স্টোয়িক শব্দটা এসেছে গ্রিক 'স্টোয়া' থেকে। স্টোয়া মানে: বারান্দা, টানা বারান্দা। আমরা সবাই প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সের সেই বাজার- মানে আগোরার কথা শুনেছি। সেই আগোরার এককোণে ছিল স্টোয়া-মানে টানা বারান্দা। একটি স্টোয়ার নাম ছিল, ‘স্টোয়া পয়েকিল’। ‘পয়েকিল’-এই গ্রিক শব্দের মানে, ‘বর্ণময়’। তার কারণ, সেই স্টোয়া পয়েকিলের দেওয়ালে ছিল নানান শিল্পকর্ম;মূল গ্রিক চিত্রকরদের আঁকা চিত্র। তো, সেই স্টোয়া পয়েকিলের বসে তত্ত্বালোচনা করতেন একজন দার্শনিক। জেনো। সময়টা? যিশুর জন্মের এই ধরুন ৩০০ বছর আগে। দার্শনিক জেনোই স্টোয়িক দর্শন বা স্টোয়ার দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। তো, স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা কি? স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা আমাদের আবেগ অনুভূতি ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্ত ছলনামাত্র। এসব সিলি বিষয় পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। যে এই আত্মজ্ঞান লাভ করেছে সে আর নিছক আবেগ অনুভূতির অধীন নয়। কোথায় যেন ভারতীয় দর্শন ভারতীয় দর্শন বলে মনে হয় না? আসলে সেরকম হওয়ারই কথা। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০। আলেকজান্দার পাঞ্জাবের ঝিলাম অবধি পৌঁছে গেছেন। ভারতবর্ষ ও পশ্চিমের মধ্যে ভাব বিনিময় অবশ্য তার আগেই শুরু হয়ে গেছে। গণিতশাস্ত্রে ০ বা শূন্যের অবদান ভারতবর্ষেরই।
তবে, স্টোয়িক দর্শনে যে করুন সুর রয়েছে তার কী কারণ।
একটা কারণ হতে পারে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তখন আলেকজান্দার মৃত। তাঁর সাম্রাজ্যটি তিনভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সেই তিনটি ভাগের মধ্যে চলছিল বিরোধ। রক্তপাত। গ্রিস, মানে এথেন্সের সেই পূর্বেকার গৌরব আর নেই। এথেন্স হতশ্রী আর ম্লান। সেই ম্লান এথেন্সের হতশ্রী আগোরায় স্টোয়া পয়েকিলে বসে জেনো অনেকটা অসহায়ভাবেই বললেন: বিষন্নতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
২
যা হোক। গ্রিকদের পরে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে দেখা গেল রোমানদের। জেনোপ্রবর্তিত স্টোয়িক দর্শন আদৃত হয়েছিল রোমানসভ্যতায়। বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার ক্ষেত্রে দর্শনটি ছিল উপযোগী। কেননা, শাসন-শোষন স্বাভাবিক। এবং শাসন-শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
৩
খ্রিস্টপূর্ব যুগে ফ্রিজিয়া জায়গাটা ছিল গ্রিসে। পরে ফ্রিজিয়া রোমানরা দখল করে নেয়। জায়গাটা এখনকার তুরস্কে। যিশুখ্রিস্টের ক্রশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার কিছুকাল পরে-অর্থাৎ ৫৫ খ্রিস্টাব্দে এপিকটেটাস এর জন্ম হয়েছিল সেই ফ্রিজিয়াতেই। তারপর তাকে বন্দি করে দাস হিসেবে রোমে নেওয়া হয়। প্রভূর নাম: ইপাফ্রোডিটাস। ভারী ক্রোধী লোক। ওই ইপাফ্রোডিটাসই একবার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁর পা খোঁড়া করে দিয়েছিল। পা ভাঙ্গার সময় এপিকটেটাস নাকি চিৎকার বা প্রতিবাদ করেননি । শুধু বলেছিলেন, এভাবে চাপ দিলে যে আমার পা ভেঙ্গে যাবে। পা শেষমেশ ভেঙ্গেই গেল। পা ভাঙার পর এপিকটেটাস নাকি বলেছিলেন, আমার পা ভেঙ্গে গেল। কথাটা শুনে ইপাফ্রোডিটাস বলল, পা ভাঙ্গল। এখন কেমন লাগছে? এপিকটেটাস বললেন, We are disturbed not by events, but by the views which we take of them. (এই হচ্ছে স্টোয়িক দর্শনের মূলকথা) যাক। এমন লোককে কি বন্দি করে রাখা যায়? এপিকটেটাস মুক্তি পেলেন। তারপর ৯০ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি রোমেই আকাদেমি খুলে দর্শন শিক্ষা দেন। কী বলতেন এপিকটেটাস? এপিকটেটাস বলতেন, All philosophy lies in two words, sustain and abstain. (এই উক্তির সঙ্গে আগের উক্তির সম্পর্ক লক্ষ করুন)
এপিকটেটাস আরও বলতেন, Be careful to leave your sons well instructed rather than rich, for the hopes of the instructed are better than the wealth of the ignorant. আর বলতেন, First learn the meaning of what you say, and then speak.
তো, সেই সময় রোমান সম্রাট ছিলেন ডোমেশিয়ান। কী কারণে সম্রাট দার্শনিকদের ভয় করতেন। তিনি রোম থেকে থেকে দার্শনিকদের নির্বাসিত করেন। এপিকটেটাস এর প্রধানতম শিষ্যের নাম ছিল আরিয়ান। এপিকটেটাস আরিয়ানের সঙ্গে রোম থেকে গ্রিসের এপিরাসে চলে যান। (জায়গাটি পশ্চিম গ্রিসে, বর্তমান আলবেনিয়ার দক্ষিণে।) এপিরাসেই বসবাস করতে থাকেন এপিকটেটাস। ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু সেখানেই হয় তাঁর।
৪
এপিকটেটাস নিজে কিছু লেখেননি। তার মৌখিক শিক্ষার ওপর আরিয়ান দুটি গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন।
(ক) এনচেইরিডিওন (রেফারেন্স বুক) এবং
(খ) ডিসকোর্স (বয়ান)।
এপিকটেটাস নৈতিকতা নিয়ে উদ্বিগ ছিলেন। পূন্যের সংজ্ঞা নির্ধারন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণি হলেও আলোকময় ঈশ্বর মঙ্গলময়-অতএব, মানুষের তার আলো চাই। মানুষ ভাগ্যকে (আগে থেকে) জানতে পারে না বলেই নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মানুষের উচিত নির্লোভ থাকা। আর, ভালোমন্দ সবই মেনে নেওয়া। অন্যের দোষক্রটিও ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা উচিত। এপিকটেটাস একবার বলেছিলেন: তুমি যদি শোনো যে কেউ তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলছে। প্রতিবাদ করো না। বরং বলো:তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জান না। আমার আরও খারাপ দিক রয়েছে। যা তুমি জান না।
এপিকটেটাস দার্শনিক জেনোর মতোই সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জাগতিক সুখশান্তিকে তুচ্ছ মনে করেছেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চর্চা করে জাগতিক সুখশান্তি অস্বীকার করেই একজন মানুষ স্বাধীন ও সুখি হতে পারে। ‘স্টোয়িক ব্লিস’-কথাটি আমরা শুনেছি। সংযমী হয়ে পরমানন্দের (ব্লিস) সন্ধান করাই স্টোয়িকদের মোক্ষ।
স্টোয়িক দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বও রয়েছে। দার্শনিক জেনো বিশ্বাস করতেন: জগতের মূল অগ্নি। আর, লোগোস হল শক্তি, বিধান ও যুক্তির সমন্বয়ে তৈরি এক অপার্থিক শক্তি। স্টোয়িকরা এই লোগোস-এর উপাসনা করেন। লোগোস এক ধরনের ঐশ্বরিক নির্দেশ-যা প্রকৃতিতে লীন হয়ে আছে। প্রকৃতি হচ্ছে দৈবশক্তি দ্বারা নির্মিত এক পদ্ধতি। প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই মানুষের বাঁচা উচিত। প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অংশ; যে কারণেই প্রত্যেকেই এক অখন্ড পরিবারের অংশ।
এই সর্বজনীন মানবতাবাদই স্টোয়িক দর্শনের উজ্জ্বলতম দিক।
৫
উপরোন্ত, এপিকটেটাস বলতেন, All religions must be tolerated... for every man (এবং নারী) must get to heaven in his own way. এই কথাটাই আজকালকার দিনের ধর্মান্ধরা মানতে চায় না। এপিকটেটাস-এর এই উক্তিটির জন্যই আজ আমি এপিকটেটাস সম্বন্ধে লিখলাম। ধর্মান্ধরা বলবে এপিকটেটাস ভুল। অথচ এপিকটেটাস বলেছেন:
যখন তুমি দরজা বন্ধ কর। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। তাই না? কিন্তু, তখন কি তুমি একা? না, তখনও তুমি একা নও। কেননা, ঈশ্বর রয়েছেন। আর রয়েছে তোমার প্রতিভা।।
যারা এত প্রগাঢ় উপলব্দি তাঁর ভুল হয় কী করে? তারপরও আমাদের সময়ের ধর্মান্ধরা বলবে: এপিকটেটাস খ্রিস্টান। (যেমন, রবীন্দ্রনাথ কেবলি হিন্দু)। এপিকটেটাস ভুল, কেননা, এপিকটেটাস খ্রিস্টান। কেননা, এপিকটেটাস বলতেন, All religions must be tolerated... for every man (এবং নারী) must get to heaven in his own way.
এপিকটটাস-এর ডিসর্কোস (বয়ান) পড়তে চাইলে-
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৫২