somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূরা তাওবার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা

৩০ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা মুসলিমরা সাধারণভাবে একটা ধারণা নিয়ে থাকি যে ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু অনেক বিদেশী স্কলার (!) সহ এদেশের নব্য নাস্তিকরা প্রায়ই বিভিন্ন আয়াত দিয়ে প্রমাণ করতে চায়, ইসলাম আসলে যুদ্ধের ধর্ম, সন্ত্রাসের ধর্ম। তারা কুর’আনের যে আয়াতগুলোকে প্রধানত রেফারেন্স ধরে, তা মধ্যে অন্যতম হল সূরা তাওবার ২৯ নম্বর আয়াত। আয়াতটির অনুবাদটি উল্লেখ করি।

“তোমরা জিহাদ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে।“

এই আয়াতটির উপর বেস করে সাধারণভাবে বোঝানো হয়, যত খ্রিস্টান ও ইহুদি পৃথিবীতে আছে, সবার সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ করতে হবে, যতক্ষণ না তারা মুসলিম হয় অথবা তাদের জন্য অপমানজনক জিযিয়া কর দিতে বাধ্য হয়। যারা ইসলামের শত্রু, তাদের জন্য এই আয়াতটি অনেক প্রিয় রেফারেন্স, ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রিয় অস্ত্র। তারা সবসময়ই সমালোচনা করবে, যেভাবে হোক ভুল ধরবে, আমার এই নোট তাদের জন্য নয়। আমার এই নোটটা সাধারণ মুসলিমদের জন্য, যেন এই আয়াতটি নিয়ে নিজেরা কোন হীনমন্যতায় না ভোগে।

প্রথমে কুর’আনে জিহাদ সম্পর্কিত বেশ কিছু আয়াত দিই। অন্যান্য ক্ষেত্রে কি বলা আছে, দেখা যাক।

১. “আর লড়াই কর আল্লাহর নিমিত্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।“ (সূরা বাকারা:১৯০)
২. ”আর তারা (ধোঁকাবাজ সম্প্রদায়, যাদের সাথে পূর্বের আয়াতে যুদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে) যদি সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর।” (সূরা আনফাল:৬১)
৩. “ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেছে এবং বহিস্কারকার্যে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তারাই জালেম। “ (সূরা মুমতাহিনা: ৮-৯)
৪. “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই।“ (সূরা বাকারা: ২৫৬)

৫. “একসময় কাফেররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, কি চমৎকার হত, যদি তারা মুসলমান হত! আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, তারা খাদ্যগ্রহণে এবং ভোগে লিপ্ত থাকুক এবং আশায় ব্যাপৃত থাকুক। অতি সত্বর তারা জেনে নেবে (প্রকৃত সত্য)।” (সূরা আল হিজর: ২-৩)
৬. “বলুন, সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক। আমি জালেমদের জন্যে অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছি, যার বেষ্টনী তাদের কে পরিবেষ্টন করে থাকবে...“ (সূরা আল কাহ্‌ফ: ২৯)
৭. “আর তোমার রব যদি চাইতেন, তবে পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছে, তাদের সবাই ঈমান নিয়ে আসতে সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্য?” (সূরা ইউনুস: ৯৯)
৮. “বলুনঃ আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সৎ পথ পাবে। রসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌছে দেয়া।“ (সূরা আল-নূর: ৫৪)
এরকম বিভিন্ন কুর’আনের আয়াতে বোঝা যাচ্ছে যে ইসলামে জোর জবরদস্তি করে ধর্ম চাপানোর কোন নিয়ম নেই। এসব আয়াতের সাপেক্ষে সূরা তাওবা-র এই আয়াতটি অন্যরকম বা বিপরীতধর্মী লাগতে পারে, যেখানে যেন বলা হচ্ছে সকল আহলে কিতাবদের (খ্রিস্টান ও ইহুদীদের) সাথে ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। আর না হয় অপমান স্বরূপ যুদ্ধপণ দিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে হবে। কিন্তু অন্য সব আয়াতের সাথে এটি পুরোপুরি কন্ট্রাডিকটরি লাগতে পারে। এভাবে দেখলে ইসলামকে খুব নিষ্ঠুর ধর্ম মনে হতে পারে। কিন্তু এই আয়াতের কনটেক্সট টা ভিন্ন। তৎকালীন সময়ে আরবের উত্তরে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বসবাস করতো, যেখানে মহানবী (স) ইসলাম প্রচারের জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন। সেখানে জাত-উ-তালাহ নামক স্থানে ১৫ জন দূতকে হত্যা করে, কা’ব বিন উমায়র গিফারী (রা) কোনরকমে পালিয়ে আসেন। এরকম দূত হত্যা সেই সময়ের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে ভীষণ অন্যায় কাজ ছিল। এছাড়া আরেক খ্রিস্টান গভর্নর মহানবী (স) এর দূত হারিতলি বিন উমায়রকে হত্যা করে। আর সেসময়ে সেই খ্রিস্টানরা রোমানদেরকে যুদ্ধে আহবান করতে থাকে এবং যার ফলশ্রুতিতে শুরাহবিল ও সিজারের এক বিরাট সৈন্যবাহিনীর সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়, যা মূতা-র যু্দ্ধ নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে রোমানদের এক কমান্ডার ফারবাহ বিন আমরাল যুজুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, যাকে সিজারের সৈন্যরা পরে ধরে নিয়ে যায় এবং ইসলাম ছেড়ে না দিলে হত্যা করা হবে, এমন বলার পরও ইসলাম না ছাড়াও সেই কমান্ডারকে সিজার হত্যা করে।

মূতার যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পরবর্তীতে সিজার নিজে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে যুদ্ধ করার জন্য। সেসময় পারস্যের সাথে যুদ্ধে সিজার জয় লাভ করায় সিজারের অনেক প্রতিপত্তি ছিল, ও ইসলামের রক্ষায় এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই যুদ্ধের প্রিপারেশনে অনেক সাহাবী অনেক ধন সম্পদ ব্যয় করেন। উমার (রা) তার সম্পত্তির অর্ধেক দান করেন, আবু বকর (রা) দান করেন সম্পূর্ণ সম্পত্তি। এই তাবুকের যুদ্ধে হাজার হাজার মুসলিম সমবেত হয়, নিজেদের প্রাণ দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেয়। ত্রিশ হাজার যোদ্ধা নিয়ে মহানবী (স) নিজে নেতৃত্ব দিয়ে তাবুকের প্রান্তরে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু এর আগে মূতার যুদ্ধে পরাজয়ের অভিজ্ঞতায় মুসলিমদের এই সেনাবাহিনীর কারণে এবার সিজার শেষ মুহূর্তে এসে যুদ্ধ না করে ফেরত চলে যায়। সেই তাবুক যুদ্ধের সময়ই সূরা তাওবার এই আয়াত নাজিল হয়, যেখানে ওখানকার আশেপাশে অবস্থিত খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে মুসলিমরা রোমান আধিপত্যের বদলে মুসলিম আধিপত্য স্থাপন করে, যাতে ওই স্টেটগুলো ব্যবহার করে পরে রোমানরা অতর্কিত আক্রমণ না করতে পারে। ওই স্টেটগুলো এমনিতেই রোমানদেরকে কর দিতো, তো সেই হিসেবে মুসলিমদেরও কর দেবার কথা, আর এই কর দেবার ফলে রোমানদের যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুসলিমরা দায়বদ্ধ হয়, এভাবেই জিযিয়ার ব্যাপারটা এসেছে। আর যদি এই স্টেটগুলো ইসলাম গ্রহণ করে, তখন জিযিয়া কর সেখান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়।

২৯ নং আয়াতের পরবর্তী ৩০ নং আয়াতটি হচ্ছে:
“ইহুদীরা বলে “ওযাইর আল্লাহর পুত্র” এবং খ্রিস্টানরা বলে “মসীহ আল্লাহর পুত্র™। এ হচ্ছে তাদের মনগড়া কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন, এরা কোন উল্টা পথে চলে যাচ্ছে।“
অর্থাৎ, এরা একদিকে আল্লাহ্‌র উপাসনা করার কথা বলে, কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রেরিত ধর্মকে তারা নিজের মত করে পরিবর্তন করে ফেলেছে। এই দু’টি আয়াত ছিল মুসলিম সেনাবাহিনীকে উজ্জীবিত করার আয়াত। কিন্তু এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে পুরো সামগ্রিক ভাবে যত অমুসলিম আছে, সবার সাথে যুদ্ধ করার কথা বলা হয় নি। যদি তাই হত, তাহলে এটি কুর’আনের অন্য সব আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যেত। এই আয়াতটি একটা নির্দিষ্ট অভিযানের সাপেক্ষে এসেছে। এরকম কনটেক্সট বেইসড আয়াত কুর’আনে আরও আছে। তাই, আমরা মুসলিমরা যদি কোথাও এই আয়াতটি নিয়ে কোন ইসলাম বিরোধীদের প্রচারণা দেখি, যেন মনের মাঝে কোন দ্বিতীয় চিন্তা না আসে। এজন্যই এই নোটটা লেখা।

Note is inspired by: Click This Link
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×