somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

০৫ ই মে, ২০১২ দুপুর ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জন্মেছি ঢাকায় । বেড়ে উঠেছি ঢাকায় । কিন্তু চট্টগ্রাম শহরটিও যেন আমার আরেক ‘জন্মশহর’। এখন তো আর চট্টগ্রাম তেমন যাওয়া হয় না। অথচ ছেলেবেলায় বছরে অন্তত দু-তিনবার চট্টগ্রামে ‘চাচারবাড়ি’ যাওয়া হত। কী সুন্দর সুন্দরই ছিল শৈশব-কৈশরের সেইসব আনন্দময় দিনগুলি !
আমি গত শতাব্দীর সত্তর দশকের কথা বলছি। তখনকার দিনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতাম ট্রেন চেপে। সারারাত কুউউ ঝিকঝিক করে ট্রেন চলত। সকালবেলায় চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে ট্রেন থামত। আমি এতই ছোট যে আমাকে ট্রেনের জানলা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হত। বিশালদেহী বড়চাচা কিংবা বড় চাচাতো ভাই আমাকে দুহাতে জাপটে ধরতেন। তারপর স্টেশনের ভিড় ঠেলে রিকশার জটলার দিকে চলেছে আরেকটা ছোট্ট ভিড়। আমরা রিকশায় উঠতাম। বাক্সপ্যাটরাও সব তোলা হত রিকশায়। রিকশাটা ঠোক্কর খেতে খেতে প্রায় ফাঁকা রাস্তা ধরে এগোতো। আমি বিস্ময়ঠাসা চোখে চারপাশে তাকাতাম। দেখতাম, চিটাগাঙ শহরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি আর দোকানপাট। তারপর কখন যে রিকশাটা বাংলাদেশ বিমান অফিসের পাশের একটা সরু ঢালু গলিতে ঢুকে যেত ।
আমরা জামাল খান লেইনে পৌঁছে যেতাম।
দেওয়াল আর সুপারি গাছে ঘেরা বেশ খানিকটা জায়গা। তারই ওপর পাশাপাশি একটি টিনসেড আর একটি পাকা দোতলা দালান। বড় চাচারা টিনসেড আর পাকা দালান মিলিয়ে থাকেন। পাকা দালানের একাংশ অবশ্য ভাড়া দেওয়া ছিল। আমি কখনও এবাড়ি, কখনও ওবাড় করছি। দু-বাড়িতেই লোকজনের ভিড়। তার অবশ্য কারণ ছিল। বড় চাচার দুই বিয়ে। দুই ঘরেই অনেকগুলি করে ছেলেমেয়ে। যে কারণে জামাল খান লেইন- এর দুটো বাড়িতে সারাক্ষণ হইহই লেগেই আছে। জানু এবং নাছিম আপা আমার দুই চাচাতো বোন । তাদের শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। তারা প্রায়ই তাদের বরদের নিয়ে চট্টগ্রাম আসতেন। দুলাভাইয়ের সঙ্গে হয়তো কুমিল্লার কোনও আত্মীয়। এসবই সেই জামাল খান লেইন- এর বাড়ির জনসংখ্যার আধিক্যের কারণ।
বড় চাচার দুই বিয়ে হলেও রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া হত একই সঙ্গে। বাইরে থেকে দুটি পরিবারের পার্থক্য একেবারেই বোঝা যেত না। পার্থক্য আসলে ছিলও না। অনেক বছর পর অবশ্য দুটি পরিবার বিরোধ প্রকট হয়ে উঠেছিল, সেই নব্বুয়ের দশকে। সে কথার ইঙ্গিত এই লেখার শেষে রয়েছে ...
দুই চাচী যেন পাল্লা দিয়ে আমাদের আদর করতেন। একজন গোছল করিয়ে দিচ্ছেন তো, আরেকজন কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছেন। বড়চাচীর রান্নার হাত ছিল চমৎকার। চট্টগ্রামে পোয়ামাছটি বরাবরই খুব পপুলার। বড় চাচী আলু-পটল দিয়ে চমৎকার পোয়ামাছ রাঁধতেন। তারপর কাঁটা বেছে বেছে খাইয়ে দিতেন। আমার তখন মনে হত ... বড়রা তো ছোটদের আদর-স্নেহ করবেই । এখন বুঝি যে ... কী এক পরম সৌভাগ্যবশত সেই শৈশব-জীবনে ক্ষণিকের তরে হলেও মহামহিম ঈশ্বরের ইচ্ছায় এই পৃথিবীতেই অনন্ত স্বর্গের রূপ দেখেছিলাম ...
চাচাতো ভাইদের মধ্যে মাহাবুব ছিল আমারই সমবয়েসি । কাজেই ওর সঙ্গেই মিশতে হত বেশি। মাহবুব আবার বেশ পড়ুয়া টাইপ ছিল। সারাক্ষণ মুখে শুধু পড়ার কথা। আমার অসহ্য লাগত! কীভাবে বইয়ের মলাট দিতে হয় তাই আমাকে সবিস্তারে শেখাত। কোন্ টিলার ওপর কোন্ ভালো ছাত্র থাকে, সেখানে আমায় নিয়ে যেত। আমার সারাক্ষণ পড়াশোনা অত ভাল লাগত না। আমার মন পড়ে থাকত বাটালি হিলের ওপর। মাহাবুবের সঙ্গে ভোরবেলা উঠে হাঁটতে বেরোতাম। জামাল খান লেইন-এর গলি দিয়ে বেড়িয়ে ডান দিকে হাঁটতে হাঁটতে কাজীর দেউড়ি, তারপর বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে দিয়ে একটা গাছের ছাওয়া মোড় পড়ত; তারপর সে মোড়ের বড় রাস্তা (সম্ভবত এশিয়ান হাইওয়ে) পেড়িয়ে একটা কলোনির পাশ দিয়ে হেঁটে দুজনে ছোট একটা টিলায় উঠে পড়তাম। মাহাবুব বলত, বাটালি হিল।
বাটালি হিলে উঠে আনন্দে আমার শরীর কাঁপত ...
কখনও জামাল খান লেইনের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা গলিপথ ধরে বিখ্যাত আশকার দিঘীর পাড় দিয়ে হাঁটতাম।
ডিসি হিল, লাভ লেইন, ব্রডওয়ে (একটা দোকানের নাম সম্ভবত) এসবই ছিল আমার ছেলেবেলার প্রিয়শব্দ।
চট্টগ্রামের নাহার বিল্ডিংয়ে আমাদের কোনও আত্মীয় থাকতেন সম্ভবত। সন্ধ্যার পর হু হু বাতাসের ভিতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিন্দু বিন্দু আলোয় ভরা কর্ণফুলি নদীর দিকে চেয়েছিলাম মনে পড়ে।
বড় চাচার সেজছেলে মামুন ভাই। তিন বয়েসে আমার চে কয়েক বছর বড়ই হবেন। বেশ লম্বা। গায়ের রং শ্যামলা। আর স্বাস্থ্যবান । পাড়ায় তারই দাপট। তারই বন্ধুবান্ধবরা বিকেলে ফুটবল খেলত। স্টেডিয়ামের পাশে যে মাঠ ছিল সে সময়, সেই মাঠে। আমিও ওদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। ঢাকার পাড়ার ক্লাবে গোলকিপার ছিলাম। ডাইনে-বাঁয়ে শূন্যে ঝাঁপিয়ে বল ধরার কায়দা শিখেছিলাম। তা প্রয়োগ করতেই সবাই অবাক হয়ে যেত।
মাঠের কিনারে বসে থাকা মাহাবুবও বোধ হয় আমার উড়ন্ত দক্ষতায় অবাক হয়ে যেত। মাহাবুব অবশ্য ফুটবল খেলত না। ও বিকেলে মাঠের কিনারায় বসে থাকত। মাহাবুব পরবর্তীতে অনেক বড় ডাক্তার হয়েছে, এর সঙ্গে ওর ছেলেবেলায় ফুটবল না-খেলার কোনও সর্ম্পক আছে কিনা বলতে পারি না।
মাহাবুব আমার সমবয়েসি হলেও মাহাবুব আমাকে কখনও সেভাবে টানত না। আমাকে টানত মামুন ভাই। এর একটা কারণ হয়তো মামুন ভাই শিল্পসাহিত্যের অত্যন্ত তুখোর সমঝদার ছিলেন। এই মোলায়েম বিষয়টি আমার পিতার গোত্রের মানুষদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। অথচ মামুন ভাই কী সুন্দর উচ্চারণ করেই না কবি নির্মলেন্দু গুণের আগুন-ঝরা কবিতা আবৃত্তি করতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ওই ছোটবয়েসেই আমি আর্টকালচার বেশ পছন্দ করতাম। এটাই ছিল মামুন ভাইয়ের প্রতি আমার আকর্ষনের অন্যতম কারণ। ঢাকার উইলস লিটিল ফ্লাওয়ার স্কুলে পড়তাম। আমি ছিলাম কায়েস আহমেদ-এর প্রিয় ছাত্র। এরি মধ্যেই তো সবাই জেনে গেছে যে কায়েস আহমেদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত উঁচুদরের একজন সাহিত্যিক। আমার সহিত্যবোধ তিনিই জাগ্রত করেছেন, তিনিই পরিশীলিত করেছেন। কাজেই আমি শিল্পঅনুরাগী মামুন ভাইয়ের পায়ে-পায়ে ঘুরতাম। ওনার বন্ধুদের সঙ্গেও মিশতাম। অবশ্য মামুন ভাই যখন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন তখন আমি সেই ভাষার বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারতাম না। অথচ আমি যেখানেই গিয়েছি- রাজশাহী কি বরিশাল-সেখানকার ভাষা কয়েকদিনের মধ্যেই মোটামুটি আয়ত্ম করতে পেরেছি, আমি কেবল চট্টগ্রামের ভাষাই আত্মস্থ করতে পারিনি!
মামুন ভাইয়ের সঙ্গে এখানে-ওখানে যেতাম।তখন মনে হয় ক্লাস টেনে পড়ি। আন্দরকিল্লার কাছে এক টিলার ওপর একটা বাড়িতে আড্ডা বসত। আড্ডার ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। ভাষা পুরোপুরি বোঝা কঠিন ছিল ঠিকই, তবে আড্ডার পরিবেশ এবং চায়ের স্বাদ চমৎকার ছিল। আরেকবার। বৃষ্টি সন্ধ্যায় কোন্ এক কলোনিতে গেছি মামুন ভাইয়ের এক বন্ধুর বাড়ি। সেই বন্ধুর মায়ের হাতের রান্না খিচুড়ি খেলাম। অপূর্ব স্বাধ। আজও মনে আছে। তার পর থেকে কেউ চট্টগ্রামের রান্নার বদনাম করলে আমার গায়ে লাগে!
সে যাই হোক। একবার মামুন ভাই আর আমি রিকশা করে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে একটা টিলা দেখিয়ে মামুন ভাই বললেন, ওই যে চিটাগাং কবরস্থান। ওখানে আমাদের দাদার কবর। কথাটা শুনে আমার বুকটা দুলে উঠল।
আমাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় । পূর্বপুরুষের জমিজমা ভালোই ছিল। আমার দাদা ফজর আলী পাটোয়ারী কৃষিকাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তার মানে আমার দাদা কৃষক ছিলেন। হয়তো তিনি ছেলেদের শিক্ষাদীক্ষার কথা ভেবেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে বড় ছেলেকে পড়াতে পাঠালেন চট্টগ্রাম শহরে। আমার বড়চাচা, আবদুল হাকিম পাটোয়ারী- পড়াশোনা শেষ করে রেলওয়েতে চাকরি নিলেন। জামাল খান লেইনের জমি সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকেই কেনা হয়েছিল। বড়চাচা গ্রাম থেকে ছোট দু-ভাইকে জামাল খান লেইন-এর বাড়িতে নিয়ে এলেন । আমার আব্বা পড়তেন চট্টগ্রাম কলিজিয়েট স্কুলে। মেজচাচাও সম্ভবত ওই স্কুলেই পড়তেন। বড় চাচা দুই ভাইকে অসম্ভব ¯েœহ করতেন। কোলেপিঠে করে মানুষ করা বলতে যা বোঝায়, রীতিমতো তাই করেছেন। ছেলেবেলায় আব্বার মুখে শুনেছি, আব্বা আর মেজচাচাকে বড়চাচা দুই উরুর ওপর বসিয়ে মাছের কাঁটা বেছে খাইতে দিতেন। পরবর্তীকালে আব্বা ‘ল’ পড়লেন। মেজচাচা মেডিকেলে। তার অনেক আগেই একবার দাদা হজে গেলেন। ফেরার পথে জাহাজে কলেরা হল। দাদা ভীষণ কাহিল হয়ে পড়লেন। জাহাজ থেকে সরাসরি মেডিকেল। আর সুস্থ হলেন না ... আমার দাদাকে চট্টগ্রাম কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল।
এভাবে চাঁদপুর জেলার একটি পরিবার অজ গ্রাম ছেড়ে এসে একটা বন্দরনগরের মাটিতে তার শিকড় ছড়িয়েছিল ...
বড় চাচা বাদেও আমার মেজচাচার বাড়িও ছিল চট্টগ্রামে। মেজ চাচা ছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের ডিএমও ( ডিভিশ্যনলাল মেডিকেল অফিসার)। মেজ চাচাকে আমরা ‘ডাক্তারচাচা’ বলে ডাকতাম। ডাক্তারচাচার কোয়ার্টার ছিল জামাল খান লেইন-এর কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যেত, একেবারে স্টেডিয়ামের ধার-ঘেঁষে। আমরা চাচাচো ভাইবোনেরা দলবেঁধে ডাক্তারচাচার বাসায় যেতাম। রাস্তা থেকে উঁচু পথ উঠে গেছে। দু’পাশে ইউক্যাপিলটাস গাছ। পাখির ডাক। রোদ। বাড়ির সামনে সাদা রং করা কাঠের বেড়া। তাতে বেগুনি রঙের ফুল। ওপাশে সবুজ রং করা টিনসেডের সুন্দর বাড়ি। দেওয়ালে সবুজ রং করা বড় বড় রুম। পিছনে সার্ভেন্টস কোয়ার্টাার। গরুও ছিল। ডাক্তার চাচার বাসায় যাওয়ার প্রধান এক আকর্ষন ছিল গরুর খাঁটি দুধ!
ডাক্তারচাচার ছেলে নেই, আট মেয়ে। পাপড়ি, কলি, বেলি, মলি, ঝুমুর, সংগ্রামী, শাপলা ও শিমূল। একটা ছবি আবছা মনে ভাসে। একটা ছোট ঘরে অনেকগুলি মেয়েদের জুতা; ফ্ল্যাট, হাইহিল। আর যে ঘরে আমার চাচাতো বোনেরা থাকত সেই ঘরজুড়ে ট্যালকম পাউডারের গন্ধ। তখনই শুনেছি ডাক্তারচাচা আর চাচীর যখন ছেলে নেই, তখন আমাকেই নাকি তারা ছেলে হিসেবে গ্রহন করবেন । এসব কারণেই হয়তো আমার এক ধরনের হামবড়া ভাব জন্মে থাকবে। আমার জন্য স্পেশাল গ্লাসে আসত স্পেশাল দুধ। আমি হয়তো গম্ভীরভাবে চুমুক দিতাম সেই স্পেশাল দুধের গ্লাসে। খাওয়ার সময় ডাক্তার-চাচী এসে খাওয়ার টেবিলে বসতেন । চাচী এমনিতেই ভীষণ আয়েসী। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়েই থাকতেন । আর শুয়ে থাকবেন না কেন? সরকারি কোয়াটারে চাকরবাকরের তো অভাব নেই।
ডাক্তার চাচার মেয়েদের মধ্যে সংগ্রামী হয়েছিল চাঁদপুরের গ্রামের বাড়ি; উনিশশো একাত্তর সালে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর ক’টা মাসে ছায়াঘেরা দাদুবাড়ির আমাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিল। আমার বয়েস তখন চার বছর। ওই সময়কার ঘটনা পরবর্তীকালে আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বাপ-চাচার ভীষণ উৎসাহ ছিল। কাজেই যখন মেজচাচার মেয়ে হল তখন সদ্যজাত কন্যার নাম রাখা হল: ‘সংগ্রামী’। অনেক বছর পর সংগ্রামী সেই নাম বদলে ফেলেছিল। একটা মেয়ের জন্য নাকি ‘সংগ্রামী’ নামটি মাননসই নয়। সংগ্রামী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নব্বুয়ের দশকে, যখন আমার বাপ-চাচারা কেউই বেঁচে নেই ...

আমার ছেলেবেলার দিনগুলিতে, মনে আছে, ঢাকার মতোই চট্টগ্রামেও পাড়া-প্রতিবেশিদের সঙ্গে মানুষে সুসম্পর্ক ছিল। মনে আছে চট্টগ্রামের জামাল খান লেইন- এর ভাড়াটেদের সঙ্গেও আমার চাচারবাড়ির সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ট ছিল। দোতলার এক ভাড়াটে মহিলাকে আমার চাচাতো ভাইবোনেরা ‘ভাবী’ বলে ডাকত। শ্যামলা রঙের দারুন প্রানবন্ত মহিলা। ওনাদের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। ওটা নিয়ে এসে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে গান শুনতাম। আমাদের ঢাকার বাড়িতে তখন ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। কথাটা আজ হাস্যকর শোনালেও সত্যি যে- সেই সত্তরের দশকে কিংবা আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের অনেক পরিবারে নিছক একটি ক্যাসেট প্লেয়ার অত্যন্ত মহার্ঘ বস্তু ছিল। আমরা মান্না দে-র গান শুনতাম । তখন মাত্তর ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। ওই বয়সেই বিভোর হয়ে মান্না দে-র শুনতাম। একটা গানের কথা মনে আছে-

চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে
সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে,
আকাশ করে ছাদটাকে বাড়াই যদি হাতটাকে
মুঠোয় ধরি দিনের সূর্য তারার রাতটাকে।

কিংবা,

এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি
মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায় ...

সেই সময়ে আমার হৃদয়ে ভালোবাসার অনুভূতি উথলে উঠেছিল কিনা তা ঠিক বলতে পারি না, তবে গানের সুরে আকূল হয়ে উঠতাম।
দরদ ভরা এক-একটা গান। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমার সংগীতশিক্ষা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে আমার মনের ওপর পড়ে থাকা একটি পরদা যেন সরে যাচ্ছিল। বালকের নির্মল হৃদয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল যাদুময়ী বাংলা গানের সুর। প্রোথিত হচ্ছিল সংস্কৃতির প্রাথমিক দীক্ষা। সেই অপার্থিব গানের সুরের ছোঁওয়ায় যেন এ কটা গোটা দুনিয়া খুলে যাচ্ছিল। এভাবে চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান লেইন- এর এক ভাড়াটে বাড়ির সামান্য একটি ক্যাসেট প্লেয়ার আমার শৈশবের আনন্দের এক তীব্র উৎস হয়ে উঠেছিল।
আমার আরও একটি বেশ আশ্চর্য ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সেই ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকত এক বুড়ি। বাচ্চাদের দেখাশোনা করত। সে বুড়ি আমাদের প্রায়ই গল্প বলত। আমরা, অর্থাৎ ছোটরা, মেঝের ওপর গোল হয়ে বসে গল্প শুনতাম। একটা গল্পের কথা মনে আছে। এক জমিদারের এ হাতি ছিল। জমিদারের ছোট মেয়ে সেই হাতি পছন্দ করত। একদিন সেই হাতি মারা গেল ... তারপর সেই ছোট মেয়ের কী কান্না কী কান্না। আমার মনে হয়েছিল, এই গল্পটা লেখা দরকার। তখন আমি মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার কেন মনে হয়েছিল যে গল্পটা লিখে রাখতে হবে? তাহলে কি আমি লেখকমন নিয়ে বেড়ে উঠছিলাম?
চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে যাবার একটি উল্লেখযোগ্য স্পট হল পতেঙ্গা সমুদ্রসৈতক। পরিবারের বড়দের সঙ্গে যেতাম পতেঙ্গা । হয়তো কুমিল্লা শহর থেকে চাচাতো বোনের বর এসেছেন । হয়তো সেই দুলাভাইকেই পতেঙ্গা নিয়ে যেতে ধরে বসলাম । সাধারণত যেতাম দুপুরের পর। বিমান অফিসের ঠিক সামনে ছিল বেবি ট্যাক্সির স্ট্যান্ড । দরদাম করে রওনা হতাম। তখনকার দিনে বেবিট্যাক্সি তে মিটার লাগানো ছিল বলে আবছা মনে পড়ে যেন। শহর ছাড়িয়ে লোনা হাওয়ার র্স্পশ পেলেই মনটা ভীষণ আনন্দে ভরে উঠত। সৈকতে দাঁড়িয়ে দেখি ঘোলাপানির অথই বিস্তার । বেলাভূমিতে অনেক পাথর। পাথরের ওপর বসে থাকতাম। অনেক ক্ষণ। তখনকার দিনে সৈকতে এত ভিড় ছিল না । আবার একেবারে ফাঁকাও ছিল না। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান ছিল ঠিকই, তবে আজকের দিনের মতন সি-বিচ ঘিরে এত উন্মাদনা তৈরি হয়নি।
চট্টগ্রাম শহরে আমার আরেকটি আনন্দের উৎস ছিল ফয়েজ লেক। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষবার ফয়েস লেক গিয়ে আমি আমার পুরনো ফয়েস লেক খুঁজে পাইনি। সত্তর এবং আশির দশকের ‘কুমারী’ ফয়েস লেক- এর সৌন্দর্যই ছিল অন্যরকম। ভারি নির্জন। বিশেষ করে সেই হাফব্রিজটি ছিল গভীর নির্জনতায় ডুবে। হ্রদের পানি তিরতির করে কাঁপত। তাতে আকাশের ছায়া। ছেলেবেলা থেকে যে ফয়েজ লেক ক’বার গিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই।
ছেলেবেলায় যেমন ঘুরতাম তেমন পড়তাম। আমি গল্পের বইয়ের কথা বলছি। জামাল খান লেইন-এর চাচার বাড়িতেও নানা ধরনের বই ছিল। একবার। মনে আছে, রোজার সময়। মন্থর দিনগুলি সব ভীষণ অলস্যে কাটত। বিমল মিত্রর উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ পড়া শুরু করলাম। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। মনে আছে, পড়ে দু-পর্বই পড়ে শেষ করছি। অতটুকুন বয়েসে ওই ঢাউশ বই দুটো পড়ে শেষ করে ফেলেছি বলে সাইফুল ভাই ভারি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
আমার কেন যেন মনে হয় এই বই পড়ার অভ্যেস আজও আমার মধ্যে রয়ে গেছে বলে জীবন আমার কাছে আজও সেভাবে বিবর্ণ হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আমার ছেলেবেলার সেই জামাল খান লেইনের বাড়ি দুটো আজ আর আর আগের মতন নেই। অনেকটাই বিবর্ণ হয়েছে গিয়েই । এখন ওই গলিতে হেঁটে গেলে আমার ছেলেবেলাকে আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। টিনসেডের বাড়িটিও আজ আর নেই। ওখানে নাকি ফ্ল্যটবাড়ি উঠেছে।
এ লেখার গোড়াতে একবার বলেছি ... আমার বড় চাচা দুই বিয়ে। দু-পক্ষের ছেলেমেয়েরা নাকি বিরোধের জের ধরে নাকি দুটি বাড়ির মাঝখানে একটি দেওয়ালও তুলেছিল। সেই নব্বুইয়ের দশকে।
১৯৯৮ সালে আমার মা মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে আম্মা আমাকে একটি বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছিলেন। কথায় কথায় আম্মা একদিন আমাকে বললেন, চিটাগাংয়ের জামাল খান লেইনের জমি তোর বড় চাচার কেনা না তোর দাদার কেনা ।
শুনে আমি রীতিমতো চমকে উঠেলিাম। কেননা, ছোটবেলা থেকে আমরা চট্টগ্রামের বাড়িকে কখনও বলি না ‘দাদাবাড়ি’, সব সময় বলে এসেছি ‘চাচারবাড়ি’।
আম্মা বললেন, তোর বড় চাচা ওনার ছোট দুই ভাইকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন বলে তোর আব্বা আর তোর ডাক্তার চাচা কখনও তাদের বাবার জমির ভাগ চায়নি ...
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১২ দুপুর ১:৫৮
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×