somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা-তৃতীয় পর্ব

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[সিরাজ সিকদারকে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই মনে হয়েছে, কোনো দলীয় স্বার্থ পূরণের জন্য। আবার ব্যক্তি সিরাজের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে অনেকে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। তারা আসলে তার আত্নত্যাগকেই কটাক্ষ করেছেন। প্রচলিত এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে ধারাবাহিকের শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। আর এটি মোটেই সিরাজ সিকদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী বা তার কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। বরং এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]

দ্বিতীয় পর্ব



আমাদের নীতি হচ্ছে, পার্টি বন্দুককে কমান্ড করবে, বন্দুক পার্টিকে কখনোই নয়।...মাওসেতুং।

তোমার নাম! আমার নাম!
ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!


সাতের দশকের শুরুতে ওপারে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিআই (এম-এল) জলপাইগুড়ির নকশালবাড়িতে সফলভাবে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একে 'বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ' হিসেবে চিহ্নিত করলে চারু মজুমদার পার্টিতে ঘোষণা করেন: নকশালবাড়ির পথ ধরেই ভারতে কৃষক বিপ্লব বিদ্রোহ হবে, মাওসেতুং-এর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের পথই আমাদের পথ, জনযুদ্ধই মুক্তির সদন -- ইত্যাদি। কলকাতার দেয়ালে লেখা হয়: নকশালবাড়ি লাল সেলাম! চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান! বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে! ৭০এর দশককে মুক্তির দশকে পরিনত করুন! --ইত্যাদি।

হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী চার মজুমদারের উদাত্ত আহ্বানে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়।

সে সময় নকশালরা সাইকেলের পাইপ কেটে ছড়ড়ার বুলেট ব্যবহার করে হাতে তৈরি সিঙ্গেল শট বন্দুক 'পাইপগান' বানায়। আর পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল ও কুঁদো ছেটে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় সহজে বহনযোগ্য কাটা-রাইফেল। এছাড়া কাঁচের বোতলের ভেতর আলকাতরা ও পেট্রোলের মিশ্রনে তৈরি হয় মলটোভ বোমা। নকশালবাদী আন্দোলনে গ্রাম ও শহরে 'শ্রেনী শত্রু খতমের লাইনে' বিপ্লব করতে এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে রাম দা তো ছিলোই।

নকশালবাদী আন্দোলনের ঢেউ এপারে মাওপন্থী বাম দলগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি সরাসরি চারু মজুমদারের খতমের লাইন গ্রহণ না করলেও নকশালী কায়দায় জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী লাইন, তথা জোতদার নিধন কর্মসূচি চালায়। এপারেও নকশালাইট ও সর্বহারাদের মধ্যে পাইপ গান ও কাটা রাইফল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে কবি সুবিমল মিশ্র লিখলেন: আবার পাইপ গান এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে, ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে। ...অর্থাৎ মাওবাদী গ্রুপগুলো সাতের দশকে 'শ্রেণী শত্রু খতমের' নামে যখন পাইপগানের যথেচ্ছ ও ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে, এমন কী তা দলীয় কোন্দল মেটাতেও ব্যবহার হতে থাকে, তখন তারা আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ে। জনযুদ্ধের অস্ত্রের বিপ্লবী ব্যবহার না হয়ে, তা ব্যবহত হতে থাকে গোষ্ঠি বিপ্লবের নামে, কখনো ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষাতেও। ...

পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দীয় নেতা, নকশালপন্থী আজিজ মেহের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, চারু মজুমদারের মতো এপাড়েও শিক্ষিত তরুণ সমাজ সহজেই সিরাজ সিকদারের বিপ্লবের থিসিসে আকৃষ্ট হয়।

সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজ মেহেরকে আটক করে ব্যপক নির্যাতন করে এবং তাকে সশস্ত্র কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন রাজনৈতিক বন্দী এবং কয়েকজন বাঙালি জেল পুলিশের বরাতে তিনি তখন দেশের সব খবরাখবরই পেতেন। এমন কী পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তার গোপন চিঠিপত্রের লেন দেন চলছিলো।

আজিজ মেহের বলেন, ...ওদিকে কিন্তু ভারতে নকশাল দমনের নামে হাজার হাজার তরুনকে হত্যা করা হচ্ছে; গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামেরা কখনো ডানে, কখনো বামে হেলছেন। কিন্তু তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণী শত্রু খতম করছেন, কখনো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। আমরা সব খবরই জেলে বসে বিশেষ চ্যানেলে পেতাম।


এই সময় কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন এবং ভিয়েতনামে হো চি মিনের কৃষক বিপ্লব ওপার বাংলা-ওপার বাংলায় তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। সারাদেশে শ্লোগান ওঠে: তোমার নাম, আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!

এদিকে ১৯৭২-৭৪ মাওবাদী বা পিকিংপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সশস্ত্রপন্থার রণোনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিস্কার ও মৃত্যূদণ্ড ঘোষণা। সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টিকে নিস্কন্টক রাখতে 'নিপাত চক্র' নামে পার্টির ভেতরে একটি অনুগত গ্রুপ করেছিলেন। এদের মূল কাজ ছিলো, পার্টির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হত্যা করা।

আজিজ মেহের জেল খানার জীবনের স্মৃতি চারণ করে বলেন, ...আমাকে নিউ ২০ সেলে স্থানান্তর করা হলো। পাশের সেলে ছিলো বৃহত্তর বরিশালের কাকচিরা গ্রামের ও বরিশাল কলেজের ছাত্র কমরেড সেলিম শাহনেওয়াজ। সে ছিলো সিরাজ সিকদারের পার্টির সদস্য। ১৯৭১ এর পরে ১৯৭৩ এ পার্টির সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সিরাজ সিকদারের নির্দেশে এই আত্নত্যাগী তরুণকে হত্যা করা হয়। যেমন হত্যা করা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে।...

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুতে পরিনত হয় মাওপন্থীরা। আজিজ মেহের বলছেন, (১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে ) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ন-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে 'ধরো আর মারো' শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।...

এদিকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র 'স্ফুলিঙ্গ' ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ন সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।...

---
তথ্যসূত্র: ১। স্মৃতি শুধু স্মৃতি নয়, আজিজ মেহের, শোভা প্রকাশ, ২০০৪।
২। বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত।

---
ছবি: সিরাজ সিকদার, আন্তর্জাল।
(চলবে)
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×