আমার ছেলে তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তো দেশের একটা নামকরা স্কুলে। সঙ্গত কারনে নাম বল্লাম না। যাহোক বছরের শুরুতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশাল এক বইয়ের লিষ্ট ধরিয়ে দিল। গুনে গুনে দেখলাম টোটাল ১৮টা বই। এবং প্রায় ১০টি বিষয়। বাংলা ইংরেজী অংক ধর্ম ছাড়াও বিজ্ঞানের বই প্রায় ৪টা। মা হিসেবে যারপরনাই আনন্দিত কারন ১৮টা বই পড়ে নির্ঘাৎ আমার পুত্রধন আইনাস্টাইন না হয়ে যাইবে কই। এবং তার প্রাথমিক ধাপ বুয়েটে ঢোকা। তাই আমার মা সহ যাবতীয় বুয়েট পড়ুয়া কিংবা পাশকৃত মায়েদের ইর্ন্টাভিউ নিতে লাগলাম। এবং এই কনক্লুশানে আসলাম যে ওস্তাদের মাইর প্রথম রাইতে। অর্থ্যাৎ ছোট বয়স থেকেই দৈাড়ের উপ্রে রাখতে হবে। তাই বইয়ের লিষ্ট পাওয়া মাত্রই তা কিনে টিনে বিশাল বইয়ের স্তুপ বাসায় নিয়ে আসলাম।
যাহোক, ক্লাস শুরু হলো এবং দেখা গেল আমার ছেলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা সেই বইগুলোর অর্ধেকই খুলে দেখলেন না। বরং প্রতিদিন বিশাল সাইজের নোট দিতে লাগলেন ক্লাসে হোম ওয়ার্ক হিসেবে এবং যথারীতি সেই সব নোট থেকে পরদিন মুখস্থ পড়া ধরতে লাগলেন। "পৃথিবী সূর্য্যের চারররররপাপাপাপাপশে ঘোরে কিংবা পৃথিবী কমলা লেলেলেবুবুবুবু ওওও র মতো চ্যাপ্তা"......... কিংবা কবিতার দশ লাইন মুখস্থ করো সেখানে দাড়ি কমা এমন কি এক লাইন আগে পিছে লিখা বইতে, তা ও মুখস্থ করতে হতো হুবুহ একই রকমভাবে। হেন বিদ্যা নেই যেখানে মুখস্থ ছাড়া গতি নাই..... বাংলা ইংরেজী বিজ্ঞান ধর্ম ইতিহাস ভূগোল.........। ইয়া মাবুদ, আমার পুত্রধন মুখস্থ করতে করতে দিশাহারা হয়ে গেল। যথারীতি সে এক সময় বিদ্রোহ করে বসলো এবং পড়াশুনায় ক্ষান্ত দিয়ে ভিডিও গেইম বা কার্টুন নিয়ে বেশী মনোযোগী হয়ে গেল। অতপর: আতংকিত মা আমি আমি খেলনা, বাই, বার্গার, চকলেট সহ বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে এমন কি ক্রেন দিয়ে টেনেও ছেলেকে পড়ামুখো করতে পারলাম না। ওওওওওও বলে রাখি আমি আবার পিটানো মা না, পিটাপিটি আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। যারা বলে বাচ্চারা মানুষ হয় লাঠির উপ্রে তাদের থেকে একশ হাত দূরে...............।
এইভাবে টানাহ্যাচরার এক সময় কানাডায় আসলাম। প্রথমদিন স্কুলে ভর্তির জন্য হোম স্কুলে গেলাম। প্রতিটি পরীক্ষায় গড়ে ৯৫% পেয়ে প্রথম হওয়া পুত্র আমার সাথে আর্টে জয়নুল আবেদিন, কারাতে অরেন্জ বেল্ট, গানে মোহাম্মদ রফি, সাতারে ব্রজেন দাস........পুত্র গর্ভে গর্বিত মা সাথে নিয়ে গেলাম তার যাবতীয় সনদ পত্র। স্কুলে ঢুকতেই চমৎকার সুন্দরী একটি মেয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বসতে দিল। কি কারনে আসা শুনার পর বললো ওর হেল্থ কার্ডটা দাও। আকাশ থেইকা পড়লাম, মনে মনে ভাবলাম আমি কি পোলারে হসপিটালে ভর্তি করতে আসছি নাকি স্কুলে??? হেল্থ কার্ডটা নিয়ে বললো, ওর ক্লাস টিচারকে কল দিচ্ছি ও এসে ওর পরীক্ষা নিবে? এবাই সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম কারন দেশের ভর্তি পরীক্ষার কথা মনে পড়ে ঘাম ছুটে গেল। ইয়া মাবুদ....আমার ছেলে কি ওরা ডিমোশোন দিবে শেষে??? আমি আমতা আমতা করে বললাম, ও তো প্রস্তুতি নিয়ে আসে নাই। আমি শুধু এডমিশান ফর্ম নিতে আসছি। রিসেপশানের মেয়েটি আমাকে কিছু না বলে ইন্টারকমে ওর ক্লাস টিচারকে ডাকলো।
ছোটখাট চাইনীজ একটি সুন্দরী মহিলা আসলো, এসেই হাত বাড়িয়ে হেন্ডশেক করলো আমাদের সাথে। বললো, আমার নাম লুসি চ্যাং। আমি তোমার সাথে এ বছরটা কাটাবো। আশা করি দারুন কিছু শিখতে পারবো। এভাবে কিছুক্ষন ইংরেজিতে কথা বলার পর বললো, তুমি যদি চাও এখনি আমার সাথে ক্লাস করতে পারো তাহলে আমি তোমাকে সব ক্লাসমেট ও টিচারদের সাথে পরিচয় করাতে পারবো কারন এখন রিসেস (টিফিন পিরিয়ড) শেষ। এর মধ্যেই আমি বলে উঠলাম, তুমি ওর এডমিশান টেস্ট নিবে না? ও বললো, সেতো আমি নিয়ে ফেলেছি। আমি আকাশ থেকে পড়লাম, কেমনে? ও হেসে বললো, টেস্ট মানে ও ইংরেজী বুঝে এবং বলতে পারে কিনা। ও চমৎকার বলে ও বুঝে। আর যদি না ও পারতো তাহলে ও কোন সমস্যা নেই। ওর জন্য এক্সট্রা ক্লাস নিতাম। যাক মাটিতে পড়তে পড়তে বেচেঁ গেলাম। এরপর জানতে চাইলাম বইয়ের লিষ্ট কিভাবে পাবো। আমার কথা শুনে এবার টিচারতো আকাশ থেকে পড়লো, বললো গ্রেড ফাইভ পর্যন্ততো নির্দিষ্ট কোন বই ই পড়ানো হয় না। মানে কি??? কইলাম মানে কি আমার পুত্র তাইলে কি পড়বে, বাসায় আমি কি পড়াবো? মনে মনে ভাবলাম.. এ নির্ঘা্ত ষড়যন্ত্র। পুত্রকে আইনাস্টাইন বানানোর জন্য এখান পর্যন্ত আসলাম শেষমেষ আইনাস্টাইন না তার ল্যাবের ঝাড়ৃুদার বানানোর পায়তারা করছে এরা..........সব ষড়যন্ত্র। টিচার বললেন সেটা তোমার চিন্তার বিষয় না ,সেটা আমার চিন্তার বিষয় আর সরকারের চিন্তার বিষয়। এই বলে পুত্রকে নিয়ে ক্লাসে চলে গেল। জীবনভর ফাইল করে রাখা রেজাল্ট বা যাবতীয় কিছুই দেখতে চাইলো না। আমি মুখস্থ বিদ্যার মা যারপরনাই সংকিত হ্রদয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।
তারপরের ঘটনা খুব দ্রুতই ঘটতে লাগলো। আমার ছেলে সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকে কিন্তু ভুলে ও কার্টুন দেখে না এমন কি গেইম ও খেলে না। হাতি দিয়ে টেনে ও ছেলেকে সেখান থেকে উঠাতে পারি না। বললেই বলে হোমওয়ার্ক করছি। সারাদিন ক্লাসের পড়ার বিষয় আর বিজ্ঞান বিষয়ক আর্টিকেল নিয়ে পড়ে থাকে। আর দুদিন পর পর স্কুলের এ্যাসাইনমেন্ট বিজ্ঞান এর নতুন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করে। এ কাজ করার জন্য টিচাররা তাদেরকে ছোট ছোট বিজ্ঞান কিট ধরিয়ে দেয়। এবং তা তারা হাতে কলমে করে প্রজেক্ট জমা দেয়। টিচার শুধু গাইড করে। এছাড়া ও টিচাররা প্রায় তাদের বিভিন্ন সাইন্স ল্যাবরেটারিতে নিয়ে যায়। ওরা নিজেরাই রিসার্সারদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নেয় তাদের মনের যত প্রশ্ন এবং রিসার্সাররা খুব আগ্রহ ভরে তাদের সে কৈাতুহলী সাধারন প্রশ্নে উত্তর দিয়ে যায় ধৈর্য্য নিয়ে, মজা করে। প্রয়োজনে হাতে কলমে ও দেখিয়ে দেয়। এমন কি বিভিন্ন বড় বড় ইউনিভার্সিগুলো বছরে কয়েকবার বাচ্চাদের জন্য ওদের ল্যাবগুলো কিভাবে কাজ করে তা দেখার আমন্ত্রন জানায়। ৬ মাসের মধ্যেই আমার ছেলে ইউনিভার্সিসিটি অব টরেন্টো, রাইসন ইউনিভার্সিসিটির সহ অনেকগুলো ল্যাবরেটারিতে কাজ দেখার সুযোগ পায় শুধুমাত্র তার আগ্রহের কারনে। বিদ্যুত কিভাবে উৎপন্ন হয় তা বইতে না ল্যাবেই দেখে আসে তারা, সৈার সিস্টেম বা ভর শূন্যবা বা মধ্যাকর্ষন কিভাবে কাজ করে তা তারা দেখতে গেল সাইন্স মিউজিয়ামে। এছাড়াও শুধুমাত্র সহজলভ্য বিজ্ঞান কিটের সাহায্যে তারা নিজেরাই তৈরী করলো বিভিন্ন মডেল। মাত্র ক্লাস সেভেনই আমার ছেলে ও তার দল রোবট সোফিয়ার ছোট ভাই বানিয়ে ফেললো ও জাতীয় রোবোটিক প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে পুরো কানাডায় মধ্যে ৭ম স্থান অর্জন করলো যেখানে তার গ্রুপের টোটাল নাম্বার ছিল ১০০ তে ৮৮। যারা প্রথম হয়েছে তারা পেয়েছে ৯৯.৯৯.....এবার বুঝেন বাকিগুলা কি জিনিয়াস।
প্রতিযোগীতার একটা পিক শেয়ার করলাম।
যাক অনেক বকবক করলাম, এবার আসল কথায় আসি। এই যে মুখস্থ বিদ্যার ধাক্কায় আমার ছেলেকে কার্টুন আর ভিডিও গেইম মুখীহলো ঠিক একই ছেলে শুধুমাত্র পড়ানোর স্টাইলে আর কিছু সহজলব্ধ উপকরনের ধাক্কায় ছোট আইনাস্টাইন হয়ে উঠলো। আমাদের দেশে যেহেতু এ মুখস্থ বিদ্যার শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টানোর ক্ষমতা আমার আপনার নেই কিন্তু এ সন্তানটিকে সত্যিকারের পড়া শেখাতে বিজ্ঞান বক্সের মতো এ ধরনের সহজলভ্য উপকরনগুলোর বড় বেশী প্রয়োজন। বইয়ের পড়াগুলোকে শুধুমাত্র কল্পনার রাজ্যে নয় হাতে কলমে যদি দেখে তাহলে তারা যেমন দ্রুত শিখবে তেমনি একবার যা শিখবে তা কখনই ভুলবে না। ভেবে দেখেন মুখস্থ বিদ্যা বা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পড়ে হয়তোবা ভালো রেজাল্ট করতে পারবে তারা কিন্তু একজন গবেষক তারা কি হতে পারবে?
বিজ্ঞান বাক্স এর ছবি নেটে খুঁজতে যেয়ে হামা ভাইয়ের ছবিটা দেখে আনন্দিত হয়ে উঠলাম তাই শেয়ার করলাম।
আশা করি বিজ্ঞান বাক্স বা এর মতো হাতে কলমে শিক্ষার উপকরনগুলোর প্রয়োজনীয়তা সবাই বুঝবে ও বাচ্চাদের গিফট্ দিতে হলে এটিই খেলনার পরিবর্তে বেছে নিবে। স্কুলে বা অন্যান্য প্রতিযোগীতায় থালা বাটি নয় একটি বই বা বিজ্ঞান বাক্স ই তুলে দিক কর্তৃপক্ষ পুরস্কার হিসেবে। আমার বিশ্বাস আগামী মাসের বইমেলায় বিজ্ঞান বাক্স এর একটি স্টল যদি দেয়া হয় তাহলে শিশুরা হামলে পড়বে সেটা নেবার জন্য। কারন তারা ও ফেডআপ এ মুখস্থ বিদ্যার দৈাড়ে।
সবাই ভালো থাকুন। নীচে কিছু বিজ্ঞান বাক্স এর লিংক দিলাম।
বিজ্ঞান বাক্স
বিজ্ঞান বক্স
বিজ্ঞান বক্স
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১:৫২