উৎসর্গ -"ব্লগার নতুন " ভাই সহ তাদেরকে যারা সবসময় ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে থেকে ন্যায়কে ও জ্ঞানী - গুনীদের থেকে ভালো জিনিসটা জানার-বুঝার-গ্রহনের চেস্টা করেন।

ছবি - kalerkantho.com
সৃষ্টিকর্তা-আল্লাহ -ভগবান-ঈশ্বরে যাদের বিশ্বাস আছে এবং যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরেও আরেক জীবন আছে এবং সেখানে সবাই তাই পাবে যা তারা এ দুনিয়ায় করেছে এবং যার যার ধর্ম জীবন ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস আছে তাদের বলা হয় আস্তিক বা ধার্মিক। আর আস্তিক শব্দটির বিপরীত শব্দ হলো নাস্তিক ।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে ,তার প্রেরিত প্রতিনিধিদের,তার নির্দেশিত জীবন ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি অবিশ্বাসীদের বলা হয় নাস্তিক। আর নাস্তিকরা নিজেদের মুক্তমনা পণ্ডিত ও জ্ঞানী ভেবে থাকেন। বস্তুত তাদের জ্ঞান অশিক্ষিতদের জানার চেয়েও সীমিত।এখানে অশিক্ষিত বলতে অক্ষরজ্ঞান বিহীন অথবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেননি এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। একজন অশিক্ষিত ব্যক্তিও তার সহজাত জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পান আর তাই একজন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির নাস্তিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, " এ পৃথিবীতে তার আগমন নিছক উদ্দেশ্যবিহীন নয়"।অথচ নাস্তিকতার দাবিদাররা (তথা কথিত শিক্ষিতরা) কোন কিছুতেই স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পাননা ।স্রষ্টাকে ছেড়ে তারা তা খুজে বেড়ান অন্য কিছুর মাঝে ।
পৃথিবী নামক গ্রহটি সৌরজগতের অন্তর্ভুক্ত। সূর্য নামক নক্ষত্রকে পৃথিবী ও অপর কিছু গ্রহ নির্ধারিত নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আবর্তন করছে। আবার পৃথিবীকে আবর্তন করছে চাঁদ নামক উপগ্রহটি। সৌরজগতের অপর অনেক গ্রহের এক বা একাধিক উপগ্রহ রয়েছে। পৃথিবীর ভূমি, পানি, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-প্লাবন, আলো-বাতাস, দিবা-রাত্রি, গাছপালা, তরুলতা, জীবজন্তু সব কিছু নিয়মনীতি পালন করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
যেমন- পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর আবর্তিত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করছে। পৃথিবীর নিজ অক্ষের আবর্তনের ফলে দিবা-রাত্রি ও জোয়ারভাটা হয়, অপর দিকে কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তনের কারণে ঋতু পরিবর্তন ও দিবা-রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য পানির তিনটি রূপ রয়েছে। কঠিন, তরল ও বায়বীয়। সূর্যের তাপে পানি বায়বীয় রূপ ধারণ করে মেঘে পরিণত হচ্ছে। মেঘ আবার বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর গাছপালা ও তরুলতাকে সজীব করে তুলছে। বায়বীয় পানি পাহাড়ের চূড়ায় বরফ হয়ে কঠিন আকার ধারণ করছে। সূর্যের তাপে গলে নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীর বর্জ্য সাগরে নিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর বর্জ্য সাগরে পড়ার পরক্ষণেই সাগরের পানির লবণাক্ততার কারণে দূষণমুক্ত হচ্ছে। পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষসহ সব জীবজন্তুর জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানুষসহ সব জীবজন্তু অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ করছে। অপর দিকে গাছপালা ও তরুলতা কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করছে ও অক্সিজেন নিঃসরণ করছে। পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু মানুষের কল্যাণে একজন সৃষ্টিকর্তা এককভাবে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা দু’জন হলে পৃথিবী ও বিশ্বজগতের নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলা কি ধরে রাখা যেত? এক সৃষ্টিকর্তা এককভাবে পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণের কারণেই মানুষের জীবনধারণের উপযোগী অক্সিজেন ও বিশুদ্ধ পানির অফুরন্ত ভাণ্ডার নিঃশেষিত হচ্ছে না।
সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত নিয়মে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে দূষিত পানি বিশুদ্ধ হচ্ছে এবং পৃথিবীতে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী সাপ বছরে একবার খোলস পাল্টায়। খোলসটি পরিবর্তনের পর পরিত্যক্ত আবরণটি সাপের কাছে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু দেখা যায়, ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপিলিকা খোলসটির বিভিন্ন খণ্ড দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজ গৃহে নিয়ে ভবিষ্যতের খাদ্য হিসেবে মজুদ করছে। মানুষ ও বিভিন্ন জীবজন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাত্যহিক যে বর্জ্য পরিত্যাগ করছে; তাতে দেখা যায় পোকামাকড়সহ অসংখ্য জলজ ও স্থলজ প্রাণীর জীবন ধারণের উপকরণ রয়েছে। এমন হাজারও উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে।
আমাদের দেশের সংবিধানেও প্রতিটি নাগরিককে আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার দেয়া হয়েছে। এ অধিকার একজন নাগরিকের কোনো ধর্ম পালন না করার অধিকার খর্ব করে না। আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধিতে যে কোনো ধর্মাবলম্বীর ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা বা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ীও ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দণ্ডনীয় অপরাধ।
আমাদের দেশের ৯০ ভাগের বেশি লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশের জনমানুষ ধর্মপ্রবণ। বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত একটি গানে ব্যক্ত করেন," মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই"। তার গানের মধ্যে সন্নিবেশিত এ বাক্যে ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি এবং তার মৃত্যু পরবর্তী এ দেশের মানুষ তার রচিত গানে ব্যক্ত আকাংখা পূরণে তাকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করেন। আমাদের জাতীয় কবির মনোবাঞ্ছা ও আকাংখার বিপরীত বক্তব্য আমাদের দেশের বরেণ্য একাধিক কবি সাহিত্যিক তাদের রচনায় তুলে ধরেছেন যা অপামর দেশবাসীর বিশ্বাসে আঘাত হানার শামিল। বাক-স্বাধীনতার কথা বলে এসব ধর্মবিরোধী বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একজন মুসলমানকে ইসলামের পাঁচটি মূল বিষয় , যথা - ঈমান(কালেমা), নামাজ, রোজা,হজ ও যাকাত এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের জন্য দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মুসলমানদের উপাসনালয় মসজিদ হতে প্রতিদিন পাঁচবার আজানের মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। ধর্মপ্রাণ যেকোনো মুসলিমের কাছে আজানের ধ্বনি অতি মধুর। আর তাই দেখা যায়, সভা বা যেকোনো অনুষ্ঠান চলাকালীন আজানের ধ্বনি শোনা গেলে আজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সভা বা অনুষ্ঠানের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। মহিলাদের দেখা যায় আজানের বাণীর প্রতি সম্মানের বহিঃপ্রকাশে মাথা উন্মুক্ত থাকলে তা শাড়ির আঁচল বা ওড়না দিয়ে আবৃত করে নেয়।
আজানের ধ্বনি যে এ দেশের জনমানুষের কাছে সুমধুর এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান মহা কবি কায়কোবাদ রচিত ‘আযান’ কবিতায়। কবিতাটিতে তিনি বলেন, "কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনি, কি মধুর আযানের ধ্বনি"।
এখন কায়কোবাদের কাছে আজানের ধ্বনি মধুর ঠেকলেও আমাদের দেশেরই অন্য কারো কাছে আজানের মধুর ধ্বনি উপদ্রব এবং কাকের কা কা শব্দ ।এখন তার দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন তার নীচু মানসিকতার পরিচায়ক অপরদিকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের ধর্মানুভূতির ব্যাপারে নেতিবাচক। তার কাব্যে উল্লিখিত বাক্যটি আমাদের দেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ীও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।
নাস্তিকরা দুই ধরনের হয় ।
এক - এ জাতীয় নাস্তিকেরা তারা তাদের নাস্তিকতার বহিঃপ্রকাশে কখনো কোনো ধরনের অবমাননাকর ও আপত্তিকর বাক্য ব্যবহার করে না বা কোন ধর্মকে অবমাননা কর কিছু বলেনা যদিও তারা কোন ধর্ম পালন করেনা।
দুই - এ জাতীয় নাস্তিকেরা তারা তাদের নিজেদের মহাজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় অপরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে এমন অবমাননাকর ও আপক্তিকর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটায় যা প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃত বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে কটাক্ষের নামান্তর।
একজন আস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ প্রবল। পক্ষান্তরে একজন নাস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ শিথিল। এ শিথিলতার কারণে অতিসহজেই তাদের অনেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন।

ছবি - pinterest.com
বাক স্বাধীনতা (মত প্রকাশ) এর ব্যাপারে পাশ্চাত্য কী বলে -
বাক স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার । মৌলিক অধিকার দাবির মূল কথা হলো- মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে একনায়কতন্ত্র, নির্মম স্বৈরতন্ত্র ও নির্দয় সাম্যবাদের প্রভাব থেকে হেফাজতের ব্যবস্থা করা, সসম্মানে জীবনের গ্যারান্টি দেয়া, তার ব্যক্তিগত যোগ্যতার উন্মেষ ঘটানো এবং চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার এমন এক পরিমণ্ডলের ব্যবস্থা করা, যা রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকবে।
পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা মৌলিক মানবাধিকারের বিবর্তনশীল ইতিহাসের সূচনা করেন খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিস থেকে। এরপর খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে এক লাফে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে প্রবেশ করেন। ষষ্ঠ থেকে দশম শতক পর্যন্ত ৫০০ বছরের ইতিহাস থেকে তারা মুখ ঘুরিয়ে নেন এ জন্য যে, সেটি ছিল ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ।গ্রিক দার্শনিকরা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও তাদের লেখালেখিতে মানবীয় সমতা ছিল অনুপস্থিত। তারা মনুসংহিতার মতো সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে এবং শাসন কর্তৃত্ব শুধু দার্শনিকদের প্রদান করেন। প্লেটো ও এরিস্টটল গণতন্ত্রের বিপক্ষে ছিলেন এবং ন্যায়বিচারকে শ্রেণিভিত্তিক করেন। এরিস্টটল তো এমনও বলেছেন, " ন্যায়বিচার হচ্ছে সেই গুণ যার সাহায্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ মর্যাদা অনুযায়ী এবং আইন অনুসারে অধিকার লাভ করে"।
এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথমে সোচ্চার হন দার্শনিক যেনো। তিনি বলেন,"প্রাকৃতিক বিধান হচ্ছে চিরন্তন। তার প্রয়োগ কোনো বিশেষ রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপরই নয়, বরং প্রতিটি মানুষের ওপর হয়ে থাকে। এটি নিরপেক্ষ আইনের চেয়ে উচ্চতর এবং ন্যায় ইনসাফের সেসব মৌলিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে"। ‘চেতনার চোখ’ দিয়ে তা সুস্পষ্টভাবে দেখা যেতে পারে। এ আইনের অধীনে অর্জিত প্রাকৃতিক অধিকারগুলো কোনো বিশেষ রাষ্ট্রের বিশেষ নাগরিকদের পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেকোনো স্থানে বসবাসকারী মানুষ কেবল মানুষ ও বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ হওয়ার ভিত্তিতে তা লাভ করে থাকে (Cranston M/Human Rights Today/ London. 1964) রোমের বিখ্যাত আইনবিদ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী সিসেরো এই মতবাদের সমর্থনে বলেন, ‘এই বিধান সর্বদা অপরিবর্তনীয় এবং এর বদল করা অপরাধ।’
মৌলিক অধিকার আন্দোলনের সূচনা হয় ব্রিটেনে রাজা ও পার্লামেন্টের ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। ১২১৫ সালে ম্যাগনাকার্টা ছিল ঐতিহাসিক দলিল। যদিও কোনো কোনো সমালোচকের মতে সেটি ছিল রাজন্যবর্গের, জনগণের নয়, স্বার্থরক্ষার দলিল। ১৪ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত ইউরোপ প্লাবিত হয় মেকিয়াভেলির দর্শনে, যার মূল মনোযোগ ছিল রাজাদের শক্তি বৃদ্ধি। উপমহাদেশের রাজতন্ত্রেও ছিল একই অবস্থা। চাণক্য, রাজা চন্দ্র গুপ্তকে মন্ত্রগুপ্তির দীক্ষা দিয়েছিলেন। শুধু রাজা ও মন্ত্রী চার কানই জানবে ওই মন্ত্র। ‘ষট্ট কর্ণাশ্ছিদ্যতে মন্ত্র’ : অর্থাৎ চার কান পেরিয়ে ছয় কানে গেলেই মন্ত্রের দফারফা। ১৭ শতকে মানুষের প্রকৃতিগত অধিকারের ধারণা ফিরে আসে। ফরাসি দার্শনিক দেনিস দিদেরোঁ ন্যাচারাল রাইটকে প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার হিসেবে গণ্য করেন। তার মতে, মানুষ একটি সার্বভৌম সদিচ্ছা (Universal Will) দ্বারা পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে সে ভালো-মন্দ বুঝতে পারে। এরপর লক, রুশো, হবস তাদের সামাজিক চুক্তির মতবাদ দিয়ে এসব সমর্থন করেন। এর পরিণতিতে ফরাসি মানবাধিকারের ঘোষণা, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পিতৃবর্গ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ছিলেন। ১৭৭৬ সালের ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া সনদে জেমস ম্যাডিসন রচিত অধিকার সনদ ঘোষিত হয়, যাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং আদালতের আশ্রয় লাভের গ্যারান্টি দেয়া হয়। টমাস জেফারসন রচিত ঘোষণায় বলা হয়, সব মানুষ সৃষ্টিলগ্নে সমান। তারা জন্মগতভাবে ঈশ্বর প্রদত্ত অপরিত্যাজ্য অধিকার পায়। এসবের মধ্যে রয়েছে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের সন্ধানের অধিকার।ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে এসব যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেও ফরাসি ও ব্রিটিশ উপনিবেশের মানুষদের জন্য তা প্রযোজ্য ছিল না। আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করা হচ্ছিল ওই সময়ই এবং দাসপ্রথা ছিল চরমে।
এখন এখানে প্রশ্ন হচ্ছে প্রকৃতি মানে কী? রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, "এক আত্মা অপর আত্মার সাথে সম্পর্ক করতে চায়"। কিন্তু কেন, কার নির্দেশে, আত্মার স্রষ্টাই বা কে, সে সম্পর্কে তিনি নিরুত্তর ছিলেন।
আজ সারা দুনিয়াজুড়েই মানবাধিকার তথা নানা অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষ চরম হতাশ। সর্বত্র আলোচনার বিষয় একচ্ছত্র রাজতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে দেয়া হলেও কথিত নির্বাচিত সংসদের গর্ভ থেকে যে একনায়কতন্ত্র জন্ম নিয়েছে, তাকে কিভাবে বশীভূত করা যায়? সারা দুনিয়া জুড়ে আদালতের ক্ষমতাও খর্ব হয়ে গেছে।এ বিষয়ে ইসলামের অবস্থানটা জেনে নেয়া প্রয়োজন।

ছবি - banglatribune.com
বাক স্বাধীনতা (মত প্রকাশ) এর ব্যাপারে ইসলাম যা বলে -
নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আল্লাহ মনোনীত একমাত্র দ্বীন প্রচার ও প্রসার শুরু করলেন, সেখানে থেকেই প্রকৃত সভ্যতার শুরু। সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দাসপ্রথার বিলোপ, সাম্য ও মানবাধিকার কায়েম, নারীমুক্তি সবই তিনি করেছেন আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে। মহান স্রষ্টা মানুষের জন্য শুধু এ পৃথিবীতে আলো, বাতাস, পানি, খাদ্যসহ জীবন ধারণের যাবতীয় উপকরণই দান করেননি বরং সামাজিক জীবন পরিচালনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানও দিয়েছেন। মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগে তাকে অধিকার ও কর্তব্যের চেতনাশক্তি দিয়েছেন। এই শক্তির নামই বোধশক্তি বা Common sense.
এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, " শপথ আত্মার এবং তার সুঠাম গঠনের।তারপর তাকে তার সৎকাজের এবং তার অসৎ-কাজের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে এবং সে ব্যর্থ হবে, যে তাকে কলুষিত করবে" (সূরা আশ শামস ,আয়াত - ৭ - ১০)। এই পৃথিবীতে আগমনকারী প্রথম মানব তার জীবনের সূচনা করেছিলেন জ্ঞানের আলো দিয়েই- " এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সে-সকল ফিরিশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও"। (সূরা বাকারা,আয়াত - ৩১)।
জগতের প্রত্যেক আত্মার সাথে আল্লাহ বৈঠক করে শপথ করিয়েছিলেন এবং তার রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন।এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, " যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত "।(সূরা বাকারা,আয়াত - ২৭) ।আর এই চেতনাশক্তিই হচ্ছে প্রাকৃতিক মতবাদ বা ইউনিভার্সাল উইল।
ইসলাম তার চিন্তা ও কর্মের ব্যবস্থায় অধিকার অর্জনের পরিবর্তে ফরজ অর্থাৎ অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদনের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। অপরিহার্য কর্তব্য সঠিকভাবে পালিত হলে অধিকারের প্রশ্ন থাকতেই পারে না। কুরআনুল করিম মানব সম্প্রদায়কে বিভিন্ন জাতিকে, নবী-রসূলগণকে, ব্যক্তিগণকে, কাফের, মুশরিক ও মুমিনদেরকে যেখানে যেখানে সম্বোধন করেছে; সেখানেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এবং এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ভিত্তিতেই দুনিয়া ও আখেরাতের কৃতকার্যতা ও উন্নতি লাভের অঙ্গীকার করেছে। আল্লাহ মৃত্যু ও জন্ম সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, মানুষ দুনিয়ায় কতটা সফলতা অর্জন করতে পারে, তা যাচাই করতে।
আর তাই অন্য ধর্মের বা অন্য মতবাদের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হলো পরমতসহিষ্ণুতা বা অন্যের মতবাদ বা ধর্মকে সম্মান করা ,আঘাত নয় । পরমতসহিষ্ণুতার পরিধি ইসলামে কত ব্যাপক ও বিস্তৃত এর ধারণা আমরা প্রিয় নবী ( সাঃ ) এর একটা জীবনচরিত থেকে পেতে পারি। তাঁর জীবনচরিত ছিল উদারতা, শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জন্মভূমি মক্কাবাসীর ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অত্যাচার-নির্যাতন চরমে পৌঁছালেও তিনি কিছুতেই সহিষ্ণুতা হারাননি। হিজরতের পর রাসূল ( সাঃ ) মক্কা ও তায়িফ বিজয়ের সময় যে অতুলনীয় ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়," বিজয়ের মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সা: সব যন্ত্রণা ভুলে গেলেন, সব অত্যাচার ক্ষমা করেন এবং মক্কাবাসীর প্রতি সর্বজনীন ক্ষমা ঘোষণা করেন। কোনো গৃহ লুণ্ঠিত হলো না বা কোনো স্ত্রীলোক অপমানিত হলো না"।
আমাদের সামাজিক-জাতীয় জীবনেও শান্তিশৃঙ্খলা সুরক্ষায় পরমত সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানবজাতির একটি মহৎ গুণ। যে সমাজে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা যত বেশি, সে সমাজে অপরাধ প্রবণতা তত কম। নবী করিম ( সাঃ ) বলেছেন, " আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার ক্ষমতা দান সবচেয়ে বেশি মূল্যবান" (বুখারি শরীফ)। ইসলামের আলোকে ধৈর্য, সংযম, উদারতা ও সহিষ্ণুতা মানুষের ঈমানকে পরিপক্ব করে। ঈমানের যতগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তার মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা অন্যতম।
পরমতসহিষ্ণুতার ব্যাপারে আল কোরআনে বলা হয়েছে," আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত"।(সূরা হা-মীম আস-সাজদা (ফুসসিলাত), আয়াত - ৩৪) ইসলামেপরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে কঠোরভাবে পালন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ছবি - jugantor.com
ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো -
১।শত্রুর হাত থেকে অমুসলিমদের রক্ষা করা।
২। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা।
৩। তাদের ধন-সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা দান।
৪। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকা।
৫।পূজা-অর্চনা থেকে পাদ্রি-পুরোহিতদের পদচ্যুত না করা।
৬। তাদের ধর্মীয় প্রতীক (ক্রুশ ও মূর্তি) বিনষ্ট না করা।
৭। তাদের কাছ থেকে উশল নেয়া হবে না।
৮। তাদের অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করা হবে না।
অমুসলিমদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক পৃথিবীর সব ভূখণ্ডে ইসলামের শান্তিকামিতার আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পরমতসহিষ্ণুতার এত বাস্তব উদাহরণ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানুষের তার নিজস্ব শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানলব্ধ পাণ্ডিত্যের কূপমণ্ডূকতায় আবদ্ধ না থেকে পাশাপাশি অন্যান্য বুদ্ধিমান বিবেকসম্পন্ন জ্ঞানী লোকের পাণ্ডিত্যের অভিজ্ঞতা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, পারস্পরিক মতামতের সারবত্তা ও যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করা ও বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে সঠিক যুক্তিযুক্ত যা প্রমাণিত হবে তা সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার মানসিকতা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করাই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ পরমতসহিষ্ণু হতে হলে তাকে অনেক উদার হতে হয়।আর রাষ্ট্র বা ধর্মীয় যেকোনো বিষয়ে সংলাপ, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সহিষ্ণুতার সঙ্গে শান্তিশৃঙ্খলা ও ঐক্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কাউকে আঘাত করে বা কাউকে ছোট করে নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে আমাদের নিজ অধিকার ও কর্তব্যের সীমারেখা সম্পর্কে জানার-বুঝার-মেনে চলার তওফিক দান করুন এবং সুন্দর ও শুশৃংখল সমাজ বির্নিমানে আমাদেরকে অবদান রাখার তওফিক দান করুন।
==============================================================
তথ্যসূত্র - আল কোরআন,হাদীস ও উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




