বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্রেনের সেলে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। বর্ষার সে দুপুরে আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টির মাঝে ছাদে উঠে সে ছুটোপুটি যেন এখনো অনুভব করতে পারি। কিংবা স্কুল থেকে ফিরে গেইট ধরে বাবার অফিস থেকে আসার জন্য অপেক্ষা করার সে অনুভূতি, মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। এখনো যে মায়ের নিভিয়া ক্রিমের গন্ধ হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসে ভর কোন দুপুরে কিংবা গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে মায়ের গায়ের গন্ধে। সেই আগের মতোই অন্ধকারে হাতড়ে মা'কে খুঁজতেই মনে পড়ে মা'তো এখন অনেক দূর আকাশের তারা।
মায়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল সুলতানা আপা আর রোকেয়া আপার। যথেস্ট বয়সের ব্যবধান হলেও তাদের সে আড্ডা, খুনসুটি ও সাথে সুলতানা আপার বানানো ছোট মুচির সাথে তেতুল গুড়ামরিচ আর চিনি দিয়ে সে ভর্তায় ভাগ বসাতে আমরা ছোটরা ভুলতাম না। তারপর হয়তো কোন রবিবার দুপুরে আমাদেরকে ফাকিঁ দিয়ে তিন বান্ধবীর বলাকা হলে সিনেমায় যাওয়া এইতো সেদিনের ঘটনা। মা আমার খুব সিনেমা পাগল মানুষ ছিল। মায়ের কাছ থেকেই জেনেছি উত্তম, সুচিত্রা, শাম্মীকাপুর, বৈজন্তীমালা, ওয়াহিদা, সুরাইয়ার নাম।
বড়দের আড্ডায় বরাবরেই আমাদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। তারপরও কখনো সখনো সুলতানা আপাকে বলতে শুনতাম, রাজকুমার ছাড়া আমি যে বিয়েই করবো না। তারপর সত্যিই একদিন এক গাড়িচড়া রাজপুত্র এসে সুলতানা আপাকে নিয়ে গেল। সে রাজপ্রাসাদে সুলতানা আপা কেমন ছিল আমি জানি না। তবে মৃত্যুর একদিন আগে সুলতানা আপাকে হাসপাতালে দেখতে গেলে সে রাজপুত্রকে অঝোরে কাঁদতে দেখেছিলাম। তারপর, মৃত্যুর বছর ঘুরতেই প্রথম মিলাদ মাহফিলে শোক পরিতপ্ত পরিবারে সে রাজপুত্রের নতুন বউকে দেখে মা'কে প্রশ্ন করেছিলাম, মা, বউ মারা গেলে কি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হয়?
আমাদের বাসার দেয়ালের ওপাশে ছিল দিদিমার বাসা। সারা বছর আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কবে পূজা আসবে আর দিদিমা দেয়ালের ওপাশ থেকে ডাকবে, শিপুর মা কইরে? আর থালা ভর্তি নাড়ু সন্দেশ মোয়া এ দেয়াল থেকে ওপারে পার হবে। সে ছোট দেয়ালটার উপরে বসতে দেখলেই দিদিমার ছোট ছেলে স্বপন কাকু একটা বকা দিয়ে নামিয়ে দিতো। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে কেন স্বপন কাকু বেলাদিকে বিয়ে করলেন না। মায়ের আদেশ পালন নাকি মিথ্যে ভালোবাসা থেকে পালানো। নতুন বউকে ঘরে তোলার সে খবর শুনে যে বেলাদি বিষ খেয়েছিল, তাহলে নিশ্চয় তার প্রেম মিথ্যে ছিল না। ছোট মনে অনেক প্রশ্নের উকিঁ ঝুঁকি ছিল তখন।
মনে পড়ে রানু পাগলীর কথা। সারাদিন কাজ করিয়ে প্রায় না খাইয়ে বিদেয় দিতো তাকে অনেকে। যেদিনই খাবার জুটতো না মায়ের কাছে হাজির হতো। মা বুঝে যেতো রানু কেন এসেছে। কিন্তু তার টনটনে প্রেস্টিজ জ্ঞান বিনে পরিশ্রমে খাবার খেতে রাজি হতো না। তাই মা তাকে ছোটখাট কাজ দিয়ে খেতে বসিয়ে দিতো। খেতে খেতে অনেক কথা বলতো সে। আমি পাশে বসে সে সব কথার মানে বোঝার চেস্টা করতাম। হয়তো কিছু বুঝতাম নয়তো নয়, শুধু অনুভব করতাম কাউকে দেয়া শাপ-শাপান্ত। মা'কে প্রশ্ন করতাম কেন রানু পাগল সবাইকে শাপ-শাপান্ত করে?
মায়ের ছিল খুব গল্পের বই পড়ার ঝোঁক আর প্রিয় লেখক ছিলেন জরাসন্ধ। লেখকের প্রতিটি বই মা'কে অসংখ্যবার পড়তে দেখেছি। রবিবার দুপুরে যখন স্কুল থাকতো না তখন মায়ের মাথার কাছে বসে জরাসন্ধর গল্পগুলো শুনতাম অনেকবার। জরাসন্ধ ছিলেন একজন জেইলার। জেলখাটা সে কয়েদীদের জীবনের সত্যিকারের গল্পই ছিল সেগুলো। গল্পের সংসারের সে কুটচালীতে বউদের পরাজয় দেখে খুব মন খারাপ হতো। মা'কে প্রশ্ন করতাম, মা, মেয়েরা কি শুধু জীবনভর হেরেই যাবে? মা, হেসে বলতেন, হারবে না তখনই যখন তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারবে।
বরফ সাদা রাস্তার মাঝে কিংবা হলুদ সে ম্যাপলের পাতার মাঝে হাটতে হাটতে কত কিছু মনে পড়ে। মায়ের কাছে ছিল কত প্রশ্ন, কত জিজ্ঞাসা.... কিছুই যে জানা হলো না, বেলা যে গড়িয়ে যায় নিজেরই অজান্তে!
-
-
-
-
ছবি বৃত্তান্ত: কানাডার ফল সিজন আমার খুব প্রিয়। যখনই সুযোগ পাই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ি। কিছু ছবি শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:০৪