ছবি - latestly.com
" রোযা " ইসলামের তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যার বিনিময় বা প্রতিদান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন নিজেই দিবেন।(ঈমান ও আমল - ৬ )। লিংক - Click This Link
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বছর ঘুরে রহমত-বরকত-মাগফিরাত ও ক্ষমার বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। সৌদি আরবে শুক্রবার হিজরি ১৪৪৩ সালের রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরা পবিত্র রমজানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছেন এবং আজ শনিবার তাদের ১লা রমজান। আর তাই বাংলাদেশে ঘরে ঘরে রোজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে এবং আজ শনিবার সন্ধ্যা রাতে তারাবীর নামাজ আদায়ের মাধ্যমে শুরু হবে রমজানের আনুষ্ঠানিকতা ও ভোর রাতে সেহরি খাওয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হবে ২০২২ সালের পবিত্র রমজানের যাত্রা। পবিত্র এ মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিবাভাগে পানাহারবঞ্চিত থেকে সংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে মহান আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ কামনা করবেন এবং রাত কাটাবেন এবাদত-বন্দেগিতে।
মাহে রমজানের ঐতিহাসিক পটভূমি
রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর ফরজ করে দেওয়া একটি বিধান। মহান আল্লাহপাক রোজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর আলোকপাত করে পবিত্র কোরআনে বলেছেন, " হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের (রোযার) বিধান দেওয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সংযমশীল হতে পার। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)। এ আয়াতে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর আগেও সব শরিয়তেই রোজা ফরজ ছিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ধারনা করা হয়, রোজার প্রচলন হজরত আদম (আঃ) এর সময় থেকে শুরু। তবে শেষ নবীর উম্মতদের মতো অন্য কোনো নবীর উম্মতরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বিশেষ মাসে রোজা পালন করত কি না সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়না।
উপরোক্ত আয়াতের তাফসিরে আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহঃ) বলেন,"রোজার হুকুম যথারীতি হজরত আদম (আঃ) এর যুগ থেকে শুরু করে আজও বিদ্যমান রয়েছে"। মাওলানা মাহমূদুল হাসানের মতে হজরত নুহ (আঃ) এর যুগে বিস্তৃত শরিয়ত অবতীর্ণ হয়। তাঁর আগেও পৃথিবীর প্রথম যুগে, শরিয়তের বিষয়াদির ওহি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সে যুগে বেশির ভাগই ছিল পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি সংক্রান্ত ওহি। আর এ প্রশ্নে হজরত নুহ (আঃ) এর যুগ ছিল একেবারেই আলাদা। এ যুগেই শুরু খোদাদ্রোহিতা ও ওহির আদেশের অমান্যতা।
হজরত নুহ (আঃ) কে লক্ষ্য করেই আল্লাহ ইরশাদ করেন,"আর নূহের প্রতি অহী করা হয়েছিল, যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া আপনার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনো ঈমান আনবে না। কাজেই তারা যা করে তার জন্য আপনি চিন্তিত হবেন না"।(সুরা হুদ,আয়াত - ৩৬)। আল্লামা ইবনে কাসির স্বীয় প্রসিদ্ধ তফসিরে লিখেছেন, হজরত জেহাক বলেছেন হজরত নুহর যুগ থেকে প্রতি মাসেই তিনটি রোজা পালন করার হুকুম ছিল এবং এ হুকুম রসুল (সাঃ) এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। এরপর যখন রমজানে রোজা পালনের হুকুম হলো তখন থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের হুকুম রহিত হলো।
মহান আল্লাহপাক হজরত মুসা (আঃ) কে তুর পর্বতে ডেকে যখন তাওরাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন তখন আল্লাহ মুসাকে সেখানে ৩০ রাত অবস্থানের নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, "এবং স্মরণ কর ওই সময়কে যখন আমি মুসার জন্য ৩০ রাত নির্ধারণ করেছিলাম এবং আরও ১০ দ্বারা তা পূর্ণ করেছিলাম। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত ৪০ রাত পূর্ণ হয়"। এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় হজরত মুসা (আঃ) এর যুগেও রোজার হুকুম ছিল। হজরত ইবনে আমরকে রসুল (সাঃ) রোজা পালনের আদেশ এভাবে করেছিলেন,"আল্লাহর কাছে যে রোজা উত্তম সে রোজা রাখ। আর সে রোজা হলো যা দাউদ রেখেছেন"। ইনজিলে দার বাদশাহর সময় বায়তুল ইলের বাসিন্দা ও বনি ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার কথা উল্লেখ রয়েছে।
বাইবেলে রোজা - বাইবেলে ‘দার’ বাদশাহের যুগে বাইতুল ইলের বাসিন্দা ও বনী ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার হুকুমের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এমনিভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সব শরিয়তেই রোজার সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব জাতির মধ্যেই রোজা পালনের বিধান ছিল।
আত্মশুদ্ধির তাগিদে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র ও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোজা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন চীনা সম্প্রদায়ের লোকরা একাধারে কয়েক সপ্তাহ রোজা রাখত। অনুরূপভাবে খ্রিস্টান পাদ্রী, পারসিক অগ্নিপূজক এবং হিন্দু-যোগীদের মধ্যেও রোজার(উপবাস) রেওয়াজ ছিল। পারসিক ও হিন্দু যোগীদের রোজার প্রকৃতি ছিল এরূপ যে, তারা রোজা থাকা অবস্থায় মাছ-মাংস, তরি-তরকারি ইত্যাদি ভক্ষণ করা হতে বিরত থাকত বটে, কিন্তু ফলমূল ও পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকত না। কিন্তু ইসলামে রোজার যে নীতি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এ দুই বিপরীতমুখী প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ।
ইসলামে রোজা এক দিকে যেমন কঠোরতা মুক্ত, অপরদিকে সর্ব প্রকার বাতুলতা থেকেও পবিত্র। অর্থাৎ ইসলামে দীর্ঘ সময় একাধারে রোজা রাখাও যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে রোজাদারকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
ছবি - theislamicinformation.com
রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদা
হযরত সালমান ফারসি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসুল (সাঃ) আমাদের রমজান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সুদীর্ঘ একটি ভাষণ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন,"হে লোকজন! তোমাদের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র মাস আগমন করেছে। এ মাসে একটি রাত আছে তা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ মাসের দিনে আল্লাহতায়ালা রোজা ফরজ করেছেন এবং রাতে নফল নামাজ দিয়েছেন। এ মাসে যারা কোনো নফল কাজ করবে সে অন্য মাসের ফরজ সমতুল্য বিনিময় এবং এ মাসের প্রতিটি ফরজ কাজে অন্য মাসের ৭০ গুণ ফরজ সমতুল্য বিনিময় লাভ করবে"।(মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১১৫১) ।
রমজান মাস হলো সবর ও ধৈর্যের অভ্যাস গড়ে তোলা ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে ইচ্ছাশক্তিকে শাণিত করার মাস।এ মাস দরিদ্র ও নিঃস্বদের প্রতি দয়া ও মমতা প্রদর্শনের প্রতি মানুষকে অভ্যস্ত করে তোলার মাস। কারণ,কোন সামর্থবান ব্যক্তি যখন ক্ষুধার্ত থাকার যাতনা অনুভব করবে, অভাবগ্রস্তদের প্রতি তার অন্তর ও অনুভূতি কোমল হবে। এ মাস ধৈর্য ও সহনশীলতার। আর ধৈর্যের প্রতিফল হলো বেহেশত। এ মাস পরস্পর সাহায্য ও সহনশীলতার। এ মাসে আল্লাহ মুমিন বান্দাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন। এ মাসে যে একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। পরকালে তাকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন এবং তাকে রোজাদারের সমতুল্য বিনিময় দান করবেন। অথচ ওই রোজাদারের বিনিময়ে কোনো কমতি হবে না। সাহাবিরা বলেন, "ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাদের সবাই ইফতার করানোর মতো সক্ষমতা রাখে না"। উত্তরে মহানবী বললেন," যে একজন রোজাদারকে একটি খেজুর, সামান্য পানি অথবা অল্প দুধের মাধ্যমে ইফতার করাবে আল্লাহ তাকেও এ মহাবিনিময় দান করবেন"। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্যের ১০ দিন ক্ষমার এবং শেষ ১০ দিন দোযখের আগুন থেকে মুক্তির জন্য বরাদ্দ। এ মাসে যারা তাদের কর্মচারীদের কাজ হালকা করে দেবে আল্লাহ তার পাপ মুছে দেবেন এবং দোজখ থেকে তাকে মুক্তি দান করবেন।
এই রমজান মাসে সকল মুসলমানের কর্তব্য হলো, রোজার মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে পবিত্র রোজার মাসের ফরজ আমল পালনে ব্রতী হওয়া এবং এর পূর্ণ প্রতিদান পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করা।
তথ্যসূত্র - আল কোরআন,হাদীস