somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমানের নবীনদের তুলনায় আমাদের সমসাময়িক জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের বই পড়ার অভ্যাস ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক বেশীই। নতুন একটা বই হাতে এলে কি করে যে সেটা শেষ করা যাবে সেটাই ছিলো তখন অনেক বড় চিন্তা। স্কুলে ব্যাকবেঞ্চে বইয়ের ভাজে লুকিয়ে ধরা পড়ে স্যারের বেতের বাড়ি খাওয়া , বিকেলে পড়ার টেবিলে হোমওয়ার্ক এর খাতার আড়ালে কেউ টের নাপানমতো সন্ত্ররপনে পাতা উল্টানো, রাতে বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ার স্মৃতিগুলো আজো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে। এইসময়ের ক্লাস টু থ্রিতে পড়া আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবীদের সারাদিন বাসায় বসে ট্যাবে গেইম খেলা ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে তাই আসলে হতাশাই জাগে।

ঘরদৌড়ের খেলায় এগিয়ে থাকার জন্য এখনকার পিতামাতারা সন্তানদের যেভাবে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছেন , আর পেছনে নিজেরাও যেভাবে ছুটে চলেছেন আর নিজেরাও সমানতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন পিছু পিছু দিনরাত , তাতে আসলে শংকাই জাগে এভাবে সমানে ছুটে বেড়িয়ে উনারা "মানুষের মতো মানুষ " বানানোর বদলে সত্যি সত্যিই না আবার "ঘোড়া"ই বানিয়ে ফেলেন শেষ পর্যন্ত। নাহলে কমিক্স পড়ার আর ফুটবলে লাথি হাকানোর বয়সে হাতে ট্যাব তুলে দেয়ার মানে হয়না।

যাইহোক , মূল প্রসঙ্গে ফেরত আসি। বলছিলাম ছোটবেলার বই পড়ার স্মৃতির কথা। সেটা ছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সরলতাপূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট অধ্যায় কৈশোরের সময় , জীবনের জটিলতার ধারেকাছেও ছিলামনা তখন। সেটা খেলার মাঠে হউক , টিভিতে দেখা থাণ্ডার ক্যাটস বা নিনজা টার্টেলদের কার্টুনেই হউক , কিংবা কমিক্স বা গল্পের বইয়ের পাতাতেই হউক। শুরুর দিকে ছিলো কমিক্সের দাপট। ক্লাসে একজন একটা নতুন কমিক্সের নাম বলতো , আর বাসায় ফিরেই সেটা কিনে দেয়ার জন্য বাবামার সাথে শুরু হতো আব্দার আর কান্নাকাটি। চাচা চৌধুরী , ফ্যান্টম , ম্যানড্রেক , হাদাভোদা , টিনটিন আর নন্টেফন্টেরা এভাবেই আবিষ্ট করে রেখেছিলো আমাদের বেশিরভাগের শৈশব। অবশ্য স্কুলের পড়ার বাইরে একটা ম্যাগাজিনের পাতাও কখনো উল্টে নাদেখা সহপাঠীও ছিলো কিছু। কিন্তু সেটা হাতেগোণা নগণ্য কয়েকজন।

ক্রমেই যত বছরে পেরোতে লাগলো , আর ক্লাস টপকাতে লাগলাম , ততই কমিক্সের উত্তেজনা ক্রমশই মিইয়ে যেতে শুরু করে। আর সেই জায়গা দখল করে নিতে শুরু করে গোয়েন্দা কাহিনী আর সায়েন্স ফিকশান। সেই বয়সে তিনটি মানুষের লেখার জন্য আমি তাঁদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। কারণ এই মানুষগুলোর লেখা হাতে না আসলে হয়তো বই পড়ার আগ্রহ অঙ্কুরেই হারিয়ে যেতো। অভ্যাস আর গড়ে উঠতোনা। এরা হলেন এডভেঞ্চার কাহিনীতে সত্যজিৎ রায় আর , গোয়েন্দা সিরিজে রকিব হাসান আর সায়েন্স ফিকশনে ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। সত্যজিৎ এর ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কু , রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা আর জাফর ইকবাল স্যারের সায়েন্স ফিকশন প্লাস "হাকারবিন" "জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়" এর মতো কিশোর উপন্যাস গুলো রীতিমতো মাতিয়ে রেখেছিলো আমাদের কৈশোরকে। বন্ধুরা একজনের বই পড়া শেষ হলে আরেকজনের আরেকটার সাথে বিনিময় করে পড়তাম।

আমার একটা সুবিধা ছিলো আমার স্কুল শিক্ষিকা মার নিজেরও পড়ার নেশা ছিলো। একটা মোটামুটি ভালো কালেকশনও ছিলো তাঁর্। তাই ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই হাতে নেয়ার সূযোগ হয়েছিলো শরৎকাহিনী। পরিচয় ঘটেছিলো তাঁর প্রিয় লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত , রোমেনা আফাজ , আগাথা ক্রিস্টি আর শার্লক হোমসের অনুবাদ , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , সুনীল , শীর্ষেন্দু আর সর্বোপরি কবিগুরুর সাথে। এটা অবশ্যই ছিলো আমার ব্যক্তিগত বিরল সৌভাগ্য। ওই বয়সে সচরাচর বেশীরভাগ কিশোরের সেটা থাকেনা। কিন্তু তারপরও মন বারবার ঘুরপাক খেতো সত্যজিৎ , রকিব হাসান আর জাফর ইকবাল স্যারকে ঘিরেই।

সম্ভবতঃ অস্টম কি নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই আমাদের এক বন্ধু স্কুল ব্যাগে করে লুকিয়ে আনেন আমাদের কাছে অপরিচিত এক নতুন লেখকের বই। বইটির নাম "শ্রাবণ মেঘের দিন" আর লেখকের নাম ,

হুমায়ূন আহমেদ।

সেই থেকে শুরু। এরপর যে মিতালী গড়ে উঠেছিলো হুমায়ূন সাহিত্যের সাথে তা আর ছিন্ন হয়নি কখনো। কলেজ থেকে ফিরে অলস সন্ধ্যায় , ভার্সিটিতে আসা যাওয়ার পথে শাটল ট্রেনে , দূরপাল্লার যানবাহনে হুমায়ূন ছিলেন আমাদের প্রজন্মের নব তারুণ্যের এক অবিচ্ছেদ্য সাথী। যখন শুনতে পেতাম তাঁর কোনো নতুন বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে , তখনই ছুটে যেতাম বইয়ের দোকানে অগ্রীম বুকিং দিতে। বইমেলায় এসে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি মারামারি করে বগলদাবা করতাম হিমু , মিসির আলী আর শুভ্রদের্। সেসময় হিমু হওয়ার একটা ট্রেন্ডই শুরু হয়ে গিয়েছিলো দেশ জুড়ে। রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই চোখে পড়তো হলুদ পাঞ্জাবি পড়া খোঁচা খোঁচা দাড়ির কোনো যুবক উদাস নয়নে হেটে যাচ্ছে রাজপথ ধরে। হিমু চরিত্রের প্রভাব এতোটাই ছিলো বিস্তৃত। জীবনে পৃথিবীবিখ্যাত অনেক নামীদামী সাড়াজাগানো লেখকের দর্শন , সাহিত্য , যুক্তিবিদ্যা নিয়ে অনেক লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু প্রথম প্রেমের মতোই হুমায়ুনের সৃষ্টিকর্মের জন্য বরাদ্দকৃত বিশেষ স্থানটি আজো সযতেই আছে হৃদয়ের মণিকোঠায়।

এতো গেলো বইয়ের কথা। তাঁর লিখিত নাটকগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো সারা দেশের দর্শকদের মাঝে।তাঁর মতো "সেন্স অফ হিউমার " সম্ভবত এতো সার্থকতার সাথে আর কেউই প্রয়োগ করে দেখাতে পারেননি। হাস্যরসের আড়ালে অনেক কঠিন কথাই তিনি বলে গেছেন প্রচ্ছন্নভাবে। বিশেষ করে "বহুব্রীহি" নাটকটির কথাই বলি। ৭৫ এর পর হতে বিটিভির অনুষ্ঠানে "রাজাকার " "আলবদর" "হানাদার বাহিনী " এই সকল শব্দ ব্যবহার করাই নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু সেই বহুব্রীহি নাটকে তিনিই প্রথম টিয়া পাখি প্রশিক্ষণের নামে বিটিভিতে পাখির বুলিতে উচ্চারণ করিয়েছিলেন ,

"তুই রাজাকার , তুই রাজাকার "

এরই নাম সৃজনশীলতা। এরই নাম সত্যিকারের শক্তিশালী কলমের কালজয়ী লেখকের লেখার ক্ষমতা। যা একমাত্র হুমায়ূনের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিলো। এই ক্ষমতাই তাঁকে এনে দিয়েছিলো "নন্দিত কথাসাহিত্যিক" এর উপাধি। আর প্রাণভরে পেয়েছিলেন আমাদের প্রজন্মের দেশজুড়ে আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ ভক্তদের বুকভরা ভালোবাসা। বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে পাঠকদের এতোটা ভালোবাসার লেখক আর কারো পক্ষেই হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। অদূরভবিষ্যতেও তার সম্ভাবনা আছে কিনা জানিনা।

আজ সেই নন্দিত কথাসাহিত্যিক এর জন্মদিন। জন্মদিনে তাই একজন নগণ্য ভক্ত হিসেবে এই মহান সাহিত্যস্রষ্টাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলাম।

শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ :-)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:২৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×