কানাডায় সাধারনত সবাই অপেক্ষা করে সামারের জন্য। ঘুরাঘুরি ছুটাছুটির জন্য সামারই বেস্ট। যার কারনে হোটেল কটেজ সামারে খালি পাওয়া খুবই কঠিন কাজ। এবং রেটও অনেক বেশী থাকে। তাই সবাই চেস্টা করে ট্যাুরের প্লানটা আগেই করতে যাতে হোটেল বুকিং পাওয়া যেমন সহজ হয় তেমনি দামেও সাশ্রয় হয়। এছাড়াও সামারে এ বুকিং পাওয়াটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে যদি লং উইকএন্ড থাকে। মানে শনি রবিবারের সাথে বাড়তি একটা সরকারী ছুটি যোগ হয়ে তিন দিনের ছুটি। এতো কিছুর পরেও সব অসাধ্য সাধন করেছে এ্যালিসা। মাত্র ১০ মিনিটে চমৎকার কটেজ বুকিং করেছে। বিশেষকরে আমার মেয়ের সুু্ইমিংপুল পছন্দের বিষয়টা ও সবসময়ই বিবেচনায় রাখে।
আমার বাসা থেকে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা লাগে Gananoque তে পৈাছাতে। সিটিতে পৈাছেই ঢুকলাম বাচ্চাদের প্রিয় ম্যাকে। সেখানে থেকে লাঞ্চ সেরে বের হতেই দেখি রাস্তায় ফল-সব্জী নিয়ে বসেছে একজন। এখানে বলে রাখি কানাডায় কেউ রাস্তায় ফল-সব্জী নিয়ে বসা মানে সে নিজের ক্ষেত থেকেই এনে বিক্রির জন্য বসে। তাই সেখানে যেয়ে এক ঝুড়ি আপেল কিনলাম কোন কারন ছাড়াই।
কটেজে চেক ইন করেই বেড়িযে পড়লাম শহর দেখতে। গুগল সার্চ করে দেখেছিলাম স্থানীয় পার্ক ও বীচ কি কি আছে। তা ধরেই প্রথমেই গেলাম Joel Stone Heritage Park। নদীর পাড় ঘেষে চমৎকার এ পার্ক। ইতিহাসের সব সাক্ষী থরে থরে সাজানো আছে।
(ছবিটা কম করে ১২ বার রিসাইজ ঘুরায়ে প্যাচায়ে ভুয়ামফিজ ভাইয়ের ভুয়া সাজেশান অনুযায়ী এড করেছি কিন্তু ইহার ল্যাজ কোনভাবেই সোজা করিতে পারি নাই)
পার্কে ঘুরে পাশের বীচ দেখে আর কিছু স্যুভেনির কিনতেই দেখি ৭ টা বাজে। ডিনারের বাচ্চাদের প্রেফারেন্স ফার্স্ট কিন্তু আমার শর্ত ছিল নো ম্যাক, হ্যাভি ডিনার হবে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে এ্যালিসার কোন মাথা ব্যাথা কখনই থাকে না। যা পায় তাই খায়। তাই ও বললো চলো যেকোন একটাতে ঢুকি। কিন্তু আমি রাজি হলাম না কারন এখানে প্রায় সব রেস্টুরেন্টে বার আছে। এটা আমি এভোয়েড করতে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুঁজলাম। বেশী দূর যেতে হলো না, গুগল ম্যাপে" ১০০০ কারি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট" খুঁজে পেলাম ৫ মিনিট ড্রাইভিং এ। সেখানে পৈাছে গাড়ি পার্ক করতে যেয়ে খুব মজা পেলাম। ও বলে রাখি কানাডায় প্রায় সব রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা যায় এবং এর পাশেই থাকে অটো পেমেন্ট অপশান। কিন্তু এখানে সেই পুরোনো মডেলের কয়েন ঢুকিয়ে পার্ক করতে হয়ে কোন টিকেট নাই।
খাবারের মান বেশ ভালোই। চিকেন, বিফ, শ্রিম্প, ভেজি.... সব আইটেমই ট্রাই করলাম। এবং বেশ ভালোই লাগলো। সিজন বলে এতো ভীড় যে ওয়েটাদের মাথা খারাপ অবস্থা। আর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টতো পারলে একজনরে দিয়া চারজনের কাম করায় । বেচারারা......
রাতে ফিরেই মেয়ের মাথা খারাপ সুইমিং পুলেই গোসল করবে। সুইমিং পুল আর জাপানী জ্যাকজিতে (গরম হট টাব) গোসল নিয়ে দারুন একটা ঘুম দিলাম। কারন সকালেই আগে থেকে বুকিং দেয়া থাউজেন্ড আইল্যান্ড ক্রুজ। (যেহেতু আগেই এ নিয়ে পোস্ট দিয়েছি তাই নতুন কিছু এড করলাম না।)
সকালেই রওনা দিলাম থাউজেন্ড আইল্যান্ড ক্রুজ অফিসে। সেখানে চেক ইন করেই উঠলাম চমৎকার একটি শিপ এ।
এটা বোল্ট আইল্যান্ড। কিন্তু এটি ইউএস এর মালিকানা। তাই পার্সপোর্ট দেখিয়ে ঢুকতে হয়। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য পেন্ডামিকের কারনে সেখানে এন্ট্রি ছিল না।
আমেরিকান মিলিয়নিয়ার জর্জ বোল্ট এটি তার স্ত্রী Louise কে উপহার হিসেবে তৈরী শুরু করেছিলেন ১৯০০ খৃস্টাব্দে। কিন্তু ১৯০৪ এ তার স্ত্রী হটাৎ মারা যাবার কারনে মাঝপথে এ ১২০ রুমের ক্যাসেলটির কাজ বন্ধ করে দেয় সে।
বোল্ট ক্যাসেলের ইতিহাস শেয়ার করলাম সবার সাথে:
১৮৫১ জার্মানে জন্ম নেয়া জর্জ বোল্ট ভাগ্য ফেরাতে আমেরিকায় আসে মাত্র ১৩ বছর বয়সে। কর্পদশূণ্য জর্জ সম্পূর্ণ নিজের চেস্টায় খুব অল্প বয়সেই হোটেল ব্যবসা শুরু করে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে ১৬ বছরের লুইসের। জর্জ তখন ২৫, এর পরের বছরই বিয়ে করেন তারা। সে সময়ে জর্জ কাজ করতো একটি হোটেলের কিচেনে। কিন্তু দু'জনের প্রচেস্টাতেই হোটেল ব্যবসায় সফলতা আসে তাদের। থাইজেন্ড আইল্যান্ডে লুইস সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতো সামারে। প্রতি বছরেই আসতো পুরো পরিবার কিছুদিন সময় কাটাতে সেখানে। স্ত্রীর পছন্দকে সন্মান জানাতে ও সারপ্রাইজ দিবে বলে ১৮৯৫ তে এ দ্বীপটি কিনে নেয় জর্জ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৯৯ সালে কাজ শুরু করে সে। জর্জের পরিকল্পনা ছিল ৫ বছরে প্রাসাদ বানানোর কাজ শেষ হবে। স্ত্রী জন্মদিন যা ভ্যালেন্টাইন ডে সেদিন উপহার দিবে এ দ্বীপটি। তাই পুরো প্রাসাদে হার্ট সেপের ছড়াছড়ি। এছাড়াও ও আইল্যান্ডটিকে হার্ট সেইপ করারও পরিক্লপনা ছিল। তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯০৪ এ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী। কিন্তু সব কল্পনাকে ছাড়িয়ে লুইস মৃত্যু বরন করেন ১৯০৪ এর জানুয়ারীতে। স্ত্রী মারা যাবার সাথে সাথে এক টেলিগ্রাফ বার্তায় শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। কিন্তু সে কাজ আর কখনোই শুরু করেননি বা ফিরেও আসেনি সে দ্বীপে ১৯১৬ সালের নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
(ছবিতে বোল্ট পরিবারের। ছবির সূত্র: https://www.boldtcastle.com/visitorinfo/about)
ছবিতে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন ছোট্ট ব্রিজটির একদিকে আমেরিকার পতাকা অন্যদিকে কানাডার। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ইর্ন্টান্যাশানাল ব্রিজ।
প্রায় ৩ ঘন্টায় পুরো আইল্যান্ড দেখা শেষ। কানাডা থেকে ইউএস বর্ডার ঘুরে ঘুরে সাথে শিপরেকের উপরে নিয়ে যায়। শত শত বছর ধরে এ সেন্ট লরেন্স নদীকে ঘিরে চলে যুদ্ধ ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকার। তাই পানির নীচে আছে অসংখ্য শিপরেক। আমি আশা করেছিলাম শিপরেক দেখতে পাবো। কিন্তু এটা নাকি অনেক গভীরে তাই ভিডিও দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই।
(ছবি গুগুল)
অবশ্য ডাইভিং এর ব্যাবস্থা আছে কিন্তু সেখানে ভাইভিং দেয়ার মতো সাহস হয় নাই।
ক্রজ শেষ করতেই দেখি সারে বারোটা বাজে। এদিকে ক্ষিদেয় পেটে চো চো। কোন রকমে ম্যাকে ঢুকে খেতে খেতেই দেখি ২ টা বাজে। হায় হায় তিনটায় টাওয়ারের বুকিং দেয়া। সেটা প্রায় ত্রিশ মিনিট ড্রাইভিং শহর থেকে। কোনরকমে ছুটলাম সেখানে।
ইউএস বর্ডার ছুয়ে রাস্তা ও ব্রিজ দিয়েই যেতে হয় সেখানে। দারুন প্রাকৃতিক দৃশ্য আর ব্রিজ মিলিয়ে অসাধারন কিছু। কিন্তু বাদ সাধলো এ্যালিসাকে নিয়ে। ব্রিজে উঠতেই টোল দিতে হয় ৫ ডলার। এ্যালিসাতো রীতিমত জেরা, কেন আমি টোল দিবো? এটা সরকারী রাস্তা ও আমি ট্যাক্স দেই। আমার অধিকার আছে এটা দিয়ে হাটার। সেখানে কেন আমি পে করবো....।
আমার মাথায় হাত ওর অগ্নিমূর্তি দেখে। জীবনভর পদ্মাুসেতু, যমুনা সেতু, বুড়িগঙ্গায় টোল দিতে অভ্যস্থ আমার কোন গায়েই লাগেনি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, কোনভাবেই টোল দিতে দিবে না। উপায় না দেখে আমি বল্লাম বাচ্চারা এখানে আছে, তুমি ঝামেলা করো না। বাচ্চাদের কথা শুনে ও রণে ক্ষ্যামা দিলো। (উপরেই সেই ব্রিজের ছবি।)
1000 Islands Tower বর্ডার ঘেষে প্রায় ১৩০ মিটার উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। এক নজরে পুরো আইল্যান্ড দেখার জন্য দারুন জায়গা। উপরের ছবির নীচেরটি ইউএস বর্ডারের দৃশ্য। লিফটে করে ৩০ সেকেন্ডে নিয়ে গেল আমাদের শেষ তিন ফ্লোরের আগেই। বাকিটুকু হেটেই উপরে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর চারপাশ। এখানে না আসলে মিস হতো বিশেষ কিছু। টাওয়ার ঘুরে নীচের স্যুভেনিরের দোকান। দাম যা দেখলাম হার্টফেল করার অবস্থা। তাই না কিনেই ভাগলাম।
কটেজে ফিরতে ফিরতে প্রায় ৭টা। মেয়ের ধাক্কাতে আবার সুইমিং পুল ও জ্যাকজিতে শাওয়ার!! এবার কোথায় খাবো বলতেই এ্যালিসা ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলো সুসি খাবো চলো। সে জানে আমার ছেলে ও আমি সুসি অসম্ভব পছন্দ করি। কিন্তু শহরের একটি মাত্র সুসির দোকান ও তারা ডাইন ইন করে না। প্যান্ডমিকের কারনে অনেক রেস্টুরেন্ট শুধু টেক-আইট সার্ভিস দেয়। বাট আমার এ্যালিসা কোনভাবেই টেক-আইট সার্ভিসে বিশ্বাসী না। তার কথা সুসি হলো আরাম করে খাওয়ার জিনিস। একটা একটা করে অর্ডার দিতেই থাকবো আর খেতেই থাকবো সেটাতেই বেশী মজা। শেষ পর্যন্ত অনেক খুজেঁ প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভে আরেক সিটি কিংস্টোনে সুসি রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেল সে। অতপর: চল্লাম সেখানে।
বুফে সিস্টেমের এ জাপানীজ সুসিবারে ৩৩০টি আইটেম আছে। একবারেই পে করে যত খুশি খাওয়া যায়। আমি ৩/৪ টা, আমার মেয়ে ১টাই আর ছেলে ৫/৬ টা আইটেম নেবার পর আমাদের আর পেটে জায়গা নেই। কিন্তু ততক্ষনে এ্যালিসার ২২ তম অর্ডার চলছে। এবং সে খেয়েই চলছে, খেয়েই চলছে , খেয়েই চলছে .......। আমি ও আমার ছেলে খাওয়া বন্ধ করে হা করে তাকিয়ে আছি। আজ এতো বছরের পরিচয়ে এতো খেতে কখনোই ওকে দেখি নাই। আমাদের হা করে তাকিয়ে থাকা দেখে একটা ধমক দিলো, তোমরাও খাবা না আবার আমাকেও খেতে দিবা না!!
ক্ষমা চাচ্ছি খাবারের ছবি পোস্ট করাতে্ এটা আমি পছন্দ করি না।
পরদিন নির্দিষ্ট কোন প্লান ছিল না তাই শহর দেখতে বের হলাম।
Gananoque সিটি ফ্রান্স কলোনির গুড়ুত্বপূর্ন সিটি। তাই সারা শহর জুড়ে ঐতির্য্যের চিহ্ন। চার্চ, পানির ফোয়ারা, পুরোনো দালান সবই আগের মতই রেখেছে।
তারপর গেলাম ছেলের পছন্দের মিউজিয়াম দেখতে। কোন টিকেট সিস্টেম নেই সেখানে তবে একটা দান বাক্স আছে ঢোকার মুখে। যে যা পারে তাই ডোনেশান দিয়ে মিউজিয়ামে ঢুকে। ছেলেকে ওর যা খুশি দিতে বল্লাম তাই পার্সটা এগিয়ে দিলাম। কৃপন ছেলে আমার পাঁচ ডলারের নোট নিলো। আমি হাসতে হাসতে বল্লাম এন্ট্রি ফি এতো কম ডোনেশান ঠিক না ।
ছোট হলে চমৎকার একটি মিউজিয়াম। Gananoque সিটির ইতিহাস জানতে এ মিউজিয়ামটা খুবই ভালো একটি মাধ্যম।
হেটে হেটে শহর ঘুর ক্লান্ত হয়ে বাচ্চারা আর কোথাও যেতে চায়নি খেতে। তাই ম্যাকই ভরসা।
পরদিন চেক আউট করে সকাল এগারোটায় বের হই। পথে ঘন্টাখানের ড্রাইভ করার পর এ্যালিসা বলে উঠলো এ্যাপল ফেস্টিভাল শুরু হয়েছে গতকাল থেকে বিগ এ্যাপল এ। সাথে আছে হ্যান্ড ফিডিং জু, চলো যাই! হ্যান্ড ফিডিং জু শুনেই বাচ্চা চেঁচামেঁচি করে উঠলো যাবো যাবো বলে। তখন কি আর ও আমার কথা শুনে সে!!! সোজা গাড়ি ঘুরায়ে সেখানে রওনা। ঘন্টা দেড়েক ড্রাইভ করে সেখানে দেখি যথেস্ট ভীড়।
এক ডলার দিয়ে ছোট ছোট বক্স থেকে পশুদের খাবার কিনে সব বাচ্চারা চেস্টা করছে পশুগুলোকে খাওয়াতে। এরা খেতে খেতে মনে এতো বিরক্ত যে কাউকে আর পাত্তা দিচ্ছে না। আমার মেয়ে অতি উৎসাহে ভেড়া/ময়ুর/খরগোশ/মুরগীর খাবার কিনেছে কিন্তু একমাত্র ছাগল ছাড়া কেউই কোন আগ্রহই দেখায় নাই। বেচারারা.......
জু ঘুরে এ্যাপল বাগান দেখে তারপর তাদের বেকারী থেকে চমৎকার এ্যাপল পাই কিনে খেতে খেতে রওনা দিলাম।
ছোট কিন্তু চমৎকার একটা ট্যুর শেষ করলাম। আজ এখানেই শেষ।
সবাই ভালো থাকেন।
আগের পর্ব দেখতে চাইলে: এইটা ছবি ব্লগ প্রতিযোগিতা না। Thousand islands ঘুরাঘুরির ছবি........
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৭:১৫