ছবি - mappr.co
উত্থান-পতন কিংবা ক্ষমতার পালাবদল দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম।আর তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতির ইতিহাসে আরও একবার বিশ্বক্ষমতার পালাবদল ঘটে। একদিকে বিশ্বে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া এবং অপরদিকে পতন ঘটে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজত্ব করে আসা অটোমান সাম্রাজ্যের। সেই সাথে মন্থর হয়ে পড়ে সম্ভাবনাময় জার্মানির গতিশীলতা। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়া-জার্মানির সাথে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়ার যে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল তা কেবল ইউরোপের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আরও অনেক দেশ সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপের খ্রিস্টান-প্রধান রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরবিরোধী যুদ্ধে মুসলমানদের তেমন কোনো স্বার্থ না থাকলেও তখনকার অটোমান সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারকেরা জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। সমৃদ্ধ অর্থনীতি, উন্নত শিল্পখাত, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, অত্যন্ত ভালোমানের অস্ত্রশস্ত্র থাকার পরেও পরাজিত হয় জার্মানি ও তার মিত্ররা। যুদ্ধ হারের পর অক্ষশক্তির দেশগুলোকে স্বাক্ষর করতে হয় বেশ কয়েকটি অপমানজনক চুক্তিতে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত লুজান চুক্তি। যার মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় বৃহৎ অটোমান সাম্রাজ্যের, জন্ম হয় আজকের আধুনিক তুরস্কের।
১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল ,আর কয়েকদিন পরেই সেটি শতবর্ষ পার হচ্ছে। এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে? তুরস্ক কি বর্তমান রক্ষণাত্মক ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হবে বা হতে পারবে? তুরস্ক কি আবার বসতে পারবে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসাবে কিংবা বিশ্বশক্তিগুলো কিভাবে দেখছে তুরস্ক এবং দেশটির এরদোগানের নেতৃত্বাধীন একে পার্টির সরকারকে? এসব প্রশ্নের অনেক কিছুর জবাব এখনো স্পষ্ট নয়,তবে সম্ভবত তুর্কিরা নতুন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
ছবি - Getty Images
তুরস্কের অবস্থান
বাংলাদেশে যেটি তুরস্ক হিসেবে পরিচিত, তা সুদীর্ঘ সময়ের মুসলিম শাসন-ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিসরে 'তুর্কিয়ে' হিসেবে পরিচিত হবে। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কয়েক বছর থেকে তুরস্ককে বিশ্বে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার অংশ হিসেবে 'তুর্কিয়ে' রাখার প্রচারণা শুরু করেন এবং তুরস্কের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ 'তুর্কিয়ে' নামটি গ্রহণ করে। বর্তমানে এটি সারা বিশ্বে 'টার্কি' হিসেবে পরিচিত।
ভৌগোলিকভাবে তুরস্কের অবস্থান ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝামাঝি। অবশ্য তুরস্কের বেশিরভাগ এলাকাই পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত এবং দুই মহাদেশের সংযোগস্থল হিসেবে বিশ্বে দেশটির গুরুত্বও অনেক। এছাড়াও তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালী যুক্ত করেছে কৃষ্ণ সাগর ও মর্মর সাগরকে। এটি ইউরোপ ও এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ। মিত্রপক্ষের স্বীকৃতি অনুযায়ী তুরস্কের আয়তন ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং এজিয়ান সাগরে উপকূল থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটারে তুরস্কের প্রবেশাধিকার সীমিত বাকি সব দ্বীপের মালিকানা শত শত মাইল দূরের গ্রীসের। লুজান চুক্তির মাধ্যমে বসফরাস প্রণালীকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়। ফলে প্রণালীর মালিকানা তুরস্কের হাতে থাকলেও এখান দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলোর উপর কোনো সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেই তুরস্কের।
সেভ্রেস চুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারের ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার মাধ্যমে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরো তুর্কি সাম্রাজ্য। অপমানকর "সেভ্রেস চুক্তি" চাপিয়ে দেয়া হয় দেশটির ওপর। কিছুদিনের ভিতরেই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা। অবশেষে লুজান চুক্তি নামে অপেক্ষাকৃত কম মন্দ আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর হয় সেভ্রেস চুক্তির বিপরীতে যার মধ্য দিয়ে আধুনিক তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয়। তবে তুর্কি রাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী অনেক শহর ও ভূখণ্ড যুক্ত করে দেয়া হয় অন্য দেশের সাথে এবং নানা বিধি-নিষেধ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে চেপে বসে তুর্কি জাতির ওপর।
মন্দেরও ভাল হিসাবে তুর্কি জাতির ইতিহাসে অন্ধকার যুগের সমাপ্তি এবং নতুন ও উজ্জ্বল দিনের সূচনা হয় লুজান চুক্তির মাধ্যমে। মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কি জাতি যে অনন্যসাধারণ দৃঢ় একতা প্রদর্শন করে এবং মাতৃভূমির সম্মান-সততা ও আত্মসম্মান রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তারই প্রেক্ষাপটে স্বাক্ষরিত হয় লুজান চুক্তি । এ চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তিবর্গ তুরস্কের জাতীয়তা ও স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।
ছবি - Getty Images
সেভ্রেস চুক্তির প্রেক্ষাপট
সময় ১৯০৯ সাল। সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে তার ভাই পঞ্চম মুহাম্মদকে সেই আসনে বসানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিল কমিটি অভ ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস (সিইউপি) ও ইয়াং টার্ক’স নামধারী তৎকালের তুর্কি জাতীয়তাবাদী যুবসমাজ।পঞ্চম মুহাম্মদ খলিফার মসনদে আসীন হলেও ততদিনে এই পদটি কেবল নামেমাত্রই ছিল, বাকি সব শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ছিল নবগঠিত সিইউপি সরকারের হাতে। খলিফা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়াকে জিহাদ হিসেবে ঘোষণা করলেও এই সিদ্ধান্ত ছিল মূলত সিইউপির কট্টরপন্থী নেতা আনোয়ার পাশার। ধারণা করা হয়েছিল ছিল যুদ্ধটি হবে ক্ষণস্থায়ী, ফলে প্রস্তুতিও ছিল তেমনই। এছাড়াও এরূপ প্রতিকূল মুহূর্তে আরব জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোও চাইছিল অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে। অটোমানদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তারা ঘরে-বাইরে দুদিক দিয়েই শত্রুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তাদের জন্য পরাজয় হয়ে দাঁড়ায় অবশ্যম্ভাবী এবং পরাজয়ের পর স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেভ্রেস চুক্তি।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য তথা উসমানীয় খেলাফত জার্মানির পক্ষে তথা অক্ষ শক্তিতে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে অক্ষ শক্তি পরাজিত হয়। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বরে জার্মানি পরাজয় স্বীকার করে নেয় এবং ১৯১৯ সালের জুনে ভার্সাই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এদিকে অটোমানদের জন্যও এই পরাজয় মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তারা চেষ্টা করতে থাকে যথাসম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি! মিত্রবাহিনী ঢুকে পড়ে অটোমানদের মূল ভূখন্ডে। মিত্রবাহিনী সম্মিলিত আক্রমণে দখল করে নিতে থাকে ইস্তাম্বুলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ। মসনদে তখন নতুন খলিফা ষষ্ঠ মুহাম্মদ। এদিকে ভেঙে গেছে সিইউপির শাসনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা, যাদের সিদ্ধান্তে এই মহাযুদ্ধে জড়িয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্য।
সেভ্রেস চুক্তির পর অটোমান সাম্রাজ্যের মানচিত্র
ছবি - Spesh531
এরূপ পরিস্থিতিতে খলিফা ছিলেন নিরুপায়। মিত্রবাহিনীর আগ্রাসন মেনে নেওয়া ছাড়া তেমন কিছুই করার ছিল না তার। তাই ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ও জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে শান্তিচুক্তির পথ বেছে নিতে হয়, তা যতই অপমানজনক হোক না কেন। ১৯২০ সালের ১০ই আগস্ট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জয়ী দেশগুলোর সকল অসম শর্ত মেনে নিয়ে সেভ্রেস চুক্তির প্রস্তাবে রাজি হন খলিফা ষষ্ঠ মুহাম্মদ।
সেভ্রেস চুক্তি অনুযায়ী -
১। উত্তর আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলসমূহের উপর অটোমানরা তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
২। আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়।
৩। স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান গঠন করা হয়।
এছাড়াও
৪। পূর্ব থ্রেস ও পশ্চিম আনাতোলিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলসহ এজিয়ান দ্বীপসমূহ ছেড়ে দিতে হয় গ্রীসের হাতে। নৌ-বন্দরগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীন রেখে অটোমান বিমান বহর নিয়ে নেয় মিত্রবাহিনী। ফলে এককালের বৃহৎ সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে আনাতোলিয়ার পার্বত্যাঞ্চল ও রাজধানী ইস্তাম্বুলে।
লুজান চুক্তির পটভূমি/প্রেক্ষাপট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি এবং অন্যান্য মিত্র বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশের অটোমান সাম্রাজ্যকে সঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ইসলামী পরাশক্তি ৬০০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার বিশাল এলাকা শাসন করেছিল। ১৯১৪ সালে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর অংশ হিসেবে, অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরির পক্ষে যুদ্ধ করে। কিন্তু এই যুদ্ধে অটোমানরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই বিপর্যয়কর পরাজয়ের সমাপ্তি ঘটে ১৯২০ সালে ফ্রান্সে সেভ্রেস চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। সেভ্রেস চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল মিত্রশক্তি ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, গ্রিস ও ইতালির কাছে হস্তান্তরের শর্ত ছিল। এই চুক্তিতে ইস্তাম্বুল এবং বসফরাসকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়।
সেভ্রেস চুক্তি চুক্তি অনুযায়ী গ্রিস, ইতালি ও ফ্রান্স তাদের নির্ধারিত অঞ্চলগুলো দখল করলে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি ছোট অংশ বাকি থাকে তবে এ চুক্তি মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়।সেভ্রেস চুক্তির অপমানকর শর্ত প্রত্যাখ্যান করে তুর্কি জাতীয়তাবাদী বাহিনী একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে এবং ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে সাকারিয়ার যুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব আনতালিয়া থেকে ফরাসি সৈন্যদের বিতাড়িত করে। তুর্কি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে ইজমির এবং তুর্কি ভূখণ্ডের অন্যান্য অঞ্চলে মিত্রশক্তির লড়াই হয়। তুর্কিরা গ্রিসের সেনাবাহিনীকেও পরাজিত করে। তুরস্ক পূর্ব থ্রেস, বেশ কয়েকটি ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সিরিয়ার সীমান্ত বরাবর একটি স্ট্রিপ, স্মার্না জেলা এবং বসফরাস ও দারদানেলেস প্রণালীর আন্তর্জাতিক অঞ্চল উদ্ধার করে।তুরস্কের এই বিজয় মিত্রশক্তিকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করে, যার ফলে নতুন করে স্বাক্ষরিত হয় লুজান চুক্তি এবং বর্তমান তুরস্কের জন্ম হয়।
লুজান চুক্তি কী?
লুজান চুক্তি হল ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত এমন একটি শান্তি চুক্তি যার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে বর্তমান তুরস্কের সীমানা অর্থাৎ আধুনিক তুরস্কের জন্ম হয় এই চুক্তির মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি বিজিত তুরস্কের উপর অপমানজনক সেভ্রেস চুক্তির শর্তাবলি চাপিয়ে দেয়। এ চুক্তির ফলে ওসমানীয় রাষ্টকে বন্দী ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল। সেভ্রেস চুক্তি ওসমানীয় সুলতান আব্দুল মজিদ ও প্রধানমন্ত্রী দামাদ ফরিদ পাশা স্বীকার করে নিলেও মুস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন জাতীয় উচ্চ পরিষদ এ সন্ধি স্বীকার করেনি বরং জাতীয় চুক্তিতে বর্ণিত শর্তাবলি বাস্তবায়নে তৎপর হয়। ১৯২২ সালের মাঝামাঝি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে ব্রিটিশ প্রতিনিধি লর্ড ব্যালাফার মুস্তফা কামালকে গেরিলাপ্রধান ও পরাজিত বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে এটা তুর্কি জাতীয় পরিষদে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মুস্তফা কামাল জাতীয় গৌরব ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ১৯২২ সালের ২৬ আগস্ট তিনি থ্রেস ও আনাতোলিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ শুরু করেন এবং ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পশ্চিম আনাতোলিয়া হতে গ্রিকদের সম্পূর্ণ বিতাড়িত করেন।
পশ্চিম আনাতোলিয়া অধিকার করে তুর্কি বাহিনী একদিকে দার্দানেলিস প্রণালি এবং অন্যদিকে ইস্তাম্বুলের দিকে ধাবিত হলে মিত্র শক্তিবর্গের টনক নড়ে। ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ যেকোনো মূল্যে দার্দানেলিস প্রণালি ও ইস্তাম্বুল প্রতিরক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইস্তাম্বুল প্রণালিসমূহ ও থ্রেসের উপর তুর্কি অধিকারের বিষয় আলোচনার জন্য মিত্রশক্তিবর্গ মুস্তফা কামালের শরণাপন্ন হয়। ফলে মুদানিয়া কনফারেন্সে উক্ত সমস্যাবলি আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুদানিয়া কনফারেন্সে তুরস্কের পশ্চিম ফ্রন্টের কমান্ডার উসমত পাশা, ইংল্যান্ডের জেনারেল হারিংটন, ফ্রান্সের জেনারেল চাপী, ইতালির জেনারেল মনবেলি এবং গ্রিসের জেনারেল মাজারাকিস অংশগ্রহণ করেন এবং মিত্র শক্তি সেভ্রেস চুক্তি বাতিল করে নতুন আরেকটি চুক্তি করার জন্য রাজী হন। নতুন এই চুক্তির মূল বিষয়ই ছিল যে , মিত্র শক্তি তুরস্ককে স্বাধীন দেশ হিসাবে মেনে নিলেও তুরস্ক যাতে কখনো পরাশক্তি হিসাবে মাথা তুলে না উঠতে পারে তা নিশ্চিত করা। আর এসব কিছু নিয়েই ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই স্বাক্ষরিত হয় লুজান শান্তি চুক্তি।
লুজান চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ বা কারা ছিল এই চুক্তিতে?
চুক্তিতে একদিকে ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে ছিলেন ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইতালি-জাপান-গ্রিস-রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা।
লুজান চুক্তি-পরবর্তী তুরস্কের বর্তমান সীমানা
ছবি - উইকিপিডিয়া
লুজান শান্তি চুক্তি
মুদানিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর মিত্রশক্তিবর্গ শান্তি চুক্তির জন্য তুরস্কের লুজান নামক স্থানে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়। ১৯২২ সালের ২০ নভেম্বর এ সম্মেলন শুরু হয়।একপক্ষে তুরস্ক এবং অন্যপক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, জাপান, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রাশিয়া, বুলগেরিয়া এতে অংশগ্রহণ করে। প্রতিনিধিরা এ কনফারেন্সে তিনটি প্রধান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। যথা -
১। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে চুক্তির নীতিমালা প্রণয়ন।
২। উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিলীন স্বীকারপূর্বক নতুন তুর্কি রাষ্ট্র ও উহার দাবি স্বীকার।
৩। ঊসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক তুর্কিদের নামে বিদেশিদের প্রদত্ত সুবিধাসমূহ বাতিল করা।
দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তির নীতিমালাসমূহ গ্রহণ করা হয়।
লুজান চুক্তি স্বাক্ষর করতে অটোমান প্রতিনিধিরা সুইজারল্যান্ডে
ছবি - Mustafa Akyol
মিত্র শক্তি বর্গ লুজান শান্তি চুক্তিতে এ মর্মে অঙ্গীকার করে যে, তারা তুরস্কের সংহতি রক্ষা করবে অর্থাৎ তুরস্কের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখা হবে। লুজান চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তদানীন্তন মিত্রশক্তি ও যুগোশ্লোভিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসমেত ইনোনু। এই চুক্তির ফলে তুরস্কের নতুন প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। লুজানের চুক্তির মাধ্যমে এর আগে স্বাক্ষরিত অপমানজনক সেভরেস চুক্তি বাতিল হয়। তুরস্কের নতুন সীমানা চিহ্নিত ও স্বীকৃত হয়। তবে একই সাথে এর মাধ্যমে ঊসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে মোস্তফা কামালের অধীনে তুর্কি প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
লুজান চুক্তিতে কোন কোন বিষয় ছিল বা বিষয়ের মীমাংসা হয়?
১। গ্রীসের সঙ্গে তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করা হয় এই চুক্তির মাধ্যমে।
২। তুরস্কে বসবাসরত অমুসলিমদের সংখ্যালঘু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তাদেরকে তুরস্কের নাগরিকত্ব দেয়া হয়।
৩। তুরস্কে বসবাসরত গ্রীক নাগরিকদেরকে গ্রীসে ফেরত নেওয়া এবং গ্রীসে বসবাসরত তুর্কি নাগরিকদেরকে তুরস্কে ফেরত আনার সিদ্ধান্ত হয়।
৪। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালি তাদের দখলকৃত তুর্কি ভূখণ্ড ছেড়ে যায়।
৫। উসমানীয় সম্রাজ্যের যে ঋণ ছিল তা শুধু তুরস্কের উপের না চাপিয়ে বরং উসমানীয় খেলাফত থেকে জন্ম নেওয়া নতুন দেশগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হয়।
৬। ৪০০ বছর ধরে চলে আসা তুরস্ক-ইরান সীমান্ত অপরিবর্তিত থেকে যায়।
৭। তুরস্ক-সিরিয়া সীমানা নির্ধারণ - সিরিয়ার সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ২০ অক্টোবর ১৯২১ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে তুরস্কের যে চুক্তি হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়।
৮। তুরস্ক-ইরাক সীমানা নির্ধারণ - ইরাক-তুরস্ক সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে লুজান চুক্তির সময়ে আলোচনা হলেও তুরস্ক ইরাকের মসুল শহরের ওপর থেকে তার অধিকার ত্যাগ না করায় লুজানে কোনো সমাধান হয়নি। তিন বছর পর ১৯২৬ সালে ব্রিটেন, তুরস্ক এবং ইরাকের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক মসুল শহরের ওপর থেকে তার অধিকার ছেড়ে দেয়।
৯। এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোর কর্তৃত্ব বণ্টন - উসমানীয়রা ১৯১২ সালে ইতালি এবং ১৯১৩ সালে গ্রীসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোকে এই দুই দেশের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক পূর্ববর্তী এই দুই চুক্তির শর্তগুলকে মেনে নেয়। এ চুক্তির মাধ্যমে শুধুমাত্র তুরস্কের ভূখণ্ড থেকে তিন মাইলের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলো তুরস্কের হাতে আসে। বাকি দ্বীপগুলো গ্রীসের হাতে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে এজিয়ান সাগরে গ্রীসের মূল ভূখণ্ড থেকে শত শত মাইল দূরে কিন্তু তুরস্কের খুবই কাছে থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবগুলো দ্বীপ গ্রীসের হাতে চলে যায়।
১০। সাইপ্রাসকে ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দেওয়া - লুজান চুক্তির ২০ নম্বর ধারা অনুযায়ী তুরস্ক সাইপ্রাসের ওপর থেকে তার সব কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে ওখানে ব্রিটেনের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। সাইপ্রাস পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা পায়। পরবর্তীতে ওখানকার তুর্কিদের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে ১৯৭৪ সালে তুরস্ক ওখানকার তুর্কি নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সামরিক অভিযান চালিয়ে সাইপ্রাসের একটি অংশ দখল করে নেয়।
১১। তুরস্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রণালীগুলোর কর্তৃত্ব নির্ধারণ - লুজানে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সেটি হল বসফরাস প্রণালী এবং দারদেনালিস বা চানাক্কালে প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের বিষয়টি। একটি জাহাজের ভূমধ্যসাগর থেকে কৃষ্ণ সাগরে যেতে হলে প্রথমে চানাক্কালে প্রণালী পরে বসফরাস প্রণালী ব্যাবহার করতে হয়। লুজানে এই দুই প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়। যে কমিটিতে তুরস্কও থাকবে কিন্তু তার হাতে কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। এছাড়াও এই দুই প্রণালীর তীরবর্তী অঞ্চলকে অস্ত্রমুক্ত রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি এর আশেপাশে কোন অস্ত্রধারী বাহিনীও রাখতে পারবে না তুরস্ক।
তুরস্ক এই প্রণালী দিয়ে অতিবাহিত জাহাজ থেকে এক কানাকরি টোলও আদায় করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু পরবর্তীতে ২০ জুলাই ১৯৩৬ সালে সুইজারল্যান্ডের মন্ট্রেক্স শহরে তুরস্ক-ব্রিটেন-ফ্রান্স-বুলগেরিয়া-অস্ট্রেলিয়া-গ্রীস- জাপান-রোমানিয়া-সোভিয়েত রাশিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে এই প্রণালী দুটি নিয়ে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে প্রণালীগুলোর কর্তৃত্ব পুরোপুরি তুরস্কের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তুরস্ক এগুলো দিয়ে অতিবাহিত কোন জাহাজ থেকে টোল নিতে পারবে না শুধু মাত্র মেইন্টেন্সের জন্য নামমাত্র কিছু টাকা নিতে পারবে।এই চুক্তিটি প্রতি বিশ বছর পরে নবায়ন হয়। সর্বশেষ নবায়ন হয়েছে ২০১৬ সালে। অর্থাৎ এই চুক্তিটি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
আগামী পর্বে সমাপ্য -
তুরস্ক নিয়ে আরো দুটি লেখা -
২। ইস্তাম্বুল খাল - শেষ পর্ব - লিংক Click This Link
১। ইস্তাম্বুল খাল - সুলতান সুলায়মানের স্বপ্নের প্রকল্প, যার বাস্তবায়ন শুরু হল এরদোগানের হাত ধরে - ১ ম পর্ব
লিংক - Click This Link
===================
তথ্যসূত্র ও সহযোগীতায় -
১। লুজান চুক্তির শতবর্ষ পর তুরস্ক - https://www.dailynayadiganta.com/sub-editorial/
২। লুজান চুক্তি - https://bn.wikipedia.org/wiki/
৩। লুজান চুক্তি: অটোমান সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক - Click This Link
৪। তুরস্কের লুজান শান্তি চুক্তি নিয়ে যতসব ভ্রান্ত ধারণা - https://www.jugantor.com/international/399319/
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১:০৬