মূল বইঃ ফালসাফাতুনা (Our Philosophy).
লেখকঃ শিয়া আলেম শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ বাক্বের আস সাদর (নাজাফ, ইরাক)
"বস্তু বিজ্ঞান (Material Science) একটি ফরমূলার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যে বিষয়ে সকল বিজ্ঞানী একমত। আর সেটি হল প্রত্যেক কারণেরই (Cause) একটি প্রতিক্রিয়া (Effect) রয়েছে। যেমন- আমরা গরুর মাংস খাই এবং তা আমাদের শরীরে মাংসপেশীর সৃষ্টি করে। এখানে গরুর মাংস হল কারণ (Cause) আর এর প্রতিক্রিয়া (Effect) হচ্ছে আমাদের শরীরের মাংসপেশী। উক্ত কারণ হল উর্ধতর আরেকটি কারণের প্রতিক্রিয়া। যেমন- গরু ঘাস খায় এবং তার গায়ে মাংসের সৃষ্টি হয়। দেখা যাচ্ছে এখানে ঘাস হচ্ছে উর্ধতর কারণ আর গরুর মাংস হচ্ছে এর প্রতিক্রিয়া। এভাবে যদি আমরা অগ্রসর হই তাহলে দেখা যাবে ঘাস হল প্রতিক্রিয়া এর উর্ধতর কারণ হচ্ছে বৃষ্টি, বৃষ্টি হল প্রতিক্রিয়া এবং এর উর্ধতর কারণ হচ্ছে মেঘ, মেঘ হল প্রতিক্রিয়া এবং এর উর্ধতর কারণ হচ্ছে সূর্য, সূর্য হচ্ছে প্রতিক্রিয়া এবং এর উর্ধতর কারণ হচ্ছে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ (Big Bang)। এভাবে আমরা যদি অগ্রসর হয়ে সর্বপ্রথম কারণের কাছে পৌছাই তাহলে আমরা বলব সর্ব প্রথম কারণ নিজেই হলেন আল্লাহ- জগতসমূহের সৃষ্টিকর্তা। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তিনি কোন কারণের প্রতিক্রিয়া? কিন্তু তিনি কোন কারণের প্রতিক্রিয়া নন। তিনি যদি কোন কারণের প্রতিক্রিয়া হতেন তাহলে তিনি প্রথম স্থানে না থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে যেতেন। কিন্তু আমরা বলছি- আল্লাহ হচ্ছেন সর্ব প্রথম কারণ। সর্ব প্রথম স্থানে থাকার কারণেই তিনিই একমাত্র অস্তিত্ব যার আগে কেউ নেই এবং তার কোন শুরুও নেই। "
এবার আমরা যারা আয়াতুল্লাহ বাকের আস সাদর এর ভক্ত তারা আরো যোগ করতে চাইঃ-
আল্লাহ কি নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেছেন? এর উত্তর হল সে ক্ষেত্রে দু'টো অবস্থার দরকার। একঃ নিজেকে সৃষ্টি করার জন্য তার ইতো মধ্যেই অস্তিত্বে থাকা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যেহেতু তার অস্তিত্ব আছেই তাহলে নিজেকে তার নতুন করে সৃষ্টি করার প্রয়োজন পড়ে না। যদি তার প্রথমে অস্তিত্ব না থাকে তাহলে তিনি যেহেতু নেই সে ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করতে নামবেন সেটাও সম্ভব নয়। তাই সূরা তাওহীদে (ইখলাস) আল্লাহ বলেছেনঃ "তার মত কেউ নেই।"
যার কোন শুরু নেই তার কোন আকার নেই, কারণ প্রত্যেক আকারেরই এক জায়গায় শুরু ও এক জায়গায় শেষ রয়েছে। যার আকার নেই তার কোন সীমা নেই অর্থাৎ তিনি অসীম। আকারকে তিনিই সর্ব প্রথম সৃষ্টি করেছেন। পানি, বাতাস ও আলো সীমাহীন নয়, এগুলো তাদের পরিমান ও শক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে সীমাবদ্ধ। এ পৃথিবীর উপরে কিছুদূর যাবার পরে বাতাসের আর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বাতাস অদৃশ্য হওয়ার কারণে অনেকে একে আকারহীন ভাবেন, অবশ্য আমরা সীমাবদ্ধকেউ আকারবদ্ধ বোঝাচ্ছি। যার আকার আছে সে একটি স্থানে অবস্থান করে। যে একটি স্থানে অবস্থান করে সে অন্য স্থানে নেই এটিও বুঝায়। যেহেতু আল্লাহ অসীম তাই তিনি সব স্থানে উপস্থিত এবং কোন স্থানে অনুপস্থিত নন। যখন শুধু আল্লাহ ছিলেন আর কেউ ছিলো না তখন স্থানও ছিলো না, সময় বলেও কিছু ছিলো না। স্থান ও সময় উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি, এদের শুরু ও শেষ রয়েছে। আল্লাহ সীমাহীন বলেই তাকে তাকে দেখা যায় না। চোখ ও দৃষ্টি আল্লাহর দু'টো সৃষ্টি, দু'টোই সীমাবদ্ধ, যারা সীমাবদ্ধ তারা সীমাহীনকে আয়ত্বে আনতে পারে না। আল্লাহ কোরআনে বলেনঃ "দৃষ্টিগুলো তাকে আয়ত্বে আনতে পারে না আর তিনি দৃষ্টিগুলোকে দখলে রেখেছেন।"
যখন কেউ প্রশ্ন করেঃ তিনি কোথায়? তখন ধরেই নেয়া যায় যে, প্রশ্নকারী আল্লাহকে সীমাবদ্ধ একটি বস্তুতে কল্পনা করে। তাদের এই চিন্তাগত দরিদ্রতা তাদেরকে মূর্তি পূজকদের শ্রেণীতে স্থান দিয়েছে, যারা এর উর্ধ্বে চিন্তা করতে পারে না।
আল্লাহ সব জায়গায় উপস্থিত কিন্তু সব অপবিত্রতা থেকে দূরে। অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতার যে দূরত্ব তেমনি সৃষ্টি থেকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সেই দূরত্ব। যে বলে আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে থাকেন এবং শেষ রাতে এবং শবে বরাত ও শবে ক্বদরে চতুর্থ আকাশে নেমে আসেন তারা এ কথার মাধ্যমে এটাই বলে যে, আল্লাহ স্থান ত্যাগ করেন, যিনি স্থান ত্যাগ করেন তার অবশ্যই আকার রয়েছে অথবা তিনি কোন স্থানে সীমাবদ্ধ ছিলেন। যা আল্লাহর অসীমতাকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর শুরু ও শেষকে স্বীকার করে, আর এ বিশ্বাস কুফরী ও শিরক এর ভিত্তি। এ ধরণের মিথ্যা হাদীস লাখো কোটি মানুষকে আধ্যাত্বিক জগত থেকে বহিস্কার করেছে। যে আল্লাহকে আঙ্গুলে গননা করে সে আল্লাহকে আকার সম্পন্ন ভাবে। যার আকার রয়েছে তাকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা যায়, যারা আল্লাহকে আকার সম্পন্ন ভাবে তারা আল্লাহকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে, যেমন- হিন্দুরা বলেঃ মনুর তিন ভাগঃ দেহ ভাগ, বাহু ভাগ ও শিরো ভাগ। খৃষ্টানরা ভাবেঃ খোদা একের ভিতরে তিনঃ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। যদি তাই হয় তাহলে খৃষ্টানরা খোদা একের ভিতরে দশ বা একের ভিতরে তেত্রিশ কোটি যে মিথ্যা তা কীভাবে প্রমাণ করবেন? আপনি কি নিজে নিজের সন্তান হতে পারেন? যদি তা অসম্ভব হয় তাহলে যিশু নিজেই খোদা হয়ে আবার নিজেই নিজের সন্তান হতে পারেন কীভাবে? গোটা বাইবেল থেকে জানা যায় যে যিশু কোথাও উল্ল্যেখ করেননি যে, আমি তোমাদের খোদা এবং আমিই আমার সন্তান, আমাকে সেজদা কর। যিনি নিজেকে খোদা দাবী করেননি তাকে খোদা বানানোর প্রয়োজন কী? খোদা যদি নিজেকে খোদা বলে স্বীকৃতি না দেন তাহলে তাকে খোদা বলে মানবো কেন?
যারা বস্তু বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণিত খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে উপরোল্লেখিত যুক্তিকে অস্বীকার করেন তারা নাস্তিকও নয়, কারণ নাস্তিক বস্তু বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে না। যেমন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাউসেদং এবং বাংলাদেশের বদরুদ্দীন উমর। যে বস্তু বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত যুক্তিকে অস্বীকার করে সে পাগল ছাড়া আর কিছু নয়, তার কথা শোনার প্রয়োজন আমাদের কারো নেই।
আল্লাহ যে একের অধিক নন এবং একের অধিক আল্লাহ থাকা যে অসম্ভব তার প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করছিঃ
আমরা উপরে প্রমাণ করেছি যে, আল্লাহ সীমাহীন। এখন আমরা প্রমাণ করব যে, সীমাহীন অস্তিত্ব শুধু একটিই থাকতে পারে, তার বেশী নয়। এখন দেখা যাক সীমাহীন অস্তিত্ব কমপক্ষে দু'টি থাকা সম্ভব কিনা। সীমাবদ্ধ খোদা হলে দু'জন নয় অনেক হওয়াও কল্পনা করা যায়। যেহেতু আমরা আল্লাহর সীমাবদ্ধতা মিথ্যা প্রমাণ করেছি, অতএব আমাদের প্রয়োজন শুধু দেখা যে, সীমাহীন দু'টি অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কিনা।
আমরা একটি রেখার দুই পাশে দু'টি সীমাহীন খোদার অস্তিত্ব কল্পনা করি। ধরুন এই রেখাটি তাদের দু'টো সত্তাকে আলাদা করে দেখাচ্ছে। এখন আপনি নিজেই দেখুন এই রেখাটি তাদের সীমানা নির্দিষ্ট করছে, যার উভয় পাশে তারা সীমাবদ্ধ। যারা সীমাবদ্ধ তারা অসীম নয়। এখন রেখাটি তুলে ফেলুন এবং দেখুন যে, দু'টি অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং শুধু একটি সীমাহীন অস্তিত্বের ঘোষণা দিচ্ছে অর্থাৎ একজন সীমাহীন আল্লাহ থাকাই সম্ভব আর কিছু নয় (এ যুক্তিটি শহীদ আয়াতুল্লাহ বাকের আস সাদর-এর)।
আল্লাহ বলেনঃ "বল, আল্লাহ এক, আল্লাহ যার উপরে সবাই নির্ভরশীল, তিনি কাউকে জন্ম দেন না এবং তিনি কারো থেকে জন্ম নেনও নি এবং তার মত কেউ নেই।" (সূরা তাওহীদ)
আল্লাহর বিষয়ে আরো আলোচনা চলবে ইনশাআল্লাহ।