল আলাদা করে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করাই এ সেতু তৈরির উদ্দেশ্য। এ জন্য একুশ শতকের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হাতে নেয় বাংলাদেশ।

উত্তাল ওই পদ্মা পেরিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা মানেই এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের দুর্দশার চিত্র। কিন্তু ভাঙ্গন কবলিত এ সর্বনাশা সর্বগ্রাসী পদ্মার বুকে বিস্ময়কর এই সেতু নির্মাণ উন্নয়নশীল বাংলাদেশের পক্ষে কতটা সহজ? কতটা চ্যালেঞ্জ?

চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ লিমিটেড (সংক্ষেপে এমবিইসি) মূল সেতুর কাজ করছে। চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সংক্ষেপে সিআরইসি)-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এমবিইসি। মেজর ব্রিজ প্রতিষ্ঠানটি পদ্মা সেতু ছাড়াও বাংলাদেশে অরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্প টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন, কুড়িল উড়ালসেতু, দপদপিয়া ব্রিজ, তৃতীয় কর্ণফুলী ব্রিজ ইত্যাদি। এছাড়াও নিজেদের দেশ চীন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থাপনা নির্মাণ করে খ্যাতি কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে- ভিয়েতনামে ‘হ্যানয় মেট্রো লাইন ২এ’, মঙ্গোলিয়ায় ‘উলানবাতর নিউ ইন্টারন্যাশাল এয়ারপোর্ট হাইওয়ে প্রজেক্ট’, ইন্দোনেশিয়ায় ‘জাকার্তা-ব্যান্ডাং হাই স্পিড রেলওয়ে’, ইসরাইলে ‘তেলআবিব লাইট রেল (পশ্চিম সেগমেন্ট)’, উজবেকিস্তানে ‘কামচিক টানেল অব অ্যাংলিয়ান-প্যাপ ইলেকট্রিফাইড রেলওয়ে’, ইথিওপিয়ায় ‘আদ্দিস আবাবা-জিবুতি রেলওয়ে’, লাওসে ‘বোতেন-ভিয়েনতিয়েন রেলওয়ে’, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দ্য পাম আইল্যান্ড সেকেন্ড রিক্লেমেশন প্রজেক্ট’, মরক্কোতে ‘মোহামেদ সিক্স ব্রিজ’, তানজানিয়ায় ‘নিয়েরেরে ব্রিজ’, তেহরানে ‘হাইওয়ে টানেল’, গ্যাবনে ‘ন্যাশনাল পার্লামেন্ট বিল্ডিং’ ইত্যাদি।


পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে কয়েকটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। মূল ব্রিজ, রিভার ট্রেইনিং, জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড, মাওয়া অ্যাপ্র্যোচ রোড, টোল প্লাজা এবং মাওয়া-জাজিরা সার্ভিস এরিয়া। মেজর ব্রিজ গ্রুপ পদ্মা ব্রিজটি বানাচ্ছে স্টিল ট্রাস গার্ডার কাঠামোতে। পুরোটাই ঢালাইকৃত। ওই গার্ডার তোলা হয় ক্রেনের সাহায্যে। সেতু তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তিয়ানি (Tianyi) নামের ক্রেন। নির্মাণ কার্যক্রমে গতি আনতে ক্রেনটি এমবিইসি কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ডেভেলপ করেছে। ক্রেনটির লিফটিং ক্ষমতা ৩ হাজার ৬০০ টন!

যারাই ওই পথে পদ্মা পাড়ি দেবেন, পদ্মার দুই কূল জুড়ে দেয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখবেন! দেখবেন নদীর বুকে অসংখ্য ভাসমান ক্রেন। জার্মানি থেকে ভাসিয়ে আনা দৈত্যাকার হাইড্রোলিক হ্যামার বা হাঁতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গাঁথা হয়েছে ১২০ মিটার উঁচু একেকটি পাইল। যন্ত্রটির বিশেষত্ব হলো এটি একবারে আড়াই হাজার টন পর্যন্ত চাপ প্রয়োগ করতে পারে। বলা হয়, এটি ১০টি বোয়িং বিমানের চেয়েও বেশি ভারি! এই ভারে খুঁটিগুলো শক্ত হয়ে বসে যায় নদীর তলদেশে। এরকম ৬টি, কোথাও বা ৭টি পাইল দিয়ে তৈরি হয় বিশাল সেতুর একেকটি স্তম্ভ।

পদ্মা নদীর বিষেশত্ব কী? খরস্রোতা পদ্মায় ব্রিজ নির্মাণ কতটা চ্যালেঞ্জের কাজ? এক্সপার্টদের ভাষ্য, পানি প্রবাহ বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরেই এর অবস্থান। হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের ওপর দিয়ে রাজশাহীতে এসে নাম নিয়েছে পদ্মা। গোয়ালন্দে এসে যমুনার সঙ্গে এবং পূর্ব দিকে চাঁদপুরে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে নদীটি। সরকারি তথ্যসূত্রগুলো বলছে, পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১,৫৭১ ফুট (৪৭৯ মিটার) এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ফুট (২৯৫ মিটার)।

গবেষণা বলছে, মাওয়া পয়েন্টে প্রতি ২০ সেকেন্ডে যে পানি প্রবাহিত হয় সেই পানি রাজধানীতে ব্যবহৃত সারা দিনের পানির সমান। পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘণমিটার পানি প্রবাহিত হয়। নদীর তলদেশে মাটি সাধারণত একদমই নরম। বালির স্তরের মতোই। যা-ই প্রবেশ করানো হবে তা-ই গিলে ফেলার মতো অবস্থা। অন্যান্য দেশে নদীর তলদেশে বেডরক পাওয়া যায় অল্পসময়েই। কিন্তু পদ্মার বেডরক অনেক গভীরে। পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির পৃষ্ঠের উচ্চতা ১৩ তলা বিল্ডিং-এর সমান।

একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্র। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল ও দীর্ঘ নদীর পানি এই পদ্মা দিয়েই নামে বঙ্গোপসাগরে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে এই দুই নদী। নদী দুটির পলি জমেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অনেকখানি অঞ্চল। সেতু নির্মাণস্থলে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। উজান থেকে নেমে আসা ওই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে ব্রিজটিকে।


পদ্মায় ব্রিজ নির্মাণের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ রিভার ট্রেইনিং বা নদী শাসন। এই নদী শাসনের কাজ দেয়া হয় চীনেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রোকে। তৈরি করা হয় কনক্রিটের ব্লক। দুই পাড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসানো হয় এসব ব্লক। নদী শাসনে শুধু পাথরই লেগেছে ৩৮ লাখ টন। ব্লক ১ কোটি ৩৩ লাখ। পৌনে দুই কোটি পিস জিও ব্যাগ আরও কত কি!
এক সাক্ষাৎকারে পদ্মা ব্রিজের রেল লিঙ্কের প্রকল্প পরিচালক ওয়াং কুন বলেছেন, ‘ব্রিজ নির্মাণে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। এখানকার নরম মাটি শাসন বেশ কঠিন কাজ। বাংলাদেশ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থান করায় এখানকার মাটিতে ব্রিজ নির্মাণের চ্যালেঞ্জটা এমনিতেই বেশি। মাটির অনেক গভীরে যেতে হয়েছে। মাটি এতটাই নরম পাচ্ছিলাম যে কোনো কোনো পাইলিংয়ে আমাদের ১০০ মিটারেরও বেশি গভীরে যেতে হয়েছে। এজন্য অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়েছে।’
ওয়াং কুন জানাচ্ছেন, নরম মাটিকে উপযোগি করে তুলতে পিভিসি টেকনলোজি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রয়োজন হয়েছে প্রচুর পরিমাণে তাপ ও বিদ্যুৎ শক্তি। এছাড়া কেমিক্যাল, মেকানিক্যাল, পলিশিং বা সিএমপি প্রযুক্তির সাহায্যে ভূ-মণ্ডলকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। কাজ করেছে কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটও। মানুষের জন্য যেখানে কাজ করা বিপজ্জনক সেখানে কাজ করানো হয়েছে ওয়েল্ডিং রোবট দিয়ে। ব্রিজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে অনেক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ব্রিজ তদারকির ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটবে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হবে। রেল পথ ম্যানেজিং সিস্টেমে কাজে লাগানো হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence- AI)।


ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ সার্ভিস এরিয়া। কি নেই এখানে? মনে হতে পারে ঝকঝকে একটি রিসোর্ট। বিশ্বমানের সব সুবিধাসহ আছে কয়েক ডজন ডুপ্লেক্স আবাসন। মোটেল মেচ। ওয়াটার ট্যাংক, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, অগ্নি নির্বাপণ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ সাকসেশন, ফুটবল মাঠ, বাস্কেটবল কোট, সুইমিং পুল, ইনডোর স্টেডিয়াম, ক্রিকেট মাঠসহ ইত্যকার সব সুবিধা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন এসব জায়গা। ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের অফিস হিসেবে। সেতুর কাজ শেষে নি:সন্দেহে এটি রূপান্তরিত হবে একটি উন্নতমানের রিসোর্টে!

এই নির্মাণযজ্ঞে অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৪২ হেক্টর জমি। সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজও সেতু নির্মাণেরই অংশ। মাওয়া-জাজিরা এই দুই প্রান্ত মিলে মোট ১২ কিলোমিটার সড়ক পদ্মা সেতুকে জাতীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করছে।

মাওয়া থেকে শরিয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত বিস্তৃত এই সেতু। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ১৮.৩০ মিটার। লেন চারটি। পাইল সংখ্যা ২৯৪টি। সড়ক ভায়াডাক্ট ৩.১৪৮ কিলোমিটার এবং রেল ভায়াডাক্ট ০.৫৩২ কিলোমিটার। ডাঙ্গার অংশ ধরলে পুরো সেতুটি হবে ৯ কিলোমিটার। অ্যাপ্রোচ রোড ১২.১১৭ কিলোমিটার। পিলারের ওপর ইস্পাতের স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। দ্বিতল সেতুর উপরতলা দিয়ে চলবে মোটরজান। মোট পিলার ৪২টি। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান জোড়া দেয়া হয়েছে। একেকটি স্প্যানের ওজন প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন। সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ভূমিকম্প সহনশীল মাত্রা রিখটার স্কেলের ৯। সেতুর আয়ুষ্কাল ১০০ বছর।

স্থাপত্য শিল্পে বহু রেকর্ডের জন্ম দিয়েছে পদ্মা সেতু। মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল স্থাপন এই রেকর্ডের অন্যতম। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুতে পাইল এতো গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি। ৪০ থেকে ৪১ তলা ভবনের সমান একেকটি পাইলের গভীরতা। বলা হয়, আমাজনের ওপর কোনো ব্রিজ তৈরির আগ পর্যন্ত এই রেকর্ড ভাঙ্গা যাবে না।

দ্বিতীয় বিশ্ব রেকর্ড হলো পিলার এবং স্প্যানের মাঝে যে বেয়ারিং থাকে সেটি। পৃথিবীতে এর আগে এরকম বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে। একেকটি বেয়ারিংয়ের ওজন ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এর আগে এমন বেয়ারিং ব্যবহার করা হয় আমেরিকার একটি ব্রিজে। সেটির ওজন ৮ হাজার মেট্রিক টন।

তৃতীয় বিস্ময় নদী শাসন। বাংলাদেশ সেতু কতৃপক্ষের তথ্য মতে, ১৪ কিলোমিটার (১.৬ মাওয়া + ১২.৪ জাজিরা) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদী শাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পরের রেকর্ড ব্রিজে ব্যবহৃত ক্রেন। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুণতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। ২০২০ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম এই ব্রিজটি বানাতেই এতো দীর্ঘ দিন ক্রেনটি ভাড়ায় খেটেছে। ক্রেনটির বাজার দর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এছাড়া রেল ও রোডওয়ে স্ল্যাপ তৈরির জন্য মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে নির্মাণ করা হয় তিনটি বিশালাকার ইয়ার্ড। এর একটি মাওয়ায়। অন্য দুটি জাজিরায়। প্রতিটি ইয়ার্ড গড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ। পানির উপরিতল থেকে স্প্যানের নিচ পর্যন্ত দূরত্ব ১৮ মিটার। পানি থেকে স্প্যানের এই দূরত্ব ছয় তলা ভবনের সমান। ফলে নিচ দিয়ে বড় যেকোনো জলযান অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। সেতুতে ব্যবহৃত রড, বালু, সিমেন্ট, স্টিলজাত কাঠামো সবই বাংলাদেশে উৎপাদিত। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোই সরবরাহ করেছে এসব উপাদান।

বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়! পদ্মার বুক চিড়ে সেতুর ঠিক দুই কিলোমিটার দূরে গিয়ে সমপরিমাণ গভীরে আরও ৭টি পিলার নির্মিত হয়েছে। এই পিলারগুলো পদ্মা সেতু থেকেও কয়েকগুণ উঁচু। এগুলো বিশাল একেকটি টাওয়ারে পরিণত হবে। নদীর দুই পাড়ের মানুষের প্রয়োজনে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্যই এই টাওয়ার। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ এই সেতুটি নির্মাণে কাজ করছেন প্রায় চার হাজার মানুষ (মূল সেতু)। যাদের মধ্যে প্রায় ২ হাজার চীনের নাগরিক। বাকিরা বাংলাদেশি।


পদ্মা সেতুই বিশ্বে প্রথম যেটি কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগসহ পরিবহন সুবিধা। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট।২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যানটি স্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সেতুর মূল কাঠামোটি দৃশ্যমান হয়। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি বলছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগি হতে ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

সেতু পারাপারে টোল হবে কতো? সরকারের সেতু বিভাগ পদ্মা সেতুর জন্য টোল হারের একটি প্রস্তাব করেছে। সেটি ফেরি টোলের চেয়ে দেড়গুণ বেশি। সেতু চালু হওয়ার পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য গাড়ি ভেদে ১০৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৭৭৫ টাকা পর্যন্ত টোল গুনতে হবে। প্রতি ১৫ বছর পর টোলের হার ১০ শতাংশ বাড়ানো হবে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের একটি চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ি সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। টোলের হার প্রস্তাব করা হয়েছে সেই ঋণ পরিশোধের কথা মাথায় রেখেই।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পাল্টে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান। এই অঞ্চলের কৃষি পণ্য খুব সহজেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে মংলা ও বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের।

পদ্মা সেতু কতটা শক্তিশালী? কতটা টেকসই? কতটা চাপ সইতে প্রস্তুত? প্রাযুক্তিক বিশ্লেষণগুলো বলছে, পদ্মা সেতুর নিচ থেকে যদি ৬৫ মিটার বা তার চেয়েও বেশি মাটিও সরে যায় এবং একই সঙ্গে যদি ৭.৫ বা ৮ রিকটার স্কেল মাত্রায় ভূমিকম্প হয় এবং একই সঙ্গে যদি ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি কোনো ওজনের জাহাজ এসে সেতুর পিলারে সজোরে ধাক্কা দেয় তারপরও সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ রাখে এই সেতু।

পদ্মা বহুমূখী সেতুর মাধ্যমে নানাভাবে উপকৃত হবেন জনসাধারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থ-সামাজিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে উপকৃত হবেন এই অঞ্চলের মানুষ। সমীক্ষার বরাত দিয়ে পদ্ম সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলছেন, ব্রিজের জন্য দারিদ্যের হার কমে হবে এক শতাংশের কাছাকাছি। এই অঞ্চলের জিডিপি বেড়ে যাবে ৩ শতাংশেরও বেশি। আর দেশীয় মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাবে ১.২৩ শতাংশের বেশি।

পদ্মা সেতু ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার গড়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথের দূরত্ব কমে আসবে। ২০১১ সালের এক প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-দক্ষিণাঞ্চল যাতায়াতে প্রায় ২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় কমে আসবে। প্রতিবছর এ অঞ্চলে দারিদ্র্যতা হ্রাস পাবে ১ শতাংশ হারে। আর জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যতা হ্রাস পাবে ০.৮ শতাংশ। এছাড়াও নদী ভাঙ্গনের কবল থেকেও মুক্তি পাবে অসংখ্য মানুষ।

চায়না রেইলওয়ে গ্রুপটি তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পদ্মা সেতু নিয়ে লিখেছে- ব্রিজ নির্মাণ কাজটি শেষ হয়ে গেলে এই ব্রিজটি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনায় বড় ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্ভাবনারদ্বার উন্মুক্ত হবে। পাশাপাশি ব্রিজটি চীন ও প্যান-এশিয়া রেলপথ সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ সময় লাগবে পূর্ণাঙ্গ ব্রিজটি নিমাণে। ব্রিজটি জনসাধরণের জন্য খুলে দেয়া হলে রাজধানীর সঙ্গে এ অঞ্চলগুলোর যাতায়াতে গড়ে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় কমে আসবে। বাংলাদেশের জিডিপিতে যোগ হবে ১.৫% প্রবৃদ্ধি।

পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির উপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর সর্বশেষ অর্থাৎ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে সেতুবন্ধন হয় পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০টি জেলা।


এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০১১ সালের এক তথ্য মতে, দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ অঞ্চলে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেশি। অথচ জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বাস পদ্মার দক্ষিণে। আর এসবের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। পদ্মা সেতু চালু হলে তারা দ্রুতই উন্নতি করতে পারবে।

১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পদ্মা সেতু নির্মাাণের পকিল্পনা হাতে নেয়। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুর কাজ প্রায় শেষের পথে। এসময় পদ্মা ব্রিজের জন্য একটা সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে। নদীর ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করতে ২০০৪ সালে জাপান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অনেক যাচাই-বাছাই শেষে কনসাল্টেন্সি সংস্থা জাইকার একটি টিম মাওয়া পয়েন্টকে নির্বাচন করেন ব্রিজের জন্য।

তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ প্রথম সভায় জাইকার প্রতিবেদনের অনুমোদন দেয়া হয়। শুরু হয় সেতুর প্রকৃত ডিজাইন প্রক্রিয়া। বিস্তারিত নকশা প্রণয়নে নিয়োগ দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান Maunsell-Aecom-কে।

২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে বহু নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী হয় পদ্মা সেতু। বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে একের পর এক দূর্নীতির অভিযোগ আসা, অভিযোগ থেকে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি প্রদান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মন্ত্রীত্ব হারানো ও কানাডিয়ান আদালতে বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি। বিশ্ব ব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেয়। বন্ধ করে অর্থায়ন। সরকারও বয়কট করে বিশ্বব্যাংককে।

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এলো ১৭ জুন, ২০১৪ সাল। সিদ্ধান্ত হয় ধার করে নয় বরং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মিত হবে সেতু। নি:সন্দেহে সাহসী সিদ্ধান্ত! চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি নামে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এদিন চুক্তিবদ্ধ হয় সরকার। কথা হলো তারা পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ করবে। এ বছরই শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ।

পদ্মা সেতু দেশের জন্য মৌলিক কী পরিবর্তন আনবে? এ প্রশ্নে মোটা দাগে দুটি ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা যায়। (ক) মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে সময় বাঁচবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসাবাণিজ্য আরও গতিশীল হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। (খ) সেতুকে ঘিরে বহু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটবে এই অঞ্চলে। গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে ইতিবাচক ও অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে এই সেতু। গড়ে উঠবে নতুন শিল্প-কারখানা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে যুগান্তকারী পরিবর্তন। স্বপ্নের সেতু দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর এখন দুই পাড়ের মানুষ।

লেখক: মো মুসা-আল -কাজিম ( বর্ষন মোহাম্মদ) নির্বাহী সম্পাদক ,দৈনিক মুন্সীগঞ্জের খবর
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৩:৩৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×