বৃষ্টি ও ফুটবল
১
আজ রাতে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। থামবে বলেও মনে হচ্ছেনা। তোতম নামের ষষ্ঠ শ্রেণীর বালকটি তার মাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে।
-মা জান আজ কি হয়েছে?
-কি হয়েছে?
-আজ স্কুলে রফিক স্যার ক্লাস নাইনে বাংলা ক্লাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। ঐ বৃষ্টিতেই স্যার নাইনের সবাইকে নিয়ে ফুটবল খেলতে মাঠে নেমে গেলেন।
-তারপর?
-তারপর আর কি সবাই মিলে মজা করে ফুটবল খেলল। জান মা আমার না খুব ইচ্ছে করছিল বৃষ্টিতে ফুটবল খেলতে। কবে যে আমাদের বাংলা ক্লাস নেয়ার সময় বৃষ্টি নামবে। আমার খুব ইচ্ছা বৃষ্টিতে স্যারের সাথে ফুটবল খেলা।
-ঠিক আছে হয়েছে, এখন ঘুমা কাল স্কুলে যেতে হবে।
-আচ্ছা, মা তুমিতো বল বাবা বৃষ্টি খুব পছন্দ করতেন।
-হু।
-বৃষ্টি নিয়ে বাবার একটা গল্প বলনা মা।
-ঘুমাতো ভ্যাজর ভ্যাজর ভালো লাগছেনা। সকালে অফিসে যেতে হবে।
শুয়ে শুয়ে তোতম স্বপ্ন বুনছিল কবে এমন ভাগ্য হবে, বাংলা ক্লাস চlলছে এমন সময় বৃষ্টি শুরু হল। স্যার বলবেন “যাতো কেউ ধীরেনের কাছ থেকে ফুটবল নিয়ে আয়”। তারপর বলবেন “চল ফুটবল খেলি”।
ধ্যেত, নাইনের ওদের ভাগ্য কত ভাল। ভাল কিছুই কেন তার সাথে হয়না।
বাবা যদি বেঁচে থাকতেন কত মজাই না হত। বাবা সম্পর্কে মা খুব বেশি কথা বলেনা। তবে বলেছেন বাবা বৃষ্টি খুব ভালবাসতেন। একদিনের কথা, সেদিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বাবা প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে শুয়ে আছেন। সেদিনের বৃষ্টি ছিল একটি বিষেশ বৃষ্টি কারন সেটি ছিল সেবছর বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। বাবা শুয়ে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছিলেন। মা বললেন “কি হয়েছে অমন এপাশ ওপাশ করছ কেন?”
-কিছু না। এপাশ ওপাশ করলাম কোথায়?
-উহু কিছু একটা হয়েছে। নয়তো তুমি এরকম করতে না। আমি তোমায় চিনি। বল আমাকে কি ব্যাপার।
-ব্যাপার কিছুই না। আচ্ছা বলি, বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে দেখেছ।
-তোমার মতলব কি?
-মতলব কিছুইনা বৃষ্টিতে ভিজব।
-খবরদার এই জ্বর নিয়ে বৃষ্টিতে নামবে না।
-এ জন্যই তোমাকে বলতে চাইনি।
-আহা রাগ করছ কেন এই জ্বর নিয়ে বৃষ্টিতে নামলে নিউমোনিয়া হয়ে মহা কেলেঙ্কারি হবে।
বলেই মা বাবার হাত ধরে টেনে বৃষ্টিতে নেমে গিয়েছিলেন। সেদিনের পুরো বৃষ্টি তাদের মাথার উপর দিয়ে গেল। এই গল্পটা অনেকবার শোনা তারপরও শুনতে ইচ্ছে করে।
২
পরদিন তোতম স্কুলে গিয়ে দেখল মহা ধুন্দুমার কান্ড ক্লাস নাইনের মিঠুর দাদা স্কুল কমিটির সভাপতি পৌর চেয়ারম্যান, গতকাল তার নাতিকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভীজে ফুটবল খেলার জন্য হেডস্যারের কাছে নালিশ নিয়ে এসেছেন। হেডস্যার বারবার তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যা হবার হয়েছে আর হবেনা, আপনি দয়া করে আমার ঘরে এসে বসুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তিনিতো গেলেনই না বরং স্কুল মাঠে দাড়িয়ে রফিক স্যারকে হুমকি দিতে লাগলেন। তিনি দেখে নেবেন রফিক স্যার এই স্কুলে কিভাবে চাকরি করেন। তোতমের প্রচন্ড রাগ হতে লাগল, মনে হচ্ছিল চেয়ারম্যানের মাথায় চেয়ার ভাঙ্গে। ও ক্লাসে গিয়ে শুনল মিঠু স্কুলে আসেনি তার জ্বর হয়েছে, এজন্যই চেয়ারম্যান সাহেব খেপেছেন। তোতম সারাদিন মন খারাপ করে ক্লাসে বসে ভাবতে লাগল, রফিক স্যার যদি না থাকেন তাহলে আর কোনদিন বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা হবে না।
পরের দিন স্কুলে এসে খবরটি শুনে তোতমের প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। রফিক স্যার আর স্কুলে থাকতে পারবেননা উনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাবা হারানো ছেলেটি নিজেকে সামলে রাখতে পারছিলনা। সে স্কুলের বাথরুমে গিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগল। ওরা এমন করল কেন। কেন এমন হয় তার পছন্দের কিছুই তার কাছে থাকে না। তার বাবাও তাকে দুই বছর বয়সে রেখে চলে গেলেন। সংসার চালাতে তার মাকে চাকরি করতে হয়। স্কুল থেকে ফিরেও তোতম মাকে কাছে পায়না। শুক্রবার তার মা সারা সপ্তাহের বাজার আর রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সেদিনও মাকে পাওয়া যায়না। আর রাতের বেলা মা সারাদিনের ক্লান্তির পর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন। তার কোন ভাই নেই, বোন নেই, মামা নেই, চাচা নেই, দাদা-দাদি, নানা-নানি কেউ নেই। তার জীবনে শুধু মা আর বিকালের খেলার সাথিরা ছাড়া কাছে যাওয়ার কেউ নেই।
৩
-মা আমি আর স্কুলে যাবনা
-কেন মিঠু
-মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রফিক স্যার আমার সবচেয়ে পছন্দের স্যার ছিলেন। তার মত ভাল স্যার স্কুলে আর একটিও নেই। সে ক্লাসে কত মজা করে গল্প বলতেন, আমার শুনতে খুব ভাল লাগত। স্যার আমাদের স্কুল ফুটবল টিমের কোচ ছিলেন। উনি চলে গেলে আর কখনও আমরা ইন্টার স্কুল কাপ জিততে পারবনা। স্যার আর কখনও ক্লাস নিবেননা, আমাদের নিয়ে ফুটবল খেলবেন না। বলেই মিঠু কাঁদতে শুরু করল।
মিঠুর মা সমস্যায় পড়েগেলেন এখন কি হবে। একমাত্র নাতির অসুখের কথা শুনে দাদার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। তাই রফিক সাহেবকে স্কুল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করিয়েছেন। এতটা নিষ্ঠুরতা করা ঠিক হয়নি। বচ্চা ছেলেরা বৃষ্টিতে ভীজে ফুটবল খেলেছে এতে দোষের কি হয়েছে। এখন ঋতু পরিবর্তনের সময় জ্বর হতেই পারে। আর এই জ্বরে তেমন কিছু হয়না। কিন্তু কি করা যায় ওর দাদা যে রাগী মানুষ। কোন কথা বলতে গেলে শুধু হু হা করেন। যা নিজে বুঝেন তাই করেন কারও কথা শুনেন না।
-বাবা
-বল বউমা? মিঠুর জ্বর কেমন? ঐ ব্যাটাকে আমি স্কুল ছাড়া করেছি, আমার নাতিকে নিয়ে ভীজে ফুটবল খেলা। আমার নাতির কিছু হলে ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব।
-মিঠু স্কুলে যাবেনা। কন্নাকাটি করছে।
-কেন?
-বাবা, ও রফিক স্যারকে ভীষণ পছন্দ করে। স্যার স্কুলে না থাকলে ও আর ঐ স্কুলে যাবেনা।
চেয়ারম্যান সাহেব চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। কোন কথা বলছিলেন না।
-বাবা, এখন কি করব আমি। ছেলে কিছু খাচ্ছেওনা।
-ঠিক আছে আমি দেখছি।
৪
পরেরদিন সকাল ন’টায় চেয়ারম্যান সাহেব নিজে মিঠুকে নিয়ে স্কুলে আসলেন। মিঠুর হাতে একটা নতুন পাঁচ নম্বর ডিয়ার বল। ও দাদার সাথে শিক্ষকদের রুমে গিয়ে দেখল রফিক স্যার কি যেন লিখছেন। আনন্দে ওর নাচতে ইচ্ছে করল, রফিক স্যার স্কুল ছেড়ে যাননি। দাদা নিজে এগিয়ে গিয়ে রফিক স্যারের পাশে দাঁড়ালেন।
-রফিক সাহেব কেমন আছেন।
রফিক স্যার দাড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন,
-জ্বি ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন।
-আমার ব্যবহারের কারনে আমি খুব লজ্জিত।
-জ্বি আমি কিছু মনে করিনি। আর গতরাতে আপনি আমার বাসায় গিয়ে একবার বলেছেন। আর বলার প্রয়োজন নেই।
-আমি আবারও সবার সামনে আপনার কাছে সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। একমাত্র নাতির অসুখের কথা শুনে আমার মাথা ঠিক ছিলনা।
-আপনি এখন আমায় সবার সামনে লজ্জায় ফেলছেন। আপনি আমার বাবার বয়সী। আমি আপনার কথা মনে রাখিনি।
-রফিক সাহেব একটা কথা ছিল।
-বলুন।
-চলুন একটু হেডস্যারের রুমে যাই। মিঠু তুমি বল রেখে ক্লাসে যাও।
কিছুক্ষন পর এসেম্বলিতে হেডস্যার চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে এলেন। তারা দুজন ফিসফিস করে কি যেন বলছিলেন। তোতমকে আজ খুব খুশি দেখাচ্ছিল। রফিক স্যার এসেম্বলির পর হ্যান্ডমাইকে বললেন
-ছেলেরা হেডস্যার এখন তোমাদের কিছু কথা বলবেন।
হেডস্যার মাইক নিয়ে বলা শুরু করলেন
-প্রিয় ছাত্ররা তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে। তোমাদের সবার প্রিয় রফিক স্যার স্কুল ছেড়ে যাচ্ছেন না। চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষন আগে এই আনন্দের সংবাদটি জানালেন।
সাথে সাথে ছাত্ররা যেন পাগল হয়ে গেল, সবাই আনন্দে চিৎকার করতে লাগল আর তালি দিতে লাগল।
-ছাত্ররা থমো, তোমাদের জন্য আরেকটি আনন্দের সংবাদ আছে। সংবাদটি হল, এবছর আমাদের স্কুলে আন্ত ক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে। প্রতিটি ক্লাসের সব সেকশন এই টুর্নামেন্টে অংশ নেবে। টুর্নামেন্টের নাম চেয়ারম্যান গোল্ড কাপ।
এরপর ছাত্ররা আবার আনন্দে চিৎকার করা শুরু করল। এবার যেন তালি আর চিৎকার থামতেই চায় না। তোতম আর মিঠু চিৎকার করতে পারছিলনা, ওদের গলা জড়িয়ে আসছিল, চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। শুধু ওরা না ছাত্রদের অনেকের চোখেই আজ পানি।
৫
পরের বছরের বর্ষার কথা। রফিক স্যার দুপুর বেলা তোতমদের বাংলা ক্লাশ নিচ্ছিলেন। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। এরপর শুরু হল প্রচণ্ড বৃষ্টি। রফিক স্যার তোতমকে ডেকে বললেন যাতো ধীরেনের কাছ থেকে ফুটবল নিয়ে আয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:০৪