মানুষ হিসেবে আমার আব্বা ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ, নিয়মানুবর্তী ও স্পষ্টভাষী। অনেককে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, এই গুণগুলো আব্বার যুবক বয়সে, এমন কী শৈশবেও ছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, আর দশজনের চেয়ে তিনি খুব একটা রসিক কিংবা বিষাদগ্রস্ত ছিলেন না। হবে হয়তো, ছিলেন খানিকটা চুপ চাপ ধরনের।
আমাদের পরিবারের শাসন মতা আব্বার হাতে ছিল না; সংসারের হর্তাকর্তা ছিলেন আম্মা। বড় আপা, ভাইজান আর আমাকে হররোজ গাল-মন্দ করার কাজটাও আম্মাই করতেন।
একদিনের ঘটনা। আব্বা একটা নৌকা বানানোর ফরমায়েশ দিয়ে এলেন। নৌকার ব্যাপারে তাঁকে খুব সিরিয়াস মনে হোল। নৌকাটা বানাতে হবে বিশেষ কায়দায় যাতে সে নৌকায় মাত্র একজন মানুষের ঠাঁই হয়। নৌকাটি বানাতে হবে বিশেষ কাঠ দিয়ে । বিশ তিরিশ বছর একটানা পানিতে থাকলেও যাতে এর কাঠ পচে না যায়। আম্মাকে খুব চিন্তিত মনে হোল। সাত-পাঁচ ভাবলেন তিনি। আব্বা কি তাহলে আচমকা জেলে হয়ে গেলেন? মাছ শিকারী?
আব্বার মুখে কিন্তু টু শব্দটিও নেই। আমাদের বাড়ির পাশে, এইতো এক মাইলের পথও না, একটা নদী আছে, শান্ত, গভীর আর কী বিশাল! এক পাড়ে দাঁড়ালে, অন্যপাড় চোখেই পড়ে না। জল থৈ থৈ করে।
একদিন সেই নৌকা আনা হোল। দিনটির কথা আমি কখনই ভুলতে পারি না। আব্বাকে দেখাল কেমন যেন ভাবলেশহীন। আনন্দ কিংবা বিষাদ তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল না। আব্বা চিরকাল যা করতেন, তাঁর টুপিটা মাথায় দিলেন। আমাদের উদ্দেশে বললেন, যাইরে। দানা-পানি কিচ্ছু সঙ্গে নিলেন না তিনি। আমরা ভেবেছিলাম আম্মা দৌড়ে গিয়ে আব্বার পথ আগলে দাঁড়াবেন। তাঁকে ফিরিয়ে আনবেন। আম্মাকে খুব বিমর্ষ দেখালেও, ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘‘যাচ্ছ যদি ওইখানেই থাইকো, আর ফিইরা আইসো না, কোনদিন না।’’
আব্বা নিরুত্তর। শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ঈশারা করলেন যেন আমি তাঁকে অনুসরণ করি। আম্মার রাগ আমার অন্তরে কাঁপন ধরালো। তবু ভয়ে ভয়ে আব্বার দিকে পা বাড়ালাম। দুজনে পৌঁছালাম নদীর কিনারে। আমার ভেতরে তখন তোলপাড় চলছে, আব্বাকে বললাম, আমারে লগে নিবেন, আপনের নাওয়ে?
এক পলকের জন্য আমাকে দেখলেন তিনি। দোয়া করলেন। তার আমাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ঈশারায়। পিতৃ আজ্ঞা বলে কথা, আমিও বাড়ি মুখে হাঁটা দিলাম। কিন্তু আব্বা পিঠ ঘুরাতেই একটা ঝোঁপের আড়ালে ঢুকে পড়লাম। আমার দুচোখ আব্বাকে অনুসরণ করতে থাকল। আমার আব্বা নির্বিকার, নৌকায় উঠলেন তিনি। দাঁড় টেনে টেনে ক্রমশ দূরে যেতে থাকলেন। নদীর জলে তাঁর সেই নৌকাটির ছায়া তখন একটা সন্তরণশীল কুমিরের মতো খেলা করছিল...।
আব্বা সেই যে গেলেন আর ঘরে ফিরলেন না। অবশ্য দূরে কোথাও যান নি তিনি, সত্যি। কেবল ওই নদীতে ভাসতে থাকলেন, ইতস্তত নাও বাইতে থাকলেন। আব্বার যে কী হয়েছিল, আর কী হয় নি, কীই বা হতে চলেছে, এসব নিয়ে নানা মুখে নানা কথা ছড়াল। আত্মী-স্বজন, পাড়া-পড়শী ও পরিজনেরা এলেন। আব্বার নদীবাসের কারণ কী জানতে চাইলেন তাঁরা।
তখন আম্মাকে মনে হলো লজ্জাবনত। কথা বলা কমিয়ে দিলেন তিনি। ভাবে প্রকাশ করলেন বিশদ। ঘটনা এমন মোড় নিল যে প্রায় সবাই ধরে নিল । যদিও মুখ ফুটে কেউ বলে নি কখনো । আব্বা পাগল হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বললেন, আলাহর কাছে কিংবা কোনো পীরের দরগায় তিনি হয়তো করার কেটেছিলেন। কেউ বললেন, আমার আব্বা গোপন ও জটিল কোনো রোগে ভূগছেন, কুষ্ঠ-টুষ্ঠ হতে পারে, পরিবারটাকে বাঁচাতেই তাঁর এই বৈরাগী হওয়া। খুব দূরে কোথাও তো যান নি তিনি, কাছাকাছিই রয়েছেন।
নদীপথের নিত্যদিনের যাত্রী ও দুই তীরের বাসিন্দাদের অনেকে বলেছেন, নৌকা নিয়ে নদীতে চলে যাবার পর আমার আব্বা, দিনে কিংবা রাতে, কখনোই খাবার জোগাড় করার জন্যও তীরে আসেন নি। মাটিতে পা রাখেন নি তিনি। শুধু ভেসে বেড়িয়েছেন একা, উদ্দেশ্যহীন। আম্মা ও আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা ধরে নিয়েছিলেন, আব্বা নিশ্চয়ই একদিন লুকিয়ে চুরিয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন, নিদেনপে নদীর অন্য কোনো পাড়ে তাঁর নাও ভিড়াবেন (যা হবে মন্দের ভালো, তাঁরও মান রা হয়, তিনিও)।
সত্য থেকে তারা কত দূরেই না ছিলেন! আব্বার রসদ সরবরাহের এক গোপন উৎস ছিল; সেটা আমি। প্রতিদিন আব্বার জন্য কিছু খাবার চুরি করতাম।
আব্বা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর প্রথম রাত নেমে এলো। আমরা সবাই মিলে নদীর তীরে আলো জ্বালালাম। চিৎকার করে ডাকলাম তাঁকে। তাঁর উদ্দেশে প্রার্থনা করলাম। কিন্তু হতাশা আমাকে পেয়ে বসলো। ভাবলাম কিছু একটা করতে হবে। পরের দিন সকালে, এক কাঁদি কলা, বেশ কটা রুটি আর কিছু চিনি সরিয়ে ফেললাম। সেগুলো নিয়ে নদীমুখো হয়ে দিলাম ছুট। আব্বা কখন আসবেন, সেই প্রতীায় রইলাম। অস্থির অস্থির লাগলো, হাঁসফাঁস শুরু হলো। অনেকণ পর তাঁকে দেখা গেল, দূরে উদ্ভাসিত হলেন তিনি। আব্বা তখন নৌকার গলুইয়ে বসা। আমাকে ঠিক ঠিক দেখেছেন তিনি। কিন্তু আমার দিকে আসলেন না। একবার হাত ঈশারাও করলেন না। আমার হাতে ধরা খাবারের পুটলিটা ওপরে তুলে ধরে তাঁকে দেখালাম। এরপর নদীর কিনারে একটা পাথরের গর্তে পুটলিটা রেখে দিলাম; গর্তটা ছিল বন্য প্রাণী, বৃষ্টি কিংবা কুয়াশা থেকে নিরাপদ। দিনের পর দিন আমি এ কান্ড করে গেলাম...। পরে জেনে অবাক হয়েছিলাম, আমার খাদ্য সরানোর ব্যাপারটা আম্মা ঠিকই টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জেনেশুনেই কিছু খাবার এদিক সেদিক রেখে দিতেন, যাতে আমি সহজেই সেগুলো নিয়ে চম্পট দিতে পারি। আব্বার প্রতি আম্মার অনুরাগ ছিল অসীম; যদিও তিনি সচরাচর তা প্রকাশ করতেন না।
আমাদের ব্যবসা আর কৃষিকাজ দেখভাল করার জন্য আম্মা তাঁর এক ভাইকে ডেকে পাঠালেন। একজন স্কুল মাস্টার যাতে আমাদের বাড়ি এসে, আমাদের পড়াশোনার তদারকি করেন সেই ব্যবস্থাও পাকাপাকি করলেন তিনি। একদিন আম্মার অনুরোধে এক ফকিরকে আনা হলো। ওই ফকির লোকটা নদীর কিনারে গেলেন। তাঁর দাবি মতে, আব্বার কাঁধে ভর করা ভূত নামাবেন তিনি। ঝাড়-ফুঁক দিলেন, হাওয়ায় বিড় বিড় করে কীসব মন্ত্রটন্ত্র জপ করলেন। ফকির ব্যাটা একবার চিৎকার করে উঠলেন, বললেন, আব্বার ওপর বদ জ্বিনের আছড় লেগেছে। আরেক দিনের ঘটনা। পুলিশের দুই সদস্যকে ডেকে আনলেন আম্মা। আব্বাকে ভয় দেখানোর জন্য এ ব্যবস্থ। পুলিশের সেই দুই সদস্য নদীর পাড়ে ঘুরা ফেরা করলেন। এতেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। সব চেষ্টাই বিফলে গেল।
এরপর থেকে আব্বাকে দূরে, মাঝে মধ্যে এত দূরে ভেসে থাকতে দেখা যেতো যে, মনে হোত যেন কোনো পথভোলা হাঁস একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে; দ্বিগি¦দিক। কারো ডাকেই সাড়া দিতেন না তিনি। কেউ তাঁর নাগালও পায় নি কখনো। যখন আব্বার ছবি তুলতে লঞ্চে করে একদল সাংবাদিক এলো, আব্বা নদীর ওপাড়ে বিল-জলার দিকে তাঁর নৌকা ঘুরিয়ে দিলেন, যে জলাশয়ের অন্ধিসন্ধি তাঁর হাতের তালুর মতোই চেনা ছিল। কিন্তু অপরিচিত কোনো ব্যক্তি ওই জলাশয়ে গেলে গোলক ধাঁধায় পড়ে সহজেই পথের দিশা হারিয়ে ফেলতেন। মাইল মাইল জলাভূমি জুড়ে হিজল আর শরবনের ভিতর দিয়ে পথের জাল পাতা ছিল। ওই স্থানটিই ছিল আমার আব্বার অভয়াশ্রম।
আব্বার বাড়ি ছেড়ে যাওয়া; অভাববোধের মধ্যেও দিনযাপনে অভ্যস্ত হতে হয়। কিন্তু আমরা খুব একটা পেরে উঠি নি, তা সম্ভব ছিল না। আমার মনে হলো, একমাত্র আমিই ছিলাম ব্যতিক্রম, বুঝতে পারতাম আব্বা কী চেয়েছিলেন আর কী চান নি। মাঝেমধ্যে ভেবে কুল-কিনারা পেতাম না এত দুর্ভোগ আমার আব্বা কী করে পোহাতেন! রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে কী করে টিকে থাকতেন তিনি? কাপড়-চোপড় বিশেষ কিছু সঙ্গে নেন নি। অথচ দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তা, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাঁকে দুঃসহ প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হয়েছে। বয়স হয়েছে তাঁর। এসময় মাঝ নদীতে। ভুলেও নোঙর করেন না তীরে, পা রাখেন না ঘাসে। কোনো চরে গিয়েও বাঁধেন না তাঁর নৌকাটিকে। না হয় একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো চরে গোপনে কোথাও কখনো নাও বাঁধলেন তিনি। কিন্তু কাঠি ঠুকে আলো জ্বালাবেন এমন কোনো দিয়াশলাইও তো সঙ্গে নেন নি। পাথরের গর্তে আমার রেখে আসা সামান্য খাবার হয়তো নিয়েছেন তিনি, তাও তো জান বাঁচানোর মতো পর্যাপ্ত নয়। আব্বার শরীর কেমন? দাঁড় টানার মতো এতটুকু শক্তিও কি অবশিষ্ট আছে তাঁর ? বর্ষায় নদীর স্রোত বাড়ে, ফুঁসে ওঠে, ভাসিয়ে আনে গাছপালা, ঘর-বাড়ি, মরা পশু। ভাসমান এইসব জন্তু আর গাছের ধাক্কায় কিংবা জলের পাকে পড়ে আমার আব্বার ছোট্ট নৌকাটি এতদিনে ডুবে যায় নি তো?
নৌকাবাসী হওয়ার পর থেকে জীবিত কোনো আত্মার সঙ্গে আব্বার কখনো কথা হয় নি। আমরাও তাঁর সম্পর্কে আর কখনো কথা তুলি নি। তবে আমার মনের আশঙ্কা দূর হতো না। দৃষ্টির বাইরে থাকলেও আব্বাকে বাইরে রাখা সম্ভব হয় নি। মুহূর্তের জন্য ভুলতে বসলেও, তাঁর কষ্টকর দিনযাপনের ভয়াবহ চিত্র আমার মনে উঁকি দিতো; সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো তখন।
বড় আপার বিয়ে হয়ে গেল। আম্মা কোনো উৎসবের আয়োজন করলেন না। সুস্বাদু কয় পদের রান্না হলো বটে, কিন্তু আব্বার কথা ভেবে সব কিছু বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল। হাড় কাঁপানো শীতে কিংবা ঝড়ের রাতে আব্বার মুখ আমার মনের আয়নায় ভেসে উঠত, কী যে একা আর নিরাপত্তাহীন তিনি, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে দুহাতে দাঁড় টেনে চলেছেন, অবিরাম।
মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বলতেন, আমার চেহারা দিনে দিনে হুবুহু আব্বার চেহারার মতো হয়ে উঠছে। তখন কল্পনার চোখে আমি দেখি, আব্বার চুল এতদিনে অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে, পেকে গেছে, আর হাতের পায়ের নখগুলো অনেক লম্বা হয়ে গেছে। মনের বনে নিত্য আনাগোনা তাঁর। শাদা চুলের একটা মানুষ, রোদে পোড়া, অনাহারে শরীর তাঁর শুকিয়ে কাঠ, তিনি নগ্নপ্রায়।
আব্বা আমাদের কখনো পাত্তা দিতেন বলে মনে হতো না। এরপরও তাঁর জন্য মায়া হোত, জাগতো শ্রদ্ধার ভাব। আব্বার জন্য খাবার চুরি করে একটা ভালো কাজ করেছিলাম বলে লোকজন আমাকে বলতো ধন্য ছেলে; আমি বলতাম, ‘আব্বা আমাকে এ রকম কাজ করার শিাই দিয়েছেন বরাবার।’
আমাদের তিনি গ্রাহ্যে আনতেন না কথাটা একশ’ ভাগ ঠিক না। এটা মিথ্যায় ভরা একটা সত্যভাষ্য মাত্র। কিন্তু আমাদের ছেড়ে আব্বা দূরে ওই নদীর বুকে চলে গেলেন কোন প্রাণে? তাও তো খুব দূরে নয়! আমি ভাবি, কেন ভাটির টানে কিংবা উজানে অদৃশ্য হয়ে গেলেন না তিনি? যেখান থেকে তাঁকে আমরা আর দেখতেই পেতাম না, তিনিও আমাদের! এর উত্তর শুধু তাঁরই জানা।
বড় আপার ছেলে হোল। পুচকে এই পুত্রশিশুটি আব্বাকে দেখানোর জন্য তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। চমৎকার একটা দিনে আমরা সবাই মিলে নদীর কিনারে গেলাম। বড় আপার পরনে বিয়ের পোশাক, হাতে ধরা ছেলেকে উর্ধ্বে উঠালেন। দুলাভাইও কম গেলেন না। আমরা সবাই মিলে আব্বাকে চিৎকার করে ডাকলাম। কিন্তু দেখা পেলাম না তাঁর। আপা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, আমরাও পরস্পরকে গলায় জুড়িয়ে ধরে কাঁদলাম।
বড় আপা চলে গেলেন দূরে, স্বামীর সংসারে । ভাইজান গেলেন শহরে। সময় তার দাঁড় টেনে বদলে দিলো সব। সবশেষে আম্মাও চলে গেলেন; বয়স হয়েছে তাঁর, এ বয়সে অন্যের সহযোগিতা দরকার পড়ে, অতএব পাকাপাকি ভাবেই চলে গেলেন তাঁর মেয়ের কাছে। আমি পড়ে রইলাম; একা, পরিত্যক্ত।
বিয়ে করার চিন্তা মাথায় আনতে পারলাম না, আমি থেকে গেলাম জীবনের লটবহর মাথায়। আমার অসহায় পিতা, নিঃসঙ্গ ভেসে আছেন ওই বিশাল নদীতে। আমাকে প্রয়োজন তাঁর। জানতাম, আমাকে তাঁর চাইই চাই। যদিও তাঁর এই নদীবাসের কারণ আমার জানা ছিল না। লোকে লোকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ কেউ বললো, নাওয়ের কারিগরের কাছে তোমার আব্বা সব গুঢ় কথা বলে গেছেন। সেই কারিগরও আজ আর বেঁচে নেই। অতএব এমন কেউ অবশিষ্ট নেই, যিনি আব্বার ঘর ছেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ আজ আমাকে বলে দিতে পারেন।
একবার খুব বৃষ্টি শুরু হলো, দিনের পর দিন অঘোর বৃষ্টি, থামবার নাম নেই, লোকজন আজগুবি সব কথা রটালো তখন। আব্বাকে তারা এ যুগের নূহ নবী আখ্যা দিলো; বললো, ‘ভয়াবহ ধরনের বন্যা হবে, এটা ওই জ্ঞানী লোকটা আগাম টের পেয়ে গিয়েছিলেন বলেই নৌকা বানিয়ে সোজা নদীতে চলে গিয়েছেন।’ আমার মনে পড়ছে, লোকজন এরকমই বলে বেড়াচিছল তখন। যাইহোক, যে কারণেই আব্বা গৃহত্যাগী হয়ে থাকেন না কেন, তাঁকে আমি দোষী সাব্যস্ত করি না। আর হ্যাঁ এতদিনে আমার চুলেও পাক ধরেছে।
বাজে বকা ছাড়া কীই বা করার আছে আমার, কী দোষ করেছি? আব্বার শূন্যতা আমার চারপাশ ঘিরে রাখে, সব সময়ই আমাকে বন্দি করে রাখে। নদী, ওই যে অদূরের নদী, সব সময়ই কেমন নতুন। আমার বৃদ্ধ বয়সের যাতনা কিনা শুরু হয়ে গিয়েছে, যেখানে জীবনের মানে শুধু প্রলম্বিত হওয়া। উদ্বেগ আর রোগ-শোক আমাকে ঘিরে ধরেছে। বাতজ্বরে পড়লাম। আর তিনি? কেন ওইসব করতে গেলেন? কী দুঃসহ যন্ত্রণাই না পোহাতে হচ্ছে তাঁকে! বয়সের ভারে নুব্জপীঠ। গায়ের বল ফুরিয়ে গেলে, একদিন হয়তো হাল ছেড়ে দেবেন, খরস্্েরাতা নদী তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভাটির দিকে। যেতে যেতে হয়তো আমার আব্বা এক ভয়াল ঘূর্ণিপাকে পাক খেতে খেতে নৌকাশুদ্ধ তলিয়ে যাবেন।
আমার অন্তরাত্মা ছেয়ে গেল বিষাদে। আব্বা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তলিয়ে যাচ্ছেন, জলের তলে দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর, আর আমি কিনা খুঁজে চলেছি শান্তি সুখ। আমার মনে অপরাধবোধ জেগে উঠলো, কিন্তু এর কারণ জানা গেল না। আমার অন্তর-জগতে বেদনাবোধ মোচড় দিয়ে উঠলো, আমি ভেবে ভেবে সারা। কী দোষ করেছি আমি!
তাহলে আমি কি উন্মাদ হয়ে পড়েছি, পাগল? না, আমাদের বাড়ির কেউ কোনদিন এমন উচ্চারণ করে নি। কাউকে কখনো উন্মাদগ্রস্ত মনে হয় নি। কেউই উন্মাদ ছিলেন না কখনো। আবার এমনও হতে পারে, সবাই ছিল পাগলের হদ্দ। আমি কী এক ঘোরের মধ্যেই নদীর কিনারে পৌঁছালাম, বাতাসে রুমাল মেলে ধরলাম। উঁচু করে আব্বাকে সংকেত পাঠালাম। দূরে, বহুদূরে দেখা গেল তাঁকে। আব্বা নৌকার গলুইয়ে বসা, আবছা ধরনের দেখা যাচ্ছে। বার বার ডাকলাম তাঁকে, কাকুতি-মিনতি করলাম। এত দিন যে কথাগুলো বলার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমি, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম,
‘আব্বা ওখানে আছেন বহু দিন, এখন আপনার বয়স হয়েছে...এবার ফিরে আসুন, আপনাকে আর কিছু করতে হবে না...ফিরে আসুন এবার, আর আমাকে বসতে দিন আপনার আসনে। আপনি চাইলে যে কোনো মুহূর্তে, এুণি; ওই নৌকার হাল আমি ধরব, আপনার স্থলাভিষিক্ত হব।’
একদমে কথাগুলো উচ্চারণ করার পর আমার হৎদস্পন্দন অনেকটা শান্ত হয়ে এলো।
আমার কথা শুনতে পেয়ে আব্বা উঠে দাঁড়ালেন। এরপর নৌকা নিয়ে আমার দিকে এগোতে থাকলেন তিনি। আমার অনুরোধ মিনতিতে কাজ হয়েছে। আর তখন হঠাৎ শিউরে উঠলাম, ভর্য়াতভাবে। কত কত বছর পর এই প্রথমবারের মতো আমার আব্বা তাঁর দুই বাহু বাড়ালেন, শূন্যে ঢেউ তুললেন তিনি। আর আমি..আমি... পারি নি...। ভয়ে কাঁপছি, মাথার চুলগুলো সব এক ঝটকায় খাড়া হয়ে গেল। আমি দৌড় দিলাম উল্টো দিকে, উন্মাদপ্রায়। আমার তখন মনে হলো, আব্বা আসছেন অন্য কোনো লোক থেকে, আর আমি সমানে মা প্রার্থনা করছি, মা...
ভয়াবহ শীত অনুভব করলাম, অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এরপর তাঁকে আর কেউ কখনো দেখে নি। এমন পরাজয়ের পর, আমি কী আদৌ আর মনুষ্য পদবাচ্য? আমি এমন কিছু যা কখনো হওয়ার কথা ছিল না। আমি তাই যা নিশ্চত করে নিরবতা। জানি, এতদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাকে জীবনের মরুভূমি আর অচিহ্নিত সমতল ভূমিতেই বসবাস করতে হবে। আমার ভয় হয়, জীবনকে হয়তো ছেটে ফেলব। কিন্তু যখন মৃত্যু আসবে তাকে বলবো, আমাকে নিয়ে চলো, দীর্ঘ দুই তীরের মাঝখানে প্রবহমান অনন্ত জলধারার বুকে, ঢেউয়ে ভাসতে থাকা ছোট্ট সেই নৌকাটিতে রাখো; আমি নদীর অতলে হারানো এক মানুষ...নদীর গভীরে...নদীটির...