অ মা।
কি হইলে?
মিনায় মোর মাথায় টাক দেসে।
অ মনু। তুই বুলির মাথায় টাক দেসো কা?
বুলি আমারে কয় ব্যঙের ছা। বলে হেসে ফেলে মিনা ।
হেসে ফেললেন জীবনানন্দ দাশও । বড় অনাবিল সে হাসি। এবং এ এক বিরল ঘটনা- যে কবি জীবনানন্দ দাশ হাসছেন। বছর পাঁচেক হল বিয়ে করেছেন কবি। কবি-স্ত্রী লাবণ্য দাশও কি কবির মুখে এরকম অনাবিল হাসি দেখেছেন কখনও? পাঁচ বছরের কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী অবশ্য খুব খিলখিলিয়ে হাসে। কন্যার হাসিমুখখানি দেখে কবি যাবতীয় বিষাদ ও উৎকন্ঠা নিমিষেই বিস্মৃত হন । মঞ্জুশ্রী কবির পরম আশ্রয় । কবিতাও, যুগপৎ লেখা ও প্রকাশ, কবির অশেষ শান্তির স্থল । এ বছর ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাখানি কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বরিশাল ও জীবনানন্দ সম্বন্ধে ভবিষ্যতের বাঙালির প্রগাঢ় কৌতূহল ও বিস্ময়ের কথা কল্পনা করে নিজস্ব কাব্যপ্রতিভার বিষয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী জীবনানন্দ দাশ এই মুহূর্তে মুচকি হাসেন।
কলাপাতার ফাঁকে উঠান। ঝলমলে রোদে একটি খড়ে-ছাওয়া মাটির ঘর। ত্রিপক্ষীয় কথোপকথন সেখানেই চলছিল। পূর্বাহ্ন। শিশুদের মা’টি দাওয়ার ওপর বসে বঁটিতে মাছ কুটছে। শিশু দুটি খেলা করছিল উঠানে । তারই এক ফাঁকে মিনা বুলির মাথায় টাক দিয়ে বসে । এবং তার অব্যবহিত সংলাপে কবি দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন। শিশু দুটিকে এবং ওদের মাকে পরম কৌতূকে অবলোকন করতে থাকেন । সেই সঙ্গে এক ঝাঁক প্রশ্নও উঁকি দেয়। মা ও শিশু দুটির ওই সংলাপ গভীর কোনও নিহিতার্থ বহন করে কি? সদূর নক্ষত্রলোকের প্রেক্ষাপটে জীবনের এইসব মামুলি কথার কি কিছু গভীর তাৎপর্য নেই ? এইসব প্রায় অনুল্লিখিত জীবনযাপন, তার শ্বাস-প্রশ্বাস, হাসিকান্না কি কেবলি সৌর প্রহেলিকা মাত্র?
কবি শ্বাস টানেন। বাতাসে খড় ও গোবরের মিশ্র গন্ধ। এইসব গন্ধ ফেলে আবার ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৩৫ সাল। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। আজ সকাল থেকেই আশ্বিনের রৌদ্র তার সোনালি রূপের ঝাঁপিখানি খুলে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অকারণ বিষন্নতায় আক্রান্ত ছিলেন কবি। তদুপরি অজ্ঞাত কারণে লাবণ্যর মুখখানি গোমড়া হয়ে ছিল । মা ও শিশুদের আলাপচারিতায় ক্ষণিক আমোদ পেয়েছেন কবি। তবে বিষন্নতা পুরোপুরি কাটেনি।
কলেজ আজ ছুটি। সাধারণত ছুটির দিনগুলোয় বরিশাল শহরের উপকন্ঠের গ্রামগুলো ঘুরে বেড়ান কবি। এ বছর বি.এম কলেজে জয়েন করে এই এক সুবিধে হয়েছে কবির,ছেলেবেলার গ্রামগুলোকে আবার নিবিড় পর্যবেক্ষনের আওতায় আনা যাচ্ছে। কতটুকু পরিবর্তন হল আলুথালু গ্রামগুলির? কীর্তনখোলার গা ঘেঁষে কত হাজার বছর ধরে জেগে আছে গ্রামীণ জনপদ। বৃষ্টিতে ভিজে, জোছনায় পুড়ে; ঝড়ে কিংবা হেমন্তের দ্বিপ্রহরে খাঁ খাঁ শূন্যতা বুকে ধারণ করে। আর কত কালই-বা টিকে রইবে? এই বোধ কবির স্নায়ূতন্ত্রে জাগ্রত করে বিপুল বিস্ময় । রূপসী বাংলার সবুজ জনপদ গভীর মমতা বিছানো। বাঁকে -বাঁকে মায়াবী হাতছানি। কুহক। আর তার চিরন্তন নির্জন প্রকৃতি। এসবই গভীর ভাবে অবলোকন আর পর্যবেক্ষণ করছেন কবি। আর সেই দেখা আর ভাবনা প্রকাশ পাচ্ছে স্বতস্ফূর্ত এক সহজ পঙতিতে-
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায়
জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন;
বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাংচিল শালিখের মতন স্বাধীন;
বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার;
একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার
বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে -নীল ধোঁয়া নরম মলিন
বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ;
ফেনসা ভাতের গন্ধে আম - মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার - বার;
ধুলিমাখা মেঠো পথটি খানিক উঁচু । তার দু’পাশে কালো জলের খাল। খালের পারে বিস্তীর্ণ সুপারি বন। সুপারি বনের প্রান্তে অনেকটা সবুজ ঘাসের মাঠ। শিশির মাখা সবুজ ঘাসেরা কবিকে টানে। গভীর ভাবে। আহা, নীরিহ সবুজ ঘাস। আশ্বিনের পূর্বাহ্নের বাতাসে দুলছে। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলো রোদের আলোয় যেন হিরকের কুচি।
উঁচু পথ থেকে নেমে কবি পায়ে পায়ে এগিয়ে যান আলোছায়ায় ঘেরা সুপারি বনের দিকে ...
কল্পচোখে দেখেন একটি হরিণ চকিতে সরে যায় খালপাড়ের দিকে । খালের কালো জলে একটি ভাসমান রাজহাঁস। গর্বিত। শুভ্র। খালের ওপারে হিজল আর তমালের বন। ওই বনে শঙ্খমালার বাস। আজ সে রূপসী আসিবে কি? বসিবে ঘাসের প’রে? আমার মুখোমুখি?
এই রকম একটি শিহরিত ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন কবি ।
আশ্বিনের নীলাভ আকাশের তলায় ১৯৩৫ সালের নির্জন দক্ষিণ বাংলা।
নির্জন ও রূপসী ।
সেই প্রগাঢ় নির্জনতা ঢুকে যায় কবির ভিতরে ...
একা একা দীর্ঘক্ষণ সবুজ ঘাসের বনে শুয়ে থাকতে ভালোবাসেন কবি। আজও ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন কবি । কবির পরনে কোঁচকানো ধুতি আর অপরিস্কার পাঞ্জাবি। তাতে ঘাসের শিশির কিছু লেগে যায়। লাগুক। ঘাসের মাঠে একটি শালিখ পাখি বসেছিল। পাখিটি এই মুহূর্তে উড়ে যায়। তারপর খালপাড়ের জামরুল গাছে বসে ইতিউতি চায়। পাশেই একটি বেলগাছ। তার ডালে বোলতার চাক। খালপাড় থেকে ঘন পানা আর শ্যাওলার গন্ধ ভেসে আসে। কবি চোখ বোজেন। মুখের ওপর সরাসরি রোদ এসে পড়েছে। আহ! অস্তিত্বের এই নিবিড় অনুভূতি। বুক ভরে শিশিরের গন্ধ মাখা ঘাসের আঘ্রান নেন কবি। কবি শৈশবেই জেনেছেন সবুজ রংটির নিজস্ব গন্ধ রয়েছে। চোখ বুজে অনেক অনেকক্ষণ কবি পড়ে থাকেন। অসাড়। তবে বোধহীন নয়। কেননা, কবির মননে গুঞ্জরিত হতে থাকে রূপসী বাংলাকে নিবেদিত আশ্চর্য সব পঙতিমালা:
আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক - পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, - চলে গেল কবে যে নীরবে,
তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত - অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি নাকো - কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে,
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল - হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা করে গেছে তারা কত দিন ....
উৎসর্গ: মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বুথ সিলি। যিনি জীবনানন্দকে নিয়ে ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’ শিরোনামে একখানি ধ্রুপদি বই লিখেছেন। এবং ফারুক মঈনউদ্দীন-যিনি বইখানি বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:১১