বকর স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর রেজিস্টার খাতাটি বন্ধ করতে করতে বললেন, "কি বললি?"
"স্যার আমার নাম ডাকলেন না?"
"কী নাম?"
"বিকাশ। বিকাশ কুমার কর্মকার।"
দুবার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এইটে কোন সেকশনে ছিলি?"
"D সেকশনে।" লজ্জিত হয়ে বললাম।
"ওহহহহ...." স্যার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন "তো অংকে আর বিজ্ঞানে কত পেয়েছিলেন?"
"....মানে স্যার.... ঐ একটু অসুস্হ ছিলাম..... মানে অংকে ৩৬, বিজ্ঞানে ৪১..."
"অসুস্হ ছিলেন? সায়েন্স খুব কঠিন। অসুস্হ মানুষের জন্য সায়েন্স না । যা হারামযাদা C সেকশনে যা।" স্যার একরকম জোর করেই ক্লাসরুম থেকে বের করে দিলেন।
ছলছল চোখে ক্লাস থেকে বের হয়ে এলাম। পুরো ক্লাসের ছেলেরা হো হো করে হেসে উঠল। আমার জিদ বেড়ে গেল। যে করেই হোক সায়েন্স পড়ব।
সাতদিন ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত এলাকার বড়ভাইদের সাহায্য নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগে।
প্রথম সাময়িক পরীক্ষার কিছুদিন আগে ঠিক পেলাম এ তিনমাসে তিনদিনও পড়েছি কিনা। মোখলেস আর মান্নান স্যারের ক্লাস করার সাহস কখনো হয়নি। বকর স্যারের ক্লাস আওয়ারে বাংলা সিনেমা, ভিডিও গেম অথবা গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে সময় কাটিয়েছি।
রেজাল্ট বের হল। পদার্থ, রসায়ন, গণিতে ফেল। উচ্চতর গণিতে ডাবল জিরো।
কয়েকজন বন্ধু মিলে কম্পিউটারের দোকানে বসে এক অমর রেজাল্টশীট তৈরি করলাম। প্রত্যেক সাবজেক্টে ৭০ এর উপর নাম্বার রেখে প্লেস দিলাম চতুর্থ। বাসায় আমার কদর বেড়ে গেল। স্কুলেও কেউ এই অপকর্ম বুঝতে পারলনা।
দিন গড়াতে লাগল......।
একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল, "এই ছেলে এই... !" তাকিয়ে দেখি আমাদের বকর স্যার । সামনে এসে বললেন, "বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন? ঠান্ডা লাগবে তো । এদিকে আয়।" পরম মমতায় স্যার আমাকে তার ছাতার মধ্যে টেনে নিলেন।
মিনিট দশেক স্যারের সাথে হাঁটলাম। আমার করুন পরিণতি নিয়ে খুব আফসোস করলেন। যাবার সময় বললেন, "সবসময় অনেস্ট থাকবি। কাউকে ঠকাবিনা আর বাবা মাকে কখনো ফাঁকি দিস না। ........ লেখাপড়া করিস না কেন? লেখাপড়া কি খুব কঠিন? লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়া কঠিন । সামান্য লেখাপড়া করতেই যদি ভয় পাস মানুষ হবি কেমন করে?"
এর ৭-৮ দিন পরেই স্যার হার্ট এটাকে মারা যান । স্যারের মৃত্যুতে খুব শকড হলাম। সহজে মেনে নিতে পারলাম না। কেমন যেন হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করলাম।
এখনো ঝুমবৃষ্টিতে যখন ক্যাম্পাসে একাকী হাঁটাহাঁটি করি শুনতে পাই কে যেন পেছন ডেকে বলছেন, "এই ছেলে এই বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন? ঠান্ডা লাগবে তো.......।"