অনেক দিন পর তাঁর সাথে দেখা হবে। তিনি অপেক্ষা করছেন। আমি মাইল মাইল দূরে থেকে তাঁর দুই চোখের ব্যাকুলতা টের পাচ্ছি । বাংলা স্টেশনে- যেখানে ট্রেন থামে না এখন- বসে আছেন তিনি। খুব অস্থির দেখাচ্ছে তাঁকে। ঘন ঘন চায়ের অর্ডার দিচ্ছেন আর সময়ের হিসাব কষছেন। গলা খাকারি দিচ্ছেন। কখন পৌঁছব তার কাছে? কত আর দূরত্ব, বড়জোর দেড় শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া। খুব দেরি তো হবে না। কয়েক ঘণ্টা। এমনও হতে পারে আর কখনই পৌঁছা হবে না কোথাও। দেখা হবে না তাঁর মুখ।
তিনি আমার চেয়ে কম করে হলেও ৪৬ বছরের বড়। এখন তাঁর বয়স অনুমান ৮০ বৎসর। যতদূর মনে পড়ে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব না জেনে এবং না মেনে সেই ছোট বেলাতেই তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়ি। তাঁকে ঘিরেই তখন গড়ে ওঠে আমার খুব ছোট্ট অথচ বিশ্বস্ত ও শান্তিময় জগৎ । এবং এই এতদিন পরেও তাঁর সাথে দেখা হওয়ার একটা দুর্বার আকর্ষণ আমি বোধ করছি। তাঁকে দেখার আনন্দ অপার। বয়স বাড়লেও তাঁর মধ্যে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। যা আমাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়।
বুড়ো হওয়ার কোনো মানে হয় না, শরীরের তাগদ থাকতে থাকতে মরে যাওয়াই ভালো- এমন একটা চিন্তার ফাঁদে একবার আমিও আটকা পড়েছিলাম। বেশ কিছুদিন ওই চিন্তা আমাকে বন্দি করে রাখে। কিন্তু তাঁকে দেখে দেখে আমার ধারণা পাল্টাতে থাকে। ক্রমে সেই ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসি । জীবন উদযাপন শুরু করি।
আমাদের দু’জনের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিল বিস্তর। অনেকে বলেছেন, আমাকে দেখতে অনেকটা তাঁর মতোই। চোখের নিচে বলিরেখাগুলো হুবহু। আমি জানি, আমাদের চিন্তার মধ্যেও রয়েছে সাযুজ্য। যদিও আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমরা স্বতন্ত্র দুটি দ্বীপ। একেবারে আলাদা। আবার টেরপাই কোথায় যেন আলাদা নই।
তিনি পড়াতেন বাচ্চাদের ইশকুলে। এখন ওই চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন বটে কিন্তুছুটি তাঁর মিলে নি। আম্মা আর আমাদের তিন ভাইবোন কখনোই খাওয়া পরার চিন্তা করি নি। নিশ্চিত মনে তাঁকে নির্ভর করেছি। এই নির্ভরশীলতা আমাদের কুণ্ঠিত করে নি কখনোই। এর দশ কারণের একটা হল: এটাই আমাদের চৌদ্দ পুরুষের চল। একজন কামাই করবেন। আর সবাই তাঁকে ঘিরে চকড়ির মতো ঘুরব। তারচেয়েও নির্মম হলো, আমাদের অভাব অভিযোগের যত তীর ছুঁড়ে দিয়েছি তাঁর দিকে।
এতদিন তিনি একা কী করে একটা সংসার টেনে এনেছেন ভেবে আমার গায়ে এখন কাঁটা দিয়ে ওঠে। এখন বয়স হয়েছে তাঁর। সংসারের দায়-দায়িত্ব থেকে ছুটি দরকার। চাই তাঁর একটু বিশ্রাম । তিনি বলেন মরার আগে কারো ছুটি হয় না। তখন ভারি মন খারাপ লাগে।
স্বীকার করছি, আমার তৈরি হতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আফসুস হয়, কেন আরো আগে তাঁর পাশে দাঁড়াই নি, কেন বলি নি তাঁকে, আব্বা আপনার বোঝা আমাকে বইবার সুযোগ দেন; ছুটি নেন এবার; সংসারের ঘানি টানতে এই তো আমি প্রস্তুত।
আব্বা আমাদের যে নিরাপদ বলয়ে রেখেছেন এতদিন, দিয়েছেন সুরা, তাতে তাঁর ঋণ শোধ করা এক জীবনে সম্ভব নয়। নিজে কোনো জিনিস না খেয়ে, দামি পোশাক না পরে, আমাদের খাইয়েছেন, পরিয়েছেন তিনি। এ জন্য সারা জীবন তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
তাঁর এই একটা গুণ এখনো আয়ত্বে আনতে পারি নি আমি। বরং হয়ে উঠেছি শ্রম বিমুখ । এর প্রধান অজুহাত হিসেবে হাজির করেছি, আমার গোপন একটা বাসনাকে। ওই বাসনাও ঠিক আমার নয়, আব্বারই। তিনি স্বপ্ন দেখেন, আমি যেন লেখক হয়ে উঠি। গল্প বলি জীবনের। আমাদের জীবনের গল্প অন্য কেউ লিখে দেবে না, লিখতে হবে আমাদেরই- এই তাঁর কথা। হবে হয়তো, এরও নেপথ্যে রয়েছে আব্বারই অতৃপ্ত বাসনা। তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হয়ে উঠে নি। এই জন্য একটা হাহাকার আছে তাঁর। এখন আমার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে চান; নিজেরই বিকাশ লাভের আশা করেন। এখন তিনি বসে আছেন বাংলা স্টেশনে। হয়তো চায়ের কাপে শব্দ তোলে চুমুক দিচ্ছেন।
আব্বার ছেলেবেলার একটা খাতা পাওয়া গেছে। খাতা বলছে: তিনি লিখতেন কবিতা লিখতেন, ছবিও আঁকতেন । কেন যে আর লিখলেন না! এই ভাবনা আমার মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল, আর তখনই তিনি বললেন চল যাই। কোনো কথা না বলে তাঁর পিছু নিলাম। আমরা হাঁটছি। ডাইনে-বায়ে ধানের তে। ধান পেকে এসেছে প্রায়, কাঁচা সোনার বরণ। ঢেউ তোলে পুবালি হাওয়া বইছে। মাথার ওপর রোদ । আমরা যাচ্ছি পশ্চিম দিক থেকে। নি:শব্দে। বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ, রোদ আর তাঁর পিছু নেওয়া সব মিলিয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে আব্বার মাথার শাদা শাদা চুল । কী যে এক অনুভূতি। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ। ঘাসের গন্ধ, রোদের গন্ধ টের পাচ্ছি। বিস্তৃত মাঠ। সোনার বরণ ফলেছে ধান। একটা টিপের মতো মনে হচ্ছে। সোনালি ধানের েেতর মাঝখানে কালো জিরে ধানের সারি। চেনা একটা সুবাস লাগল নাকে। ক্রমশ তীব্র হতে থাকে সেই সুবাস। স্পষ্ট হতে থাকে অদ্ভুত একটা শব্দ; ঠিক শব্দ নয়, গান, কালোজিরে ধানের গান । বাপ-বেটা দাঁড়িয়ে আছি। এই দৃশ্যে যোগ দেয় একটু দূরের শিশুওয়ালা নামের একটা বিল, তাতে কয়েকটা শাদা বক পাখনা মেলে। আব্বার চোখ মুখে অপার্থিব এক আনন্দ। আমি তাতে ভাগ বসাই। একজন কবিকে দেখি, যিনি শব্দের মালা গেঁথে লেখেন না তাঁর কবিতা।
তাঁরপর বাড়ি ফেরা। একটু বিশ্রাম নিয়ে আব্বা নামলেন বাড়ির সামনের বিশাল পুকুরে। আমার ছোটবেলায় গরমকালে এই পুকুরে অলইজলই খেলে, ডুব-সাঁতার দিয়ে, পাড়ার ছেলে ও দিদিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। মনে পড়ে। সেই কবে যেন, আব্বা আমার পেটের নিচে হাত রেখে সাঁতার শেখানোর তালিম দিচ্ছেন। আমি শক্ত করে ধরে আছি তাঁর হাত। একবার সাঁতার কাটছি। জলের খানিকটা গভীরে নিয়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ হাত নিলেন সরিয়ে। আমি হাত পা ছুঁড়ে ডাঙার দিকে ছুটলাম । নাকে মুখে পানি ঢুকে গেল। চোখ বড় বড় করে কোনো রকমে মাটিতে পা রাখলাম। আব্বা মিটি মিটি হাসলেন। কী আশ্চর্য সে দিনই প্রথম আবিষ্কার করলাম আমি সাঁতার শিখে গিয়েছি। এর পর থেকে আমি নির্ভার হতে থাকি, পানির ওপর ভেসে থাকার বিদ্যা আয়ত্ত্বে আনি ধীরে।
হায় ততদিনে আমার চিন্তা পাল্টে গেছে। এই পুকুরের পানিতে-গরু আর মানুষ যেখানে এক ঘাটে গোসল করে-নামার রুচি হারিয়েছি। অথচ আব্বা সেই পুরনো ভঙ্গিতে নেমে গেলেন, গোসলের অজু করলেন, ওই পানিতে কুলিকুচি করে ভাসমান ময়লা স্তর দুই হাতে সরিয়ে তৃপ্তিতে ডুব দিলেন। গামছায় গা মুছলেন, লুঙ্গির পানি নিঙড়ালেন। আমি গেলাম চাপ কলের দিকে।
আব্বার মুখে একটাও দাঁত নেই। আজকাল আর দুপুরে তেমন কিছু খান না তিনি। আম্মার কথাতেই আমার সাথে খেতে বসলেন। আম্মা মুরগীর বাচ্চা কষিয়েছেন, রেঁধেছেন আন্না কচুর শাক, ছোট মাছের চচ্চড়ি, মসুরের ডাল, দুধও আনলেন একবাটি। ভাত রাঁধলেন কালোজিরে চালের। আম্মা বাটি হাতে, একের পর এক দিতে থাকেন তরকারি । আব্বা নিজের পাত থেকেও কিছু চালান করেন আমার পাতে। আমি বলি আর না.. তারা কানই দেন না। হাজার বছরের খাবার আমাকে যেন এক বেলাতেই খাইয়ে দেবেন।
আব্বা একবার আমার একটা নোট বুকে লিখে দিলেন, জ্ঞানে, মানে, ধনে বড় হও। ভাবি হবে হয়তো, এইটাই তাঁর জীবন দৃষ্টি। সবার আগে জ্ঞান। তার পর মান; সব শেষে ধন। আব্বাকে যতদূর দেখেছি তিনি সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন। একটা সৎ জীবন যাপন করেছেন ।
আব্বা পরেন খুব সাদাসিধে ধরনের পোশাক; চলনে বলনেও একেবারে সাধারণ একটা মানুষ তিনি। কোনো বিশেষত্বই নেই প্রায়। অহংকার তো নয়ই। আমাদের গ্রামে তিনিই প্রথম øাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা আর এগুয় নি তাঁর। তারপরও ভূত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে আস্থা হারানোর মতো জ্ঞান তিনি লাভ করেছেন। সেটাই অবাক লাগে। তাঁর আস্থা ভাগ্য গড়ায়। কতৃবাচ্যে নয়।
ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, তিনি খুব বেশি কথা বলেন না, আবার গোমড়া মুখোও নন। তাঁর সাবেক ছাত্রদের অনেককে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, তাঁর কাস বরাবরই ছিল আনন্দময়। তিনি স্কুলে কখনো কাউকে বেত্রাঘাত করতেন না । অথচ তাঁর কাসে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। গোটা কাস নিয়ন্ত্রণ করতেন অন্য কোনো জাদুর বলে। আমি জানি তাঁর সেই গোপন মতার উৎস।
আব্বা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়েছেন। তবে শরীর মেদহীন, হার্টের কিংবা ডায়াবেটিসের সমস্যা নেই। সর্বংসহা তাঁর শরীর। এই ৮০ বছর বয়সে তিনি প্রায় কখনোই কোনো অসুখে ভুগেন নি। এখনও একটা অতিপুরনো সাইকেল টেনে তিনি বেরিয়ে পড়েন বাজারে। তাঁর সাবেক ছাত্রদের বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছেন, স্যারেরে সাইকেলটা ছাড়াও। কোন দিন মাথা ঘুরান দিয়া পইড়া যাবেন পথের ধারে। ভাবতেই ভয় লাগে। আব্বার দরবারে এ ব্যাপারে ফরিয়াদ কম করি নি। তাঁর এক কথা: সাইকেল চালালে ভালো লাগে, আমার তো কোনো সমস্যা হয় না।
তিনি নিজস্ব কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর বিশ্ব, অন্তরের জাদু বলে। কাজের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিতেই আগ্রহ তাঁর। আব্বাকে দেখে মনে হয়, জীবন দারুণ এক উপভোগ্য বিষয়। এই উপভোগ কৌশল সারা জীবন ধরে রপ্ত করতে হয়। একদিন তিনি আমাকে বললেন, এমন কিছু একটা করা চাই-এবং তা নিষ্ঠার সাথে- যাতে অন্যরা তোমাকে মনে রাখে। তোমার কাজ স্যা দেয় তুমি পশু থেকে আলাদা। লেখা হল তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চেতনা প্রবাহ একদিন থেমে যায় বটে। কিন্তু মানুষটার সাধনা বিফল যায় না। মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে, কারণ তা উত্তর পুরুষে সঞ্চালিত হয়।
আমার বিবেচনায় একজন সফল মানুষ তিনি। কিন্তু নিজের সম্পর্কে আব্বা বলেন, তাঁর জীবনের পনের আনাই বিফল। পঁই পঁই করে সারা জীবনে সম্পত্তি তিনি কম করেন নি। গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে একটা বাড়ি করেছেন। সেখানে আছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ নাগরিক সুবিধা। সেখানে আমার ভাই থাকেন বউ বাচ্চা নিয়ে। আব্বা ওখানেও যান নি; থেকে গেলেন ক্ুঁড়েঘরে।
একদিনের ঘটনা। সন্ধ্যা হয় হয়। ধুলা উড়িয়ে গোহালে ফেরে মাঠের গরু। আমাদের শাদা রঙের একমাত্র গাভী বাড়ির সামনের মরিচ েেত ঘাস খায়। আব্বা ওই জন্তুটার কাছে যেতেই সে বুঝে ফেলে, ঘরে ফেরার সময় হয়েছে, লেজ উচিয়ে পেশাপ করে, তারপর ভো দৌড়। আব্বা দড়ি ধরে অনেকটা ছেছড়াতে ছেছড়াতে যেতে থাকেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই একটু হাসেন তিনি।
পাখিরা ফিরছে কুলায়। একটা শাদা বক কান্ত ডানায় উড়ছে একা। খোয়ারে ঢুকছে হাঁস-মুরগিগুলো। খেলা ভেঙে বাড়ি ফিরছে ছেলের দল। আমার কানে ভেসে আসে ক্রমশ অপস্রিয়মাণ শব্দ রাশি। চান্দরে, হাসছে ঝিঙে ফুল। আকাশে রক্তিমাভা ফুটে উঠেছে। মসজিদ থেকে আসে আজানের সুর। শাখা সম্প্রদায়ের থেকে উলুধ্বনি। আব্বা গোহালে ধোয়া দিলেন। পুকুরে গেলেন অজু করতে। বারান্দায় মুসলা পেতে উচ্চ স্বরে সুরা পাঠ করতে করতে নামাজ পড়েন। ওই দিকে পাঁচালি পাঠ করছেন সুকুমার দা। বউ তার পাশে বসা। রান্না ঘরগুলো থেকে উড়ছে কালো ধোয়া। আমি বেরিয়ে পড়লাম। বিলের দিকে হাঁটা দিলাম।
রাতের খাবার খেয়ে আব্বা একটু হাঁটা-হাঁটি করেন। পিছু নিলাম তাঁর। চাঁদ উঠেছে। ধানি জমির ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদের আলো । ...ফসলের মাঠ..একটা বিল...তারপর আবার ফসলের মাঠ ...চাঁদের আলো ...আমরা হাঁটছি ধীর পায়ে।
*** ১১/০৪/১০