somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানসিক রোগ ও রোগীঃ আমাদের মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা ও অবহেলার আরেকটি উদাহরণ

১২ ই মে, ২০১৩ রাত ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘটনা-১
মনোচিকিৎসক ডাঃ হাফিজ বসে আছেন তার চেম্বারে। বদরুল সাহেব ঢুকলেন তার বড় ছেলেটিকে নিয়ে। এই ছেলেটি তার ট্রিটমেন্টে আছে আজ প্রায় ৭ বছর। ছেলেটির বয়স এখন ৩৫। নটরডেম কলেজে পড়ার সময়ই সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত। তা আজ প্রায় ১৮ বছর আগে। কোন ভাবেই এখন আর বোঝা যায় না এই ছেলেটি এক সময় এস এস সি তে মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। ছেলেটি নিয়মিত চিকিৎসা নেয়ার ফলে বেশীরভাগ সময়ই মোটামুটি ভাল থাকে। মাঝে মাঝে খুব বেশী সমস্যা হলে ১৫ দিন বা একমাস হাসপাতালে থাকতে হয়। আরিফ কে দেখলে তার খুব কষ্ট হয়, কত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের একটা ছেলের কি অবস্থা। ভাবনাতে লাগাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, “ কি খবর বাবা, কেমন আছ?” উত্তর এল “ভাল। আঙ্কেল আপনি কেমন আছেন?” আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর ডাঃ হাফিজ বুঝতে পারলেন ছেলেটির অবস্থা অনেকটাই ভাল, সে হয়ত পুরো স্বাভাবিক কখনই হবে না কিন্তু এখন যে অবস্থা সেটা ও কম না। ব্যবস্থাপত্র লিখতে শুরু করার পরই বদরুল সাহেব বললেন, “আরিফ তুমি একটু বাইরে বস, আমি তোমার আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আসছি।”

ও বাইরে যেতেই বদরুল সাহেব বললেন, “ওকে কি হাসপাতালে ভর্তি করাচ্ছেন না?”
- না কেন? ওর অবস্থা তো অনেক ভাল, শুধু শুধু কেন ভর্তি করাব?
বদরুল সাহেব কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “ আপনি আমার অনেকদিনের পরিচিত। আপনার কাছে লুকাব না।আসলে হয়েছি কি আমার আরেক ছেলে বিদেশ থেকে আসছে আজ তিন বছর পর, বউ ছেলে সহ আমাদের সাথে এবার ঈদ করবে। আপনি তো জানেন আরিফের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে কত ঝামেলা করে, আমরা এই কয়েকটা দিন নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাতে চাই। ও তো আমাদের সাথে কোন কিছুতে যোগ দিবে না , মাঝখান থেকে সবার সময়টা খারাপ কাটবে। তাই যদি এই ২০ টা দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতো খুব ভাল হত।”
ডাঃ হাফিজের মনে মনে কষ্ট পেলেও একটু ও অবাক হলেন না, কারণ তিনি জানেন মানসিক রোগীরাই সবচেয়ে বেশী অবহেলিত আমাদের এই সমাজে।

ঘটনা-২
কিছুদিন থেকেই মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে আরেফীনের। কাজে কর্মে মন বসছে না। সেদিন শিরীনের সাথে ও কোন কারণ ছাড়াই বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে। আর অফিসের কাজে কর্মে ভুল, অধীনস্থদের সাথে অহেতুক হম্বি তম্বি তো আছেই। কেন মনের এই অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ওর কলেজের বন্ধু কামালের সাথে ব্যাপারটা নিয়া কথা বলবে, ও পেশায় মনোচিকিৎসক। কিন্তু ওর ফোন নম্বরতো নেই। সোহেলের কাছে হয়ত থাকবে। সোহেল কে সব বলতেই ও বলে উঠল, “ আরে তুই কি পাগল নাকি যে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাবি?” আরেফীন বুঝল এত শিক্ষিত হয়েও সোহেল পুরোনো ধ্যান ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। ওর কাছে এখনও মানসিক রোগী হল শিকল দিয়ে বাঁধা, ঘরে বন্দী কোন আজব জীব।

ঘটনা-৩
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং। পলাশ ভাইয়ের ফোন। “কি ব্যাপার ভাই, এতদিন পর আমাকে ফোন? কেমন আছেন?”
- আমি ভাল, যেই জন্য ফোন দিলাম সেটা বলি আগে। তোর কি শাহেদ ভাই আর তুলি আপার কথা মনে আছে?
- মনে থাকবেনা মানে, কলেজের বিখ্যাত রোমান্টিক জুটি। কেমন আছেন ওরা, ওনাদের তো একটাই বাবু? বাবুটা যা সুইট, দু বছর আগে শেষ দেখেছি।
- শোন তুইতো সাইকিয়াট্রিতে ট্রেনিং করছিস পিজিতে, ওনারা তোর সিনিয়রের সাথে ফোনে কথা বলতে চায়।
- কি বল এসব, উনাদের আবার কি সমস্যা হল?
- সমস্যাটা তুলি আপার। বেশী বেশী পরিষ্কার থাকা, বার বার হাত ধোয়া, সারাদিন রুম গোছানো এইসব সমস্যা। কি যেন রোগটার নাম?
- OCD – Obsessive Compulsive Disorder. বাংলায় সহজে বলা যায় শুচিবায়ু।
- ওনার এই সমস্যা আগে থেকেই ছিল। এখন অনেক বেড়েছে। উনি এখন আলাদা রুমে থাকেন, ওনার কাপড় চোপড়, থালা- বাটি কাউকে ধরতে দেন না, বাসায় মেহমান আসলে, যাওয়ার পর পুরো বাড়ির কাপড় চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢোকেন, দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে ধোয়াধুয়িতে। বাচ্চাটার পড়ালেখা কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এবার পহেলা বৈশাখে নাকি শাহেদ ভাই ঘুরতে চেয়েছিল, উনি অনেক ধুলা এই বলে যান নি। এই নিয়ে শাহেদ ভাইয়ের সাথে সারাদিন খিটিমিটি। এমন অবস্থা যে সেপারেশন হয়ে যায় যায় অবস্থা। তুলি আপাই ফোন করে আমাকে জানাল এসব। খুব কান্নাকাটি করল।
- তাহলে আজকেই বল স্যারের চেম্বারে চলে যেতে, আমি স্যারকে বলে রাখব।
- আসলে হয়েছে কি সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলে সবাই ঊনাকে পাগল বলবে, এই ভয়ে উনি যাচ্ছেন না, না গিয়ে ফোনে যদি ট্রিটমেন্ট করা যেত খুব ভাল হত। তুই তো জানিস আমাদের দেশের অবস্থা, এই মানসিক রোগী আর রোগ এখনও আমাদের সমাজে সহজে গ্রহনীয় কোন বিষয় না।

উপরের তিনটি ঘটনাই গল্পের ছলে লিখলেও আসলে সত্যি। আমাদের দেশে Major Psychiatric Disease এ ভোগা রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১ ভাগ, খুব কম নয় এই সংখ্যাটা। আর ছোট খাট দুশ্চিন্তা, মাদকাসক্ত বা অন্যান্য Minor Psychiatric Disorder সহ এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী। কিন্তু এই রোগ আর রোগীদের নিয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা গুলো এখনও মধ্যযুগের। মজার ব্যাপার হল শিক্ষিত- অশিক্ষিত, শহুরে-গ্রাম্য, গরীব-ধনী কোন শ্রেনীর মানুষই এই বিষয়ে সচেতন না। সবার কাছেই এই রোগীরা হাসির পাত্র।

একসময় ব্রিটেনের এলিট শ্রেণীর বৈকালিক ভ্রমনের একটা জায়গা ছিল মানসিক হাসপাতাল, মানসিক রোগীর কর্মকান্ড দেখে তারা বিমলান্দ ভোগ করতেন। পশ্চিমারা সেই অবস্থা থেকে অনেক আগেই বের হয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা অনেক কিছুর মত এই বিষয়ে ও চিন্তা-ভাবনায় পিছিয়ে আছি। আমাদের চিন্তা ভাবনা গুলো এদের ব্যাপারে আরেকটু মানবীয় করতে খুব বেশী কষ্ট করতে হবেনা। প্রয়োজন একটু সদিচ্ছা আর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর মানসিকতা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৩ সকাল ৮:০২
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×