২৭ বছরের রনধীর সিং থাকে ভারতের পান্জাবে। কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবার সামান্য কিছু জমিজমা আছে আর রনধীর ছোটখাট একটা চাকরী করে দিন চালায়। আর সব সাধারন পান্জাবীদের মতো তারও স্বপ্ন কানাডায় যাবার। সেভাবেই যোগাযোগ করে লোকাল এজেন্টের সাথে। এজেন্টেই বুদ্ধি দেয় স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে কানাডায় যাওয়াই সবচেয়ে সহজ পথ কোন ঝামেলা ছাড়া। ছয়মাসের সেমিস্টার ফি দিয়ে ভর্তি হতে হবে, তারপর তিনবছর পড়বে সাথে ফুলটাইম কাজ করবে। টিউশনি, থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড় করেও দেশে দুই হাতে টাকা পাঠাতে পারবে। তিনবছর পরই কানাডার নাগরিত্ব।
রনধীর ঝাঁপিয়ে পড়ে এজেন্টের কথায়। বাবার সামান্য জমির কিছু বন্ধক রেখে কিছু বিক্রি করে এজেন্টের কাছে দেয় সব টাকা। এজেন্ট অফার লেটার নিয়ে আসে কানাডার নামকরা সরকারী কলেজ থেকে। সেভাবেই এক সময় কানাডায় পৈাছে রনধীর। পৈাছানোর পর এজেন্ট তাকে ফোন দেয় যে অফার লেটার এ একটু ঝামেলা হয়েছে সে যেন অন্য কোন কলেজে এডমিশন নেয়। রনধীর নতুন কানাডায়, পৃথিবীর এ প্রান্তের খবর কিছুই জানে না। যে টাকা টিউশন ফি দিয়েছিল তার কি হলো, কেন অফার লেটার এর ঝামেলা হলো তার কোন ব্যাখ্যা নেই। আর এ প্রান্ত থেকে সে এজেন্টের সাথে মারামারির কোন সুযোগ নেই। বাবার কাছে টাকা চাওয়ার মতো অবস্থা নেই তার। তাই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় বাস্তবতায়।
পরিচিত-অপরিচিত এর সহায়তায় প্রাইভেট একটা কলেজে ভর্তি দেখিয়ে ভিসা এক্সটেন করে। বিদেশী ছাত্র হিসেবে সাপ্তাহে ২০ ঘন্টার কাজের পারমিশন থাকলেও ক্যাশে দিন-রাত মিলে তিনটা কাজে যোগ দেয় প্রায় ১৮-২০ ঘন্টা। এতো এতো পরিশ্রম করেও ঠিকভাবে পড়ার খরচ জোগাড় করা হয়ে উঠে না। কারন কানাডার বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন লোকালদের তিনগুন প্রায়। পড়াশোনা করা মানে শুধু পাস মার্ক তোলা। এতো পরিশ্রমের পর ক্লাসে বসে ঘুমানো ছাড়া কোনই উপায় নেই তার। আর থাকা-খাওয়া মিলে কঠিন অবস্থা। থাকে দশজন মিলে একরুমের বেইজমেন্টে আর খায় গুরুদুয়ারার ফ্রি খাওয়া, রুটি আর ডাল। কবে ঠিক করে পেট পুরে খেয়েছে তা সে বলতে পারবে না। তারপরও টিউশনের টাকা জোগাড় হয় না প্রায়, ধার দেনা করতে হয় এখান সেখান থেকে।
এভাবে পাঁচ বছর কঠিন পরিশ্রম করে এক সময় কানাডার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এর এ্যাপ্লিকেশান করে। আর তারপরই দু:সংবাদটা আসে তার কাছে, যে অফার লেটার নিয়ে সে কানাডা আসে তা ভুয়া। তাই সে কানাডার জন্য অবৈধ। এবং তাকে ডিপোর্ট করা হবে কয়েক মাসের মধ্যে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রনধীর এর। আস্তে আস্তে জানতে পারে সে এজেন্ট প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭০০ ছাত্র-ছাত্রীকে কানাডায় এনেছে ভুয়া অফার লেটার দিয়ে। এবং সবচেয়ে চালাকিটা করেছে এজেন্ট কোন কাগজপত্রে সই করেনি বা তার প্রতিষ্ঠান এর নাম উল্লেখ করেনি। যার কারনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এর সুযোগ রাখেনি বা প্রমান রাখেনি।
যাহোক, রনধীর ও বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের ডিপোর্ট এর কেইস বর্তমানে আদালতে বিচারিধীন আছে। যদিও এখন পর্যন্ত তাদেরকে ডিপোর্ট এর সিদ্ধান্তই বহাল আছে। ভুয়া কাগজ নিয়ে কানাডায় আসলে কখনই সে কানাডায় কখনই ঢুঁকতে পারবে না। যতটুকু জেনেছি এসব ভুক্তভোগীদের জন্য আদালত কিছুটা নমনীয় ছিল তাই ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এতোগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এতো বছরের কঠিন পরিশ্রম, এতো টাকা পয়সা সব এখন পানিতে।
এ ঘটনা সবার জন্য একটা শিক্ষা। যারা কানাডায় স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসতে চান তাদের কাছে অনুরোধ নীচের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখার জন্য;
১) কথা হলো আপনি যদি শিক্ষিত হোন, ইংরেজী জানেন বুঝেন, ই-মেইল লিখতে জানেন তাহলে কোন দালাল বা এজেন্টের কোনই দরকার নেই। আপনি নিজেই সব কিছু করার ক্ষমতা রাখেন। কানাডার ইমিগ্রেশান ওয়েবসাইটে সবকিছু স্পষ্ট লিখা আছে। ধৈর্য্য নিয়ে ফলো করলেই হলো।
২) কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সংক্রান্ত সব বিষয় নিজেই করবেন। এখানে সামান্য কিছু ই-মেইল চালাচালি ছাড়া বাড়তি কিছু করার নেই। দালালের উপর ডিপেন্ড করার কোন প্রয়োজনই নেই।
৩) কখনই টাকা পয়সা থার্ড পার্টি দিয়ে লেনদেন করবেন না। নিজে সরাসরি করবেন। কানাডার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টে জমা দিবেন। এবং অফার লেটার পাওয়ার পরেই আপনি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নিজের এ্যাকাউন্ট ওপেন করবেন। সে এ্যাকাউন্ট থেকেই দেখতে পাবেন আপনার টাকা জমা হয়েছে কিনা বা কত টাকা জমা দিতে হবে। পুরো হিসেবটাই পাবেন।
৪) কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাপ্লাই করলেই তা যদি এ্যাক্সেপ্ট হয় তাহলে একটা স্টুডেন্ট নাম্বার ইস্যু করা হয়। এটা খুবই গুড়ুত্বপূর্ণ কারন এ স্টুডেন্ট নাম্বার নিয়ে আপনি নিজেই যাচাই করতে পারবেন এডমিশন পেপারটি আসল নাকি নকল। এবং একজন ব্যাক্তির নামে একটিই স্টুডেন্ট নাম্বার ইস্যু করা হয়, যতবারেই ভর্তি হোন বা সাবজেক্ট চেইন্জ করেন না কেন নাম্বার একই থাকবে।
এবার কিছু কানাডার স্টুডেন্ট ভিসার বাস্তবতার কথা বলি:
আপনি যদি ভাবেন কানাডায় স্টুডেন্ট ভিসার ঢুকলেই সবাই আপনাকে জামাই আদরে চাকরী ধরায়ে দিবে। তারপর দুই হাতে টাকা কামাবেন আর টিউশন ফি সহ সকল খরচ মিটাবেন তাহলে আপনি স্বপ্নের জগতে বাস করছেন;
প্রথম বাস্তবতা: স্টুডেন্ট ভিসায় সাপ্তাহে ২০ ঘন্টার বেশী কাজ করতে পারবেন না। ধরুন মিনিমাম ১৫ ডলারই বেতন পেলেন, তাহলে মাসে আয় ১২০০ ডলার। এ মূহুর্তে বাড়িভাড়া আগুন। বেজমেন্টে কয়েকজন মিলে থাকলেও ৫০০ এর নীচের পারবেন না। আর খাওয়া বা অন্যান্য খরচ আরো ৫০০-৬০০। হাতে থাকলো ১০০ বা অনেক কৃপণতা করে চললেও ৩০০ ডলার সেইভ করে কিভাবে টিউশন ফি জোগাড় করবেন? অসম্ভব!!!
আর ভাবেন যদি ক্যাশে কাজ করবেন যা সাধারনত অনেক স্টুডেন্টরা করে থাকে, তা যে কতো কঠিন ব্যাপার বলে বোঝানো যাবে না। টাকা দেয় অর্ধেক, কাজ করায় দ্বিগুন। অনেক সময় ঠিকভাবে টাকাও দেয় না, সে মূূহুর্তে স্টুডেন্টগুলোর কিছু করার থাকে না। কারন সে অবৈধভাবে ক্যাশে কাজ করছে, পুলিশও কল দিতে পারবে না। এমন ঘটনা অনেক শুনেছি এখানে, সব জায়গায়ই বাটপার আছে।
দ্বিতীয় বাস্তবতা: কানাডার জব মার্কেট ভয়াবহ। এখানে একটা চাকরী জোগাড় করা কঠিনতম একটা কাজ। বৈধ কাজ জোগাড় করতেই লোকজনের ঘাম ছুটে যায় সেখানে অবৈধ কাজ জোগাড় করা কেমন কঠিন হবে তা অনুমেয়। এ বাস্তবতাটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
তৃতীয় বাস্তবতা: কেউ যদি মনে করে আমার আত্বীয় স্বজন আছে ওদের উপর ডিপেন্ড করা যাবে তাহলে আবার একটু ভেবে দেখবেন সন্তানকে পাঠানোর আগে। এখানের বাস্তবতা হচ্ছে এটা বাংলাদেশ না, বাসায় তৃতীয় ব্যাক্তিকে আশ্রয় দেয়া অনেক কঠিন। এখানকার খরচ অনেক, দু'জন চাকরী করে মোটামুটি চলে যায়। তৃতীয় ব্যাক্তির খরচ বহন কঠিন।
যাহোক ভয় দিচ্ছি না আপনাদের, শুধু সাবধান করছি মাত্র।
সবাই ভালো থাকেন এ গরমে দেশে কিংবা কানাডায়।
সোহানী
জুন ২০২৩
খবরের লিংক শেয়ার করলাম:
News Link