এই সেদিনও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা চব্বিশজন পুলিশ খুন করল। দিনকে দিন মাওবাদীরা যেন ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণঅসাধ্য হয়ে পড়েছে, উত্তর ভারতে ওই বিপ্লবীদের তৎপরতার মাত্রা দিনদিন আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সামরিক ছাউনি বসিয়ে কিংবা পুলিশি টহল জোরদার করেও এদের যথাযথভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না বরং সময় যতই গড়াচ্ছে মাওবাদী বিপ্লবী গেরিলাদের ভূমিকা ততই বল্গাহীন হয়ে উঠছে ।
এখন যেমন মাওবাদীরা উত্তর ভারতের ক্ষমতার তখ্ততাউস্টি জবরদখল করতে রক্তাক্ত পথে তৎপর, প্রাচীন ভারতেও অনুরূপ রক্তঝরা বিপ্লবী তৎপরতা অব্যাহত ছিল; সভ্যতার শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিকগন তো বলেই গেছেন : রক্তাক্ত বিপ্লব মানবেতিহাসের আদি ও অকৃত্রিম ঝোঁক। রাজনীতির ভাষায় বিপ্লবী তৎপরতাকে শ্রেণীসংগ্রাম বলে। সভ্যতার ইতিহাসে শ্রেণীসংগ্রাম দৃষ্টান্ত অপর্যাপ্ত নয় বরং অপরিমেয়। প্রাচীন চিনের হলুদ বিদ্রোহ থেকে আরম্ভ করে ১৮৭১ সালের ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, সেই আদর্শগত উত্থানের সূত্রে বিংশ শতকের প্রারম্ভে পূর্ববাংলায় তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন প্রভৃতি গণমানুষের বিপ্লবী তৎপরতারই রক্তস্বাক্ষর।
ভারতীয় মাওবাদী; এরা হাজার বছরের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চায়। এরা কি জানে শ্রেণীসংগ্রাম কিংবা গণবিদ্রোহের ফলে রাষ্ট্রকাঠামো জোর ঝাঁকুনি খায় বটে তবে ক্ষমতাসীনেরা একেবারেই লুপ্ত হয়ে যায় না। আবার তারা বেদখল হয়ে যাওয়া ক্ষমতার তখ্ততাউস্টি পুনুরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলও হয় তারা। ক্ষমতা পুনুরুদ্ধারের পথটি কম বিচিত্র নয়। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রচন্ড গণবিদ্রোহের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় হলেও- মাত্র পাঁচ বছর পরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের বাংলাদেশি তাবেদারদের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সমর্থ হয়। হাজার বছর ধরে সংঘটিত বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের এই ধারা।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেও একটি বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবময় অধ্যায়কে চিহ্নিত করা চলে। বর্তমানে ভারতবর্ষে মাওবাদীরা তৎপরতার মূলকেন্দ্রটি ভারতের বিহার। অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবময় অধ্যায়টি সংঘটিত হয়েছিল ওই বিহার রাজ্যেই।
সেই চমকপ্রদ ইতিহাসের দিকে এবার মুখ ফেরানো যাক।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খিষ্টপূর্ব ৬ষ্ট শতকে। এর আগেও যে রাজনীতি ছিল না,তা নয়, তবে সেই ইতিবৃত্তটি আজও তেমন স্পস্ট নয়। রাম শরণ শর্মা, দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী প্রমূখ ঐতিহাসিক খিষ্টপূর্ব ৬ষ্ট শতক থেকেই রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করেছেন।
খিষ্টপূর্ব ৬ষ্ট শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকয় তে এই রাজ্যগুলির নাম পাওয়া যায়। বৌদ্ধসাহিত্যে এই রাজ্যগুলির ষোড়শ মহাজনপদ বলে অবহিত করা হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের মানচিত্র। খিষ্টপূর্ব ৬ষ্ট শতকের দিকে এখানেই গড়ে উঠেছিল ষোলটি স্থানীয় রাজ্য। ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: কাশী কোসল অঙ্গ মগজ বজ্জি মল্ল চেদি বৎস কুরু পাঞ্চাল মৎস সুরসেনা অস্মক অবন্তী গান্ধার এবং কম্বোজ। আমাদের আলোচ্য মগধ। মগধ বলতে বর্তমান দক্ষিণ বিহারের পাটনা এবং গয়া জেলাকে বোঝাত । বর্তমানে ভারতবর্ষে মাওবাদীরা তৎপরতার মূলকেন্দ্রটি এখানেই।
মগধ। গঙ্গানদী বিধৌত মগধের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। ফলে কালক্রমে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে মগধ অন্যান্য জনপদগুলির তুলনায় অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক শক্তিতে মগধ উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এগিয়ে যায়। সেকালে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল: মগধ শাসন করে যে উত্তর ভারত তার পদানত।
মগধের প্রথম রাজবংশের নাম হর্যঙ্ক বংশ। এই বংশের সম্রাটগন মগধকে উত্তরভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় শ্রেয়তর অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। হর্যঙ্ক বংশের শ্রেষ্ট নৃপতির নাম বিম্বিসার। এঁর সময়কাল ৫৪৫-৪৯২ খ্রিস্টপূর্ব । জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতায় এঁর উল্লেখ রয়েছে।
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;
বৌদ্ধ ও জৈনসাহিত্যে সম্রাট বিম্বিসারকে প্রজাবৎসল ও অত্যন্ত উদার মনের অধিকারী বলে অবহিত করা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ এঁর সমসাময়িক ছিলেন। এঁর রাজত্বকালেই প্রাচীন ভারতীয় দর্শন এক মননশীল স্তরে পৌঁছেছিল। সম্রাট বিম্বিসার চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরে জৈনধর্মের প্রবক্তা মহাবীর ও বুদ্ধ ছাড়াও অজ্ঞেয়বাদী সঞ্জয় বৈরট্টিপুত্র ও চার্বাকপন্থী নাস্তিক অজিত কেশকম্বলী নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়াতেন, নিজেদের মতবাদ জনগনের মাঝে প্রচার করতেন। রাজগৃহ নগরকে দক্ষিণ এশিয়ার এথেন্স ও সম্রাট বিম্বিসার কে গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
বিম্বিসার।
সম্রাট বিম্বিসার-এর পুত্রের নাম ছিল অজাতশক্র । এঁর সময়কাল ৪৯৩-৪৬২ খ্রিস্টপূর্ব। অজাতশক্র ভারতের ইতিহাসের কলঙ্ক। ক্ষমতার লোভে পিতা সম্রাট বিম্বিসার কে বন্দি করেন এবং কারাগারে প্রায়োপবেশনে ( না খাইয়ে) মেরে ফেলার নির্দেশ দেন অজাতশক্র । ক্ষমতালোভী অজাতশক্র ছিলেন যুদ্ধবাজ। গঙ্গার উত্তরে ৩৬ টি গণরাজ্য নিয়ে একটি প্রজাসংঘ গড়ে উঠেছিল। প্রজাসংঘ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে অজাতশক্র সামরিক অভিযান মনস্থ করেন। বুদ্ধ নিষেধ করেন। অজাতশক্র বুদ্ধের কথায় কর্ণপাত করেননি।
পাটলিপুত্র। নন্দ ও মৌর্যরা এই পাটলিপুত্রকেন্দ্র করে উত্তর ভারত শাসন করেছে। আগে মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ; পরে পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত হয়। মগধের রাজধানী পাটলিগ্রামে স্থানান্তরিত করার কথা অজাতশক্রই প্রথম ভাবেন। পাটলিগ্রামের অবস্থান ছিল গঙ্গা ও শোন নদীর মধ্যবর্তীস্থলে। এই পাটলিগ্রামই পরে প্রাচীন ভারতের বিস্ময়কর নগর পাটলিপুত্র। অজাতশক্র এর উত্তরসূরী রাজা উদয়িন এর রাজত্বকালে এই স্থানান্তরকরণ সম্পন্ন হয়।
রাজা উদয়িন এর বংশধরেরা দুর্বল ছিলেন। সুশাসনের অভাবে মগধজুড়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয় । এই সুযোগে হর্যঙ্ক বংশ দূর্বল হয়ে পড়লে শিশুনাগ নামে এক উচ্চভিলাষী ব্যাক্তি মগধ অধিকার করেন । এবং শিশুনাগই মগধে শিশুনাগ বংশ প্রতিষ্ঠিত করেন। শিশুনাগ বংশের সময়কাল ৪৩০-৩৬৪ খ্রিস্টপূর্ব। শিশুনাগ মগধের রাজধানী প্রথমে রাজগৃহে পরে আবার বৈশালীতে স্থানান্তর করেন। এঁর পুত্রের নাম কালাশোক কাকবর্ণ। ইনি মগধের রাজধানী আবার পাটলিপুত্রে নিয়ে আসেন।
এ গেল মগধের রাজনৈতিক ইতিহাস। এর আড়ালে অন্য এক ঘাতপ্রতিঘাতের চোরাস্রোত সক্রিয় ছিল- যাকে বলে সামাজিক দ্বন্দ। এই সামাজিক দ্বন্দ হল বর্ণভেদ এবং দাসপ্রথা। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে এই দুটি বিধানই জনবিক্ষোভের উপাদান বলে চিহ্নিত। বৈদিক যুগ থেকেই প্রাচীন ভারতে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। সে যুগে যারা যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দী হত তাদের দাসে পরিনত করা হত। কেউ কেউ জন্মসূত্রেও দাস হত। বর্ণাশ্রম প্রথা। সমাজের সর্বনিু জাত হিসেবে শূদ্রনিগ্রহ অব্যাহত ছিল । এরাই আজ ভারতবর্ষের সমাজে ‘দলিত’ বলে চিহ্নিত। এ প্রসঙ্গে জনৈক ভারতীয় ঐতিহাসিক লিখেছেন: In the context of traditional Hindu society, Dalit status has often been historically associated with occupations regarded as ritually impure, such as any involving butchering, removal of rubbish, removal of waste and leatherwork. Dalits work as manual labourers, cleaning latrines and sewers, and clearing away rubbish. Engaging in these activities was considered to be polluting to the individual, and this pollution was considered contagious. As a result, Dalits were commonly segregated, and banned from full participation in Hindu social life. For example, they could not enter a temple nor a school, and were required to stay outside the village. Elaborate precautions were sometimes observed to prevent incidental contact between Dalits and other castes. Discrimination against Dalits still exists in rural areas in the private sphere, in everyday matters such as access to eating places, schools, temples and water sources. It has largely disappeared in urban areas and in the public sphere.
এক ক্রান্তিকালে মগধে শাসন করছিলেন শিশুনাগ বংশের কালাশোক কাকবর্ণ।এবার মগধের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হল এক অস্পৃশ্য দলিতের হাতে। তার নাম নন্দ; এই নিুবর্ণের যুবক কালাশোক কাকবর্ণ কে হত্যা করে মগধে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা করে। এঁর সময়কাল ৪৫০-৩৬২ খ্রিস্টপূর্ব। তার আগে অবশ্য নন্দ শব্দের আগে মহাপদ্ম যোগ করে সে। আমাদের দেশের অনেক কলিম-ছলিম যেমন নামের আগে বা পরে খান-চৌধুরী যোগ করে জাতে ওঠে।
মহাপদ্মনন্দর মা ছিলেন শূদ্র রমনী। আপন পুত্রের মগধের ক্ষমতা গ্রহনের পিছনে এই নারীর ভূমিকা থাকতে পারে যেমন প্রাচীন ফিলিস্তিতে একটি নতুন ও সংশোধিত আর্দশের জয়গানে যিশু খ্রিস্টের মা মেরির সক্রিয় ভূমিকা অনেকেই বিবেচনা করেন। যিশুর জন্মকালীন সময়ে প্রাচীন ফিলিস্তিন শাসন করত রোমানরা; তারা দরিদ্র ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যধিক করারোপ করেছিল। যাতে করে জনগনের জীবনযাত্রা নাভিশ্বাস উঠছিল। তেমনি শিশুনাগ বংশের শাসন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল মগধের দরিদ্র জনগন।
সে যাই হোক। অন্য একটি সূত্রের মতে, মহাপদ্মনন্দর বাবা ছিলেন নাপিত। নাপিত আর শূদ্র রমনীর মিলনে শূদ্র নন্দর জন্ম হয়েছিল। ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা তাঁকে হীন বংশজাত বলে উল্লেখ করেছেন। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে: It is commonly believed that the caste division is somewhat uniform in North Indian society compared to South Indian society. However some prominent rulers of North India were believed to have originated from the Shudra caste, e.g. the Nandas, Nigams, and the Mauryas.
তা হলে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মগধে একটি অন্ত্যজ বিপ্লব ঠিকই সংঘটিত হয়েছিল?
হ্যাঁ। তাইই।
ভারতবর্ষে আজও দলিতরা অস্পৃশ্য।
দলিতকেন্দ্রিক বিপ্লবের ফলে প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ্য-ক্ষত্রিয় প্রাধান্যের অবসান ঘটেছিল; ব্রাহ্মণ্যবিরোধী বলে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রচার ও প্রসারে জোয়ার আসে। পাঠ করুন:The collapse of the old Ksatriya dynasties under the rigorous power politics of Mahapadma Nanda, who is explicitly denigrated as the son of a Shudra, and the support extended to followers of non-Vedic philosophies, all has been described as negative signs in the Puranas, which often identify Mahapadma Nanda's rise as a mark of Kaliyuga.
শূদ্রেরা ক্ষমতা দখলে নিলেই কলিযুগ? আর ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ জোটের শোষণশাসন স্বর্গযুগ? আজ আমরা জানি শ্র“তি-শাস্ত্র-পুরাণ ইত্যাদি কার স্বার্থে রচিত হয়েছে! ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকে ছিল আর্যাবর্ত বা আর্যের ভূমি। আর্য অভিজাতেরা সামাজিক শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে বর্ণভেদের বিধান রচেছিল। যে বিভেদের বিরুদ্ধে বাংলার লালনের হুঙ্কার -
ভেদবিধির পর শাস্ত্র কানা।
বিভেদে সে আর্যভূমি শূদ্রের ভূমি হয়ে উঠেছিল মহাপদ্মনন্দর বিপ্লবের ফলে । মগধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শূদ্রজাত নন্দবংশ। যে বংশের শাসনকাল ৩৬৪ থেকে ৩২৪ খ্রিস্টপূর্ব।
এতসব ঘটেছিল প্রাচীন বিহারে যেখানে এখন মাওবাদীদের রক্তাক্ত পদচারণা। নন্দরাজ মহাপদ্ম নন্দের মতোই মাওবাদীরাও একটি সামাজিকঅর্থনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষে অনঢ়। মাওবাদী অর্থনৈতিক লক্ষ আছে। নন্দবংশীয় শূদ্রবিদ্রোহের কি সেরকম লক্ষ ছিল? মনে হয় না। শূদ্রজাত মহাপদ্মনন্দর আর্ন্তবিপ্লবের ফলে মগধের শূদ্রসমাজের কি কোনও যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছিল? মনে হয় না। কারণ, ইতিহাস বিশ্লেষনে দেখা যায় বিপ্লবীরা ক্ষমতায় গিয়ে পূর্ববর্তী শোষকদের মতোই আচরণ করে। তাদের হৃদয়ের বিপ্লবী অনল মিইয়ে আসে। মগধে কতটুকু ধনবৈষম্যের প্রতিকার করতে পারল নন্দবংশ? মগধে শূদ্রবিপ্লবের ২৩ শ বছর পর এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বরং ইতিহাসগ্রন্থগুলি এই সাক্ষীই দেয় যে; উর্বর কৃষিজমিতে উচ্চহারে করারোপ প্রাচীন ভারতে নন্দদের সময়েই সূত্রপাত হয়েছিল। এতে কৃষকের জীবন বিপর্যস্তই হয়ে পড়েছিল বলে অনুমান করা চলে।
মগধে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু
নন্দদের অপরিমেয় ধনের কথাও ইতিহাসপুরাণে লিখিত আছে। এই ধনের কারণ মগধের উর্বর কৃষিজমিতে উচ্চহারে করারোপ। তাছাড়া বৈদেশিক আক্রমনের হুমকি নন্দদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও সুসংহত করেছিল। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্দার ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বে ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চল আক্রমন করেছিলেন। সেই সময়কার প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে গঙ্গাঋদ্ধি নামে একটি পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রের কথা শোনা যায়। গঙ্গাঋদ্ধি মগদের নন্দশাসনের করতলগত ছিল। বিদেশি লেখকদের চোখে মগধ হল প্রাসি । গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে প্রাসির শাসনাধীন ছিল।
নন্দ সাম্রাজ্য
মহাপদ্মনন্দর পরে নন্দবংশের অন্যতম শাসকের নাম ধননন্দ। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ নন্দবংশীয় রাজা ধননন্দ আলেকজান্ডারের সমসাময়িক। এঁর রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। গ্রিক লেখকদের কাছে ইনি ‘আগ্রামেস’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ২০,০০০ অশ্বারোহী, ২০০,০০০ পদাতিক, ২০০০ রথ এবং ৩০০০ হাতি ছিল। গঙ্গাহৃদি ও প্রাসি তাঁর শাসনাধীন ছিল। (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। ১ম খন্ড। পৃষ্ঠা, ১৩১)
প্রাচীন মগধ এখন কেবলি স্মৃতিচিহ্ন
এরপরও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। মগধের নন্দবংশের অপরিমেয় ধনসম্পদে মগধের শূদ্রসমাজের বিশেষ কি উন্নতি হল? নিজেদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে অকাতরে ব্যয় করেছে নন্দ সম্রাটগন। নন্দদের সৈন্যবাহিনীতে ৩০০০ হাতি ছিল। হাতির রক্ষণাবেক্ষণ তো ব্যয়বহুল। যে কারণে শূদ্রসমাজ পদদলিতই রয়ে গেল। আজও তাই আছে।
সোনার বাংলার স্বপ্নে যুদ্ধ করে আজও সোনার বাংলা স্বপ্নই রয়ে গেছে ...
তবে ইতিহাসচর্চায় আবেগ বিসর্জন দেওয়াই ভালো। নিরাবেগ ইতিহাসবিশ্লেষন অনেক সময় সত্য উপলব্ধিতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। ১৯৭২ থেকে ‘৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তৎকালীন আওয়ামী সরকার শাসনকার্যে কি স্বাধীনতা যুদ্ধের স্পিরিটটি প্রতিফলিত হয়েছিল? নাকি তাদের ভূমিকাও হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি শোষকদের মতোই? এই অনিবার্য প্রশ্নটি ভবিষ্যতেও উঠবে। কেননা, দেখা গেছে বিপ্লবীরা ক্ষমতা গিয়ে পূর্ববর্তী শোষকদের মতোই আচরণ করে। চিনের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কি সত্যিই বিপ্লবপূর্ব আদর্শে পরিচালিত? না, আমরা চিনে আরেকটি বিপ্লব কিংবা প্রতিবিপ্লবের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।