ব্লগ বা অনলাইনে পেঁয়াজ নিয়ে একের পর লিখা আসছে যে অন্য কোন টপিক্স নিয়ে লিখতে ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু ক'দিন ধরেই কিছু সত্য গল্প মাথায় ঘুরঘুর করছে। না লিখা পর্যন্ত কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। লেখক হবার যন্ত্রনা আর কি, বাধ্য হয়েই লিখলাম। লিখাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে তাই আপাতত: অর্ধেক আনলাম ও পরের পর্বে বাকিটুকু আনবো।
প্রথম গল্প:
নাজিয়া হাসান: একজন দু:খী গায়িকার গল্প
আশির দশকের জনপ্রিয় ডিসকো দিওয়ানী গান শোনেননি এমন মানুষ কম আছে। সবার মুখে মুখে ফিরতো এ গান। পাকিস্তানের জনপ্রিয় পপ সঙ্গীত শিল্পী নাজিয়া হাসান এমন কিছু গান গেয়ে রাতারাতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে। তাঁকে এ উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পপসম্রাজ্ঞী বলা হয়। শুধু উপমহাদেশেরই নয়, আরো অনেকে দেশই জনপ্রিয় ছিল এ গায়িকা।
স্মার্ট সুদর্শন জনপ্রিয় এ গায়িকার বেড়ে উঠা লন্ডনে। বিজনেস ইকোনমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন সেখানে। পাকিস্তান বা এ উপমহাদেশের প্রথা অনুযায়ি বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের বৈবাহিক এ জীবন ছিল নরকের। মাত্র ৩৫ বছরেই যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত তখনই তাঁর সংসার জীবনের নিষ্ঠুরতার কথা প্রকাশ্যে আসে। শারীরিক অত্যাচার, বিষ খাইয়ে মারা চেষ্টা থেকে হেন কিছু বাদ রাখেনি এ ভদ্র(!!)লোক। গানের জগত থেকে আগেই সরিয়ে নিয়েছিল নাজিয়াকে। শুধু তাই নয় সুন্দরী বউ নাজিয়াকে ঘরে রেখে আরেক উঠতি নায়িকার সাথে সম্পর্কের কথা তখন ছিল লোক মুখে। এ লোক সেখানেই ক্ষান্ত হয়নি, নাজিয়ার ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট করতেও অস্বীকার করে। যার কারনে নাজিয়া লন্ডনে মায়ের কাছে ফিরে আসে চিকিৎসার জন্য। আরো বাকি আছে এ ভদ্র(!!)লোকের কীর্তি, চিকিৎসা চলাকালীই নাজিয়াকে ডিভোর্স দেয়। তার এক মাস পরেই ২০০০ সালে মারা যায় নাজিয়া। আরো জানা যায় যে, নাজিয়াকে বিয়ের আগেই আরো দু'টো বিয়ে করেছিল সে। এবং দুই বিয়ের কথা গোপন করেই নাজিয়াকে বিয়ে করে।
এত কিছু পরেও নাজিয়া কেন এ সংসার টিকিয়ে রেখেছিল? কেন নাজিয়াকে এ করুণ পরিনতি ভোগ করতে হলো?
কারন, আমাদের এ উপমহাদেশের মেয়েগুলো কিভা্বে ভালো থাকতে হয় জানে না। তাদের পরিবারও জানে না কিভাবে তাদেরকে ভালো রাখতে হয়।
দ্বিতীয় গল্প:
অন্নপূর্ণা দেবী: একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীস্বত্ত্বার মৃত্যু
আপনারা কি অন্নপূর্ণা দেবীর নাম শুনেছেন? খুব সামান্য তাই না? আচ্ছা রবি শংকরকে নিশ্চয় এক নামেই চিনেন?
অন্নপূর্ণা দেবী হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর ছোট মেয়ে। সঙ্গীত চর্চার কারনে বড় মেয়ের বৈবাহিক জীবনে নেমে আসা দূর্যোগের কারনে তিনি পণ করেছিলেন ছোট মেয়ে রোসনারা খানকে এ জগতে আনবেন না। শুধুমাত্র ছেলেকে শেখাতেন। এমনই এক বিকেলে মেয়ে রোসনারা বাইরের উঠোনে খেলছিল। ভাই এর রেওয়াজের মাঝে রোসনারা দৈাড়ে এসে ভুল ধরিয়ে দিয়ে আবার খেলতে চলে যায়। তা দেখে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ অবাক হলেন। কারন শুধুমাত্র শুনে সে ভাইয়ের ভুলটা ঠিক ধরে ফেলে। মেয়ের প্রতিভায় দেখে মুগ্ধ হয়ে একজন প্রকৃত শিক্ষক পারলেন না এমন প্রতিভাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তাই ছেটো মেয়ে শেখানো শুরু করলেন। বলা হয়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন এর পরে একমাত্র অন্নপূর্ণা দেবীই তাঁর অভাব পূরন করতে পারবে। একাধারে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র অবলীলায় বাজাতে পারতেন তিনি। বলা হয় তাঁর সুর কেউ শুনতে শুরু করলে সেখান থেকে সরে যাওয়া কঠিন হতো।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বড় মেয়ের মত একই দূর্যোগ যাতে ছোট মেয়ের জীবনে না আসে তাই তাঁর ছাত্র রবি শংকর যখন বিয়ের প্রস্তাবে দিলেন তখন আর না করেননি তিনি। হয়তো ভেবেছেন, ছাত্র হিসেবে কিংবা সঙ্গীত জগতের মানুষ হিসেবে রবি শংকর মেয়ের জীবনে সুখ নিয়ে আসবে। আর সঙ্গীতচর্চাটাও চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু উনি বুঝতে পারেননি ঠিক একই দূর্যোগ তাঁর প্রিয় কন্যার জীবনেও নেমে আসবে। রবি শংকরকে বিয়ের পরই রোসনারা খান নাম থেকে অন্নপূর্ণা দেবী নাম গ্রহন করেন তিনি।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম রবি শংকর ও অন্নপূর্ণা দু'জনে মিলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসাথে অংশ নিতে শুরু করেন। কিন্তু দেখা যায় সবাই অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতই বেশী পছন্দ করছে। অসম্ভব প্রতিভাধর অন্নপূর্ণা দেবীর নাম ডাক ছড়িয়ে পরে সবখানে। একের পর এক অনুষ্ঠানের ডাক শুধু অন্নপূর্ণা দেবীর জন্যই আসে। যেকোন অনুষ্ঠানে দেবী গাইবার পর আর কেউ রবি শংকরের জন্য অপেক্ষা করে না। আর এতেই আস্তে আস্তে দেবীর জীবনে দূর্যোগ নেমে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে দেবীকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাঁধা দিতে শুরু করে স্বামী রবি শংকর। কিন্তু তাতেও থেকে থাকেনি, স্ত্রীকে প্রতিজ্ঞা করায় যে তার সাথে সংসার করতে হলে আর কখনই সে জনসম্মুখে গাইতে পারবে না। এমনও শোনা যায় রবি শংকর অন্নপূর্ণা দেবীর আঙ্গুল কেটে নেয় যাতে কোন ইন্সট্রুমেন্ট বাঁজাতে না পারে (সত্যটা জানা নেই)। তবে অন্নপূর্ণা দেবী জীবনে এ প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গেননি, কখনই আর জনসম্মুখে গান গাননি।
১৯৭০ সালে জর্জ হ্যারিসন ভারতে আসেন শুধুমাত্র অন্নপূর্ণা দেবীর মিউজিক শুনতে কিন্তু দেবী তাঁর অনুরোধও রাখেননি। এমতবস্থায়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী দেবীকে অনুরোধ করেন। যার কারনে দেবী জর্জ হ্যারিসনকে গান শোনান কিন্তু শর্ত রাখেন যে উনি যখন রেওয়াজ করবেন তখনই শুধু হ্যারিসন সেখানে থাকতে পারবে। তবে তাঁর গানের কোন রেকর্ড করতে পারবে না। আজ তাই কোন রেকর্ডই নেই অন্নপূর্ণা দেবীর অসাধারন মিউজিকের।
তো সবাই তার পরের গল্পটা নিশ্চয় জানেন। এতো এতো সেক্রিফাইস করে কি অন্নপূর্ণা দেবী তাঁর সংসার ধরে রাখতে পেরেছিল?
না পারেননি। বিয়ের পর থেকেই রবি শংকর একের পর এক নতুন নতুন সম্পর্কে জড়ায়। আর অন্নপূর্ণা দেবী? একাকী বন্দীত্ব বেছে নেয় জীবনের ৬০টি বছর। রিসিকেশ মুখার্যির জনপ্রিয় হিন্দি ছবি অমিতাভ জয়া অভিনিত "অভিমান" কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী ও রবি শংকর এর সাংসারিক টানাপোড়ার ভিত্তি করে নির্মিত। যদিও ছবিটি মিলনাত্বক কিন্তু বাস্তব জীবনে রবি শংকর ও অন্নপূর্ণা দেবী কখনই আর মুখোমুখি হননি। যদিও অন্নপূর্ণা দেবী উনার জীবন নিয়ে কখনো কিছু বলেননি কিন্তু রবি শংকরের তত্ত্বাবধানে ছেলের মৃত্যুর পর এক সাক্ষাতকারে রবি শংকরকে এর জন্য দায়ী করেন। তাকে ক্রনিক লায়ার বলেন ও তাঁর বিবাহিত জীবনের স্ট্রাগল সামনে আনেন।
যাহোক, লিখাটা শুরু করেছিলাম ভিন্ন উদ্দেশ্যে কিন্তু বড় হয়ে যাওয়াতে পর্ব হিসেবে লিখছি। আরো দু'টো পর্ব লিখার ইচ্ছে আছে। ততক্ষন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করুন আর ভালো থাকুন।
অনেক খুঁজে শুধু একটা মিউজিক পেলাম অন্নপূর্ণা দেবীর, তাই শেয়ার করলাম এখানে।
Annapurna Devi... Raag Manj Khamaj on Surbahar.
সোহানী
ডিসেম্বর ২০২৩
ছবি: গুগুল মামা
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৪২