দেখলাম মাত্রই মুক্তিপ্রাপ্ত Mrs Chatterjee vs Norway, সত্য ঘটনা অবলম্বনে ভারতীয় দৃষ্টিকোন থেকে নির্মিত মুভিটি। অনলাইন জুড়ে ছবির এতো এতো আলোচনা দেখে আগ্রহী হলাম ছবিটি দেখতে। এবং যথারীতি রিভিউ নিয়ে হাজির হলাম সম্পূর্ন আমার দৃষ্টিকোণ থেকে।
যাহোক আসল কথায় আসি.......আমি কানাডার জীবন-যাত্রা নিয়ে প্রতিটি লিখায় বলে থাকি, এখানে প্রথম এবং প্রধান প্রায়োরিটি হচ্ছে শিশুরা। শিশুদেরকে নিয়ে কখনই কোন কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করা হয় না পশ্চিমা বিশ্বে। প্রতিদিন স্কুলে ক্লাসটিচার প্রতিটা বাচ্চার খোঁজ নেয় কারো কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। যদি কোন বাচ্চা সামান্যতমও কম্লেইন করে সাথে সাথে স্যোশাল থেকে বাচ্চাদেরকে মনিটর করা হয় ও বিশেষ ক্ষেত্রে তাদেরকে স্যোশাল কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমাদের এশিয়ান বাবা-মায়েরা এ জিনিস কোনভাবেই বুঝবে না। আর যদি পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে বাস করেন তাহলেতো তা আরো বোঝার কথা না। আমরা এশিয়ান বাবা-মায়েরা ভাবি, আমার বাচ্চা আমি পেটে ধরেছি, আমি তাকে মারি ধরি সেটা আমার ব্যাপার। আমি মা-বাবা, আমার চেয়ে বাচ্চার ভালো আর কে চাইবে! প্রয়োজনে মাইর দিবো আবার আদর করবো, তাতে তোমার কি!!
কিন্তু অতি দুক্ষের সাথে জানাচ্ছি আপনাদের এ ধারনা পুরোপুরি ভুল পশ্চিমা বিশ্বে। এখানে বলা হয় বাচ্চারা রাস্ট্রের সম্পত্তি। আমরা মা-বাবা হতে পারি কিন্তু শিশুদেরকে সর্ব্বোচ্চ ভালো দেখার দায়িত্ব রাস্ট্রের, আপনার আমার নয়। ওদেরকে বড় করার জন্য রাস্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আপনি আছেন থাকবেন কিন্তু রাস্ট্র যদি মনে করে আপনার দ্বারা বাচ্চার ক্ষতি হবে তাহলে আপনাকে তার আশেপাশে ভিড়তেই দেয়া হবে না। আমাদের এশিয়ান চিন্তা-ভাবনা পশ্চিমা বিশ্বে কোনভা্ই কাজ করবে না। কিন্তু Mrs Chatterjee vs Norway সিনেমাটিতে যেভাবে নরওয়েকে ভিলেন বানিয়েছে, চোর বাটপার শিশু পাচারকারী ঘুষখোর হিসেবে দেখানো হয়েছে তা রীতিমত হাস্যকর। ভারতীয় সেন্টিমেন্ট দিয়ে মুভিটি তৈরী করা হয়েছে যার অধিকাংশই মিথ্যা ও বানোয়াট।
মুভিতে চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের কর্মীদেরকে রীতিমত ভিলেন বানিয়েছে, বাচ্চাদেরকে গাড়িতে তুলে কিডনাপ স্টাইলে নিয়ে গেছে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাচ্চাদেরকে স্যোশাল কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা আছে। পুলিশ আসে, নার্স আসে, অনেক কিছুর ব্যবস্থার পরই বাচ্চাদেরকে নেয়া হয়। হুট করে দুই স্যোশাল কর্মী এসে মায়ের কাছ থেকে চুরি করে, মাকে গাড়ির ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে বাচ্চা অন্তত নেয় না। এরকম কিছু করলে ওয়েলফেয়ারের কর্মী নয় ওরা কিডনাপার, ওদেরকে পুলিশে দেয়াই নিয়ম। সাধারন দর্শকদের সেন্টিমেন্ট বাড়াতে এমন হাস্যকর ও অদ্ভুত দৃশ্য মনে হয় এড করেছে এ ছবিতে।
এখানে নরওয়ের চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের দোষটা কি কেউ বলবে? তারা হাজার টাকা মাইনে দিয়ে কর্মী নিয়োগ দিয়েছে বাচ্চাদের সঠিক পরিচর্যা হচ্ছে কিনা তা দেখতে। বাবা-মায়ের অনুরোধে চাচার কাস্টডিতে দেয়া হয়, মাসে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা লালন পালনের জন্য দেয়া হয়। তারপরও ভিলেন বানানো হলো নরওয়েকে।
আমি যখন দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে ইমিগ্রেন্ট করেছি, তার মানে সেখানের নিয়মকানুন আমি পালন করবো সেটাই ধরা হয়। এখন যদি আমি গোয়ারের মতো বলি, বিদেশে আছিতো কি হইছে আমি আমার ইন্ডিয়ান স্টাইলে বাচ্চা পালবো। নরওয়ের আইন কানুনের ক্ষ্যাতা পুড়ি....... তাহলে আপনার জন্য একটাই পথ খোলা তাহলো ইন্ডিয়ায় ফিরে যান। আমি বাস করবো নরওয়েতে আর গোমূত্র থুক্কু হোমিওপ্যাথ দিয়ে রোগ-বালাই দূর করবো, ঘরটা বানায়ে রাখবো গরুর গোয়াল, স্বামী দেশীয় স্টাইলে সকাল বিকাল বউ পিটাবে বাচ্চাদের সামনে, হাত না ধুয়ে হাত দিয়ে কঁচলায়ে কঁচলায়ে কলা দুধ ভাত খাওয়াবো বাচ্চাদেরকে, বাচ্চার হোম ওয়ার্ক ঠিকমতো জমা দিবো না .......... সিম্পল একটা ফাজলামো। এরকম একটা অসুস্থ পরিবেশে বাচ্চাদেরকে নিয়ে যাবে নাতো কি করবে?? পুরো ছবিতে এই মা'কে অসুস্থই মনে হয়েছে। হাঁ, বাচ্চার জন্য মায়েরা জীবন দেয় কিন্তু যে স্টাইলে এ মা বাচ্চা পালছে তা হাস্যকর। তার জন্য নরওয়ে না, ইন্ডিয়ার গ্রামই উপযুক্ত। এতো বছর নরওয়ে বাস করে না শিখেছে ভাষা, না শিখেছে সেখানকার আইন কানন, না শিখেছে বাচ্চা পালার নিয়ম-কানুন।
একটা সত্য ঘটনা শেয়ার করি, তাহলে পাঠক রিলেট করতে পারবেন মুভির কাহিনীর সাথে। আমার একজন ইন্ডিয়ান প্রতিবেশী ছিল। তাদের ৫ বছরের একটা মেয়ে ছিল। তো ভদ্রলোক দেশীয় স্টাইলে বউকে মাঝে মাঝে হালকা পাতলা পিটাতো। একদিন মনে হয় কোন কারনে বাচ্চাকেও মেরেছিল। পরেরদিন স্কুলে মেয়ের গালে কালো সিটে দেখে টিচার তাকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করে। এবং বাবার মধুর ব্যবহার জানতে পারে। এবং ঘটনাক্রমে ওই টিচারও ছিল ইন্ডিয়ান। তাই সে ভালোভাবেই এশিয়ান স্বামীদের বিহেব জানে। আর তখনই সে টিচার কল দেয় স্যােশালকর্মীদের। তারপর থেকে স্যােশালকর্মীরা সকাল বিকাল সে বাসায় মনিটরিং শুরু করে। বাবা-মাকে সাইকোলজিকেল ট্রিটমেন্ট থুক্কু কাউন্সিলিং শুরু করে, প্রতিটি দিন স্কুলে একবার করে মেয়েটির সাথে দেখা করে। এভাবে মাসের পর মাস মনিটরিং এর পর তারা একেবারে সোজা। স্বামী-স্ত্রীতে বহুৎ মিল মহব্বত সহকারে বাচ্চাকে বড় করছে এখন।
আর এ মুভিতে, মাসের পর মাস মনিটরিং এর পর ও সে দম্পতি ঠিক হয়নি। (অ)ভদ্রলোক সুযোগ পেলেই বউএর উপর চড়া্ও হয়, সামান্যতমও কাজে সাহায্য করে না, কঁচলায়ে কলা দুধ ভাত খাওয়াও বন্ধ করেনি, ঘরদোরও কোন পরিস্কার করেনি..............। যাদের সামান্যতমও পরিবর্তন হয়নি, এরকম পরিবেশ ইন্ডিয়াতে ঠিক আছে কিন্তু নরওয়েতে কোনভাবেই উপযুক্ত নয়।
এ মুভিটি তৈরীই করা হয়েছে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, ছবির কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে সম্পূর্ন একপাক্ষিকভাবে। অর্থ্যাৎ ভারতীয় মায়ের দৃষ্টিতে কাহিনীটি লিখা হয়েছে। সেখানে অন্য কোন দিক বিবেচনায় আনা হয়নি। তাই পুরো মুভিতে নরওয়েকে পুরোপুরি ভিলেন বানিয়েছে।
তবে একজন এশিয়ান মা কেমন হতে পারে তা কিন্তু খুব ভালোভাবে এ চবিতে দেখানো হয়েছে। একজন মা যে সন্তানের জন্য সবকিছু করতে পারে, সন্তানকে পাবার জন্য সাধারন বিবেক বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলে, সন্তানকে ফিরে পেতে সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে তা এক কথায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলছে। রানী মুখার্জিও চমৎকারভাবে অভিনয় করেছে মায়ের ভূমিকা।
আর আরেকটি খুব গুড়ুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে এ মুভিতে। এই যে আমাগো এশিয়ান মহামূল্যবান স্বামীরা মনে করে, তুমারে যে বৈদেশ আনছি, চাকরী কইরা খাওয়াতাছি এইটাইতো বিশাল একখান কাজ। এর বাইরে ঘরের কাজ আবার কি?? ওইটাতো মাইয়ালোকের কাম। ঘরের বউ বাচ্চা পালবে, স্বামী সেবা করবে, আর স্বামীধন সকাল বিকাল বউ পিটাবে............। এইটাই হইলো গিয়া সত্য আর সব মিথ্যা।
সবাই ভালো থাকুন আর আমাগো এশিয়ান ভাইজানগো জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ুক এই প্রত্যাশায়।
সোহানী
মে ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২৩ সকাল ৮:৫২