somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" মহামানব রাসূল (সাঃ) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বিনম্র জীবনাচরণ ", যা হতে পারে মানব জাতির জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। (শেষ পর্ব )।

১৭ ই অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি - iqna.ir.bd

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ ) এ দুনিয়ায় এসেছিলেন পথ ভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়ে দিতে ৷ মিথ্যা ও অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর পথে পরিচালিত করতে ৷তাঁর আগমণ প্রথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । তাঁর আবির্ভাব সত্য ও সুন্দরের নির্ভীক বিজয়ের স্মারক ৷ তাঁর আগমনে আমরা পেয়েছি ইহকালীন শান্তির সাথে সাথে পরকালীন মুক্তির দিক-নির্দেশনা । আর তাই বিনয়ে অবনত শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই বিশ্বের সেই শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ ) ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মানবীয় গুনাবলীর সমন্বয়ে এক মহামানব। তার চাইতে উত্তম ব্যবহার কারো ছিল না বলেই তখন তাকে আল-আমিন বা বিশ্বস্ত উপাধী দেয়া হয়েছিলো । বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন মহৎ চরিত্রের অধিকারী। তার ব্যবহার সকলকে মুুুুগ্ধ করে দিতো। দাস-দাসীদের সাথে তিনি সব-সময় ভালো ব্যবহার করতেন । কখনো কাউকে কটু কথা বলা তো দূূূূরে কেউ তার বিরুদ্ধে কখনো কোন অভিযোগ করতে পারেনি। চরম শত্রুরা পর্যন্ত তাকে বিশ্বাসী বলে ডাকতো।তার শত্রুরা পর্যন্ত কোন দিন তাকে মিথ্যাবাদী বলতে পারেনি। তিনি তার জীবনে কখনো কোন দিন কোন মিথ্যা বলেনি। মক্কার কাফেররা পর্যন্ত তাকে আল-আমিন মানে বিশ্বাসী বলে ডাকত । মক্কার কাফেররা, শত্রুরা পর্যন্ত নবী মুহাম্মদ (সাঃ ) এর কাছে তাদের দামী জিনিস পত্র আমানত রাখতো।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, "নিশ্চয়ই আপনি এক মহান চরিত্রের অধিকারী"। (সূরা ক্বালাম,আয়াত - ৪)। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ আরো বলেন, " আর আমরা তো আপনাকে (হে মুহাম্মদ) সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি"। (সুরা আম্বিয়া,আয়াত - ১০৭)। অন্য এক আয়াতে আরো বলা হয়েছে,"আর আমরা তো আপনাকে সমগ্র মানুষের জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। " (সূরা সাবা,আয়াত - ২৮)।

আধুনিক কালেও হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অমুসলিম মনীষীদের সেই রকমই ধারনা যে তিনি একজন ভাল মানুষ যিনি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বিনম্র জীবনাচরণের জন্য মানুষের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । নিম্নে কয়েকজন অমুসলিম মনীষীর মন্তব্য তুলে ধরা হলো -


ছবি - ittefaq.com.bd

১। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ১৯৩৬ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুভেচ্ছা বাণীতে হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সম্পর্কে বলেছিলেন," যিনি বিশ্বের মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভবনাময় জীবনশক্তির সঞ্চার করেছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) । পয়গম্বর এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যারা অনুসরণ করেছেন, আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তারা যেন জীবন সম্পর্কে তাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং পয়গম্বরের প্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেন। তারা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন, যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়"।

২। জর্জ বার্নাড শ - পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, " মধ্যযুগের কতিপয় গণ্ডমূর্খ ধর্মোন্মাদ, ইসলাম ধর্মের বীভৎস রূপ পেশ করেছেন। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে তারা ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক আন্দোলন করেছেন। তারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে মার্জিত ভাষায় প্রকাশ করেননি। আমি তাদের সব উক্তি গভীরভাবে অনুধাবন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এক মহান ব্যক্তিত্ব, যিনি সঠিক অর্থে মানবতার মুক্তিদাতা"।

৩। কার্ল মার্কস - কার্ল মার্কস বলেছেন, " এই ট্যাক্স (যাকাত) একটি ধর্মীয় কর্তব্য, এটি আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য করণীয়। ধর্মীয় দিক ছাড়াও যাকাত একটি প্রাণবন্ত দৃঢ় সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার হাতিয়ার। এটিই মুহাম্মদী রাষ্ট্রের কোষাগার। এর দ্বারা অভাবী, গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করা হয়। ইতিহাসের এ বিরল পদ্ধতি সর্বপ্রথম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে। যাকাত এমন এক ধরনের ট্যাক্স, যা ধনী সম্পদশালী বিত্তবান ও ব্যবসায়ীদের থেকে বাধ্যতামূলভাবে আদায় করে ইসলামী রাষ্ট্রের অক্ষম, প্রতিবন্ধী, এতিম, নিঃস্ব ও অনাথদের মধ্যে বণ্টন করে থাকে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান যাবতীয় বিরোধপূর্ণ দেয়াল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ পদ্ধতির আওতায় সমগ্র জাতি একটি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ নীতির অন্তর্ভুক্ত হয়। যাকাতের মাধ্যমে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার পেছনে কখনো পারস্পরিক শক্রতা অথবা বিদ্বেষ ছিল না। এর ন্যায়সঙ্গত ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি যে নবীর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে তিনি ছিলেন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত"।

৪। পি কে হিট্টি - বিশ্ববিখ্যাত ইহুদি পণ্ডিত, ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি বলেছেন, " বিশ্বের নবীদের মধ্যে শুধু মুহাম্মাদ (সাঃ) ই একমাত্র নবী যিনি ইতিহাসের পূর্ণ আলোতে জন্ম নিয়েছেন, অর্থাৎ তার সমগ্র জীবন কথা, কাজ ও সমুদয় অবস্থা অবিকল অপরিবর্তিত অবস্থায় অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি পৃথিবীতে এমন এক ঐশী ধর্ম পেশ করেছেন, যাতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তাঁর প্রচেষ্টায় এমন একটি উন্নত সংগঠন অস্তিত্ব লাভ করল যাদের ‘আল্লাহর দল’ বলা হয়। এ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্য স্বীয় গোত্র, বংশ, পরিবার ও প্রাচীন সম্পর্ক ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই ভাইয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে তাঁরা গোত্র ও সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলো এবং বর্তমান বিশ্বের এ ষষ্ঠাংশ অধিবাসী পবিত্র সম্পর্কের কারণে এক আত্মা ও অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে"।

৫।বেনথাম - ব্রিটিশ লেখক বেনথাম বলেছেন, " মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ধর্মে সব নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্য হারাম ঘোষিত হয়েছে। এটিই তাঁর পবিত্র ধর্মের পবিত্রতার দলিল। এ কারণেই তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসাযোগ্য " ।

৬।আইজ্যাক টেইলর - ইংরেজ পাদ্রি আইজ্যাক টেইলর তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, " শুধু ইসলাম ধর্মেরই এ বিশেষত্ব যে, মানুষের জীবনের সামগ্রিক অধিকারে জাতির প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সঠিক সাম্যের বাস্তব রূপ দিয়েছে। বিভিন্ন বর্ণ ও বংশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সমঝোতা ও সহানুভ‚তি ইসলামের সূচনালগ্নে সৃষ্টি করেছে, পৃথিবীর অমুসলিম সম্প্রদায় তাদের শেষ যুগেও এমন নমুনা পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসলাম কেবল পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন বর্ণ ও বংশের মানুষের মধ্যে অধিকারে সমতা বিধান করে তাদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা নয় বরং বলা যায়, ইসলাম এতে সফল হয়েছে। আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে ছোট-বড় সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা, সাম্য ও সমঝোতার কোনো পথ ছিল না। একমাত্র ইসলামই তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে সবাইকে ভাই ভাইয়ের বন্ধনে দাঁড় করিয়েছে। এসব কিছু ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আদর্শ ও মহত্বের বড় প্রমাণ, যা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই "।

৭। জন কিটস - ইংরেজ কবি জন কিটস (মৃত্যু : ১৮২২) বলেন, " পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মাদ(সাঃ) এবং তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই "।

৮।মরিস গডফ্রে - মরিস গডফ্রে তার 'মুসলিম ইনস্টিটিউশন' গ্রন্থে বলেছেন, " মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন রাসূল ছিলেন, কোনো ধর্মবেত্তা ছিলেন না। এটি যেকোনো নিরপেক্ষ মানুষের কাছেও সুস্পষ্ট। প্রাথমিক মুসলমানদের যে সভ্যসমাজ তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল, তাঁরা তাঁর আইন ও দৃষ্টান্ত পালন করে সন্তুষ্ট ছিলেন"।

৯। এডওয়ার্ড মুনন্ট - জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক এডওয়ার্ড মুনন্ট। নবী (সাঃ) কে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, " চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কার ক্ষেত্রে তিনি যে সাফল্য অর্জন করেছেন, সে প্রেক্ষাপটে তাঁকে মানবতার মহান দরদি বলে বিশ্বাস করতেই হয়"।

এরকম শত-শহস্র অমুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদ ও জ্ঞানী-গুনী মানুষ একবাক্যে স্বীকার করেছেন মহানবী (সাঃ ) এর শ্রেষ্ঠত্ম এবং বলেছেন তিনি মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়ও বটে।


ছবি - agaminews.com

মহানবী (সাঃ ) ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার মূর্ত প্রতিক । নিজেকে সবসময় আল্লাহর আনুগত্যের উপর অটল রাখা,তার অবাধ্যতার নিকটবর্তী না হওয়া, তার সিদ্ধান্তের কারণে হা হুতাশ না করা এবং তাতে রাগান্বিত না হওয়ার নামই ধৈর্য। রাসুল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করতে গিয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে অমানুষিকভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েও ধৈর্যধারণ করেছেন।তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন দুঃখের বছর, যুদ্ধক্ষেত্রে, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, ক্ষুধা ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে। কোন ষড়যন্ত্রই তাকে দুর্বল করতে পারেনি এবং কোন পক্ষই তাকে টলাতে পারেনি। নবী মুহাম্মদ (সাঃ ) এর ধৈর্য্যের কোন কমতি ছিলো না । তায়েফ বাসীরা যখন মুহাম্মদ (সাঃ ) কে নির্মমভাবে রক্তাক্ত করে তখনো তিনি তাদেরকে ধব্বংস করার জন্য বদ দোয়া করেনি। মহানবীর উপর তায়েফবাসীর অমানবিক ভাবে পাথর ছোঁড়া দেখে ফেরেশতারা পর্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন। ফেরেশতারা পর্যন্ত তায়েফ বাসীকে ধব্বংস করে দেয়ার জন্য বললেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ ) নিষেধ করলেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। মহানবী (সাঃ ) ক্ষমার এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় মহান উদার, বিনয়ী ও নম্র ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার আধার। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নবী করিম (সাঃ ) একাধারে সমাজসংস্কারক, ন্যায়বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক।

কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, " তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। " (সূরা আল-আহজাব, আয়াত - ২১)।

তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে তারা তাঁকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি যে বিনয়-নম্র ও সৎচরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা তারা একবাক্যে অকপটে স্বীকার করেছে। দুনিয়ার মানুষকে অর্থের দ্বারা বশীভূত না করে বরং তাদের সদাচরণ, উত্তম ব্যবহার এবং সততার দ্বারা বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন।

আত্মমর্যাদাবোধ বশতঃ কখনো তিনি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি বা নগণ্য ভাবেননি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাঁর স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছিল সদা জাগ্রত। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাঁকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ ) বলেছেন," আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি"। (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আচার-আচরণে অত্যন্ত বিনয়ী। কখনো দুর্বল ব্যক্তিকে কটু কথার মাধ্যমে হেয়প্রতিপন্ন করতেন না। এমনকি কোনো মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে অসাধ্য কাজে বা কঠিন দায়িত্বে বাধ্য করতেন না। তিনি দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। সমাজে যে যতটুকু মর্যাদার অধিকারী, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন। তিনি নম্রতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন করার জন্য সাহাবায়ে কিরামদের উপদেশ দিতেন, আচার-ব্যবহারে অযথা রাগ ও ক্রোধ থেকে সর্বদা বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। তিনি মানুষকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন,"যে ব্যক্তি নম্র-বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন আর যে অহংকারী হয়, আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন"। (মিশকাত শরীফ) ।

মহানবী (সাঃ) এর কাছ থেকে বিধর্মীরাও আশাতীত সুন্দর কোমল আচরণ লাভ করত। তিনি এতই নমনীয় ও কোমলতর ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন যে তাঁর পবিত্র সংস্রব কিংবা সামান্যতম সুদৃষ্টির কারণেও অনুসারীরা তাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসত এবং মনে-প্রাণে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। তাঁর কোমল ব্যবহার সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, "নবী করিম (সাঃ ) কঠোর ভাষী ছিলেন না, এমনকি প্রয়োজনেও তিনি কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতেন না। প্রতিশোধপ্রবণতা তাঁর মধ্যে আদৌ ছিল না"।

মন্দের প্রতিবাদ তিনি মন্দ দিয়ে করতেন না, বরং মন্দের বিনিময়ে তিনি উত্তম আচরণ করতেন সব বিষয়েই। তিনি ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি এতটা বিনয়ী ও নম্র ছিলেন যে কথা বলার সময় কারও মুখমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে কথা বলতেন না। কোনো অশোভন বিষয় উল্লেখ করতেন না। তিনি সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তাঁর মধুর বচনে সবাই অভিভূত হতো। তাঁর অভিভাষণ শুনে জনসাধারণ অশ্রু সংবরণ করতে পারত না। তিনি জনগণকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, " দয়ালু প্রভু আল্লাহর ইবাদত করো, ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদান করো, সালামের বহুল প্রচলন করো এবং এসব কাজের মাধ্যমে বেহেশতে প্রবেশ করো"।(বুখারি শরীফ) । একদা এক ব্যক্তি নবী করিম (সাঃ ) কে ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ কোনটি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে জানালেন, " অভুক্তকে খাওয়ানো আর চেনা-অচেনা সবাইকেই সালাম করা"।(বুখারি ও মুসলিম)

তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ মহামানব। মানুষের সঙ্গে তার সদাচরণ একান্তই তার উদারতার পরিচায়ক। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম বিরল ব্যক্তিত্বের সন্ধান কখনো মেলে না। এমনিভাবে তিনি মানুষের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, " আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে নম্রতা ও হেয়তা অবলম্বন কোরো। কেউ যেন অন্যের ওপর গর্ব ও অহংকারের পথ অবলম্বন না করে এবং কেউ যেন কারও ওপর জুলুম না করে"। (মুসলিম শরীফ) ।

মহানবী (সাঃ) অনেকাংশেই স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের প্রয়োজনে কারও ওপর নির্ভরশীল হতেন না। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা করে নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন।

তাঁর পারিবারিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন,"রাসুলুল্লাহ (সাঃ ) বাড়িতে অবস্থানকালে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো তখন তিনি নামাজের জন্য উঠে যেতেন"। হজরত আনাস (রাঃ) বলেছেন,"পরিবারের প্রতি অধিক স্নেহপ্রবণ হিসেবে নবী করিম (সাঃ ) থেকে বেশি অগ্রগামী আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি দিবারাত্রির সময়টুকু তিন ভাগে ভাগ করে নিতেন। এক ভাগ ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্য ভাগ পরিবার-পরিজনের গৃহকর্মের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। আর এক ভাগ সময় তিনি নিঃস্ব-দুস্থজনদের জনসেবায় ব্যয় করতেন। কোনো জরুরি অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণত এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটত না"।

মহানবী (সাঃ ) সৎ স্বভাব, সত্যনিষ্ঠা, সৌজন্যবোধ, বিনয় ও নম্রতার যে অনুপম শিক্ষা দিয়েছেন, তা আমাদের সকলের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তাঁর সাধারণ জীবনযাপন, বিনম্র আচার-আচরণ, উপদেশাবলি অনুশীলন করলে এবং আদর্শ গুণাবলি নিজেদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুশীলন করে চললে মানুষ ইহকালীন কল্যাণের সাথে সাথে পারলৌকিক মুক্তি লাভেও ধন্য হতে পারে। তাই নবী করিম (সাঃ ) এর সুমহান জীবনাদর্শ থেকে মানুষের প্রতি সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, বিনম্র ব্যক্তিত্ব, আনুগত্যতা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসেবা ও মানবকল্যাণ সুনিশ্চিত করার চেষ্টা আমাদের সকলের করা উচিত। আবার অমুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদরা নবী করিম (সাঃ ) কে যেভাবে ও যে পর্যায়ে মূল্যায়ন করেছেন এবং করেন, তা থেকেও প্রতিটি মুসলমানের অনুপ্রাণিত হওয়া দরকার। শেষ নবী পৃথিবীতে আর ফিরে আসবেন না, কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শের প্রতিটি পদক্ষেপ হোক আমাদের যাত্রাপথের পাথেয়।


তথ্যসূত্র ও সহযোগীতায় - আল কোরআন,হাদীস এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম সাইয়েদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুহু আল-হোসাইনি প্রণীত " জগৎগুরু মুহাম্মাদ (সাঃ ) দ্বিতীয় খণ্ড"
======================================================================

পূর্ববর্তী পোস্ট -

মহানবী (সাঃ) এর জীবনচরিত - ৩ Click This Link
মহানবী (সাঃ) কি আসলেই সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা কেন তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ?

মহানবী (সাঃ) এর জীবনচরিত - ২ Click This Link
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (সাঃ) এর জ্ঞান (শিক্ষা) ও প্রজ্ঞা ।

মহানবী (সাঃ) এর জীবনচরিত - ১ Click This Link
" পবিত্র মাস রবিউল আউয়াল " সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (সাঃ) যিনি জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র এ মাসে । ১২ ই রবিউল আউয়ালের তাৎপর্য ও করণীয় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৭
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×