somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

০৭ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
--প্রভাষক বি.এইচ.মাহিনী*
পরীক্ষক-ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও জাতির রক্তিম সূর্যের আভা। একটি লাল-সবুজের পতাকা। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি সত্যিই বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের। ৩০শে অক্টোবর সোমবার ২০১৭ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ তালিকার মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে। একটি ভাষণ একটি জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে, হয়ে উঠতে পারে আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক। একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষণ বা বক্তৃতার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন কারণে এসব ভাষণের কোনো কোনোটি আবার ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এসব ভাষণ ছিল আলোকবর্তিকার মতো, যা ক্রান্তিকালে মানুষকে দিয়েছে মুক্তির পথ।
ভাষণের প্রেক্ষাপট : একাত্তরের ৭ মার্চ। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ৩ মার্চে নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন ভেঙে দেওয়া, দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলন ও হরতাল, জনগণের প্রত্যাশার চাপ, সব মিলিয়ে জীবনের এক কঠিন দিন পার করছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজন করা হয় বিশাল জনসমাবেশ। ওই দিন দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গেলেন একটু বিশ্রামের জন্য। প্রিয়তমা স্ত্রী পাশে বসলেন পানের বাটা নিয়ে।
সহজ-সরল এই গৃহবধূ নিজ স্বার্থ আর সন্তানের মায়া ত্যাগ করলেন দেশের মায়ায়। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাউকে ভয় করবে না। দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার যা বলা উচিত তাই বলবে, নিঃসংকোচে বলবে, নির্ভয়ে বলবে। সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করল প্রিয়তমা স্ত্রীর এই অনুপ্রেরণা। বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দান তখন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে৷ আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনায় স্লোগান মুখরিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সামনে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘মাইকটা দে’। তারপর শুরু করলেন তার কিংবদন্তিতুল্য ভাষণ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিন্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর৷ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন৷ সবার হাতে ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা৷
ভাষণের পর্যালোচনা : বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক এ ভাষণে প্রথমে তুলে ধরলেন তার দুঃখভরা হৃদয়ের কথা। কারণ দেশে বিভিন্ন শহরের রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত আর আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত স্বাধীনতা, বেঁচে থাকা আর অধিকার আদায়ের কান্না। একে একে বর্ণনা করলেন প্রথম থেকে তার নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তাব, যাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। বায়ান্ন থেকে একে একে প্রায় প্রতিটি বছরে যে রক্তপাত ঘটিয়েছে তারা তারও বর্ণনা দিলেন। এই বর্ণনা থেকে বাদ যায়নি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কথাও। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, জনগণের অধিকারই তার কাম্য। এই অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক হরতাল ও সর্বগ্রাহী আন্দোলনের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তার অবর্তমানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সবশেষে তার অগ্নিঝরা কণ্ঠে ফুটে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এক দিনের ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি৷ তিল তিল করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাটা জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রক্ষাপট তৈরি করেন৷ শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন৷ একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল৷ তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি৷ তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর' হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না৷
ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : ইউনেস্কো তাদের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটি ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে 'মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে' যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এরমধ্য দিয়ে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ-এ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ৩০শে অক্টোবর সোমবার ২০১৭ ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ইউনেস্কোর এ ঘোষণায় বিশ্ব এখন আরও বেশি করে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে।
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল৷ এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নয়, দেশের জন্যও এক বড় স্বীকৃতি৷ এখন এটাকে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে৷ বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন৷

২০১৫ সালে ক্যানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রস্থ প্রকাশ করেছিলেন৷ সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল৷ তখন অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি৷ এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল’।

‘‘ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির ফলে সারা বিশ্বের মানুষ এখন এটা জানবেন৷ ভবিষ্যতের পর ভবিষ্যত প্রজন্ম এটা জানবেন যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন মহামানব, তিনি কঠিন পরিস্থিতিতে এই ভাষণে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু না বলে জনগনকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন৷ বিশ্বে আর কোনো রাজনীতিবিদ এটা পেরেছেন বলে আমাদের জানা নেই৷ এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে৷ এটা এখন নিজস্ব গতিতে সবার কাছে পৌঁছে যাবে৷ এখন এটা ওয়েবসাইটে সবগুলো অনুবাদ তুলে দিতে হবে৷
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল৷ ১৮ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত৷ তিনি সারাজীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন৷ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সৈন্যের হাতে শহীদ হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্প্রতি ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে স্থান দিয়ে আবারো প্রমাণ করেছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, তিনি অমর।

* রচনায় : সাংবাদিক বি এইচ মাহিনী,
প্রভাষক-গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক-সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:০৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×