somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা- প্রথম পর্ব

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[সিরাজ সিকদারকে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই মনে হয়েছে, কোনো দলীয় স্বার্থ পূরণের জন্য। আবার ব্যক্তি সিরাজের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে অনেকে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। তারা আসলে তার আত্নত্যাগকেই কটাক্ষ করেছেন। প্রচলিত এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে ধারাবাহিকের শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। আর এটি মোটেই সিরাজ সিকদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী বা তার কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। বরং এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]


আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের/ জনগণ যেনো জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়...সিরাজ সিকদার।


অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তিনয়, নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।...মাওসেতুং।


সর্বহারা পার্টি গঠন, ১৯৭১

গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছয়ের দশকের শেষভাগে সারা বিশ্বের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধোপূর্ব বাংলাদেশেও। পাকিস্তানী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট, অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলাকে বেশ কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ সশস্ত্র পন্থায় মুক্ত করতে চেয়েছিলো। মাওসেতুং-এর গেরিলা যুদ্ধ অনুসরণ করে সে সময় যে সব গ্রুপ এদেশে সশস্ত্র কৃষক বিপ্লব করতে চেয়েছিলো, সাধারণভাবে তারা পরিচিতি লাভ করে পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে। আর ছিলো আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা, ভোটপন্থায় ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী মনি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, যারা চিহ্নিত হয় মস্স্কোপন্থী হিসেবে।

ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে 'জাতীয় মুক্তি আন্দোলন' হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল 'দুই শ্রেণী শত্রু' মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।

এর আগে তরুন বিপ্লবী সিরাজ সিকদার প্রথমে মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লব আকাঙ্খী যুবকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পরেই এ গ্রুপটির মূল থিসিস ছিলো: পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং 'জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের' মাধ্যমে এ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এতে স্পষ্ট লেখা হয়, আপনার ও আপনার পার্টির ছয়-দফা সংগ্রামের ইতিহাস প্রমান করেছে যে, চয়-দফা অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্তি ও স্বাধীন করে।...

এতে সিরাজ সিকদার গ্রুপ যে সব প্রস্তাব দেয়, তার ৪ নম্বর দফাটি ছিলো: ...পূর্ব বাংলার দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে 'জাতীয় মুক্তিপরিষদ' বা 'জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট' গঠন করুন।

কিন্তু আওয়ামী নেতারা সিরাজ সিকদারের এই আহ্বান উপেক্ষা করেন, যা পরে গড়ায় দুই পার্টির এক রক্তাক্ত ইতিহাসে।



১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেনী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা।

পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় 'সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি'। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয়: পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।

বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল--বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।


সে সময় সর্বহারা পার্টি শত্রুমুক্ত এলাকায় (মুক্তাঞ্চল) বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্ষদ গঠন করে।

কিন্তু এই সময় সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন, যাতে সর্বহারা পার্টি ব্যপক লোকবল হারায়।

আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনী ও সর্বহারা পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

এমনই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাক-বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী , ভারতকে অধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।

(চলবে)
---
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত।
---
ছবি: সিরাজ সিকদার, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের লিফলেট, আন্তর্জাল।
---
পড়ুন: মাওইজম ইন বাংলাদেশ : দ্য কেস অব পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি
Click This Link
কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:২৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তুই পাগল তোর বাপে পাগল

লিখেছেন আজব লিংকন, ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



রাতে অর্ধেক কাউয়া ক্যাচাল দেইখ্যা হুর বইল্যা— মোবাইল ফোনের পাওয়ার বাটনে একটা চাপ দিয়া, স্ক্রিন লক কইরা, বিছানার কর্নারে মোবাইলটারে ছুইড়া রাখলাম।

ল্যাপটপের লিড তুইল্যা সার্ভারে প্রবেশ। বৃহস্পতিবারের রাইত... ...বাকিটুকু পড়ুন

যত দোষ নন্দ ঘোষ...

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০১

"যত দোষ নন্দ ঘোষ"....

বাংলায় প্রচলিত প্রবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। যে যত দোষ করুক না কেন, সব নন্দ ঘোষের ঘাড়েই যায়! এ প্রবাদের সহজ অর্থ হচ্ছে, দুর্বল মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আমাদের বাহাস আর লালনের গান

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:৪১


দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে হৈচৈ হচ্ছে, হৈচৈ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। একটা পক্ষ আগের সরকারের সময়ে হৈচৈ করত কিন্তু বর্তমানে চুপ। আরেকটা পক্ষ আগে চুপ ছিল এখন সরব। তৃতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ থাকে না কেউ থেকে যায়

লিখেছেন বরুণা, ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০৩


চমকে গেলাম হঠাৎ দেখে
বহুদিনের পরে,
নীল জানালার বদ্ধ কপাট
উঠলো হঠাৎ নড়ে।

খুঁজিস না তুই আর খুঁজিনা
আমিও তোকে আজ,
আমরা দু'জন দুই মেরুতে
নিয়ে হাজার কাজ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরও একটি কবর খোঁড়া

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:০৪

গোরস্থানে গিয়ে দেখি
আরও একটি কবর খোঁড়া
নতুন কেউ আজ মরেছে
এমন করে বাড়ছে শুধু
কবরবাসী, পৃথিবী ছেড়ে যাবে সবাই
মালাকুল মওত ব্যস্ত সদাই
কখন যে আসে ঘরে
মৃত্যুর যে নেই ক্যালেন্ডার
যে কোন বয়সে আসতে পারে
মৃত্যুর ডাক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×