somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালনের দোহাই

১১ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনুষ্যজীবন জীবন দীর্ঘ; দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। তথাপি জীবনবাদী বাংলার পথে পথে এভাবেই নেচে নেচে জীবনের বন্দনা করেন বহূদর্শী প্রাজ্ঞ বাউলেরা ...দুঃখময় জীবনকে সুন্দর বলাই তো ধর্ম।


১. জীবনবাদী একটি গান

লালনের বহুলশ্রুত জীবনবাদী গানটি এইরকম-

এমন মানব-জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।

অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।
দেবদেবতাগন
করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।

কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে পেয়েছ এই মানব তরণী;
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়
যেন ভরা না ডোবে।

এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন
তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন
এবার ঠকলে আর
না দেখি কিনার
অধীন লালন তাই ভাবে


২.আবহমান বাংলা

এই অসাধারণ গানটি লালন ঠিক কবে লিখেছিলেন?
আজ আর তা জানার উপায় নাই। তবুও দিনক্ষণটি ১৮৫০ সালের এদিক-ওদিক ধার্য করি। যদিও প্রমাণ হাতে নাই। তবু আশা করি আমার এই প্রচেস্টায় বাংলার সাধু সমাজে অযাথা গুঞ্জন উঠবে না।
যা হোক। ‘এমন মানবজনম’ গানটির কথা ও সুর আমার এতই সমকালীন মনে হয় যে কী বলব। আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়: বাংলা বাদে অন্য দেশের ১৮৫০ সালের গান কেমন? ইংরেজি গানের কথাই ধরি।
এভাবেই কি প্রমাণিত হয় না যে বাংলা আবহমান?
অথচ, একদল লোক আজ আবহমান বাংলার ধারনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে।
অথচ, একদল লোক আজ বাউলে আবহমান ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
ধিক।

৩. নবনীতার গল্প

‘এমন মানবজনম’ গানটি আজ বহুদূর ব্যাপৃত হয়ে রয়েছে।
গত দেড়শ বছর ধরে কত গুণী শিল্পী যে গাইলেন জীবনবাদী এ গানটি।
বাংলার তরুনদের মধ্যে গাইলেন হালের নবনীতা চৌধুরী । নবনীতা, আপনারা কমবেশি জানেন, বর্তমানে বি বি সি-র বাংলা বিভাগে কর্মরত। সেই সূত্রে বাস করছেন লন্ডন শহরে। এই গানটি সেখানেও পৌঁছে গেছে নবনীতার প্রিয় একটি পছন্দের গান বলে। একটা সময় ছিল; যখন - লালনের গানের সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না নবনীতার। পড়াশোনা শেষ করে একুশে টিভিতে জয়েন করল নবনীতা: ‘দেশজুড়ে’ অনুষ্ঠানটির নাম তো শুনেছেন আপনারা? তো, সেই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেল। কাজের সূত্রেই যেতে হয়েছিল গ্রামবাংলার অতি নিভৃত প্রান্তরে।
সে সময়ই এক বাউলের মুখে বাউল গান শুনে কী যেন ভালো লাগল। ভীষন বিষন্ন হয়ে পড়লেন নবনীতা। মনের ভিতর ভীষন তোলপাড়। “এই রকম গান তো আগে শুনিনি। এতকাল আমি তাহলে কি শুনেছি? এই গান না শুনেই মরে যেতাম। ইশ!” তারপর বাউল গান নিয়ে নবনীতার খোঁজ খবর শুরু হল। অনেক বাউল গান সংগ্রহ করে শুনলেন। লালনের নাম আগেই শুনেছিলেন, শুনছিলেন লালনের নির্বাচিত কয়েকটি গানও। বাউল জগতের আরও গভীরে ঢুকে পেয়ে গেলেন ‘এমন মানবজনম আর কি হবে’ নামে জীবনের বন্দনাকারী এই গানটি। শুনে বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে গেলেন নবনীতা। ১৮৫০ সালের গান। ইংরেজি গান তো তখন ... সেই সময়কার ইংরেজি গান শুনে ইংরেজরা আজ বুঝবে না। আর আমরা ...
বাংলা ও লালনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল নবনীতার। ঠিক করলেন গান গাইবেন। লালনের গান।
২০০৭-এ বার করলেন একটি লালনগীতির অ্যালবাম।
নবনীতা আজও গুনগুন করে গান লালনের গান। লন্ডনে।
কাজেই, তখন বলছিলাম, লালনের এই গানটি আজ বহুদূর ব্যাপৃত হয়ে রয়েছেন।

৫. শিল্পের মানে

এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন,
তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন।

বাংলায় ঠিক ইউরোপের মতন দর্শন বা ফিলসফি গড়ে ওঠেনি কখনও। বাংলার দর্শনকে বলা হয় ভাব। আমার মনে হয় যে এই দুটি চরণই বাংলার ভাবের ভিতটি রচনাকারী করে দিয়েছে। সবিনয়ে আরও জানাতে চাই-বাঙালির অলিখিত সংবিধানটিও কিন্তু লালনের একটি হিতকারী গানের প্রারম্ভ দুটি চরণ।

ভবে মানুষগুরু নিষ্টা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার-

এ সবই আবেগের কথা।
তবে বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য। ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে ছেলেবেলায় দেখেছি পাড়ার এক দুধর্ষ মাস্তানকে কালো পিচ রাস্তার ওপর সাদা রঙের আলপনা আঁকতে। আপনারাও জানেন যে- এমতরো বিচিত্র দৃশ্য অনত্র বিরল। তাই বলছিলাম-বাঙালির জীবনে ও আদর্শে শিল্পের গভীর ভূমিকা স্বীকার্য।
‌'মাধুর্যভজন' অর্থ শিল্পের সাধনা। নিৎসে একবার বলেছিলেন-Atr is the proper task of life. লালন নিৎসে এঁরা হচ্ছেন সমগোত্রী। আর আমরা তাদের নাবালক শিষ্যমাত্র। আমরা কেবল এই মহাজনদের মন জানার চেষ্টা করতে পারি।

৬. নিরঞ্জন কে?

নিৎসে ঈশ্বর মানতেন না।
লালনও সে সংশয় প্রকাশ করে একটা গানে বলেছেন-

সবাই কি হবে ভবে ধর্মপরায়ন?

এই গানটার শেষ কটা চরণ এরকম-

ধর্মকর্ম আপনার মন
করে ধর্ম সব মোমিনগন;
লালন বলে কর ধর্ম
প্রাপ্তি হবে নিরঞ্জন।

নিরঞ্জন যে কে-সেই ভাবনায় জীবনভর আচ্ছন্ন ছিলেন লালন।

৭. নিরঞ্জন-এর রঞ্জিত প্রকাশ?

তবে নিরঞ্জন যিনিই হোক না কেন- তিনি যে মাধুর্যের উৎস সে নিয়ে সন্দেহ নেই মনে। এ জগতে কত যে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য। যেমন-ম্লান আলোর নির্মল ভোর, ঝিরঝির বাতাস, শিউলি ফুলের গন্ধ, শিশিরসিক্ত ঘাস, একটা নিরব নদী, তার মৌন বিস্তার ... মানবজন্ম পেয়েই তবে পঞ্চ ইনিদ্রয়ে ঝরে ঝরে পড়ে ঝরে ঝরে পড়ে এমন আমোদ।
তখন ...তখন মনে হয়-

কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে পেয়েছ এই মানব তরণী;

তবে মানবজন্ম সহজ নয়। কেননা-

দেবদেবতাগন
করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।

৮. হেগেলের দোহাই

তবে মানুষ-রুপ নিরাকার নিরঞ্জনই গঠন করলেন কিনা -তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান এক অনিবার্য বিবর্তনের কথা বলে; রেডি মেড কিছু গড়ার কথা বলে না। বিশ্বজগৎ নিরঞ্জন-এর রঞ্জিত প্রকাশ বললে হাস্য করে।তা হলে? তা হলে ম্লান আলোর নির্মল ভোর, ঝিরঝির বাতাস, শিউলি ফুলের গন্ধ, শিশিরসিক্ত ঘাস, একটা নিরব নদী, তার মৌন বিস্তারের কি মানে?
অতএব, দার্শনিক হেগেলের শরণাপন্ন হই না কেন।
হেগেল একবার বলেছিলেন, যা কিছু আছে সবই পরমের দিকে বিবর্তিত হইতেছে।
কে পরম?
লালনের সাঁই?

অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।

৯. লালনের দোহাই

সবই যখন পরমের দিকে বিবর্তিত হইতেছে এবং সে বিবর্তন যেহেতু আজও শেষ হয়নি;কাজেই সে বিবর্তন-উত্তর সত্যাসত্যে না পৌঁছেই এ দুটি চরণ আজ নির্দ্বিধায় গাওয়া যায়-

এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন,
তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন।

কেননা-

এবার ঠকলে আর
না দেখি কিনার
অধীন লালন তাই ভাবে ...

এই হচ্ছে লালনের দোহাই।


উৎসর্গ: নৃপ অনুপ।





সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১২ দুপুর ১২:৫৬
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×