কথিত কথন! কলম্বাসের সাথে জনা তিরিশেক লোক ছোট্ট জাহাজে। ১৫৯২। সবার মতলব বাণিজ্যের উদ্যেশ্যে ভারত রাজ্যে গমন। স্পেনের রাজা থেকে লাভের লোভ দেখিয়ে আসা দলটির ভাগ্যে কী আছে কে জানে! লোহিত সাগরের ভাসা জাহাজটি যেমন অনিশ্চয়তায় দুলছিল; ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন’ বাণী খানি বেশী করে স্মরণ হচ্ছিল। সখি, ভারত যে ‘দিল্লি দুরস্ত পথ’-এত সহজে কি মিলিবে তাহারে। সঙ্গে আনা খাবার অনিশ্চয়তার কারণে নগণ্য মনে হচ্ছিল। ফললও তাই। দিন সাতেকের মধ্যে সব খাদ্য তো ফুরালই; এবার শুরু মৃত্যু মিছিল। সঙ্গি সাথী দিন যাওয়ার সাথে সাথেই কমতে শুরু করেছে। একজন তো কলম্বাসকে চুপি স্বরে বলেই ছিল ‘ দোস! ভারত যেয়ে কাম নাই; বাড়ীর রাস্তা মাফি।’ তবে সাথীদের কথাকে থোরাই কেয়ার করে ‘আফ্রিদি ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল কলাম্বাস। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে খাদ্যাভাবে মৃত ভাইয়ের গোশত খেয়ে সাগরের অনিশ্চিত জীবন চলছে। জাহাজ চলছে নক্ষত্র মেপে; ম্যাপ ছিল না বলে। দীর্ঘ ৭০ দিন পর কোন এক সাঝের বেলা পানিতে কচি সবুজ ডাল জাতীয় কিছু একটা দেখা গেল। গাছের ডাল যেহেতু- সামনে নিশ্চয়ই কোন দ্বীপ অপেক্ষা করছে। খুশির একটা ধমকা হাওয়া বয়ে গেল মনে। কলম্বাসের এক সাগরেদ ইউরেকা বলে চিৎকার ‘ভারতে এসে গেছি; রুখবে মোদের কে?’ কিছু দূর এগুতেই চোখ ঝিলিক করে উঠল। হ্যা্ ঁএকেবারেই সবুজের আধার এক বনে এসে পড়েছে। পড়িমরি করে সবাই নেমে অচেনা সব ফলমূল গোগ্রাস করতে লাগল। অচেনা স্বাদ মুখে ভিন্ন রোমাঞ্চ নিয়ে এসেছিল- সন্দেহ নেই; তবে খিদের জালায় সে রোমাঞ্চ অনুভব করার সময় ছিল না। ভুতুরে জঙ্গল পেড়িয়ে সবার চক্ষু চড়কগাছ। আরে! কোথায় সোনা-দানা আর কোথায় ‘বে দানা’। আসলাম লাট মলাটদের সাথে ব্যবসা জমাতে আর লাল রঙা এসব লোকরা দেখি কৃষি করে খাচ্ছে। ক্ষণিক দেখায় তাদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ তকমা দিলেন কলম্বাসের সগযোদ্ধারা। তবে মহাভুল করে যে ইন্ডিয়ার বদলে তারা খোদ আমেরিকায এসে গেছে এই ভুল ভাঙতে সময় লাগে নি। একেই বলে ভুল করে জয়!
।।
গাট্টি গোল করে লঞ্চ এ উঠলাম ঢাকা থেকে । ভয়াবহ অবস্থা চাঁদপুরগামী লঞ্চটিতে। ঢাকার সব লোক যেন পঙ্গপালের মত শহর ছাড়ছে। সাথে উঠা বাকী ৪ জনের অবস্থা যেন ত্রিশঙ্কুর দশা। একেতো লঞ্চে ডেক ছাড়া বসার কোন জায়গা নাই; তার উপর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া। লঞ্চের নিচ তলায় মাদুর বিছিয়ে গোল টেবিল বৈঠকের ঢঙে বসা সব্বাই। জিনাস ভাই এর চাদরের উপরে। পরিচয় দিই কয়েকজনের। চিকনা-চাকনা হলেও শৈল্পিক দেহী আরিফ সাংবাদিক। আরেক জন ইয়ামাহা স্থুলকায় সালাদিন । পাশের কোন একজনের সাথে কি সব বিষয় জাহির করতে ব্যস্ত। বেশ খোশ মেজাজেই যাচ্ছিলাম। তবে সেই খোশ নাখোশ হতে সময় লাগে নি। সামনের মস্তবড় দরজাটার মাজেজা তখনও নজরে আসে নি। খানিক বাদে ভদ্র অভদ্র নির্বিশেষে চাঁদ আর লক্ষীপুরীরা দরজা খুলে ছাদে যাচ্ছে; আর ফ্রি দিয়ে যাচ্ছে একরাশ গাঁ চমকানো ঠাণ্ডা বাতাস।এবার সাথে থাকা সাংবাদিকদের ঠেকায় কে। উঠে উঠে রীতিমতো ধমকাচ্ছেন ছাদে গমনেচ্ছুক যাত্রীদের। একফাল তাকিয়ে তাদের বিরুদ্দে কুৎসা হাকছেন আরেকজন। ছাদে গিয়ে ধোয়া ছাড়ে, গপ্প মারে,টাশ খেলে ইত্যাদি সব তকমা যাত্রীদের অজান্তেই গায়ে বসিয়ে দিচ্ছেন জিনাস ভাই। তবে এসব বাধাকে কেয়ারই দিচ্ছে না কালপ্রিটরা। হাঁসি আর অনুশোচনা মিলিয়ে আমার মনে একপ্রকার কেওক্রাডং অনুভ’তি । এর মধ্যেই শেষরাতের দিকে চাঁদপুর ঘাটে এসে লঞ্চ থামল।
।।
সকাল সকাল আব্বাসকে ফলো করে জনা ছয়েক লোকের একটা দল বেড়িয়ে পড়ল। মিষ্টি রোদে চাঁদপুরকে অচানক লাগছিল। প্রবল তাপের মরুভুমির লোকদের কাছেও যে সূর্যিমামা রোমাঞ্চ নিয়ে হাজির হয়-সেদিনের কিরণ না দেখলে তা বুঝা হত না কোনো দিন। এখন যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে সেটা একটা বিষয়। পেনিনসুলা বললে ভুল হবেনা। আমাদের চাঁদপুর শহরের বিজ্ঞাপন চিত্র। পদ্মা- মেঘনা- ডাকাতিয়ার মিলনকে নদীর দিকে বেড়ে যাওয়া পেটখানি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। নৌযান থেকে দেখতে যতটা সুন্দর; পেনিনসুলার ঠিক পেটের উপর দাঁড়ালে আরো মধুকর। এমন পেনিনসুলা দ্বিতীয়টি আছে কিনা জানা নাই। এবার পেনিনসুলা ছাড়তে হবে। উদ্যেশ্য কোন চরে আনন্দভ্রমন। ভেলেন্টাইস ডেতে মেঘনার চরে অনভিপ্রেত কোন ঘটনার রেস ধরে কোন মাঝিই চরে যেতে চাচ্ছে না। আব্বাস সাথে থাকায় ভালোই হল। মিল্ল মাঝি। ঘণ্টার দুরত্বে একটা চরএ ভিড়ল ইঞ্জিন নৌকা। চর বললে ভুল হবে; বড়সড় বয়সী চর। সংগ্রামে পর থেকেই এখানটায় মানুষের বসতি। আসতে আসতে অনেক চর দেখা হয়েছে মেঘনার চর , বালির চর সে এক লম্বে ফিরিস্তি। সাথে থাকা ট্যাব দিয়ে ছবি ভিডিও তো চলছেই। তবে আফসোস হচ্ছিল জনমানবশূন্য নিরিবিলি কোন চরে ঘুরে বেড়–লে বোধ হয় সিরাম ফিলিংস হবে। ভুল ভাঙতে সময় লাগে নি। কেন ? সে কথা বিরতির পরই বলি।
।।
চর থেকে ফেরার পথে মাঝিকে বলা হল পাশের বালির চরে যেন ক্ষণিকের জন্য নাওটি ভিড়ায় । তবে ভেড়ানোর আগেই আমাদের পদ্মায় সাতড়ানোর উন্মাদনা তৈরী হল। বরাবরের মত নেতৃত্বে জিনাস ভাই। ঝাপ মারলেন এমন ভঙিতে যেন পদ্মার পানির উপর তার দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ। অন্যদের ভঙিমা ভিন্ন হলেও সবাই দেখি বেশ উপভোগই করছে। আমি ঝাপ দিব কি দিব না ভাবতেই দিলাম লাফ। হু............আহ। নদীর গভীরে যাওয়া থেকে মাথা তোলা পর্যন্ত এটা ছিল অবস্থা। ভয়াবহ ঠান্ডা। নদীর পানি ঘোলা ভালো জানতাম; তবে ঠাণ্ডা যে ভালো না সেদিন থেকে একপ্রকার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলাম। একে একে সবাই অবস্থান নিয়েছে পদ্মার শীতল পানিতে; একজন ছাড়া । ভারীদেহের কারণটাও জানি তবে ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’। বালির চরে উঠে আদিম কায়দায় কাঁদামাটি নিক্ষেপ চল্ল একদফা। তকে কাঁদাকেলিকে ছাড়িয়েছে জলকেলি। নাও যখন চরপানে এগুচ্ছিল তখন পা দুখানি পানিতে না এলিয়ে দিলে কি চলে? সে এক অপূর্ব ¯স্নিগ্ধতা। জলকেলি ভালো ; তবে পাদুকেলিও খারাপ না।
।।
বালির চরে নামাার আগে যে চরটিতে নেমেছিলাম সেটি সুবলার চর। অবস্থান শরিযতপুর! তার মানে পাক্কা একজেলা পেরিয়ে। অজান্তেই একটা রেকর্ড। শরীয়তপুরের আমাদের প্রায় সবার ১ম আগমন; কলম্বাসীয় কায়দায়। দু টোর সাথে ফারাক আকাশ পাতাল, তবে মিল পাওয়া গেল অনেক। এ চরের বাসিন্দাদেরও কোন উচ্চাশা নেই। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই মুখ্যত যেখানে। দুই জোয়ান ছাওয়ালকে জিজ্ঞাস করলাম কলেজ টলেজ আছে? তারা গর্বভরে বলল, ‘আব্বাসউদ্দিন সরকারী উচ্চবিদ্যালয়’ নামে একটা হাইস্কুল আছে; এতেই ঢের! তাদের গর্বের পারদের সাথে আরেকজনের বুক ফুলে উঠতে দেখলাম। আমাদের সফরসঙ্গীর। হাইস্কুলের নামের সাথে নিজের নাম মিলে যাওয়ায়। চরের মাটি মাড়িয়ে এগুচ্ছিলাম- অনুভুতি এমন হচ্ছে যেন ‘নয়া জামানা-খুব ছুরত হ্যা; আওর বহুত আচ্ছা হে।’ এখানকার মানুষের জীবনের অসম্ভব সরলতা যে কাউকে মোহিত করবে। চেনা নাই জানা নাই একজন তো আমাদের আতিথ্যই করতে চাইল।
- ভায়েরা কি ঘুরতে আইছেন নাকি?
-‘হ্যাঁ
- রোদে না হাইটা চলেন বাড়ীতে , যা আছে খাইবেন।
- -কলা টলা নাই ?
- আছে , তবে কাঁচাকলা।
গ্রামের বেগামরা দল বেধে পাড়া থেকে পদ্মাপাড়ে আসে। স্নানের জন্য নিজেরা জায়গা ঠিক করে নিয়েছে। কিছু ধার পর পর এ রকম গোসলধার মিলবে। দরকারী পানি নদী থেকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব উঠতি বয়সী মেয়েদের। হালকা বাদামী রঙের গরুগুলো ছেড়ে দেয়া আছে চরজুড়ে ; অনায়াসসাধ্য ধুসর ঘাসের উপর কখনো জিভ দিয়ে আচর কাটছে ,কখনো গোগ্রাস করছে। নদীর পারে গরুর ছোট্ট পাল স্মরণ করাচ্ছিল ‘ শোনো মা আমিনা রেখে দে কাজ.. ....ভেসে উঠে ।
আমার সাথে আসা জনাদের নতুন খায়েশ জন্মেছে ইলিশ খাবে। তবে খায়েশটা এতই তীব্র যেন হার মানায় সরকারবিরোধী কোন আন্দোলনকে। চোরাই ঝাটকা , বড় ইলিশ যেটাই হোক চাইই চাই। চরের বিরান এলাকায় একটা দুটো দোকানও মিল্ল দোকানদারকে ইলিশ পাওয়া যাবে কোথায় বলতেই বুঝিয়ে দিল ঠিক জায়গায়ই নক হয়েছে। জেলেদের থেকে পর্যাপ্ত মাছ বরফে রেখে দেয়া আছে। চাইলে যে কয়টা লাগে অর্ডার হবে- গরম তেলে নগদ ভাজা হবে। ভাত ফ্রি। এ অফারে আমি ছাড়া সবাই এক পায়ে খাড়া। তবে দাম শুনে খাড়া পা মারা পরতে সময় নেয় নি। চরের এ অংশটাতে সরিষার চাষও হয়েছে। সরষের পাতায় চরের দৈন্বতা ঢাকা সম্ভব ছিল না। সামনের দিকটাতে ধুসর ঘাসের চেয়ে বালির প্রভাব বেশী। সাহারা ধারার। সবাই যেন ডিসকভারী চ্যানেলের বিয়ার গ্রিলের ভ’মিকায় এক্সফোর করছিল সব। এবার হাটছি চরের বেলে মাটি দিয়ে পদ্মার পাড় ঘেষে। ছোটখাটো কক্সবাজার ক্ষণিকের জন্য যেন নেমে এসেছিল আমাদের পদ্মাপাড়ে। ‘হাত থেকে জাল ছুড়ে মারা’-মাঝিদের সাথে কথা হল।
- এ জালে ইলিশ ধরা পড়ে?
- -হ্যা, পানি বেশী হলে পড়ে দু একটা।
মাছের ঝুড়ি তল্লাশি করে দেখলাম ফরমালিনমুক্ত এ ফসড়া মাছ । বাইলা মাছেরই আধিক্য। দিব্বি চলে যাবে দু বেলা। রোগ বালাইয়ের বালাই নেই। মনে হল চরের জীবনই সুখের। শহুরে ছুটিহীন ব্যাস্ততা নেই- খাদ্যেরও কমতি নেই। মাটির মানুষ-পানির মানুষ ,আক্ষরিকার্থে এরাই। প্রকৃতির সাথে নিবিড় মিলন এদের চেয়ে আর কারো নেই।
হ্যাঁ। এখন উপলব্ধি হল-মানুষ শূণ্য চর অন্তসারসূণ্য। ধুধু বালুচর থেকে উপলব্দির কিছু নেই। মানুষই ধরার মূল সৌন্দর্য; নহে প্রকৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৫