সুপ্রাচীন দেবী ইশতার
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ইশতার। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর্বরা শক্তি, প্রেম, যুদ্ধ ও যৌনতার দেবী। ধর্মীয় উপকথার জগতে দেবী ইশতার-এর স্থান এতই গুরুত্বপূর্ন যে-তার ধারণা থেকেই পরবর্তীকালে গ্রিক যৌনতার দেবী আফ্রোদিতি, রোমান সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস, ফ্রিজিয়ার প্রকৃতি দেবী সিবিলি ও ফিনিশিয়দের স্বর্গের রানী আসতারতে-এর উদ্ভব হয়েছিল । মেসোপটেমিয়ার অন্যত্র দেবী ইশতার পূজিত হলেও- ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় ইশতার এর আরাধনা পৌঁছেছিল ব্যাপক পর্যায়ে । ব্যাবিলনিয় সাহিত্যে দেবী ইশতারকে ‘জগতের আলো’, ‘ন্যায় বিচারক’, ‘আইনদাতা’, ‘দেবীদের দেবী’, ‘বিজয়ের দেবী’, ‘পাপের ক্ষমাকারী’ এবং ‘স্বর্গ ও মর্তের আলো’ প্রভৃতি অভিধায় অবহিত করা হয়েছে ...
মেসোপটেমিয়ার মানচিত্র। সুপ্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) সুমের আক্কাদ আসিরিয়া এবং ব্যাবিলনিয়া সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। ইশতার ছিলেন মেসোপটেমিয়ার ধর্মেরই একজন অন্যতম দেবী ।
আদি পর্যায়ে ইশতার মূলত ছিলেন সেমেটিকভাষীদের দেবী । খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সেমিটিকরা মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয় সাম্রাজ্যে পৌঁছানোর পর সুমেরিয় সমাজ তাদের দেবী ইশতারকে গ্রহন করেছিল। এর একটা মূল কারণ সুমেরিয় দেবী ইনানার সঙ্গে দেবী ইশতার-এর বিস্ময়কর সাদৃশ্য । যে কারণে ইশতার এর অন্য এক নাম ইনানা। এবং ইনানার উপকথা পরিনত হয় ইশতার-এর উপকথায়। যাই হোক। ইশতার সুমেরিয় রাজধানী উরুক নগরে মহা সমারোহে পূজিত হতে থাকেন। পরে ইশতার ব্যাবিলনের অন্যতম দেবী তে উন্নীত হন ।
ইশতার।
ব্যাবিলন
ব্যাবিলন নগর এবং দেবী ইশতার ছিলেন অভিন্ন। যে কারণে নববর্ষের স্বাগত ভাষনে ব্যাবিলনের রাজা বলতেন:
ইশতার যাচ্ছেন এগিয়ে,
পুড়ছে সুগন্ধী ভেষজ
বাতাসে ছড়িয়েছে সৌরভ।
ব্যাবিলনের ইশতার-এর পাশে
তার ভৃত্যগন বাজায় বাঁশী,
ব্যাবিলনবাসী হাঁটছে আনন্দে।
ব্যাবিলন নগরের মানচিত্র । প্রাচীন এই নগরটিই ছিল দেবী ইশতার-এর নগরী।
দেবী ইশতার এর বাবা চন্দ্রদেব; মা আনতুম; ভাই: সূর্যদেব শামাশ ও বোন: পাতালের রানী ইরিশকিগাল; পরবর্তীতে আমরা দেখব বোনের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন ইশতার। যা হোক। দেবী ইশতার এর বাহন সিংহ; প্রতীক অস্টকোণ তারকা; গ্রহ: শুক্র এবং সংখ্যা পনেরো। মনে রাখতে হবে, আমরা যাকে জ্যোতিষশাস্ত্র বলি -তার উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন ব্যাবিলনে। দেবী ইশতারের গ্রহ শুক্র এবং সংখ্যা ১৫ হওয়ায় তুলারাশি নির্দেশ করে। বিস্ময়কর এই- আজও তুলারাশির জাতিকাদের অন্যান্য রাশি জাতিকাদের তুলনায় সুন্দরী বলেই মনে করা হয়।
ব্যাবিলনের ইশতার দরওয়াজা। নববর্ষে ইশতার ভক্তরা মিছিল নিয়ে এই দরওয়াজা দিয়ে যেত।
ইশতার দরওয়াজা।
প্রেম ও যৌনতার দেবী ইশতার। প্রাচীন ব্যাবিলনবাসী মনে করত ইশতারই সেই শক্তি যা নারীপুরুষকে দূর্বার আকর্ষনে কাছে টেনে আনে; এবং কেবল মানুষ নয়, দেবী ইশতার পশুপাখির জন্যও উর্বরতা বৃদ্ধি করেন । ইশতার প্রমোদবালাদেরও দেবী ছিলেন, যে কারণে ইশতার উপাসনায় গুপ্তযৌনাচার এক বিশেষ আচার বলে গন্য হত। ইশতার নিজেও অবাধ যৌনচারী ছিলেন-তার অনেক প্রেমিক ছিল। তবে কী এক রহস্যময় কারণে প্রেমিকের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করতেন দেবী। প্রাচীন মেসোপটেমিয় সাহিত্যে বারবার এই নিষ্ঠুরতার কথা উল্লেখিত হয়েছে। উরুক নগরের বীর গিলগামেশ; যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন দেবী ইশতার, গিলগামেশ কী কারণে রাজি হননি, দেবী তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যদিও সফল হননি।
যুদ্ধের দেবী ইশতার-এর বাহন সিংহ। দেবী সিংহের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতেন, হাতে থাকে ধনুক ও তূণ ভর্তি তীর। ব্যাবিলনিয় শিল্পী সে কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন ব্যাবিলনের এক দেওয়ালের গায়ে উজ্জ্বল ইঁটের টাইলস-এ এঁকেছেন সিংহ।
দেবী ইশতার এর একজন প্রেমিক ছিলেন। নাম তামমুজ। তামমুজ ছিলেন শষ্যদেবতা। (তামমুজ হিব্রু মাসের নাম) ... অল্প বয়েসে মারা গিয়েছিলেন তামমুজ। কারও কারও মতে এই মৃত্যুর পিছনে ইশতার এর ইন্ধন ছিল। যাক। দেবী ইশতার শোকে আচ্ছন্ন হলেন। প্রেমিককে ফিরিয়ে আনতে পাতালদেশে যাবেন ঠিক করলেন। সাতটি তোরণ পেরিয়ে পাতালদেশে যেতে হয়। প্রতিটি তোরণ পেরোনোর সময় পরনের কাপড়ে অংশ কিংবা অলঙ্কার জমা দিতে হয়। অবশেষে নগ্ন ইশতার পৌঁছলেন পাতালদেশে। পাতালের রানী ইরিশকিগাল-মনে থাকার কথা-ইনি দেবী ইশতার এর বোন। পাতালের রানী ইরিশকিগাল বন্দি করলেন ইশতারকে । প্রেমের দেবীকে হারিয়ে আর্তনাদ করে উঠল পৃথিবী । ইশতার এর বাবা চন্দ্রদেব সিন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। তিনি পাতালদেশে সশস্ত্র বার্তাবাহক পাঠালেন । এদের ছিল যাদুকরী শক্তি। তারা যাদুর বশে ইশতারকে উদ্ধার করল। তামমুজকেও বাঁচিয়ে তুলল এবং মত্যে ফিরিয়ে আনল।
ব্যাবিলনে প্রতি বৎসর ইশতার এর পাতালগমন স্মরণে উৎসব পালন করা হত ।
ব্যাবিলনে দেবী ইশতার-এর উপাসনালয়ের নকশা। এঁকে দেবী ইশতারের অবতার মনে করা হত। নববর্ষে ‘পবিত্র বিবাহ উৎসব’ পালন করা হত। নারী পুরোহিত ব্যাবিলনের রাজার সঙ্গে যৌনমিলনে অংশ নিতেন ...কেননা, ইশতার দেবীর আর্শীবাদে বসন্তকালেই তো নবীন পত্রালীরা লাভ করে নবজীবন ...
ব্যাবিলন নগরের উত্তরপুবে- বাৎসরিক ধর্মীয় মিছিল যে পথে যেত- তার পাশে ছিল দেবী ইশতার-এর পীঠস্থানটি। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ব্যাবিলনে ইশতার উপাসনালয়টি তে খনন কার্য চালিয়েছেন। রাজকীয় প্রাসাদের আদলের মতো করে নির্মান করা হয়েছিল উপাসনালয়টি-যার ভিতরে রান্নাঘর ছিল, ছিল অভ্যর্থনা কক্ষ ও সুপরিসর প্রাঙ্গন, ছিল শয়নকক্ষ এবং উপাসনালয়ের অন্যন্য কর্মচারীদের ঘর। একটি শয়নকক্ষে থাকত (নারী) পুরোহিত।
সাদা ঘুঘু।
উপাসনালয়ের প্রাঙ্গনে ছিল অনেক সাদা ঘুঘু । দেবী ইশতার-এর প্রিয় পাখি ছিল সাদা ঘুঘু। (দেবী আফ্রোদিতিরও প্রিয় ছিল শ্বেত ঘুঘু) ... উপাসনালয়ে ঢোকার মুখে ছিল পিঠার দোকান। ইশতার ভক্তরা পিঠা কিনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঘুঘুদের খাওয়াত। ( কত বছর আগেকার কথা! পৃথিবীতে আজও পবিত্র থান ও পবিত্র পাখি কিংবা মাছেরা রয়ে গেছে! ) পরবর্তীকালে উপাসনালয়ে ওপরে তৈরি করা হয়েছিল ঘুঘু পাখির থাকার ঘর ।
দেবী ইশতার।
ঘুঘু পাখি ছাড়াও ইশতার এর উপাসনালয়ে ছিল গণিকা। এদেরও পাখিদের মতোই পবিত্র বলে গন্য করা হত। ‘উর্বরতার কৃত্যে’ এই পবিত্র গণিকারা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করত। তারা পুরুষদের অভ্যর্থনা জানাত এবং তাদের সঙ্গে যৌনসংগমে লিপ্ত হত। ব্যাবিলনিয় প্রথা অনুযায়ী- ব্যাবিলনের প্রতিটি মেয়েকে জীবনে অন্তত একবার ইশতারের উপসনালয়ে আগত অচেনা পুরুষকে দেহদান করতে হত। সেই অচেনা পুরুষটি মেয়েদের কাছে যেত, বাছাই করত, পছন্দ হলে পয়সা ছুড়ে দিত। তারপর মেয়েটি সেই অচেনা পুরুষটিকে দেহদান করেই তবে বাড়ি ফিরতে পারত। এই কারণে ওল্ড টেস্টামেন্টে (পুরনো বাইবেলে) ইশতারকে ‘ব্যাবিলনের গণিকা’ বলে অবহিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যাবিলন সাম্রাজ্যে দীর্ঘকাল দেবী ইশতার এর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে । সে সময় দেবী ইশতার-এর একটি বাণী ব্যাবিলনবাসীর মুখে মুখে ফিরত-
I TURN THE MALE TO THE
FEMALE. I AM SHE WHO
ADORNETH THE MALE FOR
THE FEMALE; I AM SHE WHO
ADORNETH THE FEMALE
FOR THE MALE.
আমি
পুরুষকে
রূপান্তরিত করি
নারীতে। (বাংলার শ্রীচৈতন্যদেব (ষোড়শ শতক) বলেছিলেন: আমার অন্তরে রাধা (নারী) বহিরঙ্গে কৃষ্ণ (পুরুষ) ...)
আমিই নারীর জন্য
সাজিয়ে তুলি পুরুষকে ...
আমিই পুরুষের জন্য
সাজিয়ে তুলি নারীকে ...
অতিমাত্রায় রক্ষণশীল আব্রাহামের বংশধর তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট রচয়িতাদের এসব ‘পৌত্তলিক’ কাব্য কুরুচিপূর্ণ ও জটিল ঠেকতেই পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৭ ব্যাবিলনের সম্রাট ২য় নেবুচাদনেযার জেরুজালেম নগর ধ্বংস করে হিব্রুভাষীদের ব্যাবিলনের বন্দি করে নিয়ে এসেছিলেন। সে সময় তারা ব্যাবিলন নগরে ইশতার উপাসনালয়ে অবাধ যৌনাচার দেখে ঘৃনা অনুভব করেছিল, যা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছিল। পরবর্তীকালে তারা পারস্যের সম্রাট সাইরাসের বদান্যতায় মুক্ত হয়ে তাদের স্বাধীন রাজ্যে ফিরে যায় এবং তাদের সম্প্রদায়ের হিব্রুভাষী নারীকে অন্ধকার বদ্ধ কুঠুরিতে ঠেলে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়।
বর্তমানকালের শিল্পীর চোখে খ্রিস্টপূর্ব যুগের ইশতার দরওয়াজার সামনে ব্যাবিলনবাসী । এদেরই প্রধান দেবী ছিলেন ইশতার।
ইশতার।
ইশতার।
তথ্য ও ছবি: ইন্টারনেট
Click This Link
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কে কাকে বিশ্বাস করবে?
করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।
সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়
গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন
বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন
সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?
আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?
রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন