চট্টগ্রামের পুরনো নাম ছিল হরিকেল।
আর সেই হরিকেল রাজ্যের পুবে ছিল যে রাজ্যটি সেই রাজ্যের নাম ছিল আরাকান । এই আরাকান রাজ্যেরই প্রাচীন নাম ছিল “রাখাইনপিয়ে”। হ্যাঁ, আপনারা যে রাখাইন শব্দটির সঙ্গে কমবেশি পরিচিত সেই শব্দের উৎপত্তির মূলে ওই রাখাইনপিয়ে। আর আপনারা যে রাখাইন সম্প্রদায়ের নাম জানেন তাদের পূর্ব পুরুষের নিবাস ছিল ওই রাখাইনপিয়ে রাজ্যে।
তো, এবার বলি ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ কী ঘটল।
সমগ্র ইতিহাসজুড়েই তো দেখি, কথায় কথায় যুদ্ধ বাধে। তেমনি কী কারণে রাখাইনপিয়ে রাজ্যের আরাকানী সৈন্যরা হরিকেল রাজ্য-মানে বর্তমান চট্টগ্রাম আক্রমন করে বসল । তখন আরাকানের রাজা ছিলেন সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া। যুদ্ধের নেতৃত্ব তিনিই দিয়েছিলেন সম্ভবত। সময়টা দশম শতাব্দী। তখন তো তেমনি হত। রাজারা স্বয়ং হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছে যেতেন।
তো আরাকানের রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া হঠাৎই যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষনা দিলেন।
সবাই তো অবাক। কেন?
হয়তো অযাথা রক্তপাত রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়ার ভালো লাগেনি। সম্ভবত তিনি ছিলেন শান্তিবাদী।
রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া বললেন, সেট ত গোইং।
সেট ত গোইং? কী এর মানে?
আরাকানী ভাষায় সেট ত গোইং শব্দগুচ্ছের মানে, যুদ্ধ করা অনুচিত।
কারও কারও ধারনা এই কল্যানকর আরাকানী বাক্যটি থেকেই কালে কালে চট্টগ্রাম শব্দটির উৎপত্তি। ভাবলে কেমন লাগে। বাংলাদেশ এমনিতেই কল্যানকর শান্তিবাদী দেশ। চট্টগ্রামে তার গুরুত্বপূর্ন সমুদ্রবন্দর রয়েছে। প্রতিদিন কতশত জাহাজ ভিড়ছে সেখানে; দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। সেই চট্টগ্রাম শব্দের পিছনে এমন কল্যানকর সদিচ্ছা! ভাবলে কেমন যেন লাগে।
অবশ্য একটি বৌদ্ধসূত্রমতে, চট্টগ্রাম শব্দের উৎপত্তি চৈত্যগ্রাম থেকে । হয়তো এককালে চট্টগ্রামে চৈত্যগ্রাম নামে কোনও বৌদ্ধবিহার ছিল, আর সে বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গ্রাম-লোকালয়-জনপদ।
হতে পারে। তেমন সম্ভাবনা আমি একেবারেই উড়িয়ে দেব না।
তবে আমারদের ভাবতে ভালো লাগে যে এক শান্তিবাদী আরকানী রাজার সদিচ্ছাই ছিল চট্টগ্রাম শব্দটির উদ্ভবের পিছনে। এবং আমাদের দেশে যে রাখাইন সম্প্রদায়
রয়েছে তাদের কাছে যাওয়ার পর আমরা যেন একবার হলেও রাখাইনদের পূর্বপুরুষ সেই মহৎ হৃদয়ের রাখাইনরাজের কথা ভাবি।
আর আমরা যেন রামুতে রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া-এর একটি ভাস্কর্য গড়ে তুলি। আর, কোনও এক ভাদ্রের ঝকঝকে দিনে সে ভাস্কর্যটি যেন উদ্বোধন করে কোনও এক রাখাইন শিশু । সে সময় যেন ওখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষে উপস্থিত থাকে। কেননা, রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া ছিলেন দ্বিতীয় অশোক। মৌর্য সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অহিংস বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন।
এমন ভাবতে উৎসাহিত হই-রাখাইন রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া কি যুদ্ধবিরোধী কোনও শিলালিপি স্থাপন করেছিলেন?
হয়তো।
তা হলে সেটি কোথায়?
হয়তো সেই শিলালিপিটি আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘন কোনও বাঁশঝাড়ে ঢেকে আছে। সম্ভবত রামুর গহীন জঙ্গলে।
বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সেই শিলালিপিটি আজ যে খুঁজে বার করতেই হবে।
আর আশ্চর্য এই-আমরা কত কত নাম জানি-কত কত সাবষ্ট্যান্ডাড রাজনীতিবিদের নাম জানি-কেবল যুদ্ধবিরোধী ওই মহৎ হৃদয়ের রাখাইন রাজার নামটিই জানি না!
তথ্যসূত্র
(১) বাংলাপিডিয়া।
(২) বছর কয়েক আগে অদিতি ফাল্গুনী রাখাইনদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন কোনও এক ঈদসংখ্যায়। সেখানেও ওই আরাকানী রাজার কথা রয়েছে।