‘তোমার খাতার প্রথম পাতায় একে দিলাম আল্পনা ; আমার ছবি কইবে কথা যখন আমি থাকব না।’ এ জাতীয় মারফতি লাইনের কথা মোটেও ভালো লাগার নয়। নিজে নিজে হারিয়ে গিয়ে আবার ‘চিছিংফাক’ বলে ফিরে আসলে সবাইকে থ্রিলার টাইপের অনুভ’তি দেয়া যায় । মন্দ না আইডিয়াটা। মুশকিল হয়েছে এ অসামাজিক ধান্দাটা মাথায় এসেছে বয়স যখন সাত-আট। কাঁচা আমের মৌসুম তখন। সন্ধ্যায় ঝড়ে পাড়া দেড়পোয়া ওজনের আম হাতে করে ঘরের অতিকায় আলমিরার পেছনে অবস্থান। মতলব, দা-যোগে আমের কাঁচা শরীরের ব্যাবচ্ছেদ; লম্বাা সময় নিয়ে লবন-মরিচ যোগে গলাদকরণ। তবে সময় এত বেশী নেয়া হল ঘড়ির কাটা রাত আটটা-শহরের ঘড়িতে যার ওজন ১২টা! সাত বছরের পুছকে এত রাতেও বাসায় ফেরেনি-বুঝা যায় কিছু? কাহিনী হুলস্থুল। মা মারফত উদ্ধারাভিযান শুরু হলেও পুরো বাড়ী জমায়েত হতে তের মিনিট লেগেছ। অভিযানে মহিলাধেরই আধিপত্য। ভিন্ন জাতরা বেড়িয়ে পড়েছে নোয়াবাড়ীর পথ থেকে হাটে বাজারে। টিনের বেড়ার ওপার থেকে ওঠোনে অবস্থান নেয়া মহিলাদের কণ্ঠে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ।
-কই যাইব এত রাইত?
নিজের নাম বলাবলি হচ্ছে; তাই খারাপ লাগছে না । আম খাওয়া শেষ হওয়ার পরও ‘দেখিনা কী হয়’-দেখতে আরো মিনিট বিশেক দম ধরলাম। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দরজার সিটকারী খুলে বলে দিলাম
-কী গো হইছে । তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এখন মনে নেই। তবে ঘরে ভালো করে না খোজায় মা’র প্রতিই অভিযোগের তীর ছুটছিল। ফিরে পাওয়ার আন্দটা বেশ বেজায় ছিল। অন্য ঘরের চাচারা দিনকয়েক স্বরচিত অনেক মসকরা করে গেলেন আমাকে নিয়ে। তাতেও ছিল ফিরে পাওয়ার রেস। ফাইভে থাকতে এরকম আরেকটা কাণ্ডে পুরো গ্রামে হুলুস্থুল বেঁধেছিল। গণিত বার্ষিক পরিক্ষার দিন ফুটবল খেলার খায়েশে চাচাতো জেঠাতো মিলে আট নয় জন ভাটেরগাঁও মাঠে।
খেলাপাগলামিটা এতটাই খেপাটে তখন পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে আর আমি মাঠে তখনও। এদিকে বাড়ীতে চলছে তুলকালাম। সে সঙ্গে জুটেছে নগদ আতঙ্ক। কারণ দিন দুয়েক আগে ইয়াছিন নামের পাশের বাড়ীর এক ছাত্রকে নিষ্ঠুর ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে বেনামি বেরসিক এক জ্বীনের হাতে। পরে জমজম খালে (আমার স্কুল যার পাড়ে) তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বুক, নাভির চারপাশের নখের আচড় দেখে সবাই জ্বীনের কাণ্ড বলে ধরে নিয়েছে। ইয়াসিনের ঘটনা আমার হারিয়ে যাওয়ায় সাথে রসায়ণ যোগ করেছে সন্দেহ নেই। ছোট আপু মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর বিলাপ বকছে-হারায়েছে ভেবে। মাঠ থেকে ফিরে আসার পর আপুদের যে উচ্ছাস তার বর্ণনা অবর্ণণীয়। ঠোটে হাঁসির রেখা থাকলেও অঝোড়ে অশ্রু ঝড়ছিল তখনও।
‘‘মনে খুশি; চোখে কান্না - বলে যান নি রাম শর্মা”
।।
একবার রাত চারটার দিকে বাহিরে হট্টগোল শোনা গেল। কাহিনী সার; ছোটবেলা থেকে জমিয়ে রাখা কিসমিস খাইয়ে যে দাদী বড় করেছেন - তিনি হারিয়েছেন। বয়স অনেক; তাই ঘুমের ঘোরে বাইরে বেড়িয়ে কোথায় পড়ে আছেন কে জানে। বাপ চাচারা পুরো বাড়ীতে চিরুনী নয়; চালুনী অভিযান চালিছেন। কান্নাহীন সে হারানোর বেদনা যে কত ভয়ানক তা নির্বাক মুখ গুলো বলে দিচ্ছিল। বিপদে পড়লে মানুষ নাকি খড়কুটে ধরেও বাঁচতে চায়। তেমনি সান্তনারুপী মনকলা খাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হল বাড়ীর সব পুকুরে জাল মারা হবে। পানিতে পড়ে যাওয়া বয়স্ক কারো পক্ষে কতঘণ্টা বেঁচে থাকা সম্ভব। এক ঘণ্টা? দু’ঘণ্টা? তাহলে এ বৃথা প্রয়াস কেন। ঐ যে মৃত্য শোক ধীরে মনে সয়; হারালে করে আরো ক্ষয়। এই প্রথম কাউকে হারানোর দু:খ আঁচ করলাম।
ফিরে পাওয়ার আনন্দ দেখেছি অনেক দিন; হারানোর বেদনা তার চেয়েও যে সুকঠিন।
।।
চীনাদের কান্না কি খুব একটা চোখে পড়ে? মালোয়েশিয়ান বিমান হারিয়ে যাওয়ার একদিন পরই বেইজিং বন্দরে চীনা স্বজনদের কিনা গগনবিদারী আহাজারী। এ আহাজারী যতটানা সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য তার চেয়ে বেশী হারানোর আশঙ্কার। ভীনদেশ কেন? গুমের শিকার কতজনকেই তো আমরা হারিয়েছি। লাশ পাওয়ার সান্তনাটুকুও মেলে নি। সংগ্রামের সময় চিটাগাংয়ের এক বিহারীবধূকে তার স্বামী বলেছিল আমি মিটিং সেরে আসছি। সাইত্রিশ বছর পর ঐ মহিলার সাক্ষাতকার নিতে যাওয়ার পর সে বলেছিল ‘তিনি যে মিটিংয়ে গিয়েছেন; তা এখনও শেষ হয় নি।’ মহিলার চেপে রাখা বেদনার পারদ মাপার সাধ্য কি আমাদের মত না-হারানো-দলদের আছে? বাসা থেকে ধরে নিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’-গানের সুরকারকে খুন করেছে পাকি নরাধমরা। লাশটা বধ্যভ’মিতে মিলেছিল। আলতাফ মাহমুদের বউকে ববিতা বলেছিল ‘দেখেন আপা, আপনিতো লাশটা পেয়েছেন; আমি আমার ভাইকে পাইনি আজও’। হ্যাঁ - জহির রায়হান, মিরপুর থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর চল্লিশ বছরেও ঢাকার কোন অলিপথ গলিপথে দেখা যায় নি লোকটাকে। ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর রুপকারকেই থামিয়ে দিল কেউ যেন। মিডিয়া মারফত-ববিতার ভাই হারানোর বেদনা আমাদের কানে এসেছে।
--- রানা প্লাজায় যারা হারিয়ে ফেরে নি এখনও , সে না বলা শোক সইবার ক্ষমতা আছে কারো?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৪১