মাথার পেছনে দুটো হাত আড়াআড়ি দেয়া। ঝিম মেরে বসে আছেন সাদিক সাহেব। দোল চেয়ারটায় বসলেও কোন দুলুনি নেই। যেন সব কিছু থমকে আছে। দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে মর্নিওয়াক থেকে ফিরে সেই যে বসেছেন ওঠার নাম নেই।
বার কয়েক উঁকি দিয়েছেন মিসেস সাদিক, রুনু। সাদিক সাহেব আদর করে ডাকেন রুনি। অবাক চোখে দেখে চলে গেছেন নিত্যকার কাজে। বাবু দুটোকে স্কুলের জন্য তৈরী করতে হবে। সদিক সাহেবের নাস্তা। নিজের অফিসের প্রস্তুতি। সব প্রায় শেষ!
তবু নি:শব্দ বারান্দা।
হলো কি উনার? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে এলো রুনি । কপালে হাত রাখতেই মাথা তুললেন সাদিক! অমা! একি! চোখ লাল টকটকে! উদভ্রান্ত চেহারা! ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকায় মিসেসের দিকে!
যেন দূরের কাউকে প্রশ্ন করছেন এমনি ভাবে বললেন -আমরা কেন এত কিছুর পিছে ছুটছি? কন্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে! যেন গলায় কিছু আটকে আছে! কি হয়েছে? শরীর খারাপ? ডাক্তার ডাকবো? দৌড়ে ফোনের দিকে যায় রুনি।
পাগলটাকে প্রায় দেখতেন হাটার সময়। অনেকেই দেখেন। আর দশটা সাধারন পাগলের মতোই। নিরবে বসে থাকে। বিরবির করে। কখনো তাকায় কারো দিকে। বাকী সময় নিজের মাঝেই যেন ডুবে থাকে। কারো সাতে পাঁচে নেই। এভাবেই দেখছেন দীর্ঘদিন থেকে।
গতকাল রাতে হঠাৎ দু:স্বপ্নটা দেখার পর থেকে মনটা প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত সাদিক সাহেবের। । অসহায় যন্ত্রনায় সব কিছুর উপরই যেন রাগ ঝাড়তে ইচ্ছে করছিল। সকাল হাটতে এসে পথের পাশে পাথরটাতে সেই রাগেই জোরে লাথি মারতেই উড়ে গিয়ে লাগে সেই পাগলের গায়। চমকে চোখ মেলে তাকায় পাগল। দেখেও চলে যেতে উদ্যত হলেন তিনি। ফিরে তাকাতেই দেখলেন- হাত ইশারায় ডাকছো!
বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে তবু চলেই যাচ্ছিলেন সাদিক সাহেব। আবারো হাত উঁচু করে ইশারায় ডাকলো। সাথে সাথে অদ্ভুদ একটা কান্ড ঘটলো। সাদেক সাহেব নি:শ্বাস টানতেই চারপাশে একটা দারুন খুশবু পেলেন। না। বডি স্প্রের গন্ধ নয়। নিজের বগলের কাছে নাক নিলেন! অদ্ভুত ভাবে তা গন্ধহীন! শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণই। কিন্তু মাথা তুলে আবার জোরে শ্বাস নিতেই সেই মন মাতানো খুশবু!
খানিকটা ঘোরের মাঝেই যেন পা চালালেন পাগলের দিকে। যতই কাছে যাচ্ছেন গন্ধের তীব্রতা যেন বাড়ছে। ডানে বায়ে ভাল করে তাকলেন। অন্য কেউ কোন সুগন্ধী বা আতর দিয়ে হেটে যাচ্ছে কিনা? বাতাসে হয়তো সেই ঘ্রানই পাচ্ছেন! নাহ! আশে পাশে কেউ নেই। পাগলটার মূখে কি মিটিমিটি হাসি! দূর থেকেও এত পরিষ্কার চেহারা কিভাবে দেখতে পাচ্ছি। ভাবতে ভাবতেই কাছে চলে গেলেন।
পাগলটা চোখ তুলে তাকাল। অদ্ভুত স্বচ্ছ চোখ দুটো। অদ্ভুত রকম প্রশান্ত। অর্ন্তভেদী দৃষ্টিতে বেশিক্ষন চোখে চোখ রাখা যায়না এমন। আপনাতেই চোখ নেমে আসে সাদেক সাহেবের। একটা ট্যাকা দে! ক্ষনিকের জন্য হেসে উঠেন -আচ্ছা এই কহিনী। উনি বিশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেন! না তার এক টাকাই চাই!
দশ, পাঁচ দুই...নাহ এক টাকা ছাড়া নেবে না। এক টাকা খুঁজেও পাচ্ছেন না!
খানিক বিরক্তির শেষ সময়ে ট্রাউজারের তলানীতে একটা কয়েন আঙুলে বাজে। কয়েনটা নিয়ে অনেক ক্ষন তাকিয়ে থাকে পাগল।
তোর মনে খুব অশান্তি!
কষ্ট সবার জীবনেই থাকে। এসব আটপৗড়ে যাপিত জীবনের অতি সাধারন কথায় কোন আছর হয়না সাদিক সাহেবের। শুনে যায়। হু হা করেন কেবল। সাধারন সাইকোলজিক্যাল প্রাকটিসে পাগলরা খুব সেয়ানা হয় জেনেছে। তারই প্রমান পেয়ে মনে মনে হাসতে থাকেন! পাগলের মুখেও মুচকি হাসি। সেকি মাইন্ড রিড করছে নাকি! বিস্মিত হন বেশ!
পরের জন্যে সব করলি মায়ের গয়নার ঋণ শোধ করবিনা? কথা শেষ না হতেই চমকে তাকায় সাদিক সাহেব? কে এ্ই লোক? কি করে সম্ভব এই কথা জানা? সেই কলেজের রেজিষ্ট্রেশনের সময় মায়ের সব গয়না খুলে দিয়েছিলেন! বাবার হাজারো মানা সত্ত্বেও। রুনিওতো জানেনা এই কথা।
বিস্ময় দেখেও কোন ভাবান্তর নেই পাগলের! বলে যায় আপন মনেই- ঋণ শোধ কর। ঋণ শোধ কর! মিথ্যা বলবিনা, নামাজ পড়বি, গরিবের সেবা করবি! সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। ভাবে সাদিক। হিপনোটাইজড! কিন্তু যা দেখছি শুনছি সবইতো সত্য! হুশ এবং সুস্থ হালতে।
এক চিমটি ধুলো নে! চমকে তাকায় পাগলের দিকে। দৃষ্টিতে আদেশ!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধুলো তুলে হাতের তালুতে রাখে! দূর থেকেই ফু দিয়ে বললো- খেয়ে ফেল! বলায় এতটা ত্রস্ততা যেন অতি দ্রুত করতে হবে। নইলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। দ্বিধায় চেয়ে থাকে তালুতে। ওদিকে তাড়া ! কি আছে কপালে! দেখিনা কি হয় ভেবে খাবার মতো হাতটা মূখে নেয় সাদিক।
শরীরের প্রতিটা পশম দাড়িয়ে যায়! কি খাচ্ছে? মুখে আঙুর এলো কোথা থেকে! এত স্বাদ! এত সুগন্ধ! আর চোখের সামনে যেন ছায়াচিত্রের মতো পুরো জীবনটা ভেসে যায়-
সেই মায়ের গয়না বেঁচা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। প্রেম। বিয়ে! বাবার চলে যাওয়া। মায়ের গ্রামে থেকে যাওয়া! শহরে নিজের স্বার্থপরের মতো একাকী জীবন! নামকা ওয়াস্তে মায়ের খরচ পাঠানো! সন্তানদের জন্য সব সুখের আয়োজন! সব স্বপ্ন পূরনে অফিসে লাগামহীন দূর্নীতি! বেপরোয়া যাপিত জীবন! সমাজের সবার চোখে ঈর্ষনীয় সাফল্য!
হঠাৎ বদলে যায় সব দৃশ্যপট। সাদা কাফনে মোড়া এ কে? স্পষ্ট সদ্য কফিনে মোড়া মৃতদেহ দেখে চমকে ওঠে সাদিক!
ভয়েই হঠাৎ চোখ মেলেন সাদিক। আরেহ পাগলটা গেল কই? উঠে আশে পাশে তাকায়! খানিকটা দৌড়ায়! পার্কের এমাথা ও মাথা চষে ফেলে! নাহ! নেই। কোথাও নেই।
শুধু অদ্ভুত ঘ্রানটা রয়ে গেছে হাতের তালুতে!
নাহ! আজকেই ছুটি নিয়ে বাড়ী যেতে হবে। মায়ের প্রতি সত্যি অবিচার হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে দোল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় সাদিক সাহেব! ক’দিন আগেও মাকে নিয়ে দু:স্বপ্ন দেখে ঘেমে নেয়ে উঠেছিল মাঝরাতে। গুরুত্ব দেয়নি। অতিরিক্ত প্রেসার, দুশ্চিন্তার ফল ভেবে এড়িয়ে গেছে!
কিন্তু আজ । বুকটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে! অজানা শংকায় অস্থিরতায় যেন পেয়ে বসেছে। দ্রুত হাতে মায়ের নাম্বারটা খুঁজত থাকে। কালেভদ্রে ফোন করে বলে কললিষ্টে নেই! তৃতীয়বার ডায়াল করতে গিয়ে সত্যি হার্টবিট বেড়ে যায়! কি হলো? মা ফোনটা ধরছেন না কেন? আবার ডায়াল করতে যাবেন- হাতের ফোনটা বেজে ওঠে ঠিক তখনই!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:৪০