আল-মুহসাবা ও শাব্দিক অর্থ আত্ন-সমালোচনা। নিজের হিসাব নিজে করে নেয়া। পরিভাষায় মুহাসাবা শব্দের অর্ধ হল, মানুষ তার কৃতকর্ম ও কথাগুলোর প্রতি তাকাবে। যখন দেখবে সে কোন ভাল কথা বা কাজ করেছে তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং সে কথা ও কাজের উপর অটল থাকবে। আর যদি দেখে কোন খারাপ কথা বা কাজ করে ফেলেছে তাহলে সে তা ছেড়ে দেবে ও তাওবা ইসে-গফার করবে।
জ্ঞানী ও সচেতন ব্যক্তি মাত্রই কাজ করার পূর্বে চিন্তা করে দেখবে এ কাজটি তার জন্য কতোটা ভাল ফলাফল নিয়ে আসবে। যখন দেখবে যে, কাজটি ভাল ফল নিয়ে আসবে তখন সে তা করবে। আর যদি দেখে ফলাফল ভাল হবে না তখন সে করবে না।
মানুষ দুনিয়ার ব্যাপারে কোন কাজ করতে এ নীতিই অবলম্বন করে থাকে। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকুরী জীবি, কৃষক, গবেষক সকলেই এ নীতি অনুসরণ করে। প্রতিটি পদক্ষেপেই চিন্তা করে কাজটি কতটুকু সফল হবে।
একজন মুসলিম তো দুনিয়াকে আখিরাতের ক্ষেত্র বলে বিশ্বাস করে। আরো বিশ্বাস করে আজ সে যা করে যাচ্ছে কালকে তার হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। এ দিকের বিবেচনায় মানুষ যা কিছু আল্লাহর বিধি-নিষেধের আওতায় যা করবে তা আরো বেশী মুহাসাবার দাবী রাখে।
আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালন ও বর্জন হল সবচেয়ে বড় ব্যবসা। দুনিয়ার কোন ব্যবসা বা কাজ কর্মে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব, কিন্তু আখিরাত সম্পর্কিত কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কখনো সম্ভব হয় না। আখিরাতে কেহ সফলকাম হলে সেটাই হবে স্থায়ী সফলতা আর কেহ ব্যর্থ সেটাই হবে স্থায়ী ব্যর্থতা।
হাসান বসরী (রা.) বলেন, আল্লাহ ঐ বান্দার প্রতি রহম করুন, যার সামনে কোন কাজ আসলে সে চিন্তা করে এটা আল্লাহর জন্য না কি তার পার্থিব স্বার্থ আদায়ের জন্য। যদি আল্লাহর জন্য হয় সে তাড়াতড়ি পথ চলতে শুরু করে। আর যদি পার্থিব স্বার্থের জন্য হয় তাহলে সে গড়িমসি করে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুহাসাবা করতে নির্দেশ দিয়েছে :-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ. ) الحشر : ১৮)
‘হে মুমিনগন! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী কালের জন্য সে কী পাঠিয়েছে।’
ইবনে কাসীর (র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তোমাদের নিজেদের হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বে নিজের হিসাব নিজে করে নাও। এবং তাকিয়ে দেখ তুমি নিজের চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য, তোমার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের জন্য কী সঞ্চয় করেছ।
মুহাসাবার প্রতি পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের গুরুত্ব প্রদান :
উমার (রা.) বলেছেন :
حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا، فإنه أهون عليكم في الحساب غدا أن تحاسبوا أنفسكم اليوم، وتزينوا للعرض الأكبر، يومئذ تعرضون لا تخفى منكم خافية.
‘তোমরা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে নিজেদের হিসাব করে নাও। আমল ওযন করার পূর্বে নিজেদের আমলের ওযন নিজেরা করে নাও। আজকের হিসাব আগামী কালের হিসাব প্রদানকে সহজ করে দেবে। মহা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও। সে দিন উপস্তিত করা হবে তোমাদেরকে এবং তোমাদের কিছুই গোপন থাকবে না।’ মায়মুন ইবনে মেহরান বলেন :
لايكون الرجل تقيا حتى يكون لنفسه أشد محاسبة من الشريك لشريكه.
‘নিজের অংশীদার থেকে মানুষ যে রকম হিসাব করে পাওনা বুঝে নিয়ে থাকে, নিজের আমলের হিসাব তার চেয়ে কঠিনভাবে না করলে কেহ মুত্তাকী হতে পারবে না।’ হাসান বসরী (র.) বলেন :-
المؤمن قوام على نفسه، يحاسب نفسه لله عز وجل، وإنما خف الحساب يوم القيامة على قوم حاسبوا أنفسكم في الدنيا، وإنما شق الحساب يوم القيامة على قوم أخذوا الأمر من غير محاسبة.
‘আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে এ ভয় করে যে নিজের কর্মের হিসাব নিজে করবে সে সত্যিকার সাহসী মুমিন। যারা দুনিয়াতে নিজেদের কর্মের হিসাব নিজেরা করেছে পরকালে তাদের হিসাব-নিকাশ হাল্কা ও সহজ হবে। আর যারা পৃথিবীতে নিজেদের হিসাব করেনি পরকালে তাদের হিসাব দেয়া হবে অত্যন্ত কঠিন।”
মুহাসাবা কিভাবে করবেন :
মুহাসাবার জন্য শরীঅত নির্দেশিত নিদিষ্ট কোন নিয়ম নেই। মুমিন ব্যক্তি নিজে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেটা ভাল মনে করবেন সেটার হিসাব করতে চেষ্টা করবেন। যতবেশী নিজের কর্মকান্ডগুলো মুহাসাবা করবেন ততই কার কল্যাণ। কি কি বিষয়ে মুহাসাবা করা যেতে পারে এর এর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নীচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
(ক) প্রথমে হিসাব নিতে হবে আল্লাহ আমার প্রতি যে সকল কাজ, আকীদা-বিশ্বাস ফরজ করে দিয়েছেন আমি সেটা আদায় করছি কিনা ? আদায় করে থাকলে সেটা কি ইখলাছের সাথে আদায় করছি ? সেটা আদায় করতে যেয়ে রাসূলুল্লাহ (স.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করছি কিনা? এ সকল প্রশ্নের উত্তরে যদি কোন ক্রটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে তা দূর করতে হবে এবং এর জন্য তাওবা ও ইস্তেগফার করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহীদ বা আল্লাহর একাত্ববাদকে প্রাধ্যান্য দেবে। দেখতে হবে আমি তাওহীদের পরিপূর্ণ আকীদা পোষণ করছি কি না ? সকল প্রকার ছোট বড় শিরক থেকে পুত-পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছি কি না? সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা, তাওয়াক্কুল, তার কাছে আশ্রয় নেয়া ও তার কাছেই দোয়া-প্রার্থনা করছি কি না ? অত:পর ফরজ কাজের হিসাব নিতে চেষ্টা করা ; পাঁচ ওয়াক্ত সালাতসমূহ সময়মত, তার সকল শর্ত, রুকন, ওয়াজিব, সুন্নাতের সাথে আদায় হচ্ছে কি না?
(খ) আল্লাহ তাআলা যা কিছু নিষেধ করেছেন তা আমি কতখানি পরিহার করতে পেরেছি। এই বিষয়টার হিসাব নেয়া।
(গ) আমার আচার-আচারন সম্পূর্ণভাবে ইসলামী চরিত্রে পরিণত হয়েছে কি না? যদি না হয়ে থাকে তবে তা অর্জনের জন্য কোন প্রচেষ্টা চালিয়েছি কি না ? আর চরিত্রের খারাপ দিকগুলো পরিত্যাগ করতে পেরেছি কি না ? এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে থাকলে তা কতটা সফল হয়েছে ?
(ঘ) সুন্নাত ও নফল আমলগুলো আদায়ের ব্যাপারে কতখানি যত্নবান হয়েছি তা হিসেব করে দেখা।
(ঙ) উপরোল্লিখ বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সকল কাজ-কর্মগুলো আমি আল্লাহ তাআলার সন'ষ্টি অর্জন করার জন্য করতে পেরেছি কি না তার হিসোব নেয়া।
এভাবে মুহাসাবা করে, নিজের হিসাব নিজে নিয়ে যে কোন মুসলিম নিজেকে উন্নত করতে পারে। পূর্ণতা ও সফলতার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে।
মুহাসাবার নির্দিষ্ট কিছু বিষয় :
(ক) জ্ঞান অর্জন করা। জ্ঞান বলতে শরয়ী জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। যা ঈমান ও কুফর, হক ও বাতিল, সরল পথ ও ভ্রান-পথ, লাভ ও ক্ষতির, কল্যাণ ও অকল্যাণ এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। যে ব্যক্তি এ জ্ঞানে যত উন্নতি লাভ করতে পারবে তার মুহাসাবা তত পূর্ণতা লাভ করবে।
(খ) নিজের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা। নিজেকে ভাল মনে করে আত্নতৃপ্তিতে মগ্ন হওয়া উচিত নয়। কোন ভাল কাজ করে যদি মনে করেন আমি অনেক কিছু করে ফেলেছি তাহলে মুহাসাবা করা সম্ভব হবে না। আমাদের সকলের বুঝতে হবে যে আমরা যতই ভাল কাজ করে থাকিনা কেন আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে তা ক্রটিপূর্ণ। তিনি এ ক্রটি ক্ষমা করে যদি কাজটা কবুল করে নেন তাহলে এটা তাঁর অনুগ্রহ। আর যদি তিনি কাজটি ক্রটিপূর্ণ হওয়ার কারণে কবুল না করেন তাহলে এটা হবে তার ইনসাফ।
ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেনে: যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে সে ই নিজের সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখে। আর যে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞ, সে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করে থাকে।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (র.) বলেন : ‘মানুষেরা সর্বদা ভুল-ক্রুটি করে আল্লাহর ক্ষমার মুখাপেক্ষী থাকে। আর যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণভাবে আদায় করেছি এবং আল্লাহর ক্ষমার প্রয়োজন নেই, সে পথভ্রষ্ঠ।
আমাদের পূর্ববর্তীদের মুহাসাবার উদাহরণ :
আনাস (রা.) বলেন : আমি একদিন দেখলাম উমার (রা.) একটা দেয়ালের কাছে দাড়িয়ে নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, হে উমার! তুমি মুমিনদের শাসক, তোমার ধ্বংস অনিবার্য! তুমি অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করবে, নয়তো তিনি তোমাকে শাসি- দেবেন।
মুহাসাবার ফলাফল :
মুহাসাবার উপকারিতা অনেক। এর কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হল :
(ক) মুহাসাবকারী নিজের দোষত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হয়। আর যে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হতে না পারে, সে তা সংশোধন করতে পারবে না।
(খ) কু-প্রবৃত্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেয়া।
(গ) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ধৈর্য অনুধাবন করা। এভাবে যে, আমি কত বড় অন্যায় করেছি অথচ তিনি আমাকে তৎক্ষনাৎ শাস্তি না দিয়ে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
(ঘ) যে দুনিয়াতে নিজের হিসাব নিজে করবে পরকালে আল্লাহর কাছে তার হিসাব দেয়া সহজ হবে।
নুমান বিন আবুল বাশার

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




