সুপার হিউমেন ম্যাগনাস
মাত্রই কাজাকিস্তানে শেষ হলো বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন শিরোপার লড়াই। দীর্ঘ ১০ বছরের চ্যাম্পিয়ন নওরোজিয়ান Magnus Carlsen "বহুত হইছে আর না" এই বলে নিজেকে সরিয়ে নেয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লড়াই থেকে। এ ভদ্রলোককে নিয়ে লিখার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে। কারন, এ ম্যাগনাস ভদ্রলোক মানুষ না, সুপার হিউম্যান। সুপার হিউম্যান ম্যাগনাস এর প্রতিভা শুরু হয় ২ বছর বয়সে ৫০০ পিসের পাজেল সলভ্ এর মাধ্যমে। প্রথমে দাবায় আগ্রহ না থাকলেও তিন বোনের মাঝে বড় হওয়া বোনদেরকে হারাতে দাবায় আগ্রহী হোন আর এর পরই তৈরী হয় ইতিহাস। সে ইতিহাসের রেকর্ড কবে ভাঙ্গবে জানা নেই।
যা বলছিলাম, এপ্রিল ৯ থেকে ৩০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন শিরোপার এ প্রতিযোগিতায় সুপার হিউম্যান ম্যাগনাস অংশ না নেয়াতে রাশিয়ার Ian Nepomniachtchi অংশ নেন। যদিও নিষেধাজ্ঞার কারনে রাশিয়া নয় FIDE flag নিয়ে খেলেছেন। (FIDE flag মানে International Chess Federation or World Chess Federation এর পক্ষ থেকে খেলা। অর্থ্যাৎ যে সব প্রতিযোগী নিজস্ব দেশের পতাকা নিয়ে খেলতে পারে না তারা FIDE flag নিয়ে খেলায় অংশ নেয়। ই্উক্রেনের ইস্যুতে রাশিয়ার অংশগ্রহন নিষেধাজ্ঞার কারনে Ian Nepomniachtchi FIDE flag নিয়ে খেলায় অংশগ্রহন করেন।) এবং অপর পক্ষ ছিল চীনের Ding Liren। মোট ১৪ টি খেলা ৭-৭ এ ড্র হওয়াতে রেপিড টাইম ফর্মেটে টাইবেকারে ডিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। যদিও টাইবেকারের প্রথম তিনটি খেলা ড্র হয় কিন্তু ৪র্থ খেলায় ডিং জিতে যায়। অতপর: দীর্ঘ ১০ বছরের চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস এর পর নতুন চ্যাম্পিয়ন হোন ডিং।
একসময় সারা বিশ্বের সাথে আমাদের দেশেও দাবা খুব জনপ্রিয় খেলা ছিল। রাতের পর রাত জেগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেলা দেখতাম আমরা। কার কোন রেটিং বা কে নতুন গ্রান্ড মাস্টার হচ্ছে সেটা ছিল আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয়। কিন্তু দাবা তার জৈালুস হারাচ্ছে দিনে দিনে। শুধু মনে হয় আমাদের দেশই না সারা বিশ্বেই একই অবস্থা। ক্রিকেট, ফুটবল বা টেনিসের চাকচিক্যে স্লো গেইম দাবা এখন আর তেমন আকর্ষন করে না তরুনদের। তার উপর ঝলমলে ভিডিও গেমের নেশায় পড়ে থাকা তরুনরা এখন আর দাবা নিয়ে আগ্রহ দেখায় না।
নিয়াজ মোর্শেদ, রানী হামিদ, জিয়া, এনামুল হোসেন সহ অনেকেই ছিলেন নামকরা তখন। এখন যে কে তা ও ঠিক জানি না। স্কুল, জেলা বা জাতীয় পর্যায়ে অনেক খেলা হতো তখন। ঘরে ঘরে দাবা ছিল জনপ্রিয়। ছেলে বুড়ো সবাই বসে পড়তো দাবা নিয়ে। আগের দিনের বেশীরভাগ ছবিতে গুরু গম্ভীর এমন কোন চরিত্র দেখাতে হলে তাঁকে দাবা খেলতে দেখা যেত। প্রতিদিনেই খবরের কাগজে কোন না কোন দাবা খেলার খবর থাকতো। আর আমরা ছোটরা সবসময় খবরের কাগজ থেকে খবর ও খেলোয়ারদের ছবি কেটে কেটে ডায়রীতে জমা করতাম। বিশেষকরে ছুটির দিনের রঙ্গীন ছবিগুলো ছিল আমাদের কাছে প্রধান আকর্ষন।
যাহোক, সবার মতো আমাদের বাসায়ও দাবা ছিল সবারই প্রিয় খেলা। আমরা কম বেশী খেলতে পারতাম দাবা, ছোট বড় সবাই। তবে আমাদের বাসার সব খেলোয়ারদের মাঝে ছিল বিশাল শ্রেণী বিভাজন । সিডিউলড কাস্ট বা নিম্নশ্রেনী হলো আমরা যারা কম দাবা খেলা পারতাম অর্থ্যাৎ আমার মতো গুড়া বাচ্চারা যারা গুটি চিনতাম ও কোন রকমে গুটি আগায়ে খেলতে পারতাম কিন্তু দু-তিনটা প্যাঁচে আটকা পড়ে যেতাম বড়দের কাছে। আমাদের পরের ছিল ক্ষৈত্রীয় গ্রুপ, মানে যারা মোটামুটি খেলতে পারতো। মাঝারি মানের লড়াই হতো তাদের মাঝে ও মাঝে মাঝে ড্র হতো বড় গ্রুপের সাথে। আর সর্বশেষ ছিল ব্রাম্মণ গ্রুপ, যারা খুব ভালো খেলতো। তাদেরকে হারানো আমাদের জন্য বেশ কঠিন ছিল।
তো এ গুড়া বাচ্চাদলে আমি সহ কিছু কাজিন ছিলাম । মাঝারি গ্রুপে মেঝ বোন, ছোট ভাই ও ছোট কাকা ছিল। আর ব্রাম্মণ গ্রুপে ছিল আব্বু, বড় কাকা, সেজ কাকা।
আমাদের খেলার নিয়ম ছিল, সিডিউলড কাস্টরা নিজেদের মাঝে আগে খেলবে। এর মাঝে যে জিতবে সে মাঝারি মানে ক্ষৈত্রীয় গ্রুপে খেলবে। এবং তার মাঝে বিজয়ী ব্যাক্তিই একমাত্র ব্রাম্মণ গ্রুপে খেলার সুযোগ পাবে। আমরা সরাসরি ব্রাম্মণ গ্রুপে খেলার সুযোগ পেতাম না। তবে ব্রাম্মণ গ্রুপে খেলার ও ভাগ ছিল। সবার প্রথমে কাকাদের সাথে খেলবে, সেখান থেকে জিতে সর্বশেষে আব্বুর সাথে খেলবে। আমি এ জনমে সিডিউলড কাস্ট থেকে উপরে আর উঠতে পারি নাই। কিন্তু আমার মেঝ বোন বা ছোট ভাই ঠিকই আব্বুর সাথে খেলার চান্স পেয়েছিল। দু একবার মনে হয় জিতেও ছিল।
আমার ছেলের খুব ছোট থাকতেই তার সাথে আমি দাবা খেলা শুরু করেছিলাম। গত বছর পর্যন্ত আমার ছেলে বা মেয়ে আমার সাথে একটা ম্যাচেও জিতে নাই। আমি খেলি ডিফেন্সিফ, ধৈর্য্য নিয়ে। কিন্তু সে ধৈর্য্য আমার ছেলে-মেয়ের তেমন একটা নাই। হঠাৎ ই কয়েক মাস থেকে দেখি আমার ছেলে/মেয়ে রাত দিন দাবার বই, দাবার চ্যানেল নিয়ে পড়ে থাকে কিন্তু আমার সাথে বললেও খেলে না। তার বেশ কিছুদিন পর ছেলে বললো আসো তোমার সাথে খেলি, এবং খেললাম ও প্রথম বারের মতো তার কাছে হারলাম। আমি অবাক হয়ে আবার খেললাম এবং আবারো হারলাম।........... তারপর থেকে এ পর্যন্ত আর জিতি নাই ছেলের কাছে। ছেলে খেলে ট্যাকনিকেল খেলা, অনেকটা ইন্টারন্যাশানাল ম্যাচগুলো ফলো করে। আর মেয়ের সাথে তীব্র লড়াই এর পর জিতেছি কিন্তু কিছুদিন পর মনে হয় না জিততে পারবো......। তবে এ হারে আমার খুব আনন্দ হয় কারন তারা ভিডিও গেইম নিয়ে বসে পড়ে থাকে না, সময় পেলে দাবার বোর্ড নিয়ে বসে পড়ে ভাই-বোন।
যাহোক, যেমনই খেলি না কেন আমার সংগ্রহে বেশ কয়েকটা দাবার বোর্ড আছে। চোখে পড়লেই আমি কিনে ফেলি। এবং একটা হোসেরিয়ার হাতের তৈরী কাঠের দাবা বোর্ড আছে। ছেলেকে গিফট্ করেছিলাম।
আজ এতটুকুই দাবা নিয়ে, অবিষ্যতে আসবো নতুন কোন বিষয় নিয়ে নিশ্চয়।
সোহানী
মে ২০২৩
আমার সামান্য সংগ্রহ
প্রথম দু'টি ছবি গুগল মামা , আমার তোলা না নিশ্চিত
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৩ সকাল ৭:৪৭